নানা অভিযোগের মুখে থাকা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গতকাল পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। নাটকীয়ভাবে মন্ত্রিসভার সদস্য ও বেশিরভাগ কনজারভেটিভ আইন প্রণেতার সমর্থন হারানোর পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দলের নেতার পদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। রয়টার্স।
মন্ত্রিসভার ৫০ জনেরও বেশি সদস্যের পদত্যাগ এবং আইন প্রণেতাদের দাবির মুখে জনসন বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে তার দল অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে চায়।
জনসন তার ডাউনিং স্ট্রিট অফিসের বাইরে পদত্যাগ সংক্রান্ত ভাষণে বলেন, ‘আমি জানি এমন অনেক লোক আছেন, যারা এতে স্বস্তি পাবেন। হয়তো বেশ কয়েকজন হতাশও হবেন। আমি আপনাদের জানতে চাই, বিশ্বের সেরা কাজটি ছেড়ে দিয়ে আমি কতটা দুঃখিত।’
তবে উত্তরসূরী কে হবেন, তা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি নতুন মন্ত্রিসভাও নিয়োগ দিচ্ছেন।
সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, গত দুই দিনে মন্ত্রিসভার ৫০ জনেরও বেশি সদস্য পদত্যাগ করায় দল থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন বরিস। ফলে পরিণতি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
তবে গত বুধবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না জনসন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, তার দেশ যেসব অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তিনি কাজ চালিয়ে যেতে চান। এছাড়া আগাম নির্বাচন দেয়ার কোন কারণ নেই বলেও বুধবার উল্লেখ করেন তিনি। পরে গতকাল বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলের নেতার পদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তিনি। গত মঙ্গলবার পদত্যাগের ঘোষণা দেন জনসন সরকারের অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ। তাদের পদত্যাগের ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনসনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একের পর এক মন্ত্রী পদত্যাগ করতে শুরু করেন। এখন পর্যন্ত সরকারের নানা পর্যায়ের ৫০ জনেরও বেশি পদত্যাগ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনায় বরিস জনসনের প্রশাসন কলঙ্কিত হয়েছে এবং এ পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে সরকারের সঙ্গে থাকা সম্ভব হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন
বরিস জনসন বলেন, সংসদের আইনপ্রণেতাদের দাবি একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী আসুক। নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ের সময়সীমা আগামী সপ্তাহেই ঘোষণা করা হবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছিলেন কারণ ব্যক্তিগতভাবে ভোটারদের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চেয়েছিলেন। বরিস জনসন মনে করেন, এটি তার দায়িত্ব।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট সম্পন্ন করা, যুক্তরাজ্যকে করোনা মহামারী থেকে সুরক্ষা এবং ইউক্রেনে পুতিনের হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য পশ্চিমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান।
সরকার পরিবর্তনের পক্ষে না ছিলেন না জানিয়ে সহকর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাতে সফল হননি। তবে প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদপূর্ণ করতে না পারাকে অত্যন্ত ‘বেদনাদায়ক’ বলে মন্তব্য করেন জনসন। বলেন, নিজ দলের সমর্থন ধরে রাখতা না পারায় সফল হননি তিনি।
সবশেষে তার স্ত্রী-সন্তান এবং ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী এবং ডাউনিং স্ট্রিটের সব স্টাফদের প্রতি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান বরিস জনসন।
উদ্ভট কান্ড-উল্টোপাল্টা মন্তব্য
উদ্ভট কান্ড আর উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে নিয়মিতই দলের নেতাদের বিব্রত করেছেন জনসন। তার দলের অনেক প্রভাবশালী নেতাই তার কট্টর সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। তারমধ্যে জনসন এ বছরের শুরুতে ক্রিস পিনচারকে দলের ডেপুটি চিফ হুইপের পদে নিয়োগ দিলে দলের অনেক নেতা তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরাসরি আপত্তি জানান। পরে অবশ্য জনসন বলেছেন, তার ওই সিদ্ধান্ত ‘অত্যন্ত ভুল’ ছিল।
গত কয়েক মাসে বরিসের নেতৃত্বে বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত ও কেলেঙ্কারির ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। ফলে দল ও দেশের নেতা হিসেবে তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ সময় পুলিশ তাকে করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ না মানার জন্য জরিমানা করে এবং ডাউনিং স্ট্রিটের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) কর্মকর্তাদের নীতিমালা বহির্ভূত আচরণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বিশ্বে কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হলে, জনসনের ভাগ্যেও যেন শনির দশা শুরু হয়। করোনাভাইরাসকে শুরুতে গুরুত্ব না দেয়া এবং এটি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা বিশ্বনেতাদের একজন জনসন। পরে অবশ্য তিনি নিজেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে চলে গিয়েছিলেন। জনসন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ইউরোপের মধ্যে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ কোভিড-১৯ মহামারীতে আক্রান্ত এবং মারা গেছেন বলে মনে করেন তার সমালোচকরা।
বিশ্ব যখন মহামারীর সেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে। ঠিক তখনই সামনে আসে জনসনের মদ পার্টির কেলেঙ্কারির খবর। ২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যে দেশবাসীকে বিধিনিষেধে আটকে রেখে তিনি নিজে তার কার্যালয়ে হওয়া মদপানের পার্টিতে উপস্থিত থেকেছেন। যা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে ‘পার্টিগেইট’ বা ‘পার্টি কেলেঙ্কারি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। খবর প্রকাশের পর যা নিয়ে তিনি শুরুতে প্রকাশ্যে মিথ্যাচারও করেছেন।
এছাড়া ২০২১ সালের ১৬ এপ্রিলে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান, তখনও প্রধানমন্ত্রীর ডাউনিং স্ট্রিটের কার্যালয়ে কর্মীরা আরও দুটো মদের পার্টি করেছিলেন।
সেই জুলাইয়েই পতন
দেড় যুগের সাংবাদিকতা আর রাজনৈতিক জীবনের নানা উত্থান-পতন পেরোনো জনসন ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ঠিকানা গেড়েছিলেন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। ব্রেক্সিট নিয়ে বেহাল দশায় টেরিজা মের পদত্যাগের পর নেতৃত্ব নির্বাচনে জিতে কনজারভেটিভ দলের প্রধানের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জনসন। তিন বছর পর সেই জুলাই মাসেই ১০ ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়ার ঘোষণা দিতে হচ্ছে তাকে।
অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি আর লকডাউনের বিধি লঙ্ঘন করে মদের পার্টির কেলেঙ্কারির জেরে সমর্থনের পড়তি দশা, দলে একা হয়ে পড়া জনসন কিছুদিন আগেও আস্থা ভোটে জিতে দলের ভেতর তার শক্ত অবস্থানের প্রমাণ দিয়েছিলেন।
কনজারভেটিভ দলের নিয়ম অনুযায়ী, কেউ একবার আস্থা ভোটে উৎরে গেলে তার বিরুদ্ধে পরের এক বছর কোন অনাস্থা প্রস্তাব আনার সুযোগ নেই। কিন্তু আস্থা ভোটে জিতে গেলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার উদাহরণ জনসনের সামনেই ছিল। তার পূর্বসূরি টেরিজা মে আস্থা ভোটে জিতেও ছয় মাসের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই জনসন জুনের আস্থা ভোটে উৎরে গেলেও তার ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছিল না এবং সেই সংশয়কে সত্য প্রমাণ করলেন তিনি।
জন্ম পরিচয়
পিতৃকূলের দিক থেকে জনসনের আছে একইসঙ্গে ব্রিটিশ ও তুর্কি উত্তরাধিকার। তার দাদার বাবা আলি কামাল ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। উদারপন্থি এ সাংবাদিক সুলতানের গ্র্যান্ড ভিজার (প্রধানমন্ত্রী) দামাত ফরিদ পাশার মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জনসনের দাদার নানি মেরি লুই দে পিফেল ছিলেন উর্তেমবার্গের যুবরাজ পলের বংশধর, সে সূত্রে গ্রেট ব্রিটেনের রাজা জেমস ওয়ান ও রাজা জর্জ টু-রও বংশধর তিনি।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।
রাজনীতিতে আসার আগে স্ট্যানলি বিশ্বব্যাংক ও ইউরোপিয়ান কমিশনে কর্মরত ছিলেন। জনসনের নানা স্যার জেমস ফসেট ইউরোপিয়ান মানবাধিকার কমিশনেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে। বধির ছিলেন তিনি। যে কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল, জনসন সে সময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়-স্বজনরা জানিয়েছেন।
শুক্রবার, ০৮ জুলাই ২০২২ , ২৪ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলহজ ১৪৪৩
সংবাদ ডেস্ক
নানা অভিযোগের মুখে থাকা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গতকাল পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। নাটকীয়ভাবে মন্ত্রিসভার সদস্য ও বেশিরভাগ কনজারভেটিভ আইন প্রণেতার সমর্থন হারানোর পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর পদ ও দলের নেতার পদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। রয়টার্স।
মন্ত্রিসভার ৫০ জনেরও বেশি সদস্যের পদত্যাগ এবং আইন প্রণেতাদের দাবির মুখে জনসন বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে তার দল অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে চায়।
জনসন তার ডাউনিং স্ট্রিট অফিসের বাইরে পদত্যাগ সংক্রান্ত ভাষণে বলেন, ‘আমি জানি এমন অনেক লোক আছেন, যারা এতে স্বস্তি পাবেন। হয়তো বেশ কয়েকজন হতাশও হবেন। আমি আপনাদের জানতে চাই, বিশ্বের সেরা কাজটি ছেড়ে দিয়ে আমি কতটা দুঃখিত।’
তবে উত্তরসূরী কে হবেন, তা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি নতুন মন্ত্রিসভাও নিয়োগ দিচ্ছেন।
সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, গত দুই দিনে মন্ত্রিসভার ৫০ জনেরও বেশি সদস্য পদত্যাগ করায় দল থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন বরিস। ফলে পরিণতি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
তবে গত বুধবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে রাজি হচ্ছিলেন না জনসন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, তার দেশ যেসব অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তিনি কাজ চালিয়ে যেতে চান। এছাড়া আগাম নির্বাচন দেয়ার কোন কারণ নেই বলেও বুধবার উল্লেখ করেন তিনি। পরে গতকাল বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলের নেতার পদ ছাড়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তিনি। গত মঙ্গলবার পদত্যাগের ঘোষণা দেন জনসন সরকারের অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ। তাদের পদত্যাগের ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনসনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একের পর এক মন্ত্রী পদত্যাগ করতে শুরু করেন। এখন পর্যন্ত সরকারের নানা পর্যায়ের ৫০ জনেরও বেশি পদত্যাগ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনায় বরিস জনসনের প্রশাসন কলঙ্কিত হয়েছে এবং এ পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে সরকারের সঙ্গে থাকা সম্ভব হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন
বরিস জনসন বলেন, সংসদের আইনপ্রণেতাদের দাবি একজন নতুন প্রধানমন্ত্রী আসুক। নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ের সময়সীমা আগামী সপ্তাহেই ঘোষণা করা হবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছিলেন কারণ ব্যক্তিগতভাবে ভোটারদের দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চেয়েছিলেন। বরিস জনসন মনে করেন, এটি তার দায়িত্ব।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট সম্পন্ন করা, যুক্তরাজ্যকে করোনা মহামারী থেকে সুরক্ষা এবং ইউক্রেনে পুতিনের হামলার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য পশ্চিমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান।
সরকার পরিবর্তনের পক্ষে না ছিলেন না জানিয়ে সহকর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাতে সফল হননি। তবে প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদপূর্ণ করতে না পারাকে অত্যন্ত ‘বেদনাদায়ক’ বলে মন্তব্য করেন জনসন। বলেন, নিজ দলের সমর্থন ধরে রাখতা না পারায় সফল হননি তিনি।
সবশেষে তার স্ত্রী-সন্তান এবং ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস, সশস্ত্র বাহিনী এবং ডাউনিং স্ট্রিটের সব স্টাফদের প্রতি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান বরিস জনসন।
উদ্ভট কান্ড-উল্টোপাল্টা মন্তব্য
উদ্ভট কান্ড আর উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে নিয়মিতই দলের নেতাদের বিব্রত করেছেন জনসন। তার দলের অনেক প্রভাবশালী নেতাই তার কট্টর সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। তারমধ্যে জনসন এ বছরের শুরুতে ক্রিস পিনচারকে দলের ডেপুটি চিফ হুইপের পদে নিয়োগ দিলে দলের অনেক নেতা তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরাসরি আপত্তি জানান। পরে অবশ্য জনসন বলেছেন, তার ওই সিদ্ধান্ত ‘অত্যন্ত ভুল’ ছিল।
গত কয়েক মাসে বরিসের নেতৃত্বে বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত ও কেলেঙ্কারির ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। ফলে দল ও দেশের নেতা হিসেবে তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ সময় পুলিশ তাকে করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ না মানার জন্য জরিমানা করে এবং ডাউনিং স্ট্রিটের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) কর্মকর্তাদের নীতিমালা বহির্ভূত আচরণ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বিশ্বে কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হলে, জনসনের ভাগ্যেও যেন শনির দশা শুরু হয়। করোনাভাইরাসকে শুরুতে গুরুত্ব না দেয়া এবং এটি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা বিশ্বনেতাদের একজন জনসন। পরে অবশ্য তিনি নিজেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে চলে গিয়েছিলেন। জনসন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ইউরোপের মধ্যে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ কোভিড-১৯ মহামারীতে আক্রান্ত এবং মারা গেছেন বলে মনে করেন তার সমালোচকরা।
বিশ্ব যখন মহামারীর সেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে। ঠিক তখনই সামনে আসে জনসনের মদ পার্টির কেলেঙ্কারির খবর। ২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যে দেশবাসীকে বিধিনিষেধে আটকে রেখে তিনি নিজে তার কার্যালয়ে হওয়া মদপানের পার্টিতে উপস্থিত থেকেছেন। যা ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে ‘পার্টিগেইট’ বা ‘পার্টি কেলেঙ্কারি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। খবর প্রকাশের পর যা নিয়ে তিনি শুরুতে প্রকাশ্যে মিথ্যাচারও করেছেন।
এছাড়া ২০২১ সালের ১৬ এপ্রিলে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান, তখনও প্রধানমন্ত্রীর ডাউনিং স্ট্রিটের কার্যালয়ে কর্মীরা আরও দুটো মদের পার্টি করেছিলেন।
সেই জুলাইয়েই পতন
দেড় যুগের সাংবাদিকতা আর রাজনৈতিক জীবনের নানা উত্থান-পতন পেরোনো জনসন ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ঠিকানা গেড়েছিলেন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। ব্রেক্সিট নিয়ে বেহাল দশায় টেরিজা মের পদত্যাগের পর নেতৃত্ব নির্বাচনে জিতে কনজারভেটিভ দলের প্রধানের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জনসন। তিন বছর পর সেই জুলাই মাসেই ১০ ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়ার ঘোষণা দিতে হচ্ছে তাকে।
অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি আর লকডাউনের বিধি লঙ্ঘন করে মদের পার্টির কেলেঙ্কারির জেরে সমর্থনের পড়তি দশা, দলে একা হয়ে পড়া জনসন কিছুদিন আগেও আস্থা ভোটে জিতে দলের ভেতর তার শক্ত অবস্থানের প্রমাণ দিয়েছিলেন।
কনজারভেটিভ দলের নিয়ম অনুযায়ী, কেউ একবার আস্থা ভোটে উৎরে গেলে তার বিরুদ্ধে পরের এক বছর কোন অনাস্থা প্রস্তাব আনার সুযোগ নেই। কিন্তু আস্থা ভোটে জিতে গেলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার উদাহরণ জনসনের সামনেই ছিল। তার পূর্বসূরি টেরিজা মে আস্থা ভোটে জিতেও ছয় মাসের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই জনসন জুনের আস্থা ভোটে উৎরে গেলেও তার ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছিল না এবং সেই সংশয়কে সত্য প্রমাণ করলেন তিনি।
জন্ম পরিচয়
পিতৃকূলের দিক থেকে জনসনের আছে একইসঙ্গে ব্রিটিশ ও তুর্কি উত্তরাধিকার। তার দাদার বাবা আলি কামাল ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। উদারপন্থি এ সাংবাদিক সুলতানের গ্র্যান্ড ভিজার (প্রধানমন্ত্রী) দামাত ফরিদ পাশার মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জনসনের দাদার নানি মেরি লুই দে পিফেল ছিলেন উর্তেমবার্গের যুবরাজ পলের বংশধর, সে সূত্রে গ্রেট ব্রিটেনের রাজা জেমস ওয়ান ও রাজা জর্জ টু-রও বংশধর তিনি।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে।
রাজনীতিতে আসার আগে স্ট্যানলি বিশ্বব্যাংক ও ইউরোপিয়ান কমিশনে কর্মরত ছিলেন। জনসনের নানা স্যার জেমস ফসেট ইউরোপিয়ান মানবাধিকার কমিশনেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে। বধির ছিলেন তিনি। যে কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল, জনসন সে সময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়-স্বজনরা জানিয়েছেন।