গাবতলী পশুরহাট, ভিড়ের সঙ্গে বিক্রিও বেড়েছে

ঈদুল আজহার আর মাত্র এক দিন বাকি। ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর হাটগুলোতে পর্যাপ্ত পশু দেখা গেলেও এখনও হাটগুলোতে সেভাবে বিক্রি শুরু হয়নি। তবে আগের দিনের তুলনায় গতকাল গাবতলীর পশুর হাটে ক্রেতাদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই দিনের তুলনায় ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে। হাটে বেড়েছে পশু বিক্রি। কোরবানির পশু নিয়ে আসা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, হাটে আসার পর তাদের অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। হাট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হাসিল ছাড়া অতিরিক্ত টাকা আদায়ের কোন সুযোগ নেই। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হাটে স্বাস্থ্যবিধি না মানা হলেও হাট কর্তৃপক্ষ মানুষকে মাস্ক পরতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি বিতরণের কথা জানান।

সরেজমিন রাজধানীর গাবতলী পশুর হাট ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। পশু হাটের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে সবচেয়ে বড় বড় গরুগুলো। হরেক নামের বাহারি জাতের ষাঁড়। হাটের ডানদিকে বিক্রি হচ্ছে ছাগল, খাসি ও ভেড়া। হাটের মধ্যখানে দেখা মিলবে মাঝারি আকারের গরু। আর হাটের শেষ মাথায় রাখা হয়েছে ছোট গরুগুলো।

মিরপুর ১ নম্বর থেকে গাবতলী হাটে এসেছেন বাপ্পী মিয়া। তিনি বলেন, ‘হাটে গরু ভালোই এসেছে। ছোট গরুর দাম মনে হচ্ছে বেশি। আমি মাঝারি ধরনের গরু কিনবো এবার। দাম এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে।’

তাজমহল রোডের শাহারিয়ার রাহিম বলেন, ‘সকালে হাটে এসেছি। ছোট গরু দেখছি। এখনও কিনতে পারিনি। গতবারের তুলনায় এবার একটু দাম বেশি। গতবছর যে গরুর দাম ছিল ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা সে গরুর দাম রাখালিরা চাইছেন এক লাখ ৩০ থেকে দেড় লাখ টাকা।’

রাজশাহী থেকে এক ট্রাক গরু নিয়ে হাটে এসেছেন হারেস মিয়া। তিনি বলেন, ক্রেতারা আসছেন। দাম কম করে বলছেন। গত দুই দিনের তুলনায় আজকে ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি। আমি আজকে দুটি গরু বিক্রি করেছি। একটা বিক্রি করেছি এক লাখ ৭৫ হাজার ও আরেকটা এক লাখ ৩২ হাজার টাকায়। তিনি আরও বলেন, আমার আরেকটি গরু আছে এটার দাম চাচ্ছি সাড়ে তিন লাখ টাকা। ক্রেতারা দুই লাখ টাকাও দাম বলছেন না। এবার মনে হয় ব্যবসায় লাভ করতে পারবো না।

গাবতলীর পশুর হাটে বিভিন্ন অংশেই ছোট ছোট জটলা। এসব জটলার বেশিরভাগই হাটে ওঠা বড় গরুকে কেন্দ্র করে। হাটের ঠিক মাঝ বরাবর বেশ বড় একটি জটলা লক্ষ্য করা যায়। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই জটলা কিসের জন্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এ জটলা বরিশালের রাজাবাবুকে ঘিরে। বরিশালের মুলাদি সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. হুমায়ন কবির, শিক্ষকতার পাশাপাশি একটি খামারের মালিকও তিনি। এবার গাবতলী পশুর হাটের সবচেয়ে বড় গরুর মালিক এ শিক্ষক। আদর করে গরুটির নাম রেখেছেন ‘রাজাবাবু’। ঈদ বাজারে গরুটিকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রির আশা তার। সঙ্গে একটি ছাগলও ফ্রিতে দেবেন শিক্ষক হুমায়ন কবির।

হুমায়ন জানান, প্রায় সাড়ে চার বছর আগে রাজা বাবুকে ৯৮ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন তিনি। দৈনিক এ গরুর পেছনে তার এক হাজার টাকার বেশি খরচ আছে। খাবার হিসেবে দিতে হয়, গম ও চালের ভুসি, চাষ করা ঘাস আর সামান্য পরিমাণে ভালো জাতের ক্যাটেল।

গরু হাটে রাখলেই দিতে হচ্ছে টাকা

গাবতলি হাটে আসা গরু বিক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। সেখানে আসা প্রায় সব ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গরুর আকৃতি ভেদে ৩ থেকে ২০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। তবে হাট ইজারাদারদের দাবি, কেউ এমনভাবে টাকা আদায় করছে অভিযোগ করলেই ব্যবস্থা।

৭৫টি গরু নিয়ে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থেক দুলাল চোকদার গরু ফার্মের বেলাল হোসেন ও তার দল এসেছেন গাবতলী গরুহাটে। হাটে এই কয়েকদিনে কয়টি গরু বিক্রি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ৭৫টি গরুর মধ্যে তিনটি বিক্রি হয়েছে। হাটে আসলে টাকা-পয়সা লাগে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘টাকা তো নিবেই, টাকা ছাড়া এখানে রাখতে দেয় না। আগের বছরগুলোতে কিছু কম আছিলো। খরচা বাড়তাছে, আস্তে আস্তে সেজন্য দাম বাড়তেছে।’

গাবতলি হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা একটি গরুর নাম প্রিন্স। এই প্রিন্সের মালিক বানিজুর রহমান বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে আসার পর আমার এ গরু রাখতে ১৮ হাজার টাকা লেগেছে। তবে আগে ২ হাজার দিয়েছি বিক্রির পর বাকি টাকা দিব বলেছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গরু বিক্রেতা বলেন, ‘কালকে নামাইছি ওনদা (ওখানে) ওই গরুডা নামানোর জন্য তারা দুই হাজার ট্যাহা (টাকা) নিচে (নিয়েছে)। ওই যে ওহানে একটা লোক আচে নামাইতেই দেয় না। তারপর দুই হাজার ট্যাকা দিছি তারপর নামাইতে দিচে।’

গাবতলী স্থায়ী হাটের ম্যানেজার আবদুল হাসেম বলেন, ‘গাবতলী হাটে কোন টাকা নেয়া হয় না। তবে কেউ যদি এমন টাকা নেয়ার অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসে তবে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখনই মাইকিং করে দিচ্ছি কোন ব্যাপারির কোন সমস্যা, বা অসুবিধা থাকে তবে তারা যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।’

ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবেদ আলী সংবাদকে বলেন, ‘ইজারাদারদের নেয়ার কোন সুযোগ নাই। যদি এটা লঙ্ঘন করে আমাদের সম্পতি বিভাগ থেকে ইজারা দেয়া ইজারাদার যদি ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করে তারা বাতিল করতে পারবে।’ কেউ যদি এমন করে বা নিচ্ছে (টাকা) তাদের কথা সেখানকার পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও র‌্যাবকে জানানোর কথাও বলেন তিনি।

উত্তর সিটি কপোরেশনের প্রধান সম্পতি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মোহাম্মদ মাহে আলমকে বারবার টেলিফোন করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

ছোট আর মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি

ঢাকার দুই সিটিতে বসেছে ২০টি হাট। ক্রেতা- বেপারির সমাগমে জমেছে হাটগুলো। তবে গরুর দাম গেলবারের চেয়ে এবার বেশি। গরুর পাশাপাশি বিভিন্ন জাত আর আকারের ছাগলও উঠেছে হাটে। তবে এই পশুটির দামও এবার তুলনামূলক বেশি। পশুর হাট ঘুরে ক্রেতাদের সঙোহ কথা বলে জানা গেছে, লাখ টাকার নিচে ভালো মানের একটি কোরবানির পশু মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা।

গাবতলী হাটে আসা গরু বিক্রেতা এরফান আলী বলেন, ‘এবার বেঁচা-বিক্রি কমে গেছে। হাটে আসার পর মাত্র দুইটা গরু বিক্রি হয়েছে। ক্রেতাদের তেমন সাড়া মিলছে না। বেশিরভাগ ক্রেতা আসলে ৭০-৮০ হাজার টাকার মধ্যে ভালো গরু চাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। খরচ বেড়ে যাওয়ায় এক লাখের নিচে ভালো গরু বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।’ পশুর লাখ টাকা দামের ফলে তা অনেকেরই ক্রয়সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে দাবি ক্রেতাদের। রাকিবুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা জানান, ছোট সাইজের একটা গরু দেখলাম, দাম চাচ্ছে ৭৫ হাজার টাকা। অথচ কয়েক বছর আগেও এই আকারের গরু ৪০ হাজার টাকাতেই পাওয়া যেত।’

এছাড়া পুরো রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে বসেছে অবৈধ গরুর হাট। সড়ক ও ফুটপাত দখল করে মিরপুর ৬ নম্বর (বি-ব্লক মসজিদ সংলগ্ন) অবৈধ গরুর হাটটি স্থানীয় প্রভাবশালীরা বসিয়েছেন বলে জানা গেছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য, এ বছর কোরবানির হাটের জন্য গবাদিপশু সরবরাহের সংখ্যা গতবারের চেয়ে দুই লাখের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এ বছর গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত রয়েছে। গত বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে কোরবানি হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু।

হাট সংলগ্ন এলাকায় রাত ৮টা পর্যন্ত ব্যাংক চালুর ঘোষণা

রাজধানীর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পশুর হাট সংলগ্ন ব্যাংকের শাখাগুলোতে গতকাল সান্ধ্যকালীন লেনদেন চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। পাশাপাশি এসব এলাকায় আজ শুক্রবার ও আগামীকাল শনিবার ছুটির দিনে বিশেষ ব্যবস্থায় খোলা থাকবে ব্যাংক। ব্যাংকিং কার্যক্রম চলবে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। কোরবানির পশু ব্যবসায়ীদের ব্যাংকিং লেনদেনের সুবিধার্থে এই নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগের জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, আসন্ন ঈদুল আজহার আগে ৭ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সান্ধ্য ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। এর পরের দুদিন ৮ ও ৯ জুলাই (শুক্র ও শনিবার) কোরবানির হাটের নিকটবর্তী ব্যাংক শাখা খোলা থাকবে। এসব শাখায় সকাল ১০টা হতে রাত ৮টা পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে বলা হয়েছে।

পশুর শরীরে মোটাতাজার ওষুধ প্রয়োগ হয়েছে কি না জানতে হাটে র‌্যাব

ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বসেছে হাট। এসব হাটে ওঠা পশু মোটাতাজাকরণের উদ্দেশে কোন ওষুধ প্রয়োগ হয়েছে কি না জানতে অভিযান পরিচালনা করছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। কোরবানির ঈদের আমেজ শুরু হয় গরু-ছাগলের বিশাল হাট স্থাপনের মাধ্যমে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় হাট গাবতলীতে। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খামারি বা গেরস্তরা নিজ বাড়ির লালিত পশু নিয়ে এ হাটে আসেন। অনেক সময় বেশি অর্থ আয়ের লক্ষ্যে কম বয়সী বা স্বাস্থ্যের গরুর শরীরে মোটাতাজাকরণের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এবার এমন কোন ঘটনা ঘটুক, চায় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গতকাল সকাল থেকে গাবতলী পশুর হাটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে র‌্যাব। এ হাটে গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ী হাটে আনা গরুর শরীরে মোটাতাজাকরণ বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করেন। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট পশু ডাক্তারসহ অভিযান পরিচালনা করছেন। তারা দেখছেন কেউ মোটাতাজাকরণ ওষুধ প্রয়োগ করেছে কি না।’

কোন ধরনের চাঁদাবাজি বরদাস্ত করা হবে না বলে এ সময় কঠোর হুঁশিয়ারি দেন র‌্যাবের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গাবতলী পশুর এ হাটে গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি আরও বলেন, আমরা সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ করছি। করনোভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা সবার মধ্যে মাস্ক বিতরণ করছি। র‌্যাবের সব ইউনিট স্বর্বাত্মকভাবে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছে বলেও উল্লেখ করেন খন্দকার আল মঈন।

শুক্রবার, ০৮ জুলাই ২০২২ , ২৪ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলহজ ১৪৪৩

গাবতলী পশুরহাট, ভিড়ের সঙ্গে বিক্রিও বেড়েছে

শাফিউল ইমরান

image

গাবতলী গরুর হাটফেরত ক্রেতাদের দুর্ভোগ -সংবাদ

ঈদুল আজহার আর মাত্র এক দিন বাকি। ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীর হাটগুলোতে পর্যাপ্ত পশু দেখা গেলেও এখনও হাটগুলোতে সেভাবে বিক্রি শুরু হয়নি। তবে আগের দিনের তুলনায় গতকাল গাবতলীর পশুর হাটে ক্রেতাদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই দিনের তুলনায় ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে। হাটে বেড়েছে পশু বিক্রি। কোরবানির পশু নিয়ে আসা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, হাটে আসার পর তাদের অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে। হাট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হাসিল ছাড়া অতিরিক্ত টাকা আদায়ের কোন সুযোগ নেই। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। হাটে স্বাস্থ্যবিধি না মানা হলেও হাট কর্তৃপক্ষ মানুষকে মাস্ক পরতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি বিতরণের কথা জানান।

সরেজমিন রাজধানীর গাবতলী পশুর হাট ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। পশু হাটের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়বে সবচেয়ে বড় বড় গরুগুলো। হরেক নামের বাহারি জাতের ষাঁড়। হাটের ডানদিকে বিক্রি হচ্ছে ছাগল, খাসি ও ভেড়া। হাটের মধ্যখানে দেখা মিলবে মাঝারি আকারের গরু। আর হাটের শেষ মাথায় রাখা হয়েছে ছোট গরুগুলো।

মিরপুর ১ নম্বর থেকে গাবতলী হাটে এসেছেন বাপ্পী মিয়া। তিনি বলেন, ‘হাটে গরু ভালোই এসেছে। ছোট গরুর দাম মনে হচ্ছে বেশি। আমি মাঝারি ধরনের গরু কিনবো এবার। দাম এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকার মধ্যে।’

তাজমহল রোডের শাহারিয়ার রাহিম বলেন, ‘সকালে হাটে এসেছি। ছোট গরু দেখছি। এখনও কিনতে পারিনি। গতবারের তুলনায় এবার একটু দাম বেশি। গতবছর যে গরুর দাম ছিল ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা সে গরুর দাম রাখালিরা চাইছেন এক লাখ ৩০ থেকে দেড় লাখ টাকা।’

রাজশাহী থেকে এক ট্রাক গরু নিয়ে হাটে এসেছেন হারেস মিয়া। তিনি বলেন, ক্রেতারা আসছেন। দাম কম করে বলছেন। গত দুই দিনের তুলনায় আজকে ক্রেতার সংখ্যা অনেক বেশি। আমি আজকে দুটি গরু বিক্রি করেছি। একটা বিক্রি করেছি এক লাখ ৭৫ হাজার ও আরেকটা এক লাখ ৩২ হাজার টাকায়। তিনি আরও বলেন, আমার আরেকটি গরু আছে এটার দাম চাচ্ছি সাড়ে তিন লাখ টাকা। ক্রেতারা দুই লাখ টাকাও দাম বলছেন না। এবার মনে হয় ব্যবসায় লাভ করতে পারবো না।

গাবতলীর পশুর হাটে বিভিন্ন অংশেই ছোট ছোট জটলা। এসব জটলার বেশিরভাগই হাটে ওঠা বড় গরুকে কেন্দ্র করে। হাটের ঠিক মাঝ বরাবর বেশ বড় একটি জটলা লক্ষ্য করা যায়। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই জটলা কিসের জন্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এ জটলা বরিশালের রাজাবাবুকে ঘিরে। বরিশালের মুলাদি সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. হুমায়ন কবির, শিক্ষকতার পাশাপাশি একটি খামারের মালিকও তিনি। এবার গাবতলী পশুর হাটের সবচেয়ে বড় গরুর মালিক এ শিক্ষক। আদর করে গরুটির নাম রেখেছেন ‘রাজাবাবু’। ঈদ বাজারে গরুটিকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রির আশা তার। সঙ্গে একটি ছাগলও ফ্রিতে দেবেন শিক্ষক হুমায়ন কবির।

হুমায়ন জানান, প্রায় সাড়ে চার বছর আগে রাজা বাবুকে ৯৮ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন তিনি। দৈনিক এ গরুর পেছনে তার এক হাজার টাকার বেশি খরচ আছে। খাবার হিসেবে দিতে হয়, গম ও চালের ভুসি, চাষ করা ঘাস আর সামান্য পরিমাণে ভালো জাতের ক্যাটেল।

গরু হাটে রাখলেই দিতে হচ্ছে টাকা

গাবতলি হাটে আসা গরু বিক্রেতাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। সেখানে আসা প্রায় সব ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গরুর আকৃতি ভেদে ৩ থেকে ২০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। তবে হাট ইজারাদারদের দাবি, কেউ এমনভাবে টাকা আদায় করছে অভিযোগ করলেই ব্যবস্থা।

৭৫টি গরু নিয়ে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থেক দুলাল চোকদার গরু ফার্মের বেলাল হোসেন ও তার দল এসেছেন গাবতলী গরুহাটে। হাটে এই কয়েকদিনে কয়টি গরু বিক্রি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ৭৫টি গরুর মধ্যে তিনটি বিক্রি হয়েছে। হাটে আসলে টাকা-পয়সা লাগে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘টাকা তো নিবেই, টাকা ছাড়া এখানে রাখতে দেয় না। আগের বছরগুলোতে কিছু কম আছিলো। খরচা বাড়তাছে, আস্তে আস্তে সেজন্য দাম বাড়তেছে।’

গাবতলি হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা একটি গরুর নাম প্রিন্স। এই প্রিন্সের মালিক বানিজুর রহমান বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে আসার পর আমার এ গরু রাখতে ১৮ হাজার টাকা লেগেছে। তবে আগে ২ হাজার দিয়েছি বিক্রির পর বাকি টাকা দিব বলেছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গরু বিক্রেতা বলেন, ‘কালকে নামাইছি ওনদা (ওখানে) ওই গরুডা নামানোর জন্য তারা দুই হাজার ট্যাহা (টাকা) নিচে (নিয়েছে)। ওই যে ওহানে একটা লোক আচে নামাইতেই দেয় না। তারপর দুই হাজার ট্যাকা দিছি তারপর নামাইতে দিচে।’

গাবতলী স্থায়ী হাটের ম্যানেজার আবদুল হাসেম বলেন, ‘গাবতলী হাটে কোন টাকা নেয়া হয় না। তবে কেউ যদি এমন টাকা নেয়ার অভিযোগ নিয়ে আমাদের কাছে আসে তবে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখনই মাইকিং করে দিচ্ছি কোন ব্যাপারির কোন সমস্যা, বা অসুবিধা থাকে তবে তারা যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।’

ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের অঞ্চল-৪ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবেদ আলী সংবাদকে বলেন, ‘ইজারাদারদের নেয়ার কোন সুযোগ নাই। যদি এটা লঙ্ঘন করে আমাদের সম্পতি বিভাগ থেকে ইজারা দেয়া ইজারাদার যদি ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করে তারা বাতিল করতে পারবে।’ কেউ যদি এমন করে বা নিচ্ছে (টাকা) তাদের কথা সেখানকার পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও র‌্যাবকে জানানোর কথাও বলেন তিনি।

উত্তর সিটি কপোরেশনের প্রধান সম্পতি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মোহাম্মদ মাহে আলমকে বারবার টেলিফোন করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

ছোট আর মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি

ঢাকার দুই সিটিতে বসেছে ২০টি হাট। ক্রেতা- বেপারির সমাগমে জমেছে হাটগুলো। তবে গরুর দাম গেলবারের চেয়ে এবার বেশি। গরুর পাশাপাশি বিভিন্ন জাত আর আকারের ছাগলও উঠেছে হাটে। তবে এই পশুটির দামও এবার তুলনামূলক বেশি। পশুর হাট ঘুরে ক্রেতাদের সঙোহ কথা বলে জানা গেছে, লাখ টাকার নিচে ভালো মানের একটি কোরবানির পশু মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা।

গাবতলী হাটে আসা গরু বিক্রেতা এরফান আলী বলেন, ‘এবার বেঁচা-বিক্রি কমে গেছে। হাটে আসার পর মাত্র দুইটা গরু বিক্রি হয়েছে। ক্রেতাদের তেমন সাড়া মিলছে না। বেশিরভাগ ক্রেতা আসলে ৭০-৮০ হাজার টাকার মধ্যে ভালো গরু চাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। খরচ বেড়ে যাওয়ায় এক লাখের নিচে ভালো গরু বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।’ পশুর লাখ টাকা দামের ফলে তা অনেকেরই ক্রয়সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে দাবি ক্রেতাদের। রাকিবুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা জানান, ছোট সাইজের একটা গরু দেখলাম, দাম চাচ্ছে ৭৫ হাজার টাকা। অথচ কয়েক বছর আগেও এই আকারের গরু ৪০ হাজার টাকাতেই পাওয়া যেত।’

এছাড়া পুরো রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে বসেছে অবৈধ গরুর হাট। সড়ক ও ফুটপাত দখল করে মিরপুর ৬ নম্বর (বি-ব্লক মসজিদ সংলগ্ন) অবৈধ গরুর হাটটি স্থানীয় প্রভাবশালীরা বসিয়েছেন বলে জানা গেছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য, এ বছর কোরবানির হাটের জন্য গবাদিপশু সরবরাহের সংখ্যা গতবারের চেয়ে দুই লাখের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এ বছর গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য পশু প্রস্তুত রয়েছে। গত বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে কোরবানি হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু।

হাট সংলগ্ন এলাকায় রাত ৮টা পর্যন্ত ব্যাংক চালুর ঘোষণা

রাজধানীর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পশুর হাট সংলগ্ন ব্যাংকের শাখাগুলোতে গতকাল সান্ধ্যকালীন লেনদেন চলে রাত ৮টা পর্যন্ত। পাশাপাশি এসব এলাকায় আজ শুক্রবার ও আগামীকাল শনিবার ছুটির দিনে বিশেষ ব্যবস্থায় খোলা থাকবে ব্যাংক। ব্যাংকিং কার্যক্রম চলবে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। কোরবানির পশু ব্যবসায়ীদের ব্যাংকিং লেনদেনের সুবিধার্থে এই নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি’ বিভাগের জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, আসন্ন ঈদুল আজহার আগে ৭ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সান্ধ্য ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। এর পরের দুদিন ৮ ও ৯ জুলাই (শুক্র ও শনিবার) কোরবানির হাটের নিকটবর্তী ব্যাংক শাখা খোলা থাকবে। এসব শাখায় সকাল ১০টা হতে রাত ৮টা পর্যন্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করতে বলা হয়েছে।

পশুর শরীরে মোটাতাজার ওষুধ প্রয়োগ হয়েছে কি না জানতে হাটে র‌্যাব

ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বসেছে হাট। এসব হাটে ওঠা পশু মোটাতাজাকরণের উদ্দেশে কোন ওষুধ প্রয়োগ হয়েছে কি না জানতে অভিযান পরিচালনা করছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। কোরবানির ঈদের আমেজ শুরু হয় গরু-ছাগলের বিশাল হাট স্থাপনের মাধ্যমে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় হাট গাবতলীতে। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খামারি বা গেরস্তরা নিজ বাড়ির লালিত পশু নিয়ে এ হাটে আসেন। অনেক সময় বেশি অর্থ আয়ের লক্ষ্যে কম বয়সী বা স্বাস্থ্যের গরুর শরীরে মোটাতাজাকরণের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এবার এমন কোন ঘটনা ঘটুক, চায় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গতকাল সকাল থেকে গাবতলী পশুর হাটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে র‌্যাব। এ হাটে গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ী হাটে আনা গরুর শরীরে মোটাতাজাকরণ বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করেন। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট পশু ডাক্তারসহ অভিযান পরিচালনা করছেন। তারা দেখছেন কেউ মোটাতাজাকরণ ওষুধ প্রয়োগ করেছে কি না।’

কোন ধরনের চাঁদাবাজি বরদাস্ত করা হবে না বলে এ সময় কঠোর হুঁশিয়ারি দেন র‌্যাবের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। গাবতলী পশুর এ হাটে গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি আরও বলেন, আমরা সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ করছি। করনোভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ প্রতিরোধে আমরা সবার মধ্যে মাস্ক বিতরণ করছি। র‌্যাবের সব ইউনিট স্বর্বাত্মকভাবে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছে বলেও উল্লেখ করেন খন্দকার আল মঈন।