কলম্বোয় কারফিউ, বিক্ষোভকারীদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখল
চরম সংকটপূর্ণ অবস্থায় শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপাকসে মালদ্বীপে পালিয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার। ‘আইনশৃঙ্খলা ফেরাতে রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার’ নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গণবিক্ষোভের মধ্যে কলম্বোতেও কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির দুটি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
জরুরি অবস্থা জারি
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, রাজধানী কলম্বোতেও কারফিউ জারি করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ থামাতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কলম্বো গেজেটের খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে নিরাপত্তা বাহিনীকে দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার করার এবং যে লরিগুলোতে ভ্রমণ করছেন তা জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে কলম্বোর ফ্লাওয়ার রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে। বিপুল সংখ্যক মানুষ গল ফেস থেকে অবস্থানে পৌঁছে বিক্ষোভ দেখায়। তারা রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি জানান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েন করা হয়।
রনিল বিক্রমাসিংহে
ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট
গতকাল বিবিসি অনলাইনে শ্রীলঙ্কার চলমান অস্থিরতা নিয়ে দেয়া লাইভ আপডেটে জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার। শ্রীলঙ্কার স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে বলেন, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে তাকে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিতে। সংবিধানের ৩৭ ধারার ১ অনুচ্ছেদের আওতায় এই নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৩০ দিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক মুখপাত্র জানান, শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
‘শৃঙ্খলা ফেরাতে’ নির্দেশ
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশকে ‘আইনশৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার’ নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আক্রমণ করার পর টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণে তিনি এই নির্দেশ দেন। লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিক্ষোভকারীরা ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে আমাকে বিরত রাখতে চায়। তিনি আরও বলেন, আমরা ফ্যাসিবাদীদের ক্ষমতা দখল করতে দিতে পারি না।
শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের কার্যক্রম বন্ধ
রাজধানী জুড়ে তুমুল গণবিক্ষোভের মধ্যে গতকাল দেশটির দুটি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল রুপাভিহিনি। গতকাল দুপুর নাগাদ চ্যানেলটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সম্প্রচার প্রকৌশলীরা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হয়। এর পরপরই চ্যানেলটির দপ্তরে বিক্ষোভকারীরা ঢুকে যায়। বিবিসি আরও জানায়, ঘটনার ঘণ্টাখানেক পর শ্রীলঙ্কার আরেকটি রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এই চ্যানেলের নাম ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানা য়ায়নি।
সামরিক প্লেনে পালালেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট
বেসামরিক প্লেন ও সমুদ্রপথে চেষ্টার পর অবশেষে সামরিক প্লেনে করে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। গত শনিবার বিক্ষোভকারীরা বাসভবনে ঢুকে পড়ার পর থেকেই পালিয়ে ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট। পালানো অবস্থাতেই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্টের ভাই ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বসিল রাজাপাকসেও দেশ ছেড়েছেন বলে জানতে পেরেছে বিবিসি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
৭৩ বছর বয়সী এই নেতা স্থানীয় সময় গতকাল রাত ৩টার দিকে মালদ্বীপের রাজধানী মালে পৌঁছান। এ সময় গোতাবায়া রাজাপাকসের সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ও দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তা। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার বিমানবাহিনীর একটি প্লেনে দেশ ছাড়েন রাজাপাকসে। এর মধ্য দিয়ে গত কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতায় থাকা রাজাপাকসে পরিবারের পতন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডেইলি মিররের এক খবরে এ কথা বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার রাতে দেশ ছেড়ে পালান শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। সেখান থেকে তার সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখল
গণআন্দোলনের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যাওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখলে নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। ওই কার্যালয়ের সামনে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশের পর আনন্দে, উল্লাসে ফেটে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। এ সময় পালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং প্রধানমন্ত্রী রণিলের বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে থাকে তারা। কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ ড্রাম বাজাতে শুরু করে। এ সময় বাইরে থাকা বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার পতাকা উড়াতে থাকে।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশের সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি গল ফেস গ্রিন থেকে প্রায় ২০ মিনিটের হাঁটাপথ দূরত্বে ফ্লাওয়ার রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে ছোড়ে।
কলম্বোতে বিবিসির এক সংবাদদাতা জানিয়েছেন, বিক্রমাসিংহের সর্বশেষ বিবৃতির ফলে রাজধানী কলম্বোতে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা জোরদার করা হতে পারে। আরও জানা যায়, চরম উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে তার দপ্তরে নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পক্ষ থেকে সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি এবং পশ্চিম প্রদেশে কারফিউ জারির পাশাপাশি কিছু আদেশ জারি করেছেন রনিল বিক্রমাসিংহে।
স্বাধীনতার পর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কা। বৈদেশিক মূদ্রার তীব্র সংকটের কারণে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না দেশটি। এক সময়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশটিতে চলছে খাদ্য সংকট। জ্বালানি তেল কিনতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে মৃত্যুও হয়েছে কয়েকজনের। ওষুধসহ নিত্যপণ্যের সংকটে জনজীবন বিপর্যস্ত। দেশের এ পরিস্থিতির জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার পরিবারকে দায়ী করে আসছে শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীরা। গত দুই দশক ধরে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির ক্ষমতায় রয়েছে রাজাপাকসে পরিবার, যাদের উৎখাতে এবার উঠেপড়ে লেগেছে হাজারো বিক্ষোভকারী।
ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মুখে পড়ে দেশটি বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধেও ব্যর্থ হয়েছে। এস শশীধরন নামে ৩০ বছর বয়সী এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘আমরা চাই রনিল পদত্যাগ করুক। যারা গোতাকে পালাতে সাহায্য করেছে তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করুন। আমরা আমাদের চুরি হওয়া টাকা ফেরত চাই।’
এর আগে, গত মেতে সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, তিনি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বড় ভাই।
নিজেদের বৈদেশিক ঋণ খেলাপি ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ পরিশোধ করার কথা। এই ঋণের চলতি বছরের কিস্তি স্থগিত করেছে দেশটি। বর্তমানে দেশটির মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
কলম্বো : বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কার্নিশে উঠে শ্রীলঙ্কার পতাকা উড়িয়ে উল্লাস করে
আরও খবরবৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই ২০২২ , ৩০ আষাঢ় ১৪২৯ ১৫ জিলহজ ১৪৪৩
কলম্বোয় কারফিউ, বিক্ষোভকারীদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখল
সংবাদ ডেস্ক
কলম্বো : বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কার্নিশে উঠে শ্রীলঙ্কার পতাকা উড়িয়ে উল্লাস করে
চরম সংকটপূর্ণ অবস্থায় শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপাকসে মালদ্বীপে পালিয়ে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার। ‘আইনশৃঙ্খলা ফেরাতে রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার’ নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গণবিক্ষোভের মধ্যে কলম্বোতেও কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির দুটি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
জরুরি অবস্থা জারি
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, রাজধানী কলম্বোতেও কারফিউ জারি করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ থামাতে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কলম্বো গেজেটের খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে নিরাপত্তা বাহিনীকে দাঙ্গাবাজদের গ্রেপ্তার করার এবং যে লরিগুলোতে ভ্রমণ করছেন তা জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে কলম্বোর ফ্লাওয়ার রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে। বিপুল সংখ্যক মানুষ গল ফেস থেকে অবস্থানে পৌঁছে বিক্ষোভ দেখায়। তারা রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি জানান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েন করা হয়।
রনিল বিক্রমাসিংহে
ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট
গতকাল বিবিসি অনলাইনে শ্রীলঙ্কার চলমান অস্থিরতা নিয়ে দেয়া লাইভ আপডেটে জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার। শ্রীলঙ্কার স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেবর্ধনে বলেন, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে তাকে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিতে। সংবিধানের ৩৭ ধারার ১ অনুচ্ছেদের আওতায় এই নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৩০ দিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক মুখপাত্র জানান, শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
‘শৃঙ্খলা ফেরাতে’ নির্দেশ
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশকে ‘আইনশৃঙ্খলা ফেরাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার’ নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আক্রমণ করার পর টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণে তিনি এই নির্দেশ দেন। লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিক্ষোভকারীরা ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে আমাকে বিরত রাখতে চায়। তিনি আরও বলেন, আমরা ফ্যাসিবাদীদের ক্ষমতা দখল করতে দিতে পারি না।
শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের কার্যক্রম বন্ধ
রাজধানী জুড়ে তুমুল গণবিক্ষোভের মধ্যে গতকাল দেশটির দুটি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল রুপাভিহিনি। গতকাল দুপুর নাগাদ চ্যানেলটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সম্প্রচার প্রকৌশলীরা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে হয়। এর পরপরই চ্যানেলটির দপ্তরে বিক্ষোভকারীরা ঢুকে যায়। বিবিসি আরও জানায়, ঘটনার ঘণ্টাখানেক পর শ্রীলঙ্কার আরেকটি রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এই চ্যানেলের নাম ও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানা য়ায়নি।
সামরিক প্লেনে পালালেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট
বেসামরিক প্লেন ও সমুদ্রপথে চেষ্টার পর অবশেষে সামরিক প্লেনে করে দেশ ছেড়ে মালদ্বীপে পালিয়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। গত শনিবার বিক্ষোভকারীরা বাসভবনে ঢুকে পড়ার পর থেকেই পালিয়ে ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট। পালানো অবস্থাতেই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। প্রেসিডেন্টের ভাই ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বসিল রাজাপাকসেও দেশ ছেড়েছেন বলে জানতে পেরেছে বিবিসি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন।
৭৩ বছর বয়সী এই নেতা স্থানীয় সময় গতকাল রাত ৩টার দিকে মালদ্বীপের রাজধানী মালে পৌঁছান। এ সময় গোতাবায়া রাজাপাকসের সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী ও দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তা। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার বিমানবাহিনীর একটি প্লেনে দেশ ছাড়েন রাজাপাকসে। এর মধ্য দিয়ে গত কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতায় থাকা রাজাপাকসে পরিবারের পতন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডেইলি মিররের এক খবরে এ কথা বলা হয়েছে, গত মঙ্গলবার রাতে দেশ ছেড়ে পালান শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। সেখান থেকে তার সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখল
গণআন্দোলনের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যাওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখলে নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। ওই কার্যালয়ের সামনে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশের পর আনন্দে, উল্লাসে ফেটে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। এ সময় পালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং প্রধানমন্ত্রী রণিলের বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে থাকে তারা। কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ ড্রাম বাজাতে শুরু করে। এ সময় বাইরে থাকা বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার পতাকা উড়াতে থাকে।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রবেশের সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি গল ফেস গ্রিন থেকে প্রায় ২০ মিনিটের হাঁটাপথ দূরত্বে ফ্লাওয়ার রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে ছোড়ে।
কলম্বোতে বিবিসির এক সংবাদদাতা জানিয়েছেন, বিক্রমাসিংহের সর্বশেষ বিবৃতির ফলে রাজধানী কলম্বোতে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা জোরদার করা হতে পারে। আরও জানা যায়, চরম উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে তার দপ্তরে নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের পক্ষ থেকে সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি এবং পশ্চিম প্রদেশে কারফিউ জারির পাশাপাশি কিছু আদেশ জারি করেছেন রনিল বিক্রমাসিংহে।
স্বাধীনতার পর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত ২ কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কা। বৈদেশিক মূদ্রার তীব্র সংকটের কারণে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধসহ প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না দেশটি। এক সময়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশটিতে চলছে খাদ্য সংকট। জ্বালানি তেল কিনতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে মৃত্যুও হয়েছে কয়েকজনের। ওষুধসহ নিত্যপণ্যের সংকটে জনজীবন বিপর্যস্ত। দেশের এ পরিস্থিতির জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার পরিবারকে দায়ী করে আসছে শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীরা। গত দুই দশক ধরে এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির ক্ষমতায় রয়েছে রাজাপাকসে পরিবার, যাদের উৎখাতে এবার উঠেপড়ে লেগেছে হাজারো বিক্ষোভকারী।
ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মুখে পড়ে দেশটি বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধেও ব্যর্থ হয়েছে। এস শশীধরন নামে ৩০ বছর বয়সী এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘আমরা চাই রনিল পদত্যাগ করুক। যারা গোতাকে পালাতে সাহায্য করেছে তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করুন। আমরা আমাদের চুরি হওয়া টাকা ফেরত চাই।’
এর আগে, গত মেতে সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, তিনি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বড় ভাই।
নিজেদের বৈদেশিক ঋণ খেলাপি ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ পরিশোধ করার কথা। এই ঋণের চলতি বছরের কিস্তি স্থগিত করেছে দেশটি। বর্তমানে দেশটির মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।