আ’লীগের বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টি, বিরক্ত রওশন

এক যুগের বেশি আওয়ামী লীগের ঘরে থেকে এখন বেরিয়ে যেতে চাইছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। সম্প্রতি জাপার শীর্ষ নেতাদের সরকারবিরোধী বক্তব্য এবং সর্বশেষ ইভিএম নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অবস্থান এরই আভাস বলে মনে করছেন জাপা এবং অন্য একাধিক দলের রাজনীতিবিদরা। এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাপার এই অবস্থানকে নিজেদের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছে বিএনপি।

প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে ছোট ভাই জিএম কাদের এবং স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে বিবাদ ছিল। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে এক সময় রওশন এরশাদ আপোষ-মীমাংসা করে জিএম কাদেরকে দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এ প্রসঙ্গে রওশন ঘনিষ্ট জাপার এক নেতা সংবাদকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে ভাঙতে চাননি ম্যাডাম (রওশন এরশাদ)। দলে ঐক্য থাকলে শক্তি থাকবে। ম্যাডাম বলেন, জাতীয় পার্টি উনার (এইচএম এরশাদ) সন্তানের মতো, সন্তানের মতোই উনি ভালবাসতেন পার্টিকে। পার্টি টিকে থাকলে, জনগণের মনের মাঝে উনি (এরশাদ) বেঁচে থাকবেন, এই ভাবনা থেকেই আপোষ করেছেন ম্যাডাম।’

প্রয়াত সামরিক শাসক এরশাদের উত্তরসূরী হিসেবে স্ত্রী রওশন দলের নেতৃত্বে আসবেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে তৃণমূল কর্মীদের জোরালো সমর্থন ছিল। রওশন শেষ পর্যন্ত আপোষের মধ্য দিয়ে দলের নেতৃত্বে ছেড়ে দিলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার পদ হাতে রেখেছেন। ছেলে সাদ এরশাদকে (রাহগির আলমাহি এরশাদ) রংপুর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য করেছেন, দলের যুগ্ম মহাসিব পদেও রেখেছেন। এটি ছিল প্রয়াত এইচএম এরশাদের আসন।

জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা এখন বলছে, তারা কারো সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচন করবে না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাপা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসন ব্যবস্থাকে স্বৈরশাসনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার অভিযোগ, ‘দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। একদলীয় স্বৈরশাসন চালু ব্যবস্থা চলছে। আর সংবিধানকে কাটাকাটি করে স্বৈরতন্ত্রকে বৈধতা দেয়া হয়েছে।’

জাতীয় পার্টি আগামীতে কারও ‘ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার হবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটের বিষয়ে আগ্রহী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নিজে এই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আগ্রহের কারণে তার জোট শরিকরাও ইভিএমে আগ্রহ দেখিয়েছে। কারণ ১৪ দলের শীর্ষ নেতাও শেখ হাসিনা। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে মতবিনিময়ে ইভিএমের নানা দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করলেও জোটের শরিক নেতারা আগামী নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি। তাবে বাদ সেঁধেছে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টি। ইসিকে তারা জানিয়েছে, তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার চায় না। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্তেই ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া হয়েছে বলে ইসির মতবিনিময় সভায় জানিয়েছেন জাপা মহাসচিব কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু।

জাপার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহল জাতীয় পার্টির সঙ্গে ঐক্য করতে চাইছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাপা থেকে বিএনপিতে যোগ দেয়া এবং বিএনপি থেকে জাপায় যাওয়া জ্যেষ্ঠ কিছু নেতার মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ আছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে ভোট করার বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত আছে।

রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে গত দুই দশকে জোটগত নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জোটগত ভোটের সুবিধা পায় বিএনপি। জামায়াত এবং আরও কয়েকটি ধর্মীয় দলকে নিয়ে চার দলীয় জোট করে তারা সংসদে বড় সংখ্যাগড়িষ্ঠতা অর্জন করে।

এরপর নবম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এবং কিছু বাম দলকে নিয়ে মহাজোট গঠন করে ভোট করে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মহাজোট সংসদীয় ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৩ আসনে জয়ী হয়। জোটগত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বাড়ে তখন থেকেই। সরকারি দলের অংশ হিসেবে মন্ত্রিসভায় জাপার সদস্যদের স্থান দেয়া হয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো ওই নির্বাচন বর্জন করে। সংসদীয় ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়সহ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও তাদের সমমনা দলগুলো মিলেমিশে প্রায় সবকটি আসনে বিজয়ী হয়। দশম সংসদে জাপাকে বিরোধী দল করা হলেও মেয়াদের ৫ বছরে তারা সরকারপন্থীর মতোই আচরণ করে।

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান আদালতের রায়ে দ-প্রাপ্ত হওয়ায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াত আদালতের আদেশে নিবন্ধন হারিয়ে ওই নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে ভোট করতে পারেনি। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটে বিএনপির ফল বিপর্যয় ঘটে। যদিও বিএনপি এবং আরও বেশ কিছু দল ওই নির্বাচনে ‘ব্যাপক কারচুপির’ অভিযোগ তোলে।

আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। মহাজোটের সঙ্গী হিসেবে জাপা শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ছিল। তবে আওয়ামী লীগ পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির নেতাদের না রাখায় দলটির (জাপা) মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এইচএম এরশাদের মৃত্যুর পর জাপা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। পরে আপোষের মধ্য দিয়ে জিএম কাদের দায়িত্ব পান, রওশন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

এর মধ্যে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক (বিদিশা এরশাদ) নিজেকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে জাতীয় পার্টিতে শুরু হয় নতুন আলোচনা। বিদিশার অভিযোগ, জিএম কাদের দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো দল পরিচালনা করছেন। ভবিষ্যতে পার্টির ‘অস্তিত্ব বাঁচাতে’ তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ‘দায়িত্ব দেয়া হয়েছে’। এতে রওশন এরশাদের সম্মতি আছে বলেই দাবি বিদিশার। এ ঘটনায় জাপার রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। বিদিশা সংবাদকে বলেন, ‘জিএম কাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট করবেন বলে চূড়ান্ত করেছেন। জাপার অনেক নেতা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। তবে তারা এখন মুখ খুলছেন না।’ জাতীয় পার্টির দায়িত্ব নেয়ার বিষয়ে তার পক্ষে সরকারের সমর্থন আছে বলেও দাবি করেন বিদিশা।

বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন রওশনের অসুস্থ শরীর নিয়ে ‘হঠাৎ’ বাংলাদেশে আসা এবং জাপার বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে নতুন প্রশ্ন দেখা দেয়। গত ২৭ জুন ব্যাংকক থেকে ঢাকায় এসে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে ওঠেন রওশন। সংসদের বাজেট অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি ঢাকা এসেছেন বলে জানান তার ঘনিষ্ঠজনরা। ২ জুন ওয়েস্টিনে জাপার ব্যানারে এক মতবিনিময় সভার ডাক দেন রওশন।

প্রেসিডিয়ামের সব সদস্য, দলীয় সংসদ সদস্য ও দলের সাবেক সংসদ সদস্যদের (এমপি) আমন্ত্রণ জানানো হলেও প্রেসিডিয়ামের দুইজন সদস্য ছাড়া আর কেউ রওশনের সেই সভায় যাননি, দলের বর্তমান এমপিরাও কেউ যাননি।

জাপার প্রেসিডিয়ামের দুই সদস্য হাবিবুর রহমান হবি ও কারী হাবিবুল্লাহ বেলালী এবং সংসদ সদস্যদের মধ্যে শুধু রওশনপুত্র সাদ এরশাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, রওশন যখন কিছু নেতাকর্মী নিয়ে মতবিনিময় সভা করছিলেন তখন জিএম কাদেরসহ দলটি অন্যান্য নেতা ও সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই বনানী কার্যালয়ে ছিলেন। ওই সভায় রওশন অভিযোগ করে বলেন, ‘জাপায় স্বৈরতন্ত্র চলছে’। দীর্ঘদিন বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকাকালে জাপার বর্তমান নেতারা তার খোঁজ নেয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। জিএম কাদের দায়িত্বে আসার পর যেসব নেতাদের দল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, তারাই রওশনের খোঁজ নিয়েছেন, দেখতে গিয়েছেন বলেও জানান এরশাদপতœী।

কাজী জাফর, শাহ্ মোয়াজ্জেম, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ প্রয়াত ও বর্তমান কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে স্মরণ করে ‘দলছুট’ নেতাদের পুনরায় দলে ফিরিয়ে আনার আগ্রহ প্রকাশ করেন রওশন। তিনি বলেন, এরশাদ থাকলে জাপার অবস্থা ‘এমন হতো না’। জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করতে যা প্রয়োজন তিনি সবই করবেন বলেও জানান।

এদিকে রওশন এরশাদকে আবার দলের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন এরশাদের আরেক ছেলে এরিক এরশাদ। মা বিদিশার সঙ্গে হোটেল ওয়েস্টিনে গিয়ে এরিক তার ‘বড় মা’ রওশনকে এ অনুরোধ জানান। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ‘সরকার বিরোধী জোটে যাওয়ার’ নেপথ্য পরিকল্পনার বিষয়ে জাপার বর্তমান নেতৃত্বকে ‘হুঁশিয়ার করতেই’ রওশনের হঠাৎ ঢাকা সফর কি না, এ নিয়ে দলে ও দলের বাইরে আলোচনা রয়েছে।

এদিকে রওশনের ঢাকা আগামনকে স্বাগত না জানালেও ব্যাংকক ফিরে যাওয়ার দিন জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপার অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতা বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এরশাদের জাতীয় পার্টির ‘কিছু রিজার্ভ ভোট সারাদেশেই আছে’। আর উত্তরবঙ্গের বেশকিছু আসনে জাপা যে দলের সঙ্গী হবে, তাদের জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে জাপা ‘অন্যতম ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর’ হবে। তাই আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুটো দলই জাপাকে জোটসঙ্গী করতে চাইবে।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই ২০২২ , ৩০ আষাঢ় ১৪২৯ ১৫ জিলহজ ১৪৪৩

আ’লীগের বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টি, বিরক্ত রওশন

ফয়েজ আহমেদ তুষার

এক যুগের বেশি আওয়ামী লীগের ঘরে থেকে এখন বেরিয়ে যেতে চাইছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। সম্প্রতি জাপার শীর্ষ নেতাদের সরকারবিরোধী বক্তব্য এবং সর্বশেষ ইভিএম নিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অবস্থান এরই আভাস বলে মনে করছেন জাপা এবং অন্য একাধিক দলের রাজনীতিবিদরা। এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাপার এই অবস্থানকে নিজেদের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছে বিএনপি।

প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের নেতৃত্ব নিয়ে ছোট ভাই জিএম কাদের এবং স্ত্রী রওশন এরশাদের মধ্যে বিবাদ ছিল। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে এক সময় রওশন এরশাদ আপোষ-মীমাংসা করে জিএম কাদেরকে দলের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এ প্রসঙ্গে রওশন ঘনিষ্ট জাপার এক নেতা সংবাদকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টিকে ভাঙতে চাননি ম্যাডাম (রওশন এরশাদ)। দলে ঐক্য থাকলে শক্তি থাকবে। ম্যাডাম বলেন, জাতীয় পার্টি উনার (এইচএম এরশাদ) সন্তানের মতো, সন্তানের মতোই উনি ভালবাসতেন পার্টিকে। পার্টি টিকে থাকলে, জনগণের মনের মাঝে উনি (এরশাদ) বেঁচে থাকবেন, এই ভাবনা থেকেই আপোষ করেছেন ম্যাডাম।’

প্রয়াত সামরিক শাসক এরশাদের উত্তরসূরী হিসেবে স্ত্রী রওশন দলের নেতৃত্বে আসবেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে তৃণমূল কর্মীদের জোরালো সমর্থন ছিল। রওশন শেষ পর্যন্ত আপোষের মধ্য দিয়ে দলের নেতৃত্বে ছেড়ে দিলেও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার পদ হাতে রেখেছেন। ছেলে সাদ এরশাদকে (রাহগির আলমাহি এরশাদ) রংপুর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য করেছেন, দলের যুগ্ম মহাসিব পদেও রেখেছেন। এটি ছিল প্রয়াত এইচএম এরশাদের আসন।

জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা এখন বলছে, তারা কারো সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে নির্বাচন করবে না। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাপা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসন ব্যবস্থাকে স্বৈরশাসনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার অভিযোগ, ‘দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। একদলীয় স্বৈরশাসন চালু ব্যবস্থা চলছে। আর সংবিধানকে কাটাকাটি করে স্বৈরতন্ত্রকে বৈধতা দেয়া হয়েছে।’

জাতীয় পার্টি আগামীতে কারও ‘ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার হবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটের বিষয়ে আগ্রহী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নিজে এই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই আগ্রহের কারণে তার জোট শরিকরাও ইভিএমে আগ্রহ দেখিয়েছে। কারণ ১৪ দলের শীর্ষ নেতাও শেখ হাসিনা। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে মতবিনিময়ে ইভিএমের নানা দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করলেও জোটের শরিক নেতারা আগামী নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহারের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেননি। তাবে বাদ সেঁধেছে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টি। ইসিকে তারা জানিয়েছে, তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার চায় না। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্তেই ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া হয়েছে বলে ইসির মতবিনিময় সভায় জানিয়েছেন জাপা মহাসচিব কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু।

জাপার এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নীতিনির্ধারণী মহল জাতীয় পার্টির সঙ্গে ঐক্য করতে চাইছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাপা থেকে বিএনপিতে যোগ দেয়া এবং বিএনপি থেকে জাপায় যাওয়া জ্যেষ্ঠ কিছু নেতার মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ আছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে ভোট করার বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত আছে।

রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে গত দুই দশকে জোটগত নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে জোটগত ভোটের সুবিধা পায় বিএনপি। জামায়াত এবং আরও কয়েকটি ধর্মীয় দলকে নিয়ে চার দলীয় জোট করে তারা সংসদে বড় সংখ্যাগড়িষ্ঠতা অর্জন করে।

এরপর নবম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এবং কিছু বাম দলকে নিয়ে মহাজোট গঠন করে ভোট করে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে মহাজোট সংসদীয় ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৩ আসনে জয়ী হয়। জোটগত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব বাড়ে তখন থেকেই। সরকারি দলের অংশ হিসেবে মন্ত্রিসভায় জাপার সদস্যদের স্থান দেয়া হয়।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো ওই নির্বাচন বর্জন করে। সংসদীয় ১৫৩ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়সহ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও তাদের সমমনা দলগুলো মিলেমিশে প্রায় সবকটি আসনে বিজয়ী হয়। দশম সংসদে জাপাকে বিরোধী দল করা হলেও মেয়াদের ৫ বছরে তারা সরকারপন্থীর মতোই আচরণ করে।

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান আদালতের রায়ে দ-প্রাপ্ত হওয়ায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি। বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াত আদালতের আদেশে নিবন্ধন হারিয়ে ওই নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে ভোট করতে পারেনি। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটে বিএনপির ফল বিপর্যয় ঘটে। যদিও বিএনপি এবং আরও বেশ কিছু দল ওই নির্বাচনে ‘ব্যাপক কারচুপির’ অভিযোগ তোলে।

আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। মহাজোটের সঙ্গী হিসেবে জাপা শুরুতে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ছিল। তবে আওয়ামী লীগ পরবর্তীতে ক্ষমতায় এসে মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টির নেতাদের না রাখায় দলটির (জাপা) মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এইচএম এরশাদের মৃত্যুর পর জাপা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। পরে আপোষের মধ্য দিয়ে জিএম কাদের দায়িত্ব পান, রওশন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।

এর মধ্যে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক (বিদিশা এরশাদ) নিজেকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে জাতীয় পার্টিতে শুরু হয় নতুন আলোচনা। বিদিশার অভিযোগ, জিএম কাদের দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো দল পরিচালনা করছেন। ভবিষ্যতে পার্টির ‘অস্তিত্ব বাঁচাতে’ তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ‘দায়িত্ব দেয়া হয়েছে’। এতে রওশন এরশাদের সম্মতি আছে বলেই দাবি বিদিশার। এ ঘটনায় জাপার রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় শুরু হয়। বিদিশা সংবাদকে বলেন, ‘জিএম কাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট করবেন বলে চূড়ান্ত করেছেন। জাপার অনেক নেতা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। তবে তারা এখন মুখ খুলছেন না।’ জাতীয় পার্টির দায়িত্ব নেয়ার বিষয়ে তার পক্ষে সরকারের সমর্থন আছে বলেও দাবি করেন বিদিশা।

বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন রওশনের অসুস্থ শরীর নিয়ে ‘হঠাৎ’ বাংলাদেশে আসা এবং জাপার বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষাপটে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে নতুন প্রশ্ন দেখা দেয়। গত ২৭ জুন ব্যাংকক থেকে ঢাকায় এসে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে ওঠেন রওশন। সংসদের বাজেট অধিবেশনে যোগ দিতে তিনি ঢাকা এসেছেন বলে জানান তার ঘনিষ্ঠজনরা। ২ জুন ওয়েস্টিনে জাপার ব্যানারে এক মতবিনিময় সভার ডাক দেন রওশন।

প্রেসিডিয়ামের সব সদস্য, দলীয় সংসদ সদস্য ও দলের সাবেক সংসদ সদস্যদের (এমপি) আমন্ত্রণ জানানো হলেও প্রেসিডিয়ামের দুইজন সদস্য ছাড়া আর কেউ রওশনের সেই সভায় যাননি, দলের বর্তমান এমপিরাও কেউ যাননি।

জাপার প্রেসিডিয়ামের দুই সদস্য হাবিবুর রহমান হবি ও কারী হাবিবুল্লাহ বেলালী এবং সংসদ সদস্যদের মধ্যে শুধু রওশনপুত্র সাদ এরশাদ সভায় উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, রওশন যখন কিছু নেতাকর্মী নিয়ে মতবিনিময় সভা করছিলেন তখন জিএম কাদেরসহ দলটি অন্যান্য নেতা ও সংসদ সদস্যদের অধিকাংশই বনানী কার্যালয়ে ছিলেন। ওই সভায় রওশন অভিযোগ করে বলেন, ‘জাপায় স্বৈরতন্ত্র চলছে’। দীর্ঘদিন বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকাকালে জাপার বর্তমান নেতারা তার খোঁজ নেয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। জিএম কাদের দায়িত্বে আসার পর যেসব নেতাদের দল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, তারাই রওশনের খোঁজ নিয়েছেন, দেখতে গিয়েছেন বলেও জানান এরশাদপতœী।

কাজী জাফর, শাহ্ মোয়াজ্জেম, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ প্রয়াত ও বর্তমান কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে স্মরণ করে ‘দলছুট’ নেতাদের পুনরায় দলে ফিরিয়ে আনার আগ্রহ প্রকাশ করেন রওশন। তিনি বলেন, এরশাদ থাকলে জাপার অবস্থা ‘এমন হতো না’। জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করতে যা প্রয়োজন তিনি সবই করবেন বলেও জানান।

এদিকে রওশন এরশাদকে আবার দলের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন এরশাদের আরেক ছেলে এরিক এরশাদ। মা বিদিশার সঙ্গে হোটেল ওয়েস্টিনে গিয়ে এরিক তার ‘বড় মা’ রওশনকে এ অনুরোধ জানান। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ‘সরকার বিরোধী জোটে যাওয়ার’ নেপথ্য পরিকল্পনার বিষয়ে জাপার বর্তমান নেতৃত্বকে ‘হুঁশিয়ার করতেই’ রওশনের হঠাৎ ঢাকা সফর কি না, এ নিয়ে দলে ও দলের বাইরে আলোচনা রয়েছে।

এদিকে রওশনের ঢাকা আগামনকে স্বাগত না জানালেও ব্যাংকক ফিরে যাওয়ার দিন জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপার অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতা বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এরশাদের জাতীয় পার্টির ‘কিছু রিজার্ভ ভোট সারাদেশেই আছে’। আর উত্তরবঙ্গের বেশকিছু আসনে জাপা যে দলের সঙ্গী হবে, তাদের জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে জাপা ‘অন্যতম ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর’ হবে। তাই আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুটো দলই জাপাকে জোটসঙ্গী করতে চাইবে।