বছর পেরিয়ে গেলেও ভয়াল সেই মুহূর্তের কথা এখনও ভুলতে পারেননি মধ্যবয়সী সিদ্দিক। প্রায় রাতেই সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। প্রাণে বাঁচতে সেদিন কাঁচের জানালা ভেঙে দুইতলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আগুনে দগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা পেলেও এত উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে কোমরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল তার। সাড়ে তিন মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন হাসপাতালে। সিদ্দিক কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড কারখানায়। সজীব গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এই প্রতিষ্ঠানটিতে গত বছরের ৮ জুলাই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। টানা দুই দিন পর্যন্ত জ্বলে এই আগুন। এই ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৪ জন। চতুর্থ তলার একটি কক্ষ থেকেই দগ্ধ ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষের গাফিলতির অভিযোগে হত্যা মামলা হলেও তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। একই ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে ৫১টি মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। সেগুলোও শুনানি পর্যায়ে রয়েছে।
পুলিশের হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, তাদের তদন্তকাজ শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই তারা অভিযোগপত্র দাখিল করবেন। এদিকে এই ঘটনায় কারখানার মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ হাসেম, তার চার ছেলেসহ আটজন গ্রেপ্তার হলেও তারা সবাই এখন জামিনে মুক্ত। এদিকে ন্যায়বিচার পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান হতাহত পরিবারগুলো।
হাসেম ফুডের ছয়তলা বিশিষ্ট ভবনটির বিভিন্ন তলায় লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট, জুস, নসিলা, নুডুলস, ক্যান্ডিসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হতো। নিচতলা ও ষষ্ঠতলায় ছিল খাদ্য প্রস্তুতের কাঁচামালের গুদামঘর (স্টোর রুম)। কাঁচামালের অধিকাংশই তেল, ঘি, রেজিনসহ দাহ্য বস্তু। যদিও পুরো ভবনটিই গুদাম হিসেবে ব্যবহারের কথা ছিল। ভবনের মূল গেটে বড় করে ‘সেন্ট্রাল স্টোর’ লেখা ছিল। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের কার্যক্রম চলত।
দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। স্বাভাবিক দিনের মতোই কার্যক্রম চলছিল কারখানাটিতে। দ্বিতীয় শিফটের কর্মীরা তখন সবেমাত্র কাজ শুরু করেছেন। প্রতি শিফটে দুই শতাধিক কর্মী ওই ভবনে কাজ করতেন। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে নিচতলায় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। কারখানায় বিপুল দাহ্যবস্তু থাকার কারণে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ৩৪ হাজার বর্গফুটের বিশাল আয়তনের এই ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও বহির্গমন পথ ছিল না। তদন্তে ভবন নির্মাণে অনিয়মেরও প্রমাণ পেয়েছিল প্রশাসন। এই কারণে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘ভবনটির নিচতলায় সেন্ট্রাল কমপ্রেসার সেন্টারের পাশে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে এবং প্রতি ফ্লোরে প্রচুর পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত আগুনটি ছড়িয়ে গেছে। এছাড়া ভবন মালিক সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যে নিয়মকানুন, আইন ও বিধিবিধান আছে সেগুলো প্রতিপালন করেননি। যার ফলে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
এখনও কাঁদেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ৫৪ জনের পরিবারের লোকজন। অসুস্থ খেতমজুর পিতার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা ছেড়ে রূপগঞ্জে হাসেম ফুডে চাকরি নেয় ১২ বছর বয়সী ছেলে হাসনাইন। অগ্নিকান্ডে প্রাণ যায় তার। ছেলের কথা মনে পড়লে এখনও হাউমাউ করে কাঁদেন নাজমা বেগম। তখন তাকে কেউ সামলাতে পারেন না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নিঃস্বপ্রায় খেতমজুর ফজলুর রহমান। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘পোলাডারে শেষ মুহূর্তে চোখের দেখাও দেখতে পারি নাই কেউ। বস্তাবন্দী অবস্থায় তার শরীরের কিছু অংশ আমাগোরে দেয়। ওইভাবেই কবর দেই।’
আহত সিদ্দিক বলেন, ‘ওইদিনের স্মৃতি মনে পড়লেই চোখ দিয়ে পানি আসে আমার। আর মাত্র ৩০ সেকেন্ড ভেতর থাকলে আমি শেষ হইয়া যাইতাম। লাফাইয়া পইড়া বাঁচছি। আমার মনে হইতেছিল না যে আমি বাঁইচা আছি।’
এই ঘটনার বিচার চান হতাহতের স্বজনরা। তবে ন্যায়বিচার পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান তারা। ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। বিচার কার কাছে চামু? গরিবের বিচার এই দেশে নাই।’
এদিকে নিহতের পরিবারকে প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল কারখানা কর্তৃপক্ষ। তবে ওই ক্ষতিপূরণ গ্রহণের সময় স্বজনদের পক্ষ থেকে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়া হয় বলে জানান ফজলুর। তিনি বলেন, ‘ঢাকার ফার্মগেটে ডাইকা আমাগো ২ লাখ টাকা দিছিল। ওই টাকা নেয়ার সময় ১২০ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিছিল। আমি পড়তে জানি না। ওইখানে কী লেখছে তা বলতে পারি না।’
ন্যায়বিচার নিয়ে সন্দিহান নিহত কিশোরী মাহমুদার (১৫) ভাই সুমনও। তিনি বলেন, পাশের ভবনে আইসবার সেকশনে কাজ করত তার ছোট বোন মাহমুদা। ঘটনার দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য ওই ভবনে কাজের দায়িত্বে ছিল।
‘কপালে মরণ লেখা থাকলে তা আর খন্ডায় কে? আগের বছর বাবা মারা যায়। এরপর ছোট বোন। বাড়িতে একমাত্র পুরুষ মানুষ আমি। সবাই কানছে, আমি কানতেও পারি নাই। বিচার তো চাই, কিন্তু বিচারটা করবো কেডা?’
ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে কারখানার মালিকসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছিল। ওই মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তারা। পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন তারা। মামলাটির সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি নারায়ণগঞ্জের বিশেষ পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদোন্নতিপ্রাপ্ত) দেলোয়ার হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন, ডিএনএ প্রতিবেদনসহ খুটিনাটি বিষয় আমরা খতিয়ে দেখেছি। তদন্তের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। কোথাও কোন কিছু ছুটে গেল কি না তা নিয়ে যাচাই-বাছাই করছি। আমরা যেকোন সময় অভিযোগপত্র দাখিল করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মামলাটি নিষ্পত্তি করতে পারব বলে মনে করছি। যারাই এই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হবে তারা শাস্তি পাবে বলেই আশা করছি।’
এদিকে জেলা আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান সংবাদকে জানান, গ্রেপ্তার ৮ আসামিই জামিনে আছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিল প্রশাসন। তবে ওই ভবন ছাড়া হাসেম ফুডের অন্যান্য ভবনে কার্যক্রম চলছে। যদিও কারখানাটিতে এখনও পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা নেই। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বলছে, ট্রেড লাইসেন্সসহ ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ অফিসের লাইসেন্স তাদের নেই। এমনকি কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের লাইসেন্স নবায়নের জন্যও তারা আবেদন করেনি।
এসব কারণে কারখানার কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে বলে জানান উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়–য়া। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে মেশিনারিজ নষ্ট হয়ে যায় বলে একটি আবেদন তারা করেছিল। সে অনুযায়ী ট্রায়াল পর্যায়ে মেশিন চালু রাখার জন্য কার্যক্রম তারা চালাচ্ছে।’
তিনি জানান, কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে তারা ৫১টি মামলা করেছিলেন। এর মধ্যে ৪৯টি মামলা নিহতদের ক্ষতিপূরণ দাবিতে। মামলাগুলো শুনানি পর্যায়ে রয়েছে। গত বুধবারও একটি মামলার শুনানি ছিল। ওইদিন কাগজপত্র দাখিলের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষ সময়ের আবেদন করেন।
এ নিয়ে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড কারখানা কর্তৃপক্ষ কথা বলতে রাজি হননি। তবে কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মামুনুর রশিদের দাবি তারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক তানহারুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিকমতো থাকলে আগুনে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো না। ঘটনার পর আমরা বারবার তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য তাগিদ দিয়েছি। কারখানার ভেতর ফায়ার সেফটি নিয়ে তারা কাজ করছে। তবে পুরোপুরি ফায়ার সেফটি এখনও তারা স্থাপন করেনি। যদিও কারখানার ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ছাড়া অন্যান্য সব ভবনেই কার্যক্রম তারা চালাচ্ছেন।’
‘কোন কারখানায় যদি অন্তত হাইড্রেন্ট স্থাপন করা থাকে তাহলেও বড় দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। কিন্তু কারখানাগুলো তা করে না। আমরা বারবার তাদের তাগিদ দেই কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করেন না। বিশেষ করে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা তাদের ইনভেস্ট কিন্তু ফায়ার সেফটি তারা ঠিকমতো রাখেন না বলেই বড় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। মেঘনা শিল্পাঞ্চলে কয়েকদিন আগে বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ভালো থাকায় আগুন নেভানো সহজ হয়েছে। হতাহতের ঘটনা সেখানে ঘটেনি।’
এক বছর আগে দুর্ঘটনা ও স্বজন হারানোদের আহাজারি -ফাইল ছবি
আরও খবরশুক্রবার, ০৮ জুলাই ২০২২ , ২৪ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলহজ ১৪৪৩
সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ
এক বছর আগে দুর্ঘটনা ও স্বজন হারানোদের আহাজারি -ফাইল ছবি
বছর পেরিয়ে গেলেও ভয়াল সেই মুহূর্তের কথা এখনও ভুলতে পারেননি মধ্যবয়সী সিদ্দিক। প্রায় রাতেই সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। প্রাণে বাঁচতে সেদিন কাঁচের জানালা ভেঙে দুইতলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আগুনে দগ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা পেলেও এত উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে কোমরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল তার। সাড়ে তিন মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন হাসপাতালে। সিদ্দিক কাজ করতেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড কারখানায়। সজীব গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এই প্রতিষ্ঠানটিতে গত বছরের ৮ জুলাই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। টানা দুই দিন পর্যন্ত জ্বলে এই আগুন। এই ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৪ জন। চতুর্থ তলার একটি কক্ষ থেকেই দগ্ধ ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষের গাফিলতির অভিযোগে হত্যা মামলা হলেও তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। একই ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে ৫১টি মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। সেগুলোও শুনানি পর্যায়ে রয়েছে।
পুলিশের হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, তাদের তদন্তকাজ শেষ পর্যায়ে। শীঘ্রই তারা অভিযোগপত্র দাখিল করবেন। এদিকে এই ঘটনায় কারখানার মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ হাসেম, তার চার ছেলেসহ আটজন গ্রেপ্তার হলেও তারা সবাই এখন জামিনে মুক্ত। এদিকে ন্যায়বিচার পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান হতাহত পরিবারগুলো।
হাসেম ফুডের ছয়তলা বিশিষ্ট ভবনটির বিভিন্ন তলায় লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট, জুস, নসিলা, নুডুলস, ক্যান্ডিসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হতো। নিচতলা ও ষষ্ঠতলায় ছিল খাদ্য প্রস্তুতের কাঁচামালের গুদামঘর (স্টোর রুম)। কাঁচামালের অধিকাংশই তেল, ঘি, রেজিনসহ দাহ্য বস্তু। যদিও পুরো ভবনটিই গুদাম হিসেবে ব্যবহারের কথা ছিল। ভবনের মূল গেটে বড় করে ‘সেন্ট্রাল স্টোর’ লেখা ছিল। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের কার্যক্রম চলত।
দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। স্বাভাবিক দিনের মতোই কার্যক্রম চলছিল কারখানাটিতে। দ্বিতীয় শিফটের কর্মীরা তখন সবেমাত্র কাজ শুরু করেছেন। প্রতি শিফটে দুই শতাধিক কর্মী ওই ভবনে কাজ করতেন। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে নিচতলায় বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। কারখানায় বিপুল দাহ্যবস্তু থাকার কারণে মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ৩৪ হাজার বর্গফুটের বিশাল আয়তনের এই ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও বহির্গমন পথ ছিল না। তদন্তে ভবন নির্মাণে অনিয়মেরও প্রমাণ পেয়েছিল প্রশাসন। এই কারণে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘ভবনটির নিচতলায় সেন্ট্রাল কমপ্রেসার সেন্টারের পাশে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে এবং প্রতি ফ্লোরে প্রচুর পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত আগুনটি ছড়িয়ে গেছে। এছাড়া ভবন মালিক সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যে নিয়মকানুন, আইন ও বিধিবিধান আছে সেগুলো প্রতিপালন করেননি। যার ফলে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
এখনও কাঁদেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো ৫৪ জনের পরিবারের লোকজন। অসুস্থ খেতমজুর পিতার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা ছেড়ে রূপগঞ্জে হাসেম ফুডে চাকরি নেয় ১২ বছর বয়সী ছেলে হাসনাইন। অগ্নিকান্ডে প্রাণ যায় তার। ছেলের কথা মনে পড়লে এখনও হাউমাউ করে কাঁদেন নাজমা বেগম। তখন তাকে কেউ সামলাতে পারেন না। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে নিঃস্বপ্রায় খেতমজুর ফজলুর রহমান। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘পোলাডারে শেষ মুহূর্তে চোখের দেখাও দেখতে পারি নাই কেউ। বস্তাবন্দী অবস্থায় তার শরীরের কিছু অংশ আমাগোরে দেয়। ওইভাবেই কবর দেই।’
আহত সিদ্দিক বলেন, ‘ওইদিনের স্মৃতি মনে পড়লেই চোখ দিয়ে পানি আসে আমার। আর মাত্র ৩০ সেকেন্ড ভেতর থাকলে আমি শেষ হইয়া যাইতাম। লাফাইয়া পইড়া বাঁচছি। আমার মনে হইতেছিল না যে আমি বাঁইচা আছি।’
এই ঘটনার বিচার চান হতাহতের স্বজনরা। তবে ন্যায়বিচার পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দিহান তারা। ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। বিচার কার কাছে চামু? গরিবের বিচার এই দেশে নাই।’
এদিকে নিহতের পরিবারকে প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল কারখানা কর্তৃপক্ষ। তবে ওই ক্ষতিপূরণ গ্রহণের সময় স্বজনদের পক্ষ থেকে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়া হয় বলে জানান ফজলুর। তিনি বলেন, ‘ঢাকার ফার্মগেটে ডাইকা আমাগো ২ লাখ টাকা দিছিল। ওই টাকা নেয়ার সময় ১২০ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিছিল। আমি পড়তে জানি না। ওইখানে কী লেখছে তা বলতে পারি না।’
ন্যায়বিচার নিয়ে সন্দিহান নিহত কিশোরী মাহমুদার (১৫) ভাই সুমনও। তিনি বলেন, পাশের ভবনে আইসবার সেকশনে কাজ করত তার ছোট বোন মাহমুদা। ঘটনার দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য ওই ভবনে কাজের দায়িত্বে ছিল।
‘কপালে মরণ লেখা থাকলে তা আর খন্ডায় কে? আগের বছর বাবা মারা যায়। এরপর ছোট বোন। বাড়িতে একমাত্র পুরুষ মানুষ আমি। সবাই কানছে, আমি কানতেও পারি নাই। বিচার তো চাই, কিন্তু বিচারটা করবো কেডা?’
ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে কারখানার মালিকসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছিল। ওই মামলায় গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন তারা। পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন তারা। মামলাটির সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি নারায়ণগঞ্জের বিশেষ পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদোন্নতিপ্রাপ্ত) দেলোয়ার হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন, ডিএনএ প্রতিবেদনসহ খুটিনাটি বিষয় আমরা খতিয়ে দেখেছি। তদন্তের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। কোথাও কোন কিছু ছুটে গেল কি না তা নিয়ে যাচাই-বাছাই করছি। আমরা যেকোন সময় অভিযোগপত্র দাখিল করে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মামলাটি নিষ্পত্তি করতে পারব বলে মনে করছি। যারাই এই ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হবে তারা শাস্তি পাবে বলেই আশা করছি।’
এদিকে জেলা আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান সংবাদকে জানান, গ্রেপ্তার ৮ আসামিই জামিনে আছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিল প্রশাসন। তবে ওই ভবন ছাড়া হাসেম ফুডের অন্যান্য ভবনে কার্যক্রম চলছে। যদিও কারখানাটিতে এখনও পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা নেই। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বলছে, ট্রেড লাইসেন্সসহ ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ অফিসের লাইসেন্স তাদের নেই। এমনকি কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের লাইসেন্স নবায়নের জন্যও তারা আবেদন করেনি।
এসব কারণে কারখানার কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে বলে জানান উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়–য়া। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে মেশিনারিজ নষ্ট হয়ে যায় বলে একটি আবেদন তারা করেছিল। সে অনুযায়ী ট্রায়াল পর্যায়ে মেশিন চালু রাখার জন্য কার্যক্রম তারা চালাচ্ছে।’
তিনি জানান, কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে তারা ৫১টি মামলা করেছিলেন। এর মধ্যে ৪৯টি মামলা নিহতদের ক্ষতিপূরণ দাবিতে। মামলাগুলো শুনানি পর্যায়ে রয়েছে। গত বুধবারও একটি মামলার শুনানি ছিল। ওইদিন কাগজপত্র দাখিলের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষ সময়ের আবেদন করেন।
এ নিয়ে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড কারখানা কর্তৃপক্ষ কথা বলতে রাজি হননি। তবে কারখানার সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মামুনুর রশিদের দাবি তারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক তানহারুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিকমতো থাকলে আগুনে এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো না। ঘটনার পর আমরা বারবার তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য তাগিদ দিয়েছি। কারখানার ভেতর ফায়ার সেফটি নিয়ে তারা কাজ করছে। তবে পুরোপুরি ফায়ার সেফটি এখনও তারা স্থাপন করেনি। যদিও কারখানার ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ছাড়া অন্যান্য সব ভবনেই কার্যক্রম তারা চালাচ্ছেন।’
‘কোন কারখানায় যদি অন্তত হাইড্রেন্ট স্থাপন করা থাকে তাহলেও বড় দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। কিন্তু কারখানাগুলো তা করে না। আমরা বারবার তাদের তাগিদ দেই কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করেন না। বিশেষ করে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা তাদের ইনভেস্ট কিন্তু ফায়ার সেফটি তারা ঠিকমতো রাখেন না বলেই বড় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। মেঘনা শিল্পাঞ্চলে কয়েকদিন আগে বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ভালো থাকায় আগুন নেভানো সহজ হয়েছে। হতাহতের ঘটনা সেখানে ঘটেনি।’