চামড়া শিল্প ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা

ট্যানারি শিল্পে চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। এ চামড়া অন্য সময় সংগৃহীত পশুর চামড়া থেকে উন্নতমানের। প্রতি বছর চামড়ার বার্ষিক চাহিদার সিংহভাগ জোগান আসে কোরবানির পশু থেকে। ফলে এ শিল্পের জন্য উন্নতমানের চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীরাও এ সময় ব্যস্ত থাকেন। কোরবানির সময় যে চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তা দিয়েই সারা বছর ট্যানারি শিল্পের কারখানাগুলো চলে। দীর্ঘদিনে বাংলাদেশে চামড়াশিল্প এগিয়েছে অনেকটা ঢিমেতালে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শিল্পটি কিছুটা গুরুত্ব পেতে থাকে। বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে সরকার প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।

ট্যানারি শিল্পের বার্ষিক চামড়ার মোট চাহিদার ৭০-৮০ ভাগই সংগ্রহ করা হয় কোরবানির পশু থেকে। একই সময়ে বিপুল পরিমাণ চামড়া সরবরাহ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ সময় সব চামড়া নিজেদের নগদ অর্থে কিনতে পারেন না। এ কারণে তারা এসে ধরনা দেন ব্যাংকগুলোতে, বিশেষ করে রাষ্ট্র-মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে। চামড়া কিনতে সাধারণত এক বছর মেয়াদে ঋণ দেওয়া হয়। এ ব্যবসায় জড়িত গ্রাহকরা তা পেয়ে থাকেন। চামড়া খাতে বিতরণ করা ঋণের একটা বড় অংশই বছরের পর বছর খেলাপি হয়ে আছে। এসব কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো চামড়া কেনায় ঋণ দিতে আগ্রহ দেখায় না, যদিও বর্তমানে এ খাতে ঋণ আদায়ের হার আগের তুলনায় ভালো। ব্যাংকগুলো সতর্কতার সঙ্গে ঋণ অনুমোদনের ফলে খেলাপির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কমে আসছে ইদানীং।

অনেক দিন থেকেই নাজুক পরিস্থিতি পার করছে দেশের চামড়া শিল্প। পানির চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে কোরবানিকৃত পশুর কাঁচা চামড়া। কয়েক বছর ধরে নামমাত্র মূল্যে কাঁচা চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। তার পরও এ খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই খেলাপি ঋণের চক্রে আটকা পড়েছেন। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে এখনো কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু না হয়নি।

উল্লেখ্য, পোশাক খাত সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা, রপ্তানিতে নগদ সহায়তা সুবিধা, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকে। যেটা অন্য কোনো খাত পায় না। নানা সংকটের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দেশের চামড়া শিল্প। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া কেনা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন, চামড়া কেনার মতো টাকা তাদের হাতে নেই; আবার ব্যাংক ঋণও মিলছে না।

হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে সরকার ‘রেড জোন’ ঘোষণা করায় মালিকরা সেই জমি না পারছেন বিক্রি করতে, না পারছেন বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নিতে। আবার সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে এখনো প্রস্তুত হয়নি কঠিন বর্জ্য শোধনাগার। পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্প না হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্রও দিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কঠিন সময় পার করছেন ট্যানারি মালিকরা। সাভারে চালু থাকা ১২৩টি ট্যানারির বেশির ভাগই চীনে চামড়া রপ্তানি করে। মহামারীর প্রভাবে চীনে রপ্তানি বন্ধ থাকায় অনেক চামড়া পড়ে আছে। চীনের ক্রেতারা ট্যানারিতে চামড়া পরিদর্শনেও আসেননি। রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেও। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, ৯০ শতাংশ ট্যানারি বন্ধের পথে। চামড়া রপ্তানি না হওয়ায় ট্যানারিগুলো আর্থিক সংকটে পড়ছে। এতে ঋণের সুদ বাড়ছে। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে বেশির ভাগ ট্যানারি খেলাপি হবে। এ সংকট উত্তরণে সরকারের সহায়তা দরকার। উদ্যোক্তরা বলেছেন, পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদনে যাওয়ার আগপর্যন্ত ব্যাংক ঋণে তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হোক। ট্যানারি মালিক ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত, সেসব প্রতিষ্ঠানকে দায়দেনা পরিশোধের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছর সময় দেওয়া যাবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ৫ কোটি টাকার বেশি, তাদের দায়দেনা পরিশোধের জন্য সময় দেওয়া যাবে সর্বোচ্চ ৫ বছর।

কোনো সন্দেহ নেই যে, পোশাক খাত বাংলাদেশে একটি সফল খাত। সরকার পোশাক খাতকে যে যে সুবিধা দিয়েছে, একই সুবিধা চামড়া খাতকে দিলে তারাও সফল হবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, সমান সুবিধা পেলে চামড়া খাত থেকে বছরে এক হাজার ডলার পণ্য রপ্তানি হবে। চামড়া খাত নিয়ে একটা রোডম্যাপ করা জরুরি। একই সঙ্গে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দেশে চামড়া শিল্পের যথেষ্ট কাঁচামাল থাকলেও এই খাত এখনো বিকশিত হতে পারেনি। সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো চালু হয়নি। কাঁচামাল থাকলেই হবে না, এর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে প্রচুর রাসায়নিক ব্যবহার হয়। শ্রমিকের অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে হবে। এসব কাজ করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই চামড়া খাতের রপ্তানি বাড়বে। চামড়া শিল্পে চীনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এদেশে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।

পরিকল্পিতভাবে চামড়া শিল্পে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে বাংলাদেশ। এ খাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এর মাধ্যমে। পরিবেশবান্ধব আধুনিক চামড়া শিল্প গড়ে আমাদের অর্থনীতিতে আরো চাঙ্গাভাব সৃষ্টি করা যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুণগত মানের চামড়া, সস্তা মজুরির শ্রমিক ও কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতাসহ অন্যান্য তুলনামূলক সুবিধা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা জোরদার করতে চামড়া শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রসার ও বিদেশি ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ট্যানারি শিল্পে গুণগত পরিবর্তন আনার জোরালো উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে আরো মজবুত করতে হলে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। চামড়া শিল্পের মানোন্নয়নে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির লক্ষ্যে আরো লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন, চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা, চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সমন্বয় গড়ে তোলা, ব্যবসায়ীদের চামড়া রপ্তানির বিপরীতে পাওনা শুল্ক ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া, চামড়া সংরক্ষণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব নিরসন, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে লবণ ও অন্যান্য ব্যবহৃত কেমিক্যালের মূল্য না বাড়ানো, চামড়ার রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে আরো কার্যকর করাসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শুধুমাত্র গার্মেন্টস শিল্পের ওপর ভরসা না করে চামড়া শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ রপ্তানি আয়ের পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে যে সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে তা কোনোভাবেই অবহেলা না করে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ আর কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকবে না, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনাময় পথ ধরে এগিয়ে যাবে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পকে দীর্ঘদিন ধরে যে অবহেলা করা হয়েছে তার ফলশ্রুতিতে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা কাটিয়ে উঠতে সময়োপযোগী কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পোশাক খাত সরকারের কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, সম্ভাবনায় খাত হওয়া সত্ত্বেও চামড়াশিল্প খাত কেন সমান সুবিধা পায় না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ী, গবেষকসহ সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক। তাঁরা বলেছেন, চামড়া খাত যদি পোশাক খাতের মতো সমান সুবিধা পায়, তাহলে এ খাত থেকে বছরে এক হাজার কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি করা সম্ভব।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

image

প্রতি বছর চামড়ার বার্ষিক চাহিদার সিংহভাগ জোগান আসে কোরবানির পশু থেকে

আরও খবর
শিক্ষা খাত এত ধাক্কা সইবে কেমনে?
কোরবানির পশু মোটাতাজাকরণ : জনস্বাস্থ্যে ঝুঁকি ও করণীয়

শুক্রবার, ০৮ জুলাই ২০২২ , ২৪ আষাড় ১৪২৮ ২৮ জিলহজ ১৪৪৩

চামড়া শিল্প ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা

রেজাউল করিম খোকন

image

প্রতি বছর চামড়ার বার্ষিক চাহিদার সিংহভাগ জোগান আসে কোরবানির পশু থেকে

ট্যানারি শিল্পে চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ। এ চামড়া অন্য সময় সংগৃহীত পশুর চামড়া থেকে উন্নতমানের। প্রতি বছর চামড়ার বার্ষিক চাহিদার সিংহভাগ জোগান আসে কোরবানির পশু থেকে। ফলে এ শিল্পের জন্য উন্নতমানের চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীরাও এ সময় ব্যস্ত থাকেন। কোরবানির সময় যে চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তা দিয়েই সারা বছর ট্যানারি শিল্পের কারখানাগুলো চলে। দীর্ঘদিনে বাংলাদেশে চামড়াশিল্প এগিয়েছে অনেকটা ঢিমেতালে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শিল্পটি কিছুটা গুরুত্ব পেতে থাকে। বিপুল সম্ভাবনাময় এ খাত থেকে সরকার প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।

ট্যানারি শিল্পের বার্ষিক চামড়ার মোট চাহিদার ৭০-৮০ ভাগই সংগ্রহ করা হয় কোরবানির পশু থেকে। একই সময়ে বিপুল পরিমাণ চামড়া সরবরাহ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ সময় সব চামড়া নিজেদের নগদ অর্থে কিনতে পারেন না। এ কারণে তারা এসে ধরনা দেন ব্যাংকগুলোতে, বিশেষ করে রাষ্ট্র-মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে। চামড়া কিনতে সাধারণত এক বছর মেয়াদে ঋণ দেওয়া হয়। এ ব্যবসায় জড়িত গ্রাহকরা তা পেয়ে থাকেন। চামড়া খাতে বিতরণ করা ঋণের একটা বড় অংশই বছরের পর বছর খেলাপি হয়ে আছে। এসব কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো চামড়া কেনায় ঋণ দিতে আগ্রহ দেখায় না, যদিও বর্তমানে এ খাতে ঋণ আদায়ের হার আগের তুলনায় ভালো। ব্যাংকগুলো সতর্কতার সঙ্গে ঋণ অনুমোদনের ফলে খেলাপির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক কমে আসছে ইদানীং।

অনেক দিন থেকেই নাজুক পরিস্থিতি পার করছে দেশের চামড়া শিল্প। পানির চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে কোরবানিকৃত পশুর কাঁচা চামড়া। কয়েক বছর ধরে নামমাত্র মূল্যে কাঁচা চামড়া কিনছেন ব্যবসায়ীরা। তার পরও এ খাতের বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই খেলাপি ঋণের চক্রে আটকা পড়েছেন। সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে এখনো কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চালু না হয়নি।

উল্লেখ্য, পোশাক খাত সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা, রপ্তানিতে নগদ সহায়তা সুবিধা, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা পেয়ে থাকে। যেটা অন্য কোনো খাত পায় না। নানা সংকটের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দেশের চামড়া শিল্প। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া কেনা নিয়েও দুশ্চিন্তায় আছেন ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন, চামড়া কেনার মতো টাকা তাদের হাতে নেই; আবার ব্যাংক ঋণও মিলছে না।

হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে সরকার ‘রেড জোন’ ঘোষণা করায় মালিকরা সেই জমি না পারছেন বিক্রি করতে, না পারছেন বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নিতে। আবার সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরীতে এখনো প্রস্তুত হয়নি কঠিন বর্জ্য শোধনাগার। পরিবেশবান্ধব ট্যানারি শিল্প না হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্রও দিচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কঠিন সময় পার করছেন ট্যানারি মালিকরা। সাভারে চালু থাকা ১২৩টি ট্যানারির বেশির ভাগই চীনে চামড়া রপ্তানি করে। মহামারীর প্রভাবে চীনে রপ্তানি বন্ধ থাকায় অনেক চামড়া পড়ে আছে। চীনের ক্রেতারা ট্যানারিতে চামড়া পরিদর্শনেও আসেননি। রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেও। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, ৯০ শতাংশ ট্যানারি বন্ধের পথে। চামড়া রপ্তানি না হওয়ায় ট্যানারিগুলো আর্থিক সংকটে পড়ছে। এতে ঋণের সুদ বাড়ছে। কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে বেশির ভাগ ট্যানারি খেলাপি হবে। এ সংকট উত্তরণে সরকারের সহায়তা দরকার। উদ্যোক্তরা বলেছেন, পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদনে যাওয়ার আগপর্যন্ত ব্যাংক ঋণে তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হোক। ট্যানারি মালিক ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত, সেসব প্রতিষ্ঠানকে দায়দেনা পরিশোধের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছর সময় দেওয়া যাবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতি ৫ কোটি টাকার বেশি, তাদের দায়দেনা পরিশোধের জন্য সময় দেওয়া যাবে সর্বোচ্চ ৫ বছর।

কোনো সন্দেহ নেই যে, পোশাক খাত বাংলাদেশে একটি সফল খাত। সরকার পোশাক খাতকে যে যে সুবিধা দিয়েছে, একই সুবিধা চামড়া খাতকে দিলে তারাও সফল হবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, সমান সুবিধা পেলে চামড়া খাত থেকে বছরে এক হাজার ডলার পণ্য রপ্তানি হবে। চামড়া খাত নিয়ে একটা রোডম্যাপ করা জরুরি। একই সঙ্গে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দেশে চামড়া শিল্পের যথেষ্ট কাঁচামাল থাকলেও এই খাত এখনো বিকশিত হতে পারেনি। সিইটিপি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এখনো চালু হয়নি। কাঁচামাল থাকলেই হবে না, এর গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে প্রচুর রাসায়নিক ব্যবহার হয়। শ্রমিকের অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে হবে। এসব কাজ করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই চামড়া খাতের রপ্তানি বাড়বে। চামড়া শিল্পে চীনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এদেশে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।

পরিকল্পিতভাবে চামড়া শিল্পে বিভিন্ন উৎপাদনমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে বাংলাদেশ। এ খাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এর মাধ্যমে। পরিবেশবান্ধব আধুনিক চামড়া শিল্প গড়ে আমাদের অর্থনীতিতে আরো চাঙ্গাভাব সৃষ্টি করা যায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুণগত মানের চামড়া, সস্তা মজুরির শ্রমিক ও কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতাসহ অন্যান্য তুলনামূলক সুবিধা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা জোরদার করতে চামড়া শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রসার ও বিদেশি ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ট্যানারি শিল্পে গুণগত পরিবর্তন আনার জোরালো উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বেশি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিতকে আরো মজবুত করতে হলে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। চামড়া শিল্পের মানোন্নয়নে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির লক্ষ্যে আরো লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন, চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা, চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সমন্বয় গড়ে তোলা, ব্যবসায়ীদের চামড়া রপ্তানির বিপরীতে পাওনা শুল্ক ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া, চামড়া সংরক্ষণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব নিরসন, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে লবণ ও অন্যান্য ব্যবহৃত কেমিক্যালের মূল্য না বাড়ানো, চামড়ার রপ্তানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে আরো কার্যকর করাসহ প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শুধুমাত্র গার্মেন্টস শিল্পের ওপর ভরসা না করে চামড়া শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ রপ্তানি আয়ের পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে যে সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে তা কোনোভাবেই অবহেলা না করে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ আর কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকবে না, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনাময় পথ ধরে এগিয়ে যাবে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে। সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পকে দীর্ঘদিন ধরে যে অবহেলা করা হয়েছে তার ফলশ্রুতিতে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা কাটিয়ে উঠতে সময়োপযোগী কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পোশাক খাত সরকারের কাছ থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, সম্ভাবনায় খাত হওয়া সত্ত্বেও চামড়াশিল্প খাত কেন সমান সুবিধা পায় না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ী, গবেষকসহ সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক। তাঁরা বলেছেন, চামড়া খাত যদি পোশাক খাতের মতো সমান সুবিধা পায়, তাহলে এ খাত থেকে বছরে এক হাজার কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি করা সম্ভব।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]