৫ম শতাব্দীর হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা ‘বটগোহালী’

সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে পাহাড়পুরের পাশে অবস্থিত বটগোহালী নামের একটি গ্রাম। এটি শুধু গ্রামের নাম ছিলো না, এটি একটি প্রাচীন সভ্যতা। ওই নামে ছিল মৌজারও নাম। কালে কালে সেই গ্রামের নাম ও মৌজার নাম বটগোহালী থেকে পরিবর্তন হয়ে গোয়ালভিটা হয়েছে ।

ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বিহার পাহাড়পুরের নাম জানে না এমন মানুষ খুজে পাওয়া যাবে না। আর এই বিহারটি দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক আসে এখানে। বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বের কাছে এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। এই ঐতিহাসিক স্থানটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত। এর পাশেই ছিল বটগোহালী গ্রাম। পাহাড়পুর রয়ে গেছে আজও, কিন্তু হারিয়ে গেছে প্রাচীন সভ্যতা বটগোহালী।

এখন বটগোহালী গ্রামের নাম হয়েছে গোয়ালভিটা আর এই গোয়ালভিটা নামেই হয়েছে মৌজা। কালের বিবর্তনে বটগোহালী গ্রামের নামটি হারিয়ে গেছে। বটগোহালী থেকে গোয়ালভিটা একটি হারিয়ে যাওয়া গ্রামের নাম।

ইতিহাস সূত্রে জানাযায়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি প্রাচীন গ্রামের নাম ছিলো বটগোহালী। এবং এই বটগোহালী নামেই মৌজা ও ছিলো। এই বটগোহালী গ্রামেই একটি প্রাচীন জৈন বিহার ছিল। পাহাড়পুর বিহার খননকালে একটি পান্ডুলিপি পাওয়া যায়।

এই লিপি থেকে জানা যায়, এক ব্রাহ্মণ দম্পতি কর্তৃক বটগোহালীতে অবস্থিত একটি জৈন বিহারের ‘অইত’ পূজা ও একটি বিশ্রামাগারের জন্য কিছু জমি দান করা হয়েছিল। এই জৈন বিহারের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত জৈন গুরু গুহ নন্দী । সেই মন্দিরে তাঁর বহু শিষ্য-প্রশিষ্য বসবাস করতেন।

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে জৈন বিহারটি যে একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছিল, যার পা-ুলিপিটি তা প্রমাণ করে। এখানে এখনো যে কোন জায়গার মাটি খুঁড়লে প্রাচীন ইটের অনেক প্রাচুর্য পাওয়া যায়। এই গ্রামে এখনো রয়েছে কালো পাথর। কালের বিবর্তনে সেই গ্রামে আজ প্রাচীন ইট বা কালো পাথর থাকলেও নেই সেই আদি গ্রামের নাম। কেউ জানে না সেই নামে এই গ্রাম ছিলো।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বদলগাছীর পাহাড়পুরের উত্তর দিকে অবস্থিত গোয়ালভিটা গ্রামে বাঁশঝাড়ের নিচে ইটের প্রাচুর্য । গ্রামেই রয়েছে কালো বৃহ?্ৎ আকৃতির পাথর। প্রাচীন বটগোহালী গ্রাম আর বর্তমানের গোয়ালভিটা গ্রামের বিভিন্ন মানুষেরা জানিয়েছেন কিংবদন্তির বিভিন্ন গল্প।

এই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফা বলেন, আজকের গোয়ালভিটা গ্রামটিই যে বটগোহালী গ্রাম সেটা শুনেছি। এখানে একটি জৈন? মন্দির থাকার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই গ্রামের মাটির নিচে রয়েছে প্রচুর ইট। সেগুলো হয়তো সেই জৈন মন্দিরের ইট।

গোয়ালভিটা গ্রামের মোস্তফা বলেন, বটগোহালী গ্রামের নাম আমি প্রথম শুনলাম, ইতিপূর্বে আমি শুনিনি। তবে এই গ্রামের মাটির নিচে রয়েছে শুধু ইট আর ইট। বেশি দূর খনন করা যায় না। অনেকেই এই ইট দিয় বাড়ীর প্রাচীর তৈরি করেছে।

একই গ্রামের জহুরুল(৬০) বলেন, হ?্যাঁ শুনেছি এই গ্রামের নাম ছিলো বটগোহালী। তবে কত বছর আগে এই গ্রামের নাম পরিবর্তন করে গোয়ালভিটা হয়েছে সেটি তাঁর জানা নেই। আরেক ব্যক্তি আফতাব হোসেন বলেন, বটগোহালী গ্রাম হতে পারে। কিন্তু আজকে এর নাম গোয়ালভিটা। এই গোয়ালভিটাতেই পাহাড়পুর বাজার। এই গ্রামে মাটির উপরে এখনো কালো পাথর আছে। আমার দাদারা গল্প করতো এখানে মসজিদের সামনে দুটি পাথর ছিলো। স্থানীয় লোকজন এই পাথরের উপর বসে ওজু করতো। কিছু বিদেশি লোকজন সেই মসজিদের পাথর রিসার্চ করতে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে লোক মুখে শোনাযায় সেই পাথর দুটি নাকি সোনার পাথর ছিল।

প্রাচীন বটগোহালী গ্রামের বিষয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক রাজ্জাক আহমেদর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, পাহাড়পুর খননকালে পঞ্চম আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদের শাসনকালের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। সেই মুদ্রা থেকে ধারণা করা যায় বাগদাদের সঙ্গে পাহাড়পুরের যোগাযোগ ব?্যবস্থা ছিল। সেই সময় মানুষ নদী ও সমুদ্র পথে যাতায়াত করত। গ্রামে একটি বিল আছে। এই বিল সেই আমলের নূর নদী। এই নূর নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে বাগদাদে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল। তিনি আরো বলেন সোমপুর বিহারের নিচে আরো ইতিহাস দাফন আছে যা খনন করলে জানা যাবে।

এ ব?্যাপারে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কাষ্টডিয়ান ফজলুল হক আরজু বলেন, এই নামে কোন গ্রাম আছে কিনা জানিনা। আমার চাকরি এখানে বেশি দিন হয়নি। তবে বিহারের গেটর উওর দিকে ছিল তা আমি জেনেছি। এ ব?্যাপারে পূর্বের কাস্টডিয়ান বলতে পারবে।

এ বিষয়ে ১৯৯০ সালে দায়িত্বে থাকা কাস্টডিয়ান মাহবুব আলম বলেন, সোমপুর বিহার আজ পাহাড়পুর নামে পরিচয় পেয়েছে। খননকালে পাহাড়পুরের নিচে আরো বিহার আছে বলে জানা গেছে। অন?্য এক বিহারের উপর আজকের পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। বটগোহালী গ্রামের নাম বললে তিনি বলেন, আজকের গোয়ালভিটা গ্রামই হয়তো বটগোহালী গ্রাম। এই গ্রামের নিচে প্রাচীনতম সভ?্যতা বিদ?্যমান রয়েছে। গ্রামের মাটি খনন করলে পুরনো ইট পাওয়া যায়।

এ ব?্যাপারে বগুড়া আঞ্চলিক প্রতœতত্ব কর্মকর্তা নাহিদ সুলতানা বলেন, আমরা ২০০৭ সালে কিছু খনন কাজ করেছি। পাহাড়পুরের নিচে আরো একটি বিহার থাকার সম্ভাবনা বয়েছে। তবে ঐ স্থানে নতুন করে খনন করলে আরো ইতিহাস বের হবে।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই ২০২২ , ৩০ আষাঢ় ১৪২৯ ১৫ জিলহজ ১৪৪৩

৫ম শতাব্দীর হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা ‘বটগোহালী’

প্রতিনিধি, বদলগাছী (নওগাঁ)

image

সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে পাহাড়পুরের পাশে অবস্থিত বটগোহালী নামের একটি গ্রাম। এটি শুধু গ্রামের নাম ছিলো না, এটি একটি প্রাচীন সভ্যতা। ওই নামে ছিল মৌজারও নাম। কালে কালে সেই গ্রামের নাম ও মৌজার নাম বটগোহালী থেকে পরিবর্তন হয়ে গোয়ালভিটা হয়েছে ।

ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বিহার পাহাড়পুরের নাম জানে না এমন মানুষ খুজে পাওয়া যাবে না। আর এই বিহারটি দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক আসে এখানে। বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বের কাছে এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। এই ঐতিহাসিক স্থানটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত। এর পাশেই ছিল বটগোহালী গ্রাম। পাহাড়পুর রয়ে গেছে আজও, কিন্তু হারিয়ে গেছে প্রাচীন সভ্যতা বটগোহালী।

এখন বটগোহালী গ্রামের নাম হয়েছে গোয়ালভিটা আর এই গোয়ালভিটা নামেই হয়েছে মৌজা। কালের বিবর্তনে বটগোহালী গ্রামের নামটি হারিয়ে গেছে। বটগোহালী থেকে গোয়ালভিটা একটি হারিয়ে যাওয়া গ্রামের নাম।

ইতিহাস সূত্রে জানাযায়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার থেকে তিন কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে একটি প্রাচীন গ্রামের নাম ছিলো বটগোহালী। এবং এই বটগোহালী নামেই মৌজা ও ছিলো। এই বটগোহালী গ্রামেই একটি প্রাচীন জৈন বিহার ছিল। পাহাড়পুর বিহার খননকালে একটি পান্ডুলিপি পাওয়া যায়।

এই লিপি থেকে জানা যায়, এক ব্রাহ্মণ দম্পতি কর্তৃক বটগোহালীতে অবস্থিত একটি জৈন বিহারের ‘অইত’ পূজা ও একটি বিশ্রামাগারের জন্য কিছু জমি দান করা হয়েছিল। এই জৈন বিহারের প্রধান ছিলেন বিখ্যাত জৈন গুরু গুহ নন্দী । সেই মন্দিরে তাঁর বহু শিষ্য-প্রশিষ্য বসবাস করতেন।

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে জৈন বিহারটি যে একটি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ছিল, যার পা-ুলিপিটি তা প্রমাণ করে। এখানে এখনো যে কোন জায়গার মাটি খুঁড়লে প্রাচীন ইটের অনেক প্রাচুর্য পাওয়া যায়। এই গ্রামে এখনো রয়েছে কালো পাথর। কালের বিবর্তনে সেই গ্রামে আজ প্রাচীন ইট বা কালো পাথর থাকলেও নেই সেই আদি গ্রামের নাম। কেউ জানে না সেই নামে এই গ্রাম ছিলো।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বদলগাছীর পাহাড়পুরের উত্তর দিকে অবস্থিত গোয়ালভিটা গ্রামে বাঁশঝাড়ের নিচে ইটের প্রাচুর্য । গ্রামেই রয়েছে কালো বৃহ?্ৎ আকৃতির পাথর। প্রাচীন বটগোহালী গ্রাম আর বর্তমানের গোয়ালভিটা গ্রামের বিভিন্ন মানুষেরা জানিয়েছেন কিংবদন্তির বিভিন্ন গল্প।

এই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা তোফা বলেন, আজকের গোয়ালভিটা গ্রামটিই যে বটগোহালী গ্রাম সেটা শুনেছি। এখানে একটি জৈন? মন্দির থাকার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই গ্রামের মাটির নিচে রয়েছে প্রচুর ইট। সেগুলো হয়তো সেই জৈন মন্দিরের ইট।

গোয়ালভিটা গ্রামের মোস্তফা বলেন, বটগোহালী গ্রামের নাম আমি প্রথম শুনলাম, ইতিপূর্বে আমি শুনিনি। তবে এই গ্রামের মাটির নিচে রয়েছে শুধু ইট আর ইট। বেশি দূর খনন করা যায় না। অনেকেই এই ইট দিয় বাড়ীর প্রাচীর তৈরি করেছে।

একই গ্রামের জহুরুল(৬০) বলেন, হ?্যাঁ শুনেছি এই গ্রামের নাম ছিলো বটগোহালী। তবে কত বছর আগে এই গ্রামের নাম পরিবর্তন করে গোয়ালভিটা হয়েছে সেটি তাঁর জানা নেই। আরেক ব্যক্তি আফতাব হোসেন বলেন, বটগোহালী গ্রাম হতে পারে। কিন্তু আজকে এর নাম গোয়ালভিটা। এই গোয়ালভিটাতেই পাহাড়পুর বাজার। এই গ্রামে মাটির উপরে এখনো কালো পাথর আছে। আমার দাদারা গল্প করতো এখানে মসজিদের সামনে দুটি পাথর ছিলো। স্থানীয় লোকজন এই পাথরের উপর বসে ওজু করতো। কিছু বিদেশি লোকজন সেই মসজিদের পাথর রিসার্চ করতে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে লোক মুখে শোনাযায় সেই পাথর দুটি নাকি সোনার পাথর ছিল।

প্রাচীন বটগোহালী গ্রামের বিষয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক রাজ্জাক আহমেদর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, পাহাড়পুর খননকালে পঞ্চম আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদের শাসনকালের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। সেই মুদ্রা থেকে ধারণা করা যায় বাগদাদের সঙ্গে পাহাড়পুরের যোগাযোগ ব?্যবস্থা ছিল। সেই সময় মানুষ নদী ও সমুদ্র পথে যাতায়াত করত। গ্রামে একটি বিল আছে। এই বিল সেই আমলের নূর নদী। এই নূর নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে বাগদাদে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল। তিনি আরো বলেন সোমপুর বিহারের নিচে আরো ইতিহাস দাফন আছে যা খনন করলে জানা যাবে।

এ ব?্যাপারে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কাষ্টডিয়ান ফজলুল হক আরজু বলেন, এই নামে কোন গ্রাম আছে কিনা জানিনা। আমার চাকরি এখানে বেশি দিন হয়নি। তবে বিহারের গেটর উওর দিকে ছিল তা আমি জেনেছি। এ ব?্যাপারে পূর্বের কাস্টডিয়ান বলতে পারবে।

এ বিষয়ে ১৯৯০ সালে দায়িত্বে থাকা কাস্টডিয়ান মাহবুব আলম বলেন, সোমপুর বিহার আজ পাহাড়পুর নামে পরিচয় পেয়েছে। খননকালে পাহাড়পুরের নিচে আরো বিহার আছে বলে জানা গেছে। অন?্য এক বিহারের উপর আজকের পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। বটগোহালী গ্রামের নাম বললে তিনি বলেন, আজকের গোয়ালভিটা গ্রামই হয়তো বটগোহালী গ্রাম। এই গ্রামের নিচে প্রাচীনতম সভ?্যতা বিদ?্যমান রয়েছে। গ্রামের মাটি খনন করলে পুরনো ইট পাওয়া যায়।

এ ব?্যাপারে বগুড়া আঞ্চলিক প্রতœতত্ব কর্মকর্তা নাহিদ সুলতানা বলেন, আমরা ২০০৭ সালে কিছু খনন কাজ করেছি। পাহাড়পুরের নিচে আরো একটি বিহার থাকার সম্ভাবনা বয়েছে। তবে ঐ স্থানে নতুন করে খনন করলে আরো ইতিহাস বের হবে।