আর্ত মানবের সেবায় ৩ যুগ নিরলস ডা. যুগল ব্রহ্মচারী

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার একটি গ্রাম রহিমপুর। গ্রামে আছে রহিমপুর অযাচক নামে একটি আশ্রম। সেখানে রোগী দেখেন চিকিৎসক মানবেন্দ্র নাথ সরকার। এই আশ্রমেই থাকেন, বাগান করেন, অনাথ-পিছিয়ে পড়া ছেলেদের গড়ে তোলার কাজ করেন। এক-দুই বছর ধরে নয়, তিন যুগের বেশি সময় ধরে এভাবে মানবসেবায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন তিনি। লোকে তাঁকে ডাকেন ‘যুগল ব্রহ্মচারী’ নামে।

মানবেন্দ্র নাথ সরকার বলছিলেন, ‘আমি তখন কিশোর। বাবা বলেছিলেন বড় হয়ে মানুষর জন্য কাজ করবে। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। এরপর একটি প্রতিষ্ঠানে দেড় বছর কাজ করি। সেখানে কিছু ভালো লাগত না। গ্রামে ফিরে আসি। শুরু হয় রহিমপুর অযাচক আশ্রমের জীবন।’

মানবেন্দ্র নাথ সরকার রহিমপুর অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ। ১৯৩১ সালে শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব এ আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন মানবেন্দ্র। এরপর ৩৮ বছর ধরে তিনি এখানেই আছেন।

সেকাল আর একালের চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসক মানবেন্দ্র বলেন, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী দেখি। আগে দেখতাম ৪০ থেকে ৫০ জন। সময় নিয়ে রোগী দেখার চেষ্টা করি। সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস, গ্রামের মানুষের কাছে আমাদের এই প্রজন্মের চিকিৎসকেরা ফিরে আসবেন। তাঁদের সেবা করবেন। রাষ্ট্র একজন চিকিৎসককে কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য তৈরি করেনি, তৈরি করেছে মানবসেবা করার জন্য।’

দেবীদ্বার উপজেলার এগারো গ্রামের বেগম এমজে মামুন আক্তার এসেছেন মানবেন্দ্রর কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার মাথায় সমস্যা। ওনারে দেখাতে আসলাম। তিনি অনেকক্ষণ ধরে রোগী দেখেন। টাকা লাগে না।’ মুরাদনগর উপজেলার দারোরা গ্রামের জহিরুল হক ও ফাতেমা বেগম এসেছেন তাঁর কাছে। তাঁরা বললেন, তাঁর (মানবেন্দ্র) কাছ এলে রোগ ভালো হয়ে যায়। ওষুধ নয়, ব্যবহারে।

মানবেন্দ্র নাথ সরকার মানবসেবায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে প্রথম আলো-গ্রামীণফোন সম্মাননা পান। ২০০৮ সালে এটিএন বাংলা ও ইউনিলিভার তাঁকে ‘সাদা মনের মানুষ’–এর সম্মাননা দেয়। তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালের ১০ জানুয়ারি কুমিল্লার মুরাদনগরের মোচাগড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সুধীর রঞ্জন সরকার ও মায়ের নাম রেণু বালা সরকার। মাকে হারান ১৯৬৪ সালে। ১৯৭১ সালে তাঁর বাবাকে মোচাগড়া গ্রাম থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে। দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে মানবেন্দ্র দ্বিতীয়।

রোগী দেখার পাশাপাশি মানবেন্দ্র নাথ সরকার আশ্রম প্রাঙ্গণে নার্সারি করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘স্বাবলম্বী নার্সারি’। ২০০০ সাল থেকে তিনি আশ্রমে মোমবাতি ও আগরবাতির কারখানা করেন। এখন মোমবাতির কারখানা বন্ধ। তবে আগরবাতির কারখানা চালু আছে। এর মাধ্যমে আশপাশের অন্তত ৫০টি পরিবার আর্থিকভাবে লাভবান হয়। অসহায় নারী, বৃদ্ধা ও অনাথদের জন্য তিনি উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের সাত একর জায়গা নিয়ে বিপন্ন মাতৃসদন ও অনাথ আশ্রম বানিয়েছেন। এ ছাড়া খাগড়াছড়িতে ছোট ছোট অন্তত সাতটি স্কুল করেছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার, ০৫ জুলাই ২০২২ , ২১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলহজ ১৪৪৩

আর্ত মানবের সেবায় ৩ যুগ নিরলস ডা. যুগল ব্রহ্মচারী

প্রতিনিধি, মুরাদনগর (কুমিল্লা)

image

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার একটি গ্রাম রহিমপুর। গ্রামে আছে রহিমপুর অযাচক নামে একটি আশ্রম। সেখানে রোগী দেখেন চিকিৎসক মানবেন্দ্র নাথ সরকার। এই আশ্রমেই থাকেন, বাগান করেন, অনাথ-পিছিয়ে পড়া ছেলেদের গড়ে তোলার কাজ করেন। এক-দুই বছর ধরে নয়, তিন যুগের বেশি সময় ধরে এভাবে মানবসেবায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন তিনি। লোকে তাঁকে ডাকেন ‘যুগল ব্রহ্মচারী’ নামে।

মানবেন্দ্র নাথ সরকার বলছিলেন, ‘আমি তখন কিশোর। বাবা বলেছিলেন বড় হয়ে মানুষর জন্য কাজ করবে। ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। এরপর একটি প্রতিষ্ঠানে দেড় বছর কাজ করি। সেখানে কিছু ভালো লাগত না। গ্রামে ফিরে আসি। শুরু হয় রহিমপুর অযাচক আশ্রমের জীবন।’

মানবেন্দ্র নাথ সরকার রহিমপুর অযাচক আশ্রমের অধ্যক্ষ। ১৯৩১ সালে শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেব এ আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেন মানবেন্দ্র। এরপর ৩৮ বছর ধরে তিনি এখানেই আছেন।

সেকাল আর একালের চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসক মানবেন্দ্র বলেন, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী দেখি। আগে দেখতাম ৪০ থেকে ৫০ জন। সময় নিয়ে রোগী দেখার চেষ্টা করি। সমস্যার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস, গ্রামের মানুষের কাছে আমাদের এই প্রজন্মের চিকিৎসকেরা ফিরে আসবেন। তাঁদের সেবা করবেন। রাষ্ট্র একজন চিকিৎসককে কেবল অর্থ উপার্জনের জন্য তৈরি করেনি, তৈরি করেছে মানবসেবা করার জন্য।’

দেবীদ্বার উপজেলার এগারো গ্রামের বেগম এমজে মামুন আক্তার এসেছেন মানবেন্দ্রর কাছে। তিনি বলেন, ‘আমার মাথায় সমস্যা। ওনারে দেখাতে আসলাম। তিনি অনেকক্ষণ ধরে রোগী দেখেন। টাকা লাগে না।’ মুরাদনগর উপজেলার দারোরা গ্রামের জহিরুল হক ও ফাতেমা বেগম এসেছেন তাঁর কাছে। তাঁরা বললেন, তাঁর (মানবেন্দ্র) কাছ এলে রোগ ভালো হয়ে যায়। ওষুধ নয়, ব্যবহারে।

মানবেন্দ্র নাথ সরকার মানবসেবায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে প্রথম আলো-গ্রামীণফোন সম্মাননা পান। ২০০৮ সালে এটিএন বাংলা ও ইউনিলিভার তাঁকে ‘সাদা মনের মানুষ’–এর সম্মাননা দেয়। তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালের ১০ জানুয়ারি কুমিল্লার মুরাদনগরের মোচাগড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সুধীর রঞ্জন সরকার ও মায়ের নাম রেণু বালা সরকার। মাকে হারান ১৯৬৪ সালে। ১৯৭১ সালে তাঁর বাবাকে মোচাগড়া গ্রাম থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে হত্যা করে। দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে মানবেন্দ্র দ্বিতীয়।

রোগী দেখার পাশাপাশি মানবেন্দ্র নাথ সরকার আশ্রম প্রাঙ্গণে নার্সারি করেছেন। নাম দিয়েছেন ‘স্বাবলম্বী নার্সারি’। ২০০০ সাল থেকে তিনি আশ্রমে মোমবাতি ও আগরবাতির কারখানা করেন। এখন মোমবাতির কারখানা বন্ধ। তবে আগরবাতির কারখানা চালু আছে। এর মাধ্যমে আশপাশের অন্তত ৫০টি পরিবার আর্থিকভাবে লাভবান হয়। অসহায় নারী, বৃদ্ধা ও অনাথদের জন্য তিনি উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের সাত একর জায়গা নিয়ে বিপন্ন মাতৃসদন ও অনাথ আশ্রম বানিয়েছেন। এ ছাড়া খাগড়াছড়িতে ছোট ছোট অন্তত সাতটি স্কুল করেছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়।