গৌতম রায়
জ্যোতিবাবু কি শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে ঋদ্ধ করেছিলেন? নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আশা জাগিয়েছিলেন ভারতের রাজনীতিতে? ভারতীয় উপমহাদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে কি জ্যোতিবাবু তার জীবদ্দশাতে একটা আইকনে পরিণত হননি? উপমহাদেশে যখন ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা একটা অভিশাপ হিসেবে আগামী দিনের রাজনীতিকে ঢেকে ফেলবার ষড়যন্ত্র করছে, তখন খান আবদুল ওয়ালি খান থেকে শুরু করে শেখ হাসিনাÑ প্রত্যেকে নিজের দেশে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে স্থাপনের উদ্দেশে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদে জ্যোতিবাবুর কর্মজীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করেননি?
জ্যোতিবাবুর নিজের কখনও রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। থাকলে ব্রিটিশ শাসনের অন্তিমপর্বে যখন বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন, তেমনটা কখনও করতেন না। সে যুগেও আবার এ যুগেও সমাজে একটু বেশি গুরুত্ব পাওয়ার জন্যে একটা বড় অংশের লেখাপড়া জানা লোকজন কমিউনিস্টদের সঙ্গে মেলামেশা করেন। ফলে বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট্যে মধ্যবিত্তের কাছে তাদের একটা অন্য রকমের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। আর সেইসব পড়াশোনা জানা লোকজন, বিদ্যাচর্চা যাদের চতুর ও করেছে, তারা সংসদীয় রাজনীতিতে নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষাকে চরিতার্থ করতে যোগ দেন বুর্জোয়া রাজনীতির বেড়াজালে।
এ ধরনের রাজনৈতিক চরিত্র ব্রিটিশ আমলে আমরা অনেক দেখেছি। ফিরোজ গান্ধী, যার সঙ্গে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ার সময়ে রজনীপাম দত্তের সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদি ঘিরে জ্যোতিবাবুর যথেষ্ট সংযোগ ছিল। সেই ফিরোজ কিন্তু ভারতে ফিরে করেছিলেন কংগ্রেসি রাজনীতি। মজার কথা হলো, বুর্জোয়া রাজনীতির ভেতরে থেকে একটা বিদ্রোহী ইমেজ বজায় রাখবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন।
একই কথা প্রযোজ্য ’৪৭-এর দেশভাগের কালের বামপন্থি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা মুসলিম লীগে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক স্তরের অন্যতম শীর্ষ নেতা আবুল হাশেম সম্পর্কেও প্রযোজ্য। সোনার পাথরবাটির মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিবিরে তিনি নিজের একটা বামপন্থি ইমেজ বজায় রাখতেন। কিন্তু কখনো কমিউনিস্ট শিবিরের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেননি। বুর্জোয়া রাজনীতিতে এই বামপন্থী ইমেজ ধরে রাখলে দলীয় স্তরে বা সংসদীয় রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ফিরোজ গান্ধী থেকে আবুল হাশেম বা বিভাগোত্তর পশ্চিমবঙ্গে সাতের দশকে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস চালানোর অন্যতম ষড়যন্ত্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়Ñ প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
এসব ব্যক্তি স্বার্থবাহী লোকেদের পথে হেঁটে কোনো দিন রাজনীতি করেননি জ্যোতি বসু। প্রথম জীবনে তিনি যদি তার বামপন্থী আদর্শবোধের একটা লোকদেখানো অভিনয় তার বন্ধু তথা ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধীর মতো করে বুর্জোয়া রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতেন, তাহলে বুর্জোয়া রাজনীতির কলকাঠি যাদের হাতে, তারা অনেক আগেই জ্যোতিবাবুকে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের থেকে হাজার গুণ বেশি গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে মেলে ধরতেন। রাষ্ট্রপতি তো কোন ছাড়, বুর্জোয়া রাজনীতিই তখন প্রধানমন্ত্রী তখতে জ্যোতিবাবুর মতো বাস্তববোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বসাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। ইন্দিরার পরিবারতন্ত্র তখন অনেক আগেই সংকটের সামনে দাঁড়াত।
কী হলে কী হতোÑএমন হাইপথিটিকাল বিশ্লেষণে কখন ইতিহাস চর্চা চলে না। কিন্তু কী হলে কী হতোÑজ্যোতিবাবুর ক্ষেত্রে তেমন কল্পিত কথা এই কারণেই আলোচিত হলো যে, জ্যোতিবাবু যে ব্যক্তি স্বার্থকে নিজের রাজনৈতিক জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও জায়গা দেননি- এই বৈশিষ্ট্যটির জন্য তিনি তার সমসাময়িক রাজনীতির কালে একজন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন।
বিরোধী নেতা হিসেবে জ্যোতিবাবুর সাফল্য, প্রশাসক হিসেবে তার সাফল্যের ইউএসপি। তার গোটা জীবনের রাজনীতির যে দুটি পর্যায়, বিরোধী নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রী- এ দুটি কালের রাজনীতির ধারাপ্রবাহের সঙ্গে আজকের ভারতের রাজনীতির ধারা প্রবাহের কোন তুলনাই চলে না। বিরোধী দলনেতা হিসেবে মানুষের স্বার্থবাহী পদক্ষেপে শাসককে বাধ্য করবার ক্ষেত্রে জ্যোতিবাবুর যে সাফল্য, তার ধারে কাছে আজ পর্যন্ত ভারতের কোন প্রান্তে কোন দলের বিরোধী নেতা পৌঁছতে পারেননি। বিরোধী নেতা হিসেবে সাফল্যই কিন্তু প্রশাসক হিসেবে জ্যোতিবাবুকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।
ছয়ের দশকে দুইবার স্বল্প সময়ের জন্য জ্যোতিবাবু পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিছুটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই সেই সময়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব জ্যোতিবাবুকে পালন করতে হয়েছিল। তার নিজের দল সিপিআই (এম) একক বৃহত্তম দল হওয়া সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্ট পরিচালনার বাধ্যবাধকতা থেকে বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায় তখন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রশাসক হিশেবে অজয়বাবু ছিলেন অযোগ্য এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটিও ছিল তার শূন্য। যে কংগ্রেস দলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে দল ছেড়ে তার বাংলা কংগ্রেস গঠন করা, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করতে সেই কংগ্রেস দলের সঙ্গে তিনি বোঝাপড়া করে প্রায় প্রথম দিন থেকে চলতেন। যুক্তফ্রন্ট টিকিয়ে রাখার যে দায়বদ্ধতা থেকে জ্যোতিবাবুরা ছোটদলের অজয়বাবুকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে চলেছিলেন, সেই দায়বদ্ধতার পরিচয় অজয়বাবু কখনো রাখেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতিবাবুর গাজোলের ওসিকে বদলি করবার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি ভেঙেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী অজয়বাবু। যুক্তফ্রন্ট্রের সঙ্গী এসইউসি কুলতলি থানার ওসি দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুন হওয়ার পর পুলিশের একটা অংশকে জ্যোতিবাবুকে ব্যক্তিগতমাবে হেনস্থা করবার জন্যে প্ররোচিত করেছিল। পুলিশের একাংশ মিছিল নিয়ে বিধানসভার ভেতরে জ্যোতিবাবুকে আক্রমণ করতে পর্যন্ত গিয়েছিল।
প্রশাসনিক জ্যোতিবাবুর আত্মপ্রকাশ লগ্নে ও বাস্তববোধ, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলবার স্বভাবজাত দক্ষতা আর মানুষের স্বার্থের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাÑএই ত্রিবেণীসঙ্গমের ধারা থেকে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব ছাড়বার শেষদিন পর্যন্ত একটিবারের জন্যেও বিচ্যুত হননি। বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার নিজের দল সিপিআই (এম) এর একক গরিষ্ঠতার নিরিখে সব থেকে ছোট বামফ্রন্ট শরিকের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনÑএটা জ্যোতিবসুর রাজনৈতিক চরিত্রে কখনও দেখা যায়নি। আবার বিরোধী রাজনীতির প্রতি রাজনৈতিকভাবে আক্রমণাত্মক হলেও বামফ্রন্টের গরিষ্ঠতার নিরিখে বিরোধীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাÑএটাও জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক চরিত্র বিরোধী ছিল। তার সময়ের অনেক বিরোধী নেতাই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, তারা তাদের নিজের দলের কাছে যে সম্মান, মর্যাদা পাননি, সেটা পেয়েছিলেন জ্যোতিবাবুর কাছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীকে মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নে জ্যোতিবাবুকেই শেষ আইকন বলা যেতে পারে। ভবিষ্যৎ রাজনীতি কি ধারায় বইবে, তার জ্যোতিষ সংকেত দেওয়া তো কলমচির কাজ নয়। এখন পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতির যে ধারাভাষ্য আছে, তাতে খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে হয় যে, নিজেদের ব্যাপক গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও আইনসভার ভেতরে ও বাইরে জ্যোতিবাবু বিরোধীদের যে মর্যাদা দিয়েছিলেন, তেমন মর্যাদা জ্যোতিবাবুর পরে কোনো স্তরের প্রশাসকের কাছ থেকেই কোনো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি পাননি। জ্যোতিবাবু যেমন ছাঁচে ঢালা কমিউনিস্ট ছিলেন না, তেমনিই তিনি কখনো বাস্তবতার নামে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে কমিউনিজমের ধারণাকে গুলিয়েও দেননি। সময়ের নিরিখে উন্নয়নের ধারার যে অদলবদল, সে সম্পর্কে তিনি কখনো কোনো রকম গোঁড়ামির আশ্রয় নেননি। আবার উন্নয়নের নামে কখনো কোনো রকম হটকারী পথে ও হাঁটেননি। উন্নয়ন কখনো অলীক স্বপ্ন বিলাসের ওপর নির্ভর করে হয় না। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই সম্ভব এই বুর্জোয়া পরিকাঠামোর ভেতরেও মানুষের জীবন-জীবিকার মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী পদক্ষেপ গ্রহণÑএটা জ্যোতিবাবু শুধু০ বিশ্বাসই করতেন না, নিজের প্রতিটি কর্মকা-ের ভেতরে ও সেই বিশ্বাসের বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে গিয়েছেন।
বাঙালির প্রতি জ্যোতিবাবুর ভালোবাসার ঋণ বাঙালি কখনো শোধ করবার স্পর্ধা রাখে না। জ্যোতিবাবু না থাকলে ঐতিহাসিক পানি চুক্তি হওয়া সম্ভব ছিল না। এই পানি চুক্তি সম্পাদনে জ্যোতিবাবু বাংলাদেশকে বা তার কন্যাসম শেখ হাসিনার প্রতি কোনো পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছিলেনÑতা ভাবা ভুল। পানি চুক্তির ভেতর দিয়ে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে ইন্দিরা গান্ধী যে নয়া সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা দেখিয়েছিলেন, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তই যেন জ্যোতিবাবু ওই পানি চুক্তি সংগঠনে প্রধান ভূমিকা নিয়ে করেছিলেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জ্যোতিবাবুর উদ্যোগে পানি চুক্তি হয়েছিল, আর তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য পাওনা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
শনিবার, ০৯ জুলাই ২০২২ , ২৫ আষাড় ১৪২৮ ২৯ জিলহজ ১৪৪৩
গৌতম রায়
জ্যোতিবাবু কি শুধু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে ঋদ্ধ করেছিলেন? নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আশা জাগিয়েছিলেন ভারতের রাজনীতিতে? ভারতীয় উপমহাদেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে কি জ্যোতিবাবু তার জীবদ্দশাতে একটা আইকনে পরিণত হননি? উপমহাদেশে যখন ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা একটা অভিশাপ হিসেবে আগামী দিনের রাজনীতিকে ঢেকে ফেলবার ষড়যন্ত্র করছে, তখন খান আবদুল ওয়ালি খান থেকে শুরু করে শেখ হাসিনাÑ প্রত্যেকে নিজের দেশে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্যবোধকে স্থাপনের উদ্দেশে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদে জ্যোতিবাবুর কর্মজীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করেননি?
জ্যোতিবাবুর নিজের কখনও রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। থাকলে ব্রিটিশ শাসনের অন্তিমপর্বে যখন বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেন, তেমনটা কখনও করতেন না। সে যুগেও আবার এ যুগেও সমাজে একটু বেশি গুরুত্ব পাওয়ার জন্যে একটা বড় অংশের লেখাপড়া জানা লোকজন কমিউনিস্টদের সঙ্গে মেলামেশা করেন। ফলে বুর্জোয়া সমাজের বৈশিষ্ট্যে মধ্যবিত্তের কাছে তাদের একটা অন্য রকমের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। আর সেইসব পড়াশোনা জানা লোকজন, বিদ্যাচর্চা যাদের চতুর ও করেছে, তারা সংসদীয় রাজনীতিতে নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষাকে চরিতার্থ করতে যোগ দেন বুর্জোয়া রাজনীতির বেড়াজালে।
এ ধরনের রাজনৈতিক চরিত্র ব্রিটিশ আমলে আমরা অনেক দেখেছি। ফিরোজ গান্ধী, যার সঙ্গে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়ার সময়ে রজনীপাম দত্তের সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদি ঘিরে জ্যোতিবাবুর যথেষ্ট সংযোগ ছিল। সেই ফিরোজ কিন্তু ভারতে ফিরে করেছিলেন কংগ্রেসি রাজনীতি। মজার কথা হলো, বুর্জোয়া রাজনীতির ভেতরে থেকে একটা বিদ্রোহী ইমেজ বজায় রাখবার চেষ্টা তিনি করেছিলেন।
একই কথা প্রযোজ্য ’৪৭-এর দেশভাগের কালের বামপন্থি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা মুসলিম লীগে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক স্তরের অন্যতম শীর্ষ নেতা আবুল হাশেম সম্পর্কেও প্রযোজ্য। সোনার পাথরবাটির মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিবিরে তিনি নিজের একটা বামপন্থি ইমেজ বজায় রাখতেন। কিন্তু কখনো কমিউনিস্ট শিবিরের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেননি। বুর্জোয়া রাজনীতিতে এই বামপন্থী ইমেজ ধরে রাখলে দলীয় স্তরে বা সংসদীয় রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ফিরোজ গান্ধী থেকে আবুল হাশেম বা বিভাগোত্তর পশ্চিমবঙ্গে সাতের দশকে আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস চালানোর অন্যতম ষড়যন্ত্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়Ñ প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
এসব ব্যক্তি স্বার্থবাহী লোকেদের পথে হেঁটে কোনো দিন রাজনীতি করেননি জ্যোতি বসু। প্রথম জীবনে তিনি যদি তার বামপন্থী আদর্শবোধের একটা লোকদেখানো অভিনয় তার বন্ধু তথা ইন্দিরা গান্ধীর স্বামী ফিরোজ গান্ধীর মতো করে বুর্জোয়া রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতেন, তাহলে বুর্জোয়া রাজনীতির কলকাঠি যাদের হাতে, তারা অনেক আগেই জ্যোতিবাবুকে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের থেকে হাজার গুণ বেশি গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে মেলে ধরতেন। রাষ্ট্রপতি তো কোন ছাড়, বুর্জোয়া রাজনীতিই তখন প্রধানমন্ত্রী তখতে জ্যোতিবাবুর মতো বাস্তববোধ সম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে বসাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। ইন্দিরার পরিবারতন্ত্র তখন অনেক আগেই সংকটের সামনে দাঁড়াত।
কী হলে কী হতোÑএমন হাইপথিটিকাল বিশ্লেষণে কখন ইতিহাস চর্চা চলে না। কিন্তু কী হলে কী হতোÑজ্যোতিবাবুর ক্ষেত্রে তেমন কল্পিত কথা এই কারণেই আলোচিত হলো যে, জ্যোতিবাবু যে ব্যক্তি স্বার্থকে নিজের রাজনৈতিক জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও জায়গা দেননি- এই বৈশিষ্ট্যটির জন্য তিনি তার সমসাময়িক রাজনীতির কালে একজন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন।
বিরোধী নেতা হিসেবে জ্যোতিবাবুর সাফল্য, প্রশাসক হিসেবে তার সাফল্যের ইউএসপি। তার গোটা জীবনের রাজনীতির যে দুটি পর্যায়, বিরোধী নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রী- এ দুটি কালের রাজনীতির ধারাপ্রবাহের সঙ্গে আজকের ভারতের রাজনীতির ধারা প্রবাহের কোন তুলনাই চলে না। বিরোধী দলনেতা হিসেবে মানুষের স্বার্থবাহী পদক্ষেপে শাসককে বাধ্য করবার ক্ষেত্রে জ্যোতিবাবুর যে সাফল্য, তার ধারে কাছে আজ পর্যন্ত ভারতের কোন প্রান্তে কোন দলের বিরোধী নেতা পৌঁছতে পারেননি। বিরোধী নেতা হিসেবে সাফল্যই কিন্তু প্রশাসক হিসেবে জ্যোতিবাবুকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল।
ছয়ের দশকে দুইবার স্বল্প সময়ের জন্য জ্যোতিবাবু পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিছুটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই সেই সময়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব জ্যোতিবাবুকে পালন করতে হয়েছিল। তার নিজের দল সিপিআই (এম) একক বৃহত্তম দল হওয়া সত্ত্বেও যুক্তফ্রন্ট পরিচালনার বাধ্যবাধকতা থেকে বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায় তখন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। প্রশাসক হিশেবে অজয়বাবু ছিলেন অযোগ্য এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটিও ছিল তার শূন্য। যে কংগ্রেস দলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে দল ছেড়ে তার বাংলা কংগ্রেস গঠন করা, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করতে সেই কংগ্রেস দলের সঙ্গে তিনি বোঝাপড়া করে প্রায় প্রথম দিন থেকে চলতেন। যুক্তফ্রন্ট টিকিয়ে রাখার যে দায়বদ্ধতা থেকে জ্যোতিবাবুরা ছোটদলের অজয়বাবুকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে চলেছিলেন, সেই দায়বদ্ধতার পরিচয় অজয়বাবু কখনো রাখেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জ্যোতিবাবুর গাজোলের ওসিকে বদলি করবার সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি ভেঙেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী অজয়বাবু। যুক্তফ্রন্ট্রের সঙ্গী এসইউসি কুলতলি থানার ওসি দুর্ভাগ্যজনকভাবে খুন হওয়ার পর পুলিশের একটা অংশকে জ্যোতিবাবুকে ব্যক্তিগতমাবে হেনস্থা করবার জন্যে প্ররোচিত করেছিল। পুলিশের একাংশ মিছিল নিয়ে বিধানসভার ভেতরে জ্যোতিবাবুকে আক্রমণ করতে পর্যন্ত গিয়েছিল।
প্রশাসনিক জ্যোতিবাবুর আত্মপ্রকাশ লগ্নে ও বাস্তববোধ, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলবার স্বভাবজাত দক্ষতা আর মানুষের স্বার্থের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাÑএই ত্রিবেণীসঙ্গমের ধারা থেকে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব ছাড়বার শেষদিন পর্যন্ত একটিবারের জন্যেও বিচ্যুত হননি। বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার নিজের দল সিপিআই (এম) এর একক গরিষ্ঠতার নিরিখে সব থেকে ছোট বামফ্রন্ট শরিকের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনÑএটা জ্যোতিবসুর রাজনৈতিক চরিত্রে কখনও দেখা যায়নি। আবার বিরোধী রাজনীতির প্রতি রাজনৈতিকভাবে আক্রমণাত্মক হলেও বামফ্রন্টের গরিষ্ঠতার নিরিখে বিরোধীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাÑএটাও জ্যোতিবাবুর রাজনৈতিক চরিত্র বিরোধী ছিল। তার সময়ের অনেক বিরোধী নেতাই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, তারা তাদের নিজের দলের কাছে যে সম্মান, মর্যাদা পাননি, সেটা পেয়েছিলেন জ্যোতিবাবুর কাছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধীকে মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নে জ্যোতিবাবুকেই শেষ আইকন বলা যেতে পারে। ভবিষ্যৎ রাজনীতি কি ধারায় বইবে, তার জ্যোতিষ সংকেত দেওয়া তো কলমচির কাজ নয়। এখন পর্যন্ত ভারতীয় রাজনীতির যে ধারাভাষ্য আছে, তাতে খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই বলতে হয় যে, নিজেদের ব্যাপক গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও আইনসভার ভেতরে ও বাইরে জ্যোতিবাবু বিরোধীদের যে মর্যাদা দিয়েছিলেন, তেমন মর্যাদা জ্যোতিবাবুর পরে কোনো স্তরের প্রশাসকের কাছ থেকেই কোনো বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি পাননি। জ্যোতিবাবু যেমন ছাঁচে ঢালা কমিউনিস্ট ছিলেন না, তেমনিই তিনি কখনো বাস্তবতার নামে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে কমিউনিজমের ধারণাকে গুলিয়েও দেননি। সময়ের নিরিখে উন্নয়নের ধারার যে অদলবদল, সে সম্পর্কে তিনি কখনো কোনো রকম গোঁড়ামির আশ্রয় নেননি। আবার উন্নয়নের নামে কখনো কোনো রকম হটকারী পথে ও হাঁটেননি। উন্নয়ন কখনো অলীক স্বপ্ন বিলাসের ওপর নির্ভর করে হয় না। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই সম্ভব এই বুর্জোয়া পরিকাঠামোর ভেতরেও মানুষের জীবন-জীবিকার মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী পদক্ষেপ গ্রহণÑএটা জ্যোতিবাবু শুধু০ বিশ্বাসই করতেন না, নিজের প্রতিটি কর্মকা-ের ভেতরে ও সেই বিশ্বাসের বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে গিয়েছেন।
বাঙালির প্রতি জ্যোতিবাবুর ভালোবাসার ঋণ বাঙালি কখনো শোধ করবার স্পর্ধা রাখে না। জ্যোতিবাবু না থাকলে ঐতিহাসিক পানি চুক্তি হওয়া সম্ভব ছিল না। এই পানি চুক্তি সম্পাদনে জ্যোতিবাবু বাংলাদেশকে বা তার কন্যাসম শেখ হাসিনার প্রতি কোনো পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছিলেনÑতা ভাবা ভুল। পানি চুক্তির ভেতর দিয়ে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে ইন্দিরা গান্ধী যে নয়া সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা দেখিয়েছিলেন, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তই যেন জ্যোতিবাবু ওই পানি চুক্তি সংগঠনে প্রধান ভূমিকা নিয়ে করেছিলেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, জ্যোতিবাবুর উদ্যোগে পানি চুক্তি হয়েছিল, আর তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য পাওনা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]