শিক্ষা খাত এত ধাক্কা সইবে কেমনে?

মাছুম বিল্লাহ

করোনার ধাক্কায় শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটি সামাল দিতে না দিতেই অবার এলো বন্যা। তছনছ করে দিয়েছে দেশের অনেক অঞ্চল। অভাবনীয়রূপে দেখা দিয়েছে এবার বন্য। গত করোনার কারণে ৫৭১ দিন বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময়ে লেখাপড়া হয়নি বললেই চলে। গত কয়েক মাস ধরে পুরোদমে চলছিল শ্রেণী কার্যক্রম। সে অনুযায়ী স্কুল ও মাদ্রাসায় অর্ধবার্ষিক আর প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নির্ধারিত ছিল। ঘোষাণা ছিল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা আয়োজনের। কিন্তু দেশের দুই অঞ্চলে চলমান বন্যা ফের ধাক্কা দিয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে বন্ধ আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এভাবে একটির পর একটি ধাক্কা খাচ্ছে।

আগামী এক মাসের মধ্যে এই পরীক্ষা শুরুর কোন সম্ভাবনা নেই। আগস্টে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। এটিও অক্টোবরের আগে নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে না। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১৫ জেলা বন্যাকবলিত। এগুলোর সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে মধ্যাঞ্চলের আরও তিনটি জেলা। এগুলোর মধ্যে আবার সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা চলে গেছে পানির নিচে ছিল। বাকি জেলাগুলোর অবশ্য বন্যাকবলিত নয়। জানা গেছে, এ কারণে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলায় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ডুবে যায়নি এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আবার আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পর্যন্ত জানা গেছে যে, ১৩৫১টি বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

বন্যাকবলিত জেলাগুলোর মধ্যে অন্তত ১৩৪ উপজেলার স্কুল এখনও বন্ধ আছে। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ফেনীর ফুলাগাজী আর মানিকগঞ্জের দৌলতপুর। এসব উপজেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী জুনের মধ্যেই আক্রান্ত জেলা-উপজেলার প্রায় সব বন্যামুক্ত হতে পারে। হ্যাঁ, এসব বন্যা কবলিত এলাকাগুলোর পানি নেমে গেছে; কিন্তু পানি নেমে গেলেই লেখপাড়া শুরু করা যাবে না দুই কারণে। প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংস্কার বা নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ঈদুল আজহার ছুটি শুরু গেছে; যা চলবে ১৯ জুলাই পর্যন্ত। সেই হিসেবে বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষার্থীরা অবারও এক মাসের বেশি লেখাপড়া থেকে দূরে থাকছে।

একই বাস্তবতায় এবারের এসএসসি ও সমামানের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। ১৯ জুন পরীক্ষা শুরুর লক্ষ্যে সারা দেশে খাতা ও প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বন্যা তা শুরু করতে দেয়নি। আগামী ২২ আগস্ট এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর সূচি ছিল তাও শুরু করা যাবে কিনা সন্দেহ। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানায় যে, নতুন করে কোন বৈরী পরিস্থিতি তৈরি না হলে ঈদের পূর্বে এসএসসি পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশ করা হবে এবং ঈদের পর পরীক্ষা শুরু হবে। পত্রিকায় দেখলাম এসএসসি পরীক্ষা আগস্টে হতে পারে। আমরা এখনও সেই অপেক্ষায় আছি। বন্যাকবলিত কিছু এলাকায় শিক্ষার্থীদের বই-খাতা বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাদের নতুন করে বই দেওয়া প্রয়োজন, সেটি শিক্ষা বিভাগ যাতে খেয়াল রাখে সেই অনুরোধ করছি।

সিলেট বিভাগের এবং দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অনেক জেলাসহ মোট ১২টি জেলায় বন্যায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন স্তরের অন্তত এক কোটি শিক্ষার্থীর। দরিদ্র কয়েকশ ছাত্রছাত্রীর বইÑখাতা ভেসে গেছে, ডুবে গেছে তাদের ঘরবাড়ি। প্লাবিত হয়েছে এমনকি পুরোপুরি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে বহু একতলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যাদুর্গত এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থার মাঠপর্যায়ের চিত্র শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত অধিদপ্তর জানাচ্ছেন। তাদের পাঠানো তথ্যমতে, সিলেট অঞ্চলে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও ভাঙ্গনের ক্ষত রেখে যাচেছ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানিয়েছেন সংস্কার করা না হলে এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরু করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। শিক্ষা খাতে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার মধ্যেই এবারের বন্যা ডুবিয়ে দিল শিক্ষা ব্যবস্থাকেও। বন্যা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংস্কারসহ এ খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্টজন। তারা বলছেন, বন্যার সময় ও বন্যা পরবর্তীতে খাদ্য, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও শিক্ষাখাতের ক্ষতি বা বন্যাপরবর্তী করণীয় বিষয়ে সেভাবে কোন আলোচনা বা উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। অথচ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী আর পুরো শিক্ষা খাত।

কয়েক বছর ধরেই ফেব্রুয়ারি মাসে এসএসসি আর এপ্রিল মাসে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হতো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হতো ফলাফল। এ ধারায় বিগত বছরগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রমে একটি নিয়মিত রুটিনও চালু হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা সনাক্ত হওয়ার পর ছেদ পড়ে এই কার্যক্রমে। আর সেই থেকে শিক্ষায় যেন দুর্ভাগ্য এসে হাজির হচ্ছে একটির পর একটি। ২০২২ সালের ১৯ জুন শুরু হওয়ার কথা ছিল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। চলতি বছর ২০ লাখ ২১ হাজার ৮৬৮ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেওয়ার কথা; যা গতবারের তুলনায় ২ লাখ ২১ হাজার ৩৮৬ জন কম। তাদের মধ্যে ছাত্র ১০ লাখ ৯ হাজার ৫১১ জন এবং ছাত্রী ১০ লাখ ১২ হজার ৩৫৭ জন। মোট ২৯ হাজার ৫৯১টি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করার কথা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়। সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ৬ জুলাই। ২০২২ সালের সংশোধিত ও পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাস অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে এবারের পরীক্ষাও। পরীক্ষার সময় ৩ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ২ ঘণ্টা করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুন অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ ধার্য করা হয়েছিল ২৪ জুন। পরীক্ষার শেষে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের কথা ছিল। সবই ভেস্তে গেল এ বন্যার কারণে।

শিক্ষা বাজেটে এ ধরনের দৈব দুর্বিপাকের কথা চিন্তা করে কিছু বরাদ্দ রাখতে হয় সেটি কিন্তু এবারের বাজেটে আমরা দেখিনি যদিও করোনা বিষয়টি আমাদের শিখিয়ে গেছে যে, যে কোন সময় এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সিলেটসহ দেশের কয়েকটি অঞ্চল বন্যায় তলিয়ে গেছে, তার প্রভাব কিন্তু পড়েছে দেশের সর্বত্র। শিক্ষার্থীরা যে প্লান করে, আশা করে বসেছিল যে, এসএসসি পরীক্ষার পর তারা পরবর্তী শিক্ষাস্তরে যাবে সেটি মারাত্মকভাবে ধাক্কা খেল। তাদের মন ভেঙ্গে গেছে। এত ধাক্কা কি শিক্ষা খাত সইতে পারে? করোনার চতুর্থ ধাক্কার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু নদীর পানি ইতোমধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। হয়তো নতুন করে বন্য আবারও হতে পারে। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় বলা যায় না। কি হবে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের যারা শিক্ষার একটি স্তর অতিক্রম করতে চাচ্ছে কিন্তু দৈব-দুর্বিপাক যেন অতিক্রম করতেই দিচ্ছে না।

শুধু কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ? মানবসৃষ্ট দুর্যোগও যেন পিছু ছাড়ছে না শিক্ষার। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে প্রতি বছর শতকরা দশজনেরও বেশি শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। শিক্ষকদের প্রায়শই এমন পরিবেশে কাজ করতে হয়; যা দুঃসাহসী ব্যক্তিকেও ভগ্নোৎসহ করে ফেলতে পারে এবং সেই পেশা শিক্ষককে ফলপ্রসূ পারিতোষিকের আশ^াস দেয় না। এদেশে স্কুল ও কলেজ চালানোর স্বীকৃতি নিয়ে তিন, পাঁচ বা আঠারো বছর অতিক্রান্ত হলেও এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে শিক্ষকরা ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রেস ক্লাবের সামনে ঈদের দিনও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন, কিন্তু সুরাহা হয়নি। বরং এমপিওভুক্তির নতুন নতুন আইনের বেড়াজালে তাদের আবদ্ধ করা হয়েছে।

কাজ অবশ্য ধীরে ধীরে এগোচ্ছে কিন্তু শিক্ষা এমনই একটি খাত যে, এর ক্ষতির পরিমাণ চোখে হয়তো দেখা যায় না কিন্তু এর ক্ষতি একটি জাতিকে বহন করতে হয় দীর্ঘদিন। ইতোমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে তাই সমাজ এখন সামাল দিতে পারছে না কোনভাবে। অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়েছে যে, শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে হত্যা করতে পারে। শিক্ষার যে অবস্থা একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানকে রাজনৈতিক কারণে ধর্মের নাম দিয়ে মহোৎসাহে গলায় জুতার মালা পরিয়ে শত শত দর্শকের আনন্দের খোরাক জোগাতে পারে, সেটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? শিক্ষার ওপর এত অমানবিকতা কেন?

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]

শুক্রবার, ০৮ জুলাই ২০২২ , ২৪ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলহজ ১৪৪৩

শিক্ষা খাত এত ধাক্কা সইবে কেমনে?

মাছুম বিল্লাহ

করোনার ধাক্কায় শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটি সামাল দিতে না দিতেই অবার এলো বন্যা। তছনছ করে দিয়েছে দেশের অনেক অঞ্চল। অভাবনীয়রূপে দেখা দিয়েছে এবার বন্য। গত করোনার কারণে ৫৭১ দিন বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময়ে লেখাপড়া হয়নি বললেই চলে। গত কয়েক মাস ধরে পুরোদমে চলছিল শ্রেণী কার্যক্রম। সে অনুযায়ী স্কুল ও মাদ্রাসায় অর্ধবার্ষিক আর প্রথম সাময়িক পরীক্ষা নির্ধারিত ছিল। ঘোষাণা ছিল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা আয়োজনের। কিন্তু দেশের দুই অঞ্চলে চলমান বন্যা ফের ধাক্কা দিয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে বন্ধ আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এভাবে একটির পর একটি ধাক্কা খাচ্ছে।

আগামী এক মাসের মধ্যে এই পরীক্ষা শুরুর কোন সম্ভাবনা নেই। আগস্টে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়ার কথা ছিল। এটিও অক্টোবরের আগে নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে না। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১৫ জেলা বন্যাকবলিত। এগুলোর সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে মধ্যাঞ্চলের আরও তিনটি জেলা। এগুলোর মধ্যে আবার সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা চলে গেছে পানির নিচে ছিল। বাকি জেলাগুলোর অবশ্য বন্যাকবলিত নয়। জানা গেছে, এ কারণে সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলায় কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ডুবে যায়নি এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আবার আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ পর্যন্ত জানা গেছে যে, ১৩৫১টি বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

বন্যাকবলিত জেলাগুলোর মধ্যে অন্তত ১৩৪ উপজেলার স্কুল এখনও বন্ধ আছে। এ তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ফেনীর ফুলাগাজী আর মানিকগঞ্জের দৌলতপুর। এসব উপজেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস অনুযায়ী জুনের মধ্যেই আক্রান্ত জেলা-উপজেলার প্রায় সব বন্যামুক্ত হতে পারে। হ্যাঁ, এসব বন্যা কবলিত এলাকাগুলোর পানি নেমে গেছে; কিন্তু পানি নেমে গেলেই লেখপাড়া শুরু করা যাবে না দুই কারণে। প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংস্কার বা নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ঈদুল আজহার ছুটি শুরু গেছে; যা চলবে ১৯ জুলাই পর্যন্ত। সেই হিসেবে বন্যাকবলিত এলাকার শিক্ষার্থীরা অবারও এক মাসের বেশি লেখাপড়া থেকে দূরে থাকছে।

একই বাস্তবতায় এবারের এসএসসি ও সমামানের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। ১৯ জুন পরীক্ষা শুরুর লক্ষ্যে সারা দেশে খাতা ও প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বন্যা তা শুরু করতে দেয়নি। আগামী ২২ আগস্ট এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর সূচি ছিল তাও শুরু করা যাবে কিনা সন্দেহ। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানায় যে, নতুন করে কোন বৈরী পরিস্থিতি তৈরি না হলে ঈদের পূর্বে এসএসসি পরীক্ষার সময়সূচি প্রকাশ করা হবে এবং ঈদের পর পরীক্ষা শুরু হবে। পত্রিকায় দেখলাম এসএসসি পরীক্ষা আগস্টে হতে পারে। আমরা এখনও সেই অপেক্ষায় আছি। বন্যাকবলিত কিছু এলাকায় শিক্ষার্থীদের বই-খাতা বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাদের নতুন করে বই দেওয়া প্রয়োজন, সেটি শিক্ষা বিভাগ যাতে খেয়াল রাখে সেই অনুরোধ করছি।

সিলেট বিভাগের এবং দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অনেক জেলাসহ মোট ১২টি জেলায় বন্যায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন স্তরের অন্তত এক কোটি শিক্ষার্থীর। দরিদ্র কয়েকশ ছাত্রছাত্রীর বইÑখাতা ভেসে গেছে, ডুবে গেছে তাদের ঘরবাড়ি। প্লাবিত হয়েছে এমনকি পুরোপুরি পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে বহু একতলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যাদুর্গত এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থার মাঠপর্যায়ের চিত্র শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত অধিদপ্তর জানাচ্ছেন। তাদের পাঠানো তথ্যমতে, সিলেট অঞ্চলে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও ভাঙ্গনের ক্ষত রেখে যাচেছ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানিয়েছেন সংস্কার করা না হলে এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরু করা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। শিক্ষা খাতে করোনার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার মধ্যেই এবারের বন্যা ডুবিয়ে দিল শিক্ষা ব্যবস্থাকেও। বন্যা পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংস্কারসহ এ খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্টজন। তারা বলছেন, বন্যার সময় ও বন্যা পরবর্তীতে খাদ্য, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও শিক্ষাখাতের ক্ষতি বা বন্যাপরবর্তী করণীয় বিষয়ে সেভাবে কোন আলোচনা বা উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। অথচ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী আর পুরো শিক্ষা খাত।

কয়েক বছর ধরেই ফেব্রুয়ারি মাসে এসএসসি আর এপ্রিল মাসে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হতো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হতো ফলাফল। এ ধারায় বিগত বছরগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রমে একটি নিয়মিত রুটিনও চালু হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা সনাক্ত হওয়ার পর ছেদ পড়ে এই কার্যক্রমে। আর সেই থেকে শিক্ষায় যেন দুর্ভাগ্য এসে হাজির হচ্ছে একটির পর একটি। ২০২২ সালের ১৯ জুন শুরু হওয়ার কথা ছিল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। চলতি বছর ২০ লাখ ২১ হাজার ৮৬৮ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেওয়ার কথা; যা গতবারের তুলনায় ২ লাখ ২১ হাজার ৩৮৬ জন কম। তাদের মধ্যে ছাত্র ১০ লাখ ৯ হাজার ৫১১ জন এবং ছাত্রী ১০ লাখ ১২ হজার ৩৫৭ জন। মোট ২৯ হাজার ৫৯১টি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করার কথা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়। সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ৬ জুলাই। ২০২২ সালের সংশোধিত ও পুনর্বিন্যাসকৃত সিলেবাস অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে এবারের পরীক্ষাও। পরীক্ষার সময় ৩ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ২ ঘণ্টা করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে ২৫ জুন অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ ধার্য করা হয়েছিল ২৪ জুন। পরীক্ষার শেষে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশের কথা ছিল। সবই ভেস্তে গেল এ বন্যার কারণে।

শিক্ষা বাজেটে এ ধরনের দৈব দুর্বিপাকের কথা চিন্তা করে কিছু বরাদ্দ রাখতে হয় সেটি কিন্তু এবারের বাজেটে আমরা দেখিনি যদিও করোনা বিষয়টি আমাদের শিখিয়ে গেছে যে, যে কোন সময় এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সিলেটসহ দেশের কয়েকটি অঞ্চল বন্যায় তলিয়ে গেছে, তার প্রভাব কিন্তু পড়েছে দেশের সর্বত্র। শিক্ষার্থীরা যে প্লান করে, আশা করে বসেছিল যে, এসএসসি পরীক্ষার পর তারা পরবর্তী শিক্ষাস্তরে যাবে সেটি মারাত্মকভাবে ধাক্কা খেল। তাদের মন ভেঙ্গে গেছে। এত ধাক্কা কি শিক্ষা খাত সইতে পারে? করোনার চতুর্থ ধাক্কার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু নদীর পানি ইতোমধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। হয়তো নতুন করে বন্য আবারও হতে পারে। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় বলা যায় না। কি হবে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের যারা শিক্ষার একটি স্তর অতিক্রম করতে চাচ্ছে কিন্তু দৈব-দুর্বিপাক যেন অতিক্রম করতেই দিচ্ছে না।

শুধু কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ? মানবসৃষ্ট দুর্যোগও যেন পিছু ছাড়ছে না শিক্ষার। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে প্রতি বছর শতকরা দশজনেরও বেশি শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। শিক্ষকদের প্রায়শই এমন পরিবেশে কাজ করতে হয়; যা দুঃসাহসী ব্যক্তিকেও ভগ্নোৎসহ করে ফেলতে পারে এবং সেই পেশা শিক্ষককে ফলপ্রসূ পারিতোষিকের আশ^াস দেয় না। এদেশে স্কুল ও কলেজ চালানোর স্বীকৃতি নিয়ে তিন, পাঁচ বা আঠারো বছর অতিক্রান্ত হলেও এমপিওভুক্ত না হওয়ার কারণে শিক্ষকরা ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রেস ক্লাবের সামনে ঈদের দিনও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন, কিন্তু সুরাহা হয়নি। বরং এমপিওভুক্তির নতুন নতুন আইনের বেড়াজালে তাদের আবদ্ধ করা হয়েছে।

কাজ অবশ্য ধীরে ধীরে এগোচ্ছে কিন্তু শিক্ষা এমনই একটি খাত যে, এর ক্ষতির পরিমাণ চোখে হয়তো দেখা যায় না কিন্তু এর ক্ষতি একটি জাতিকে বহন করতে হয় দীর্ঘদিন। ইতোমধ্যে যে ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে তাই সমাজ এখন সামাল দিতে পারছে না কোনভাবে। অবস্থা কোথায় দাঁড়িয়েছে যে, শিক্ষার্থী একজন শিক্ষককে হত্যা করতে পারে। শিক্ষার যে অবস্থা একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানকে রাজনৈতিক কারণে ধর্মের নাম দিয়ে মহোৎসাহে গলায় জুতার মালা পরিয়ে শত শত দর্শকের আনন্দের খোরাক জোগাতে পারে, সেটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? শিক্ষার ওপর এত অমানবিকতা কেন?

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]