বন্যায় ক্ষত-বিক্ষত ছাতক-সিলেট রেলপথ, অরক্ষিত কয়েক কোটি টাকার সম্পদ

চলমান বন্যায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে সিলেট-ছাতক রেলপথ। অরক্ষিত হয়ে পড়েছে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। এমনিতেই করোনা মহামারীর পর বন্ধ ছিল সিলেট-ছাতক পথে রেল চলাচল। বন্যার পানির তীব্র স্রোতে এ রেললাইনের অধিকাংশ স্থানে সরে গেছে স্লিপারের নিচের মাটি ও পাথর। বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের নিচে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর দাবি করেছে, রেললাইনের বিভিন্ন স্থানে এখনও পানি। ক্ষয়ক্ষতি এখনও নিরূপণ সম্ভব হয়নি। এ রুটে পুনরায় রেল চলাচল নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাথর, বালি, চুনাপাথর ও কমলাসহ মালপত্র আনা-নেয়ার জন্যই মূলত ১৯৫৪ সালে সিলেট-ছাতক রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব পরিবহনের সঙ্গে ব্যাপক সুবিধা সৃষ্টি হয় ছাতক অঞ্চলসহ সুনামগঞ্জ জেলার মানুষের যাতায়াতে। সে সময় ট্রেনই ছিল একমাত্র ভরসা। শুরু থেকেই রেল বিভাগের রাজস্ব আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ছাতক-সিলেট রেলপথটি। করোনা মহামারীর আগ পর্যন্ত সচল ছিল এ রেলপথ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৫৪ সালে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে পশ্চিম-উত্তরে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ওই সময়ে এ রেলপথের সর্বশেষ স্টেশন হিসেবে ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। এর আগে এটি ছিল আখাউড়া-কুলাউড়া-সিলেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

১৯৭৯ সালে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের রাজস্ব আয়ে ছাতক বাজার স্টেশন শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখল করে নেয়। প্রতিদিনই এ পথে তিনটি ট্রেন যাতায়াত করত। মাঝে নানা অজুহাত দেখিয়ে কমিয়ে দেয়া হয় ট্রেন ও ট্রেনের বগি সংখ্যা। ট্রেনে করে প্রায় ৪৫ মিনিটে ছাতক থেকে সিলেট পৌঁছানো যায়। সিলেট-ছাতক রেলপথের ট্রেন খাজাঞ্চীগাঁও, সৎপুর ও আফজালাবাদ স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে। ছাতক, সিলেটের সৎপুর ও খাজাঞ্চীগাঁও এলাকার কয়েক হাজার মানুষের সিলেট শহর ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এক সময় যোগাযোগের এ রেলপথই ছিল একমাত্র মাধ্যম। শিল্প শহর ছাতক থেকে চুনাপাথর, সিমেন্ট, সিøপার, বালি, বোল্ডার পাথরসহ মালপত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে এ রেলপথে সড়কপথের চেয়ে পরিবহন খরচ কয়েক গুণ কম। এজন্য এ রেলপথ দিয়ে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী ছিলেন ব্যবসায়িরা। যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রেও জনপ্রিয় ছিল এ রেলপথ। সিলেট থেকে ছাতকে রেলপথের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের ভাড়া মাত্র ১০ টাকা। ট্রেনের ভাড়া ১০ টাকার বিপরীতে বাসের ভাড়া বর্তমানে ৬০ টাকা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া ৮০-১০০ টাকা। সুনামগঞ্জ জেলার সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ও সহায়তার চাল-গমসহ বিভিন্ন পণ্য এ রেলপথে পরিবহন করা হতো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রেলপথে পণ্যসামগ্রী ছাতক নিয়ে এসে নৌপথে জেলার অন্যান্য উপজেলায় পৌঁছানো সহজ হতো। এতে ট্রাক ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ সরকারি অর্থ সাশ্রয় হতো বলে জানা গেছে।

করোনা মহামারীর পর থেকে সিলেট-ছাতক রেললাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে এ পথ দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। চলমান বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সিলেট-ছাতক রেলপথের। বন্যার পানির তীব্র স্রোতে রেললাইনের অধিকাংশ স্থানে সরে গেছে স্লিপারের নিচের মাটি ও পাথর। স্থানে স্থানে রেললাইনের নিচে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত।

ছাতক এর বাসিন্দা হারুন অর রশীদ জানান, শিল্পনগরী ছাতকের বিভিন্ন শিল্পকারখানার প্রাণ ছিল সিলেট-ছাতক রেলপথ। অযত্ন-অবহেলায় এ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এবার বন্যা এসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে রেলপথটি। জায়গায় জায়গায় স্লিপার উপড়ে অন্যত্র সরে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে বিশাল গর্তের। গুরুত্বপূর্ণ এ রেলপথ দ্রুত সংস্কার করা না হলে স্লিপার ও বিভিন্ন সরঞ্জাম চুরি হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথের দ্রুত সংস্কার দাবি জানান। বাংলাদেশ রেলওয়ে সিলেটের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন জানান, বন্যার পানিতে সিলেট-ছাতক রেললাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি নেমে গেলে এর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে। চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে ক্ষতি নিরূপণে রেললাইন পরিদর্শন করা হবে।

মঙ্গলবার, ০৫ জুলাই ২০২২ , ২১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলহজ ১৪৪৩

বন্যায় ক্ষত-বিক্ষত ছাতক-সিলেট রেলপথ, অরক্ষিত কয়েক কোটি টাকার সম্পদ

লতিফুর রহমান রাজু, সুনামগঞ্জ

চলমান বন্যায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে সিলেট-ছাতক রেলপথ। অরক্ষিত হয়ে পড়েছে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। এমনিতেই করোনা মহামারীর পর বন্ধ ছিল সিলেট-ছাতক পথে রেল চলাচল। বন্যার পানির তীব্র স্রোতে এ রেললাইনের অধিকাংশ স্থানে সরে গেছে স্লিপারের নিচের মাটি ও পাথর। বিভিন্ন স্থানে রেললাইনের নিচে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তর দাবি করেছে, রেললাইনের বিভিন্ন স্থানে এখনও পানি। ক্ষয়ক্ষতি এখনও নিরূপণ সম্ভব হয়নি। এ রুটে পুনরায় রেল চলাচল নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাথর, বালি, চুনাপাথর ও কমলাসহ মালপত্র আনা-নেয়ার জন্যই মূলত ১৯৫৪ সালে সিলেট-ছাতক রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব পরিবহনের সঙ্গে ব্যাপক সুবিধা সৃষ্টি হয় ছাতক অঞ্চলসহ সুনামগঞ্জ জেলার মানুষের যাতায়াতে। সে সময় ট্রেনই ছিল একমাত্র ভরসা। শুরু থেকেই রেল বিভাগের রাজস্ব আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ছাতক-সিলেট রেলপথটি। করোনা মহামারীর আগ পর্যন্ত সচল ছিল এ রেলপথ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৫৪ সালে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে পশ্চিম-উত্তরে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ওই সময়ে এ রেলপথের সর্বশেষ স্টেশন হিসেবে ছাতক বাজার রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ করা হয়। এর আগে এটি ছিল আখাউড়া-কুলাউড়া-সিলেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

১৯৭৯ সালে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের রাজস্ব আয়ে ছাতক বাজার স্টেশন শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখল করে নেয়। প্রতিদিনই এ পথে তিনটি ট্রেন যাতায়াত করত। মাঝে নানা অজুহাত দেখিয়ে কমিয়ে দেয়া হয় ট্রেন ও ট্রেনের বগি সংখ্যা। ট্রেনে করে প্রায় ৪৫ মিনিটে ছাতক থেকে সিলেট পৌঁছানো যায়। সিলেট-ছাতক রেলপথের ট্রেন খাজাঞ্চীগাঁও, সৎপুর ও আফজালাবাদ স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে। ছাতক, সিলেটের সৎপুর ও খাজাঞ্চীগাঁও এলাকার কয়েক হাজার মানুষের সিলেট শহর ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এক সময় যোগাযোগের এ রেলপথই ছিল একমাত্র মাধ্যম। শিল্প শহর ছাতক থেকে চুনাপাথর, সিমেন্ট, সিøপার, বালি, বোল্ডার পাথরসহ মালপত্র দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে এ রেলপথে সড়কপথের চেয়ে পরিবহন খরচ কয়েক গুণ কম। এজন্য এ রেলপথ দিয়ে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী ছিলেন ব্যবসায়িরা। যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রেও জনপ্রিয় ছিল এ রেলপথ। সিলেট থেকে ছাতকে রেলপথের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটারের ভাড়া মাত্র ১০ টাকা। ট্রেনের ভাড়া ১০ টাকার বিপরীতে বাসের ভাড়া বর্তমানে ৬০ টাকা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া ৮০-১০০ টাকা। সুনামগঞ্জ জেলার সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ও সহায়তার চাল-গমসহ বিভিন্ন পণ্য এ রেলপথে পরিবহন করা হতো। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রেলপথে পণ্যসামগ্রী ছাতক নিয়ে এসে নৌপথে জেলার অন্যান্য উপজেলায় পৌঁছানো সহজ হতো। এতে ট্রাক ভাড়ার চেয়ে কয়েক গুণ সরকারি অর্থ সাশ্রয় হতো বলে জানা গেছে।

করোনা মহামারীর পর থেকে সিলেট-ছাতক রেললাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে এ পথ দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। চলমান বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে সিলেট-ছাতক রেলপথের। বন্যার পানির তীব্র স্রোতে রেললাইনের অধিকাংশ স্থানে সরে গেছে স্লিপারের নিচের মাটি ও পাথর। স্থানে স্থানে রেললাইনের নিচে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত।

ছাতক এর বাসিন্দা হারুন অর রশীদ জানান, শিল্পনগরী ছাতকের বিভিন্ন শিল্পকারখানার প্রাণ ছিল সিলেট-ছাতক রেলপথ। অযত্ন-অবহেলায় এ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এবার বন্যা এসে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে রেলপথটি। জায়গায় জায়গায় স্লিপার উপড়ে অন্যত্র সরে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে বিশাল গর্তের। গুরুত্বপূর্ণ এ রেলপথ দ্রুত সংস্কার করা না হলে স্লিপার ও বিভিন্ন সরঞ্জাম চুরি হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথের দ্রুত সংস্কার দাবি জানান। বাংলাদেশ রেলওয়ে সিলেটের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন জানান, বন্যার পানিতে সিলেট-ছাতক রেললাইনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি নেমে গেলে এর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে। চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে ক্ষতি নিরূপণে রেললাইন পরিদর্শন করা হবে।