প্রসঙ্গ টাকা পাচার

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়, এটা কোন নতুন ঘটনা না। স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকার টাকা পাচার রোধে নিয়েছেন নানা পদক্ষেপ। টিভি চ্যানেলগুলোতে নিশীকথকরা সারারাত জ্ঞান দেন টাকা পাচার বন্ধ করতে। কিন্তু কার্যত কিছু হয় না। বরং প্রতি বছর গাণিতিক হারে আবার কখনো কখনো জ্যামিত হারে বাড়ছে টাকা পাচারের পরিমান। এ অর্থবছরে টাকা পাচার রোধে সরকার চমকপ্রদ পদক্ষেপ নিয়েছেন। পাচারকারী যদি পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনে তাহলে ৭ শতাংশ টাকা রাজকোষে জমা দিয়ে, বাকি টাকার মালিক হয়ে যাবে পাচারকারী।

দেশে পাচার হওয়া টাকাগুলো পাচারকারীরা কীভাবে পায়, তা সবার জানা দরকার। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, নামে বেনামে ঋণ নিয়ে ওই ঋণের টাকা ব্যাংকে পরিশোধ না করে, তা বিদেশে পাচার করা হয়। সরকারি আমলাদের ঘুষের টাকা পাচার হয়ে চলে যায় বিদেশ। এ দেশে কিছু প্রভাবশালী মানুষ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প এর টাকা নয় ছয় করে হাতিয়ে নেয়, তাছাড়া কতিপয় প্রতারক নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা মালিক হয়ে যায। আর এই সব টাকাই বিদেশে পাচার কর হয়ে থাকে। বাংলাদেশের অর্থ বেশি পাচার হয় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে।

এ বছর গত বছরের চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেশি টাকা বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাকগুলোতে পাচার হয়। দেশটির ব্যাংক ইন সুইজারল্যান্ড নামে একটি প্রতিবদনে বলা হয়, ২০২১ সালের শেষের দিকে, দেশটির ২৩৯টি ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা রয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রা। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এক সুইস ফ্রা সমান বাংলাদেশি ৯৫ টাকা। দেশের টাকা এভাবেই চলে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। অপর দিকে সরকার তা রোধ করতে যে আইন বা পদ্ধতি বা কৌশল গ্রহণ করেছেন, তা অনেকটা বালির বাধের মতো। পাচারকারীর কৌশলের কাছে ধোপে টিকছে না সরকারের নেয়া এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তাই বেড়েই চলছে বিদেশে অর্থ পাচার। তবে এই পাচারকারী যদি বিদেশে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতো তাহলে ভয়ে আর টাকা পাচার করত না। যেমন বেকায়দায় পড়েছে পিকে হাওলাদার ভারতে অর্থ পাচার করে।

বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের পাচারকারীদের মধ্যে অন্যতম পাচারকারী পিকে হাওলাদার। পিকে হালদারের পুরো নাম প্রশান্ত কুমার হালদার। পিকে দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও খাত থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছেন। কীভাবে পিকে এত বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিলেন, তা দেশবাসীকেও জানানো দরকার। পিকে হালদার দেশে একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, পিঅ্যান্ডএর ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল এগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হল ইন্টার ন্যাশনাল, হাল ট্রাভেলস, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যে কর্তা ব্যক্তিরা, পিকের এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ দিয়েছেন তারা কি কি সূচকে নীরিক্ষা করে পিকের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ পাওয়ার যোগ্য মনে করেছেন, তা জানা জরুরি। এক পিকে নয় এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেকেই।

তাই অর্থপাচার রোধ করতে হলে মূল শেকড়টা বের করা দরকার। কারণ পিকে এরকম সহজভাবে ঋণ নিতে না পারলে অর্থ পাচার করতে পারত না। সরকারের ফিন্যান্সিয়াল ইনভেস্টিগেটর হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের ভূমিকাটা কি, তাও জনসম্মুখে আসা উচিত। তারা কেন বলতে পারল না পিকে দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নয়-ছয় করছে। তারা কি দায়িত্ব অবহেলা করেনি? পিকে হালদার একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ফিন্যান্সিয়াল ইনভেস্টিগেটদের কাছ থেকে তথ্য না নিয়ে কি বাংলাদেশ ব্যাংক পিকে হালদারকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মনোয়ন দিয়েছিলেন। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে রয়েছে মারাত্মক গলদ, যার জন্য শেয়ারবাজারের আজকের এই দুর্গতি। তাছাড়া রয়েছে দেশের প্রতিটি ব্যাংকের আমানত ঘাটতি। দেশে ঋণ খেলাপি গাণিতিক হারে বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পিকে বিপুল পরিমাণে অর্থ ভারতে পাচার করে, যা ভারতে গোয়েন্দাদের জালে ধরা পড়ে। অথচ বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তা ধরতে পারেনি।

ভারত সরকারের তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পিকে হালদারকে পশ্চিম বাংলায় গ্রেপ্তার করেন। পশ্চিম বাংলায় অশোক নগর, বারাসাতসহ বেশ কয়েকটি স্থানে রয়েছে পিকের বিলাস বহুল বাড়ি। ২৪ পরগনা জেলায় পিকে এর রয়েছে হাজার বিঘা জমি। ভারত সরকার এতদ সম্পর্কিত বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা পেয়েই পিকেকে গ্রেপ্তার করে। আইনি জটিলতা এমন সৃষ্টি হতে যাচ্ছে যে, পিকে তার ভারতীয় সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে না। বাংলাদেশ এই সম্পদ ফেরত পাবে কি না, তাও যাবে না বলা। বাংলাদেশে রয়েছে পিকে হালদারের মতো হাজার হাজার অর্থ পাচারকারী। তারাও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করে। বাংলাদেশের সিংহ ভাগ অর্থ পাচার হয় ইউরোপিয়ন ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এই দেশগুলো যদি ভারতের মতো পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করত, তাহলে ভয়ে বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থ পাচার করার সাহস পেত না। ভবিষ্যতের পাচার রোধকল্পে সরকারের উচিত, যেসব দেশে অর্থ পাচার হচ্ছে, সে দেশের সরকারের সঙ্গে বৈঠক করা। তাদের অনুরোধ করা পাচার হওয়া টাকা ফেরত দেয়া এবং পাচারকারীকে ওই দেশে গ্রেপ্তার করা। তাহলেই বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে টাকা পাচার হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের পাচারকারীরা কানাডা আমেরিকায় বিলাসবহুল বাড়ি বানাচ্ছে। কিন্তু কানাডা বা আমেরিকার সরকার এদের অর্থ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে না।

অন্যদিকে পিকে হঠাৎ সম্পত্তির মালিকানা হওয়ার বিষয়টা ভারতীয় গোয়েন্দাদের জালে ধরা পরে, তাই তারা পিকেকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। অন্যদিকে কানাডা আমেরিকা যারা নিজেদের সভ্য এবং উন্নত বিশ্ব হিসেবে দাবি করে, তারা অবৈধ অর্থ পাচারকারী এবং জাতির জনকের খুনিদের লালনপালন করে। এই হলো কানাডা আমেরিকার সভ্যতার নমুনা। বাংলাদেশের নিশীকথক কথিত সুশীলরা কী ভারত, আমেরিকা , কানাডা, সুইজারল্যান্ডে পাচার হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন কখনো। দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরের কিছু সুশাসন বিশ্লেষকের সৃষ্টি হয়েছে, যারা নিজেদের চেহারা বিভিন্ন চ্যানেলে প্রদর্শন করে সুশাসক গবেষক হিসেবে, তারপর এই প্রদর্শন করা ছবি আপলোড করেন ফেসবুকে, আর আপলোড করা এই পুঁজি সুশাসক বিশ্লেষকরা তুরগের কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ঠিকাদারিসহ নানা স্বার্থ হাসিল করে নেয়। এভাবেই সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে পিকের ন্যায় দুর্নীতি পরায়ন কিছু মানুষের। এদেরই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থনে পাচারকারীরা বিদেশে অর্থ পাচারের সহযোগিতা পায়।

সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেয়া উচিত, যে সব দেশে অর্থ পাচার হয়ে যায়, সে দেশের সরকারকে বলা তারা যেন ভারতের ন্যায় পাচারকারীকে আটক করে। এবং এদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]

মঙ্গলবার, ০৫ জুলাই ২০২২ , ২১ আষাড় ১৪২৮ ২৫ জিলহজ ১৪৪৩

প্রসঙ্গ টাকা পাচার

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন

দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়, এটা কোন নতুন ঘটনা না। স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকার টাকা পাচার রোধে নিয়েছেন নানা পদক্ষেপ। টিভি চ্যানেলগুলোতে নিশীকথকরা সারারাত জ্ঞান দেন টাকা পাচার বন্ধ করতে। কিন্তু কার্যত কিছু হয় না। বরং প্রতি বছর গাণিতিক হারে আবার কখনো কখনো জ্যামিত হারে বাড়ছে টাকা পাচারের পরিমান। এ অর্থবছরে টাকা পাচার রোধে সরকার চমকপ্রদ পদক্ষেপ নিয়েছেন। পাচারকারী যদি পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনে তাহলে ৭ শতাংশ টাকা রাজকোষে জমা দিয়ে, বাকি টাকার মালিক হয়ে যাবে পাচারকারী।

দেশে পাচার হওয়া টাকাগুলো পাচারকারীরা কীভাবে পায়, তা সবার জানা দরকার। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, নামে বেনামে ঋণ নিয়ে ওই ঋণের টাকা ব্যাংকে পরিশোধ না করে, তা বিদেশে পাচার করা হয়। সরকারি আমলাদের ঘুষের টাকা পাচার হয়ে চলে যায় বিদেশ। এ দেশে কিছু প্রভাবশালী মানুষ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প এর টাকা নয় ছয় করে হাতিয়ে নেয়, তাছাড়া কতিপয় প্রতারক নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা মালিক হয়ে যায। আর এই সব টাকাই বিদেশে পাচার কর হয়ে থাকে। বাংলাদেশের অর্থ বেশি পাচার হয় সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে।

এ বছর গত বছরের চেয়ে ৫৫ শতাংশ বেশি টাকা বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাকগুলোতে পাচার হয়। দেশটির ব্যাংক ইন সুইজারল্যান্ড নামে একটি প্রতিবদনে বলা হয়, ২০২১ সালের শেষের দিকে, দেশটির ২৩৯টি ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা রয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রা। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় আট হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রা, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এক সুইস ফ্রা সমান বাংলাদেশি ৯৫ টাকা। দেশের টাকা এভাবেই চলে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। অপর দিকে সরকার তা রোধ করতে যে আইন বা পদ্ধতি বা কৌশল গ্রহণ করেছেন, তা অনেকটা বালির বাধের মতো। পাচারকারীর কৌশলের কাছে ধোপে টিকছে না সরকারের নেয়া এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তাই বেড়েই চলছে বিদেশে অর্থ পাচার। তবে এই পাচারকারী যদি বিদেশে গিয়ে সর্বস্বান্ত হতো তাহলে ভয়ে আর টাকা পাচার করত না। যেমন বেকায়দায় পড়েছে পিকে হাওলাদার ভারতে অর্থ পাচার করে।

বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের পাচারকারীদের মধ্যে অন্যতম পাচারকারী পিকে হাওলাদার। পিকে হালদারের পুরো নাম প্রশান্ত কুমার হালদার। পিকে দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও খাত থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছেন। কীভাবে পিকে এত বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিলেন, তা দেশবাসীকেও জানানো দরকার। পিকে হালদার দেশে একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, পিঅ্যান্ডএর ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল এগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হল ইন্টার ন্যাশনাল, হাল ট্রাভেলস, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের যে কর্তা ব্যক্তিরা, পিকের এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ দিয়েছেন তারা কি কি সূচকে নীরিক্ষা করে পিকের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ পাওয়ার যোগ্য মনে করেছেন, তা জানা জরুরি। এক পিকে নয় এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেকেই।

তাই অর্থপাচার রোধ করতে হলে মূল শেকড়টা বের করা দরকার। কারণ পিকে এরকম সহজভাবে ঋণ নিতে না পারলে অর্থ পাচার করতে পারত না। সরকারের ফিন্যান্সিয়াল ইনভেস্টিগেটর হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের ভূমিকাটা কি, তাও জনসম্মুখে আসা উচিত। তারা কেন বলতে পারল না পিকে দেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নয়-ছয় করছে। তারা কি দায়িত্ব অবহেলা করেনি? পিকে হালদার একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ফিন্যান্সিয়াল ইনভেস্টিগেটদের কাছ থেকে তথ্য না নিয়ে কি বাংলাদেশ ব্যাংক পিকে হালদারকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মনোয়ন দিয়েছিলেন। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে রয়েছে মারাত্মক গলদ, যার জন্য শেয়ারবাজারের আজকের এই দুর্গতি। তাছাড়া রয়েছে দেশের প্রতিটি ব্যাংকের আমানত ঘাটতি। দেশে ঋণ খেলাপি গাণিতিক হারে বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। পিকে বিপুল পরিমাণে অর্থ ভারতে পাচার করে, যা ভারতে গোয়েন্দাদের জালে ধরা পড়ে। অথচ বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তা ধরতে পারেনি।

ভারত সরকারের তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পিকে হালদারকে পশ্চিম বাংলায় গ্রেপ্তার করেন। পশ্চিম বাংলায় অশোক নগর, বারাসাতসহ বেশ কয়েকটি স্থানে রয়েছে পিকের বিলাস বহুল বাড়ি। ২৪ পরগনা জেলায় পিকে এর রয়েছে হাজার বিঘা জমি। ভারত সরকার এতদ সম্পর্কিত বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা পেয়েই পিকেকে গ্রেপ্তার করে। আইনি জটিলতা এমন সৃষ্টি হতে যাচ্ছে যে, পিকে তার ভারতীয় সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে না। বাংলাদেশ এই সম্পদ ফেরত পাবে কি না, তাও যাবে না বলা। বাংলাদেশে রয়েছে পিকে হালদারের মতো হাজার হাজার অর্থ পাচারকারী। তারাও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করে। বাংলাদেশের সিংহ ভাগ অর্থ পাচার হয় ইউরোপিয়ন ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এই দেশগুলো যদি ভারতের মতো পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করত, তাহলে ভয়ে বাংলাদেশ থেকে কেউ অর্থ পাচার করার সাহস পেত না। ভবিষ্যতের পাচার রোধকল্পে সরকারের উচিত, যেসব দেশে অর্থ পাচার হচ্ছে, সে দেশের সরকারের সঙ্গে বৈঠক করা। তাদের অনুরোধ করা পাচার হওয়া টাকা ফেরত দেয়া এবং পাচারকারীকে ওই দেশে গ্রেপ্তার করা। তাহলেই বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে টাকা পাচার হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের পাচারকারীরা কানাডা আমেরিকায় বিলাসবহুল বাড়ি বানাচ্ছে। কিন্তু কানাডা বা আমেরিকার সরকার এদের অর্থ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছে না।

অন্যদিকে পিকে হঠাৎ সম্পত্তির মালিকানা হওয়ার বিষয়টা ভারতীয় গোয়েন্দাদের জালে ধরা পরে, তাই তারা পিকেকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। অন্যদিকে কানাডা আমেরিকা যারা নিজেদের সভ্য এবং উন্নত বিশ্ব হিসেবে দাবি করে, তারা অবৈধ অর্থ পাচারকারী এবং জাতির জনকের খুনিদের লালনপালন করে। এই হলো কানাডা আমেরিকার সভ্যতার নমুনা। বাংলাদেশের নিশীকথক কথিত সুশীলরা কী ভারত, আমেরিকা , কানাডা, সুইজারল্যান্ডে পাচার হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন কখনো। দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরের কিছু সুশাসন বিশ্লেষকের সৃষ্টি হয়েছে, যারা নিজেদের চেহারা বিভিন্ন চ্যানেলে প্রদর্শন করে সুশাসক গবেষক হিসেবে, তারপর এই প্রদর্শন করা ছবি আপলোড করেন ফেসবুকে, আর আপলোড করা এই পুঁজি সুশাসক বিশ্লেষকরা তুরগের কার্ড হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে ঠিকাদারিসহ নানা স্বার্থ হাসিল করে নেয়। এভাবেই সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে পিকের ন্যায় দুর্নীতি পরায়ন কিছু মানুষের। এদেরই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থনে পাচারকারীরা বিদেশে অর্থ পাচারের সহযোগিতা পায়।

সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নেয়া উচিত, যে সব দেশে অর্থ পাচার হয়ে যায়, সে দেশের সরকারকে বলা তারা যেন ভারতের ন্যায় পাচারকারীকে আটক করে। এবং এদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে।

[লেখক : উন্নয়নকর্মী]