আত্মোৎসর্গের আনন্দ উৎসব

এম এ কবীর

ষষ্ঠ হিজরিতে ঈদুল আজহার প্রচলন। ঈদুল আজহা প্রতি বছর আনন্দের ও ত্যাগের পয়গম নিয়ে হাজির হয়। ঈদুল আজহাকে ঈদুল কবির অর্থাৎ মহান ঈদ বলা হয়। আজহা শব্দ জুবেহ থেকে উৎপত্তি। জবেহ করা ক্রিয়াপদ, আর আজহা অর্থাৎ জুবেহ বিশেষ্য পদ যার অর্থ কোরবানি। কোরবান বা কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। এ শব্দটি কুবরের শব্দ মূল থেকে উৎপত্তি। কুবরের অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। তাহলে ঈদুল আজহার অর্থ দাঁড়ায় কোরবানি বা উৎসর্গ বা ত্যাগের আনন্দ। ঈদুল আজহায় আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ ও কোরবানির চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে। ঈদ সমাজের সব ভেদাভেদ ও সীমানা মুছে দিয়ে মানুষে মানুষে মহামিলন ঘটায়। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করায় ঈদ। ঈদের দিনে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী আনন্দকে একত্রে উপভোগ করেন। ঈদ আনন্দের মধ্যে দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ মর্মবাণী সবার কাছে প্রতিধ্বনিত হয় ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এ মর্মবাণী সব অন্যায় অবিচার ও অসাম্যকে অতিক্রম করে এক ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরণা জোগায়। পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কালের পরিক্রমায় হাজারো মহামানবের আগমন ঘটেছে এ ধরাপৃষ্ঠে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হজরত ইবরাহিম আ.। যিনি স্বীয় প্রাণ কলিজার টুকরা হজরত ইসমাঈল আ.-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। সন্তানও বাবার ছুরির নিচে শিরকে নত করে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আজও চির অমর হয়ে আছেন বিশ^বাসীর কাছে। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু কোরবানি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাই বিশে^র কোটি মুসলমান এ বিধানটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রতি বছর পালন করে থাকে।

শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নির্দিষ্ট গৃহপালিত পশু আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবাই করা। ইসলামে অনেক ধরনের কোরবানি বা ত্যাগের বিধান রয়েছে। আমাদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের কোরবানি রয়েছে। এক ধরনের কোরবানি হলো জানের কোরবানি যেমন- নামাজ, রোজা ইত্যাদি বিধান। এগুলো পালন করতে গিয়ে নিজের দেহকে কষ্ট দিতে হয়। আরেক ধরনের কোরবানি হলো মালের কোরবানি যেমন- দান-সাদাকাহ, জাকাত ইত্যাদি। আরেক ধরনের কোরবানি হলো মনের কোরবানি, অর্থাৎ মনের খায়েশ নিজের প্রবৃত্তি দমন করার কোরবানি। অন্যান্য কোরবানির মতো এটিও একটি বড় কোরবানি। কারণ, মানুষের জন্য জানমাল ব্যয় করা সহজ, অর্থাৎ জানমালের কোরবানি দেয়া সহজ কিন্তু মনের কোরবানি দেয়া কঠিন। মানুষ অকাতরে নিজের সম্পদ ব্যয় করতে সহজে প্রস্তুত হয়ে যায়, কিন্তু নিজের মনের ধ্যান-ধারণা নিজের মনের বুঝ, নিজের মনের যুক্তি সহজে ছাড়তে প্রস্তুত হয় না। কেননা, ঈদুল আজহার পশু কোরবানির মাধ্যমে মালেরও কোরবানি হয়, একই সঙ্গে মনেরও কোরবানি হয়। কোরবানির পশু জবাই করতে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়, এই অর্থের প্রতি মনের যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসাকে কোরবানি করতে হয়।

আল্লাহ পাক হজরত ইবরাহিম আ.-কে স্বপ্নের মাধ্যমে আদেশ দেন তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করে দাও। তখন ইসমাঈল আ.-এর বয়স সাত বছর মতান্তরে ১৩ বছর ছিল। নবীদের স্বপ্ন ওহি, তাই নবীরা যা স্বপ্ন দেখেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই স্বপ্ন অনুযায়ী তিনি পুত্রকে কোরবানি করার জন্য মিনার ময়দানে নিয়ে গেলেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘অতঃপর সে যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম আ. ইসমাঈলকে বললেন, হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে জবাই করছি; এখন তোমার অভিমত কি বলো, ইসমাঈল আ. বললেন, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ (সূরা সাফফাত-১০২) তাফসিরে বলা হয়েছে, ইসমাঈল স্বীয় পিতাকে বললেন, আমাকে শক্ত করে বাঁধবেন, যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। নড়াচড়া করলে আপনার জবাই করতে কষ্ট হবে, আপনার গায়ে রক্ত ছিঁটে গিয়ে লাগবে। আর ছুরিটাকেও ভালোভাবে ধারালো করে নিন, যাতে তাড়াতাড়ি জবাই সেরে ফেলতে পারেন। এভাবে হজরত ইবরাহিম আ. পুত্রকে জবাই করার উদ্যোগ নিলেন। (তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন) আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা পিতাপুত্র উভয়ে যখন আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করার জন্য নিজেদের সোপর্দ করল, আর ইবরাহিম স্বীয় পুত্রকে জবাই করার জন্য উপুড় করে শোয়ালো, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তোমার স্বপ্নকে তুমি বাস্তবে পরিণত করেছ। এটা ছিল এক মহাপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ। আল্লাহ বলেন ‘আমি তার পুত্রের বদলে একটি মর্যাদাবান দুম্বা জান্নাত থেকে পাঠিয়ে দিলাম।’ (সূরা সাফফাত : ১০৩-১০৭)

হজরত ইবরাহিম আ.-এর শিক্ষাকে অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের ওপরও কোরবানির বিধান রাখা হয়েছে। ঈদ মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিরই একটা অংশ। ঈদের আনন্দ অন্তর থেকে উপলদ্ধি করতে পারে একমাত্র মুসলমানরাই। ঈদুল আজহায় আল্লাহ্-তায়ালার প্রতি হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করার যে আনন্দ তাও মুসলমানদেরই একান্ত ও নিজস্ব।

কালের চাহিদা অনুযায়ী মুসলিম জাতি তার আদর্শ সামনে রেখে জাতির অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার প্রয়োজনে কোরবানি দেন। কোরবানির পশু জবাই আসলে প্রতীকী। কোরবানি দেয়ার রীতিটি পৃথিবীর আদিকাল থেকেই চলমান। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর সময়কালেও কোরবানির রেওয়াজ চালু ছিল। কোরবানি হযরত আদম (আ.)-এর সুন্নত ও আদর্শ। সে সময় কোরবানিকৃত মাংস পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসলে তা যদি আকাশ থেকে অগ্নিবর্ষিত হয়ে পুড়ে যেত তাহলে কোরবানি আল্লাহ কবুল করেছেন বলে প্রতীয়মান হতো। যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তার সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হয় সারা বিশে^। এ উৎসব আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কোরবানির উৎসব। ঈদুল আজহা ত্যাগের আত্মসমর্পণের এবং আত্মোপলব্ধির মহান স্মারক।

কোরবানি শুধু একটি আনন্দ উৎসব নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। ঈদুল আজহা আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় উজ্জীবিত এক অনন্য সাধারণ আনন্দ উৎসব। কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত এবং সর্বযুগের মানুষের জন্য অনুস্মরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। শুধু পশু নয়, প্রয়োজনে পশুত্বের কোরবানি দিতে হয়। প্রত্যেক মানুষের ভেতর একটি হিং¯্র পশু আছে, যেটা আমাদের প্রতিনিয়ত অন্যায় ও পাপ কাজে উৎসাহিত করে এবং আত্মাকে পাপিষ্ট আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপিষ্ট আত্মা। মানুষের আন্তরাত্মা পাপে ও গোনাহে ভরা, যেটার সম্মিলিত নাম পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ট আত্মা অর্থাৎ পশুত্বকেই কোরবানি করার পর পশু কোরবানি করা উচিত। হযরত ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করার আগে হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের জীবনকে কোরবানি করেছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পরিবার সারা মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ পরিবার। মুসলিম পরিবারের মধ্যে ধর্মীয়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কোরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর আদর্শের তাত্ত্বিক ও বাস্তবরূপ। প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের সদস্যদের মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ ও কোরবানি।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

শনিবার, ০৯ জুলাই ২০২২ , ২৫ আষাড় ১৪২৮ ২৯ জিলহজ ১৪৪৩

আত্মোৎসর্গের আনন্দ উৎসব

এম এ কবীর

ষষ্ঠ হিজরিতে ঈদুল আজহার প্রচলন। ঈদুল আজহা প্রতি বছর আনন্দের ও ত্যাগের পয়গম নিয়ে হাজির হয়। ঈদুল আজহাকে ঈদুল কবির অর্থাৎ মহান ঈদ বলা হয়। আজহা শব্দ জুবেহ থেকে উৎপত্তি। জবেহ করা ক্রিয়াপদ, আর আজহা অর্থাৎ জুবেহ বিশেষ্য পদ যার অর্থ কোরবানি। কোরবান বা কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ বা ত্যাগ। এ শব্দটি কুবরের শব্দ মূল থেকে উৎপত্তি। কুবরের অর্থ নৈকট্য বা সান্নিধ্য। তাহলে ঈদুল আজহার অর্থ দাঁড়ায় কোরবানি বা উৎসর্গ বা ত্যাগের আনন্দ। ঈদুল আজহায় আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ ও কোরবানির চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে। ঈদ সমাজের সব ভেদাভেদ ও সীমানা মুছে দিয়ে মানুষে মানুষে মহামিলন ঘটায়। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করায় ঈদ। ঈদের দিনে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী আনন্দকে একত্রে উপভোগ করেন। ঈদ আনন্দের মধ্যে দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ মর্মবাণী সবার কাছে প্রতিধ্বনিত হয় ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ এ মর্মবাণী সব অন্যায় অবিচার ও অসাম্যকে অতিক্রম করে এক ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরণা জোগায়। পৃথিবীর ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত কালের পরিক্রমায় হাজারো মহামানবের আগমন ঘটেছে এ ধরাপৃষ্ঠে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হজরত ইবরাহিম আ.। যিনি স্বীয় প্রাণ কলিজার টুকরা হজরত ইসমাঈল আ.-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। সন্তানও বাবার ছুরির নিচে শিরকে নত করে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আজও চির অমর হয়ে আছেন বিশ^বাসীর কাছে। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ কোরবানির প্রতীক হিসেবে পশু কোরবানি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাই বিশে^র কোটি মুসলমান এ বিধানটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রতি বছর পালন করে থাকে।

শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য নির্দিষ্ট গৃহপালিত পশু আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবাই করা। ইসলামে অনেক ধরনের কোরবানি বা ত্যাগের বিধান রয়েছে। আমাদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের কোরবানি রয়েছে। এক ধরনের কোরবানি হলো জানের কোরবানি যেমন- নামাজ, রোজা ইত্যাদি বিধান। এগুলো পালন করতে গিয়ে নিজের দেহকে কষ্ট দিতে হয়। আরেক ধরনের কোরবানি হলো মালের কোরবানি যেমন- দান-সাদাকাহ, জাকাত ইত্যাদি। আরেক ধরনের কোরবানি হলো মনের কোরবানি, অর্থাৎ মনের খায়েশ নিজের প্রবৃত্তি দমন করার কোরবানি। অন্যান্য কোরবানির মতো এটিও একটি বড় কোরবানি। কারণ, মানুষের জন্য জানমাল ব্যয় করা সহজ, অর্থাৎ জানমালের কোরবানি দেয়া সহজ কিন্তু মনের কোরবানি দেয়া কঠিন। মানুষ অকাতরে নিজের সম্পদ ব্যয় করতে সহজে প্রস্তুত হয়ে যায়, কিন্তু নিজের মনের ধ্যান-ধারণা নিজের মনের বুঝ, নিজের মনের যুক্তি সহজে ছাড়তে প্রস্তুত হয় না। কেননা, ঈদুল আজহার পশু কোরবানির মাধ্যমে মালেরও কোরবানি হয়, একই সঙ্গে মনেরও কোরবানি হয়। কোরবানির পশু জবাই করতে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়, এই অর্থের প্রতি মনের যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসাকে কোরবানি করতে হয়।

আল্লাহ পাক হজরত ইবরাহিম আ.-কে স্বপ্নের মাধ্যমে আদেশ দেন তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করে দাও। তখন ইসমাঈল আ.-এর বয়স সাত বছর মতান্তরে ১৩ বছর ছিল। নবীদের স্বপ্ন ওহি, তাই নবীরা যা স্বপ্ন দেখেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই স্বপ্ন অনুযায়ী তিনি পুত্রকে কোরবানি করার জন্য মিনার ময়দানে নিয়ে গেলেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘অতঃপর সে যখন পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম আ. ইসমাঈলকে বললেন, হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে জবাই করছি; এখন তোমার অভিমত কি বলো, ইসমাঈল আ. বললেন, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ (সূরা সাফফাত-১০২) তাফসিরে বলা হয়েছে, ইসমাঈল স্বীয় পিতাকে বললেন, আমাকে শক্ত করে বাঁধবেন, যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। নড়াচড়া করলে আপনার জবাই করতে কষ্ট হবে, আপনার গায়ে রক্ত ছিঁটে গিয়ে লাগবে। আর ছুরিটাকেও ভালোভাবে ধারালো করে নিন, যাতে তাড়াতাড়ি জবাই সেরে ফেলতে পারেন। এভাবে হজরত ইবরাহিম আ. পুত্রকে জবাই করার উদ্যোগ নিলেন। (তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন) আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা পিতাপুত্র উভয়ে যখন আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করার জন্য নিজেদের সোপর্দ করল, আর ইবরাহিম স্বীয় পুত্রকে জবাই করার জন্য উপুড় করে শোয়ালো, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তোমার স্বপ্নকে তুমি বাস্তবে পরিণত করেছ। এটা ছিল এক মহাপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ। আল্লাহ বলেন ‘আমি তার পুত্রের বদলে একটি মর্যাদাবান দুম্বা জান্নাত থেকে পাঠিয়ে দিলাম।’ (সূরা সাফফাত : ১০৩-১০৭)

হজরত ইবরাহিম আ.-এর শিক্ষাকে অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের ওপরও কোরবানির বিধান রাখা হয়েছে। ঈদ মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিরই একটা অংশ। ঈদের আনন্দ অন্তর থেকে উপলদ্ধি করতে পারে একমাত্র মুসলমানরাই। ঈদুল আজহায় আল্লাহ্-তায়ালার প্রতি হজরত ইবরাহিম (আ.) এর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস উৎসর্গ করার যে আনন্দ তাও মুসলমানদেরই একান্ত ও নিজস্ব।

কালের চাহিদা অনুযায়ী মুসলিম জাতি তার আদর্শ সামনে রেখে জাতির অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার প্রয়োজনে কোরবানি দেন। কোরবানির পশু জবাই আসলে প্রতীকী। কোরবানি দেয়ার রীতিটি পৃথিবীর আদিকাল থেকেই চলমান। মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর সময়কালেও কোরবানির রেওয়াজ চালু ছিল। কোরবানি হযরত আদম (আ.)-এর সুন্নত ও আদর্শ। সে সময় কোরবানিকৃত মাংস পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসলে তা যদি আকাশ থেকে অগ্নিবর্ষিত হয়ে পুড়ে যেত তাহলে কোরবানি আল্লাহ কবুল করেছেন বলে প্রতীয়মান হতো। যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তার সন্তুষ্টি ও মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আজহা উদ্যাপিত হয় সারা বিশে^। এ উৎসব আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কোরবানির উৎসব। ঈদুল আজহা ত্যাগের আত্মসমর্পণের এবং আত্মোপলব্ধির মহান স্মারক।

কোরবানি শুধু একটি আনন্দ উৎসব নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও দর্শন। ঈদুল আজহা আত্মোৎসর্গের প্রেরণায় উজ্জীবিত এক অনন্য সাধারণ আনন্দ উৎসব। কোরবানি দেয়ার ক্ষেত্রে হজরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত এবং সর্বযুগের মানুষের জন্য অনুস্মরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। শুধু পশু নয়, প্রয়োজনে পশুত্বের কোরবানি দিতে হয়। প্রত্যেক মানুষের ভেতর একটি হিং¯্র পশু আছে, যেটা আমাদের প্রতিনিয়ত অন্যায় ও পাপ কাজে উৎসাহিত করে এবং আত্মাকে পাপিষ্ট আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপিষ্ট আত্মা। মানুষের আন্তরাত্মা পাপে ও গোনাহে ভরা, যেটার সম্মিলিত নাম পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ট আত্মা অর্থাৎ পশুত্বকেই কোরবানি করার পর পশু কোরবানি করা উচিত। হযরত ইসমাইল (আ.) কে কোরবানি করার আগে হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের জীবনকে কোরবানি করেছিলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর পরিবার সারা মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ পরিবার। মুসলিম পরিবারের মধ্যে ধর্মীয়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শবোধ স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিম পরিবারের মূল্যবোধের ভিত্তি হলো আল কোরআন ও সুন্নাহ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর আদর্শের তাত্ত্বিক ও বাস্তবরূপ। প্রত্যেক মুসলিম পরিবারের সদস্যদের মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ ও কোরবানি।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]