দেশি টিভি চ্যানেলগুলোর দর্শক কমছে কেন?

রেজাউল করিম খোকন

বাংলাদেশের টেলিভিশন দর্শক সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। ক্রমেই দর্শক বিদেশি চ্যানেলমুখী হচ্ছেন। আগে এই প্রবণতা শহরাঞ্চলের দর্শকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হলেও এখন গ্রামীণ এলাকার টিভি দর্শকরাও ব্যাপক হারে বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখার প্রতি ঝুঁকছেন। আজকাল আমাদের এখানকার অধিকাংশ দর্শকের মধ্যে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা বেশ চোখে পড়ে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা টিভি সিরিয়ালগুলো দেখতে এদেশের শহরাঞ্চলে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর দর্শক যেমন আগ্রহী, মফস্বল এবং গ্রামেও একই অবস্থা।

বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলের অভাব না থাকলেও এই সময়ের দর্শকদের মন ভরানোর মতো উন্নতমানের উপভোগ্য টিভি সিরিয়াল এবং বিনোদনমূলক টিভি শোর যথেষ্ট অভাব রয়েছেÑএ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। কয়েকটি প্রাইম টিভি চ্যানেল মাঝেমধ্যে মানসম্পন্ন উপভোগ্য ধারাবাহিক নাটক প্রচার করলেও মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের চাপে অতিষ্ঠ দর্শক সেগুলো দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন খুব স্বাভাবিকভাবেই। বিভিন্ন চ্যানেলের ঈদ আয়োজন ঈদের আনন্দ, খুশির মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়ার কথা থাকলেও আনন্দের এ বিশেষ আয়োজন এখন রীতিমতো যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। বিরক্তির উদ্রেক করছে। দেশীয় কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শুদ্ধ বাংলা ভাষাকে হেয় করছে। নতুন প্রজন্মকে জগাখিচুড়ি মার্কা ভাষা, অপসংস্কৃতি শেখানো হচ্ছে। কমেডি নাটকের নামে ভাড়ামি, পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে, বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করে অযথা হাসানোর অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমাদের এখানকার টিভি চ্যানেলের ইদানীংকার গোটা আয়োজনের বেশির ভাগই হয় ভারতীয় টিভি এবং চলচ্চিত্রের অন্ধ অনুকরণ কিংবা বিজাতীয় সংস্কৃতির আদলে।

প্রশ্ন হলো, আমাদের বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে এসব কী হচ্ছে? কেন করা হচ্ছে? কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে ভালো, উন্নতমানের নাটক যে হয় না, তা বলা যাবে না। তবে বিজ্ঞাপনের চাপে সেই ভালো নাটক এক নাগাড়ে মনোযোগ দিয়ে দেখার সুযোগ দেয় না টিভি চ্যানেলগুলো। যতটুকু সময় নাটক দেখানো হয়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সময় ধরে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এ যেন নাটকের ফাঁকে বিজ্ঞাপন নয়, বিজ্ঞাপনের ফাঁকে নাটক প্রচার। এ কারণে দর্শক আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত নাটক দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন খুব সহজেই। স্বাভাবিকভাবে তারা ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালের প্রতি ঝুঁকছেন।

দেশীয় চ্যানেলগুলো ক্রমেই দর্শক হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে পড়ছে, অথচ এ নিয়ে চ্যানেলগুলোর যেন মাথাব্যাথা নেই, তাদের টনক নড়ছে নাÑযা দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। দর্শক হারানোর কারণ খুঁজে বের করে তার প্রতিকারে উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে না কোনো দেশি টিভি চ্যানেলকে। বাংলাদেশের টিভি নাটক এবং ধারাবাহিকের একসময় দারুণ সুনাম এবং বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল, যা দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়েছে বলা চলে। এখন দীর্ঘ দীর্ঘ বিজ্ঞাপন বিরতি দিয়ে বিভিন্ন চ্যানেলে নাটক-ধারাবাহিকের নামে যা দেখানো হয়, তা দেখার মতো ধৈর্য বেশির ভাগ দর্শকেরই নেই। নির্মাণের কাহিনী, দুর্বল অভিনয়, যাচ্ছেতাই নির্মিত, অহেতুক কাহিনীকে টেনে লম্বা করার প্রবণতা দর্শকদের ভিনদেশি সিরিয়াল দেখতে উৎসাহিত করেছেÑবললে অন্যায় হবে না।

একসময়ে বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক এবং ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখার জন্য দর্শক প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে যথাসময়ে ঘরে ফিরতেন, যখন এই ধারাবাহিক নাটক এবং অনুষ্ঠানগুলো দেখানো হতো রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত, অথচ এখন কোন টিভি চ্যানেলে কোন দিন কখন কী নাটক, ধারাবাহিক দেখানো হয় তার খোঁজ রাখেন না বেশির ভাগ দর্শক। এখনও যে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে ভালো নাটক, ধারাবাহিক দেখানো হয় না, তা বলা যাবে না। তবে সেই নাটক কিংবা ধারাবাহিক দেখতে বসে দর্শক ক্রমাগত বিজ্ঞাপনের চাপে পিষ্ট হতে হতে একসময় রিমোটের বোতাম টিপে হাফ ছেড়ে বাঁচেন। বিজ্ঞাপনের আধিক্য দর্শকদের বাংলাদেশি চ্যানেল বিমুখ করে তুলছে। দীর্ঘসময় ধরে একটানা বিজ্ঞাপন প্রচার তো রয়েছেই, তাছাড়া যে কোন খবর বা অনুষ্ঠানের মধ্যে টিভি পর্দায় সেকেন্ডে ভেসে উঠছে নির্বাক বিজ্ঞাপন সিরিজ। টিভিতে নাটক অথবা খবর প্রচারকালীন সময়ে পর্দার চারপাশে অগণিত বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ির ফলে মূল অনুষ্ঠানটি চাপা পড়ে যায়, বিজ্ঞাপন মেলাই মুখ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। বিজ্ঞাপনের এত নির্যাতন সহ্য করে কোনো ভালো বোধসম্পন্ন দর্শক আমাদের দেশি টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান বা খবর দেখতে যাবে কোন দুঃখে? অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রায়ই বলা হয়, ‘এখন আমরা ছোট্ট বিরতিতে যাচ্ছি, খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি, কোথাও যাবেন না’। অথচ বাস্তবতা হলো, ঘোষিত ছোট্ট বিরতি আর ছোট্টটি থাকে না। একটানা ১৫-২০ মিনিট বিজ্ঞাপন প্রচারের উদাহরণ প্রতিদিনই লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন চ্যানেলে। বাধ্য হয়ে দর্শক অন্য চ্যানেলে চোখ রাখেন।

টিভি চ্যানেলের কর্তা ব্যক্তিরা দর্শকদের কী মনে করেন জানি না। তাদের এটা বোঝা উচিত, বিজ্ঞাপনের চাপে দর্শক যত বেশি পিষ্ট হবেন, ততই তারা টিভির অনুষ্ঠানমালা দেখা থেকে দূরে সরে যাবেন। আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অতি বাণিজ্যিক মনোভাব তাদের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনছে। দেশি চ্যানেলগুলোর শোচনীয় ব্যর্থতা আমাদের দর্শকদের মনোযোগ, আগ্রহ কৌতূহলকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে। ফলে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাত্র কয়েকটি বিদেশি টিভি চ্যানেলের কাছে আমাদের প্রায় তিন ডজন চ্যানেলের পরাজয় দুঃখজনক। যে কোন বিবেকবান, দেশ প্রেমিক সচেতন মানুষ তাতে ব্যাথিত, আলোড়িত না হয়ে পারে না। অতি বাণিজ্যিক মানসিকতা ত্যাগ করে দর্শকদের কাছে দেয়া কমিটমেন্ট অনুযায়ী সময়োপযোগী বিনোদন সম্ভার টিভি পর্দায় আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে উৎসাহী দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে আমাদের সিনেমা শিল্পের মতো চরম বিপর্যয় নেমে আসবে টিভি অঙ্গনেও।

একসময়ে অধিকাংশ টিভি চ্যানেল পরিত্যক্ত হিসেবে বিবেচিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দিনে দিনে অনেক নতুন নতুন টিভি চ্যানেল চালু হয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করে গেলেও সব দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না দুর্বল এবং অনুন্নত মানের অনেকগুলো চ্যানেল। এমন অনেক দর্শক রয়েছেন যারা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের মাত্র কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো একেবারেই দেখেন না। এসব চ্যানেলের প্রতি তাদের তেমন আকর্ষণ নেই। অথচ চ্যানেলগুলো নিয়মিতই ধারাবাহিক নাটক, টক শো, সংগীতানুষ্ঠান এবং ঘণ্টায় ঘণ্টায় সংবাদ প্রচার করে যাচ্ছে, যা দেখার মতো দর্শকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তাহলে এখন প্রশ্ন, এতো ঢাকঢোল পিটিয়ে নিত্য নতুন টিভি চ্যানেল চালুর যথার্থতা কোথায়?

এখন চাইলেই দর্শক ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যখন তখন দেশি বিদেশি সব ধরনের সিনেমা দেখতে পারছেন। ফলে তাদের রুচি পছন্দ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখন ঘরোয়া বিনোদনে দর্শকদের বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। কিছুদিন আগেও দর্শক দেশি-বিদেশি বিভিন্ন টিভি চ্যানেল নির্ভর থাকলেও এই মুহূর্তে টিভি যেন দর্শকদের আগের মতো টানতে পারছে না, বরং দর্শক টিভিবিমুখ হয়ে পড়ছেন নানা সঙ্গত কারণে।

দেশি বিদেশি সব টিভি চ্যানেলের কন্টেন্টের বৈচিত্র্যহীনতা, একঘেয়ে পুরোনো ট্র্যাকের গল্প-কাহিনী পরিবেশন, ঘুরে ফিরে কিছু নির্দিষ্ট জনপ্রিয় তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীর পারফরমেন্স সর্বোপরি অনুষ্ঠান প্রচারকালীন সময়ে কিছুক্ষণ পর পর বিজ্ঞাপনের মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা দর্শকদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অনেক দিন ধরেই দর্শক বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্বেচ্ছাচারিতার কবল থেকে মুক্তি পেতে হাসফাঁস করছিলেন। দর্শকদের সেই অবস্থা থেকে বিকল্প ঘরোয়া বিনোদন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ওটিটি (ওভার দ্য টপ) স্বস্তির সুবাতাস বয়ে এনেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দর্শকরা এখন আমাজন প্রাইম ভিডিও, নেটফ্লিক্স, ডিজনি হটস্টার, জি ফাইভ, হইচই, সনি লিভ প্রভৃতি জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নিয়মিতভাবে নিত্যনতুন সিনেমা, ওয়েব সিরিজ এবং অন্যান্য কন্টেট দেখছেন।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই ২০২২ , ৩০ আষাঢ় ১৪২৯ ১৫ জিলহজ ১৪৪৩

দেশি টিভি চ্যানেলগুলোর দর্শক কমছে কেন?

রেজাউল করিম খোকন

বাংলাদেশের টেলিভিশন দর্শক সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। ক্রমেই দর্শক বিদেশি চ্যানেলমুখী হচ্ছেন। আগে এই প্রবণতা শহরাঞ্চলের দর্শকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হলেও এখন গ্রামীণ এলাকার টিভি দর্শকরাও ব্যাপক হারে বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখার প্রতি ঝুঁকছেন। আজকাল আমাদের এখানকার অধিকাংশ দর্শকের মধ্যে ভারতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা বেশ চোখে পড়ে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা টিভি সিরিয়ালগুলো দেখতে এদেশের শহরাঞ্চলে নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর দর্শক যেমন আগ্রহী, মফস্বল এবং গ্রামেও একই অবস্থা।

বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলের অভাব না থাকলেও এই সময়ের দর্শকদের মন ভরানোর মতো উন্নতমানের উপভোগ্য টিভি সিরিয়াল এবং বিনোদনমূলক টিভি শোর যথেষ্ট অভাব রয়েছেÑএ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। কয়েকটি প্রাইম টিভি চ্যানেল মাঝেমধ্যে মানসম্পন্ন উপভোগ্য ধারাবাহিক নাটক প্রচার করলেও মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের চাপে অতিষ্ঠ দর্শক সেগুলো দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন খুব স্বাভাবিকভাবেই। বিভিন্ন চ্যানেলের ঈদ আয়োজন ঈদের আনন্দ, খুশির মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়ার কথা থাকলেও আনন্দের এ বিশেষ আয়োজন এখন রীতিমতো যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। বিরক্তির উদ্রেক করছে। দেশীয় কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শুদ্ধ বাংলা ভাষাকে হেয় করছে। নতুন প্রজন্মকে জগাখিচুড়ি মার্কা ভাষা, অপসংস্কৃতি শেখানো হচ্ছে। কমেডি নাটকের নামে ভাড়ামি, পেটে সুড়সুড়ি দিয়ে, বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করে অযথা হাসানোর অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমাদের এখানকার টিভি চ্যানেলের ইদানীংকার গোটা আয়োজনের বেশির ভাগই হয় ভারতীয় টিভি এবং চলচ্চিত্রের অন্ধ অনুকরণ কিংবা বিজাতীয় সংস্কৃতির আদলে।

প্রশ্ন হলো, আমাদের বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে এসব কী হচ্ছে? কেন করা হচ্ছে? কিছু কিছু টিভি চ্যানেলে ভালো, উন্নতমানের নাটক যে হয় না, তা বলা যাবে না। তবে বিজ্ঞাপনের চাপে সেই ভালো নাটক এক নাগাড়ে মনোযোগ দিয়ে দেখার সুযোগ দেয় না টিভি চ্যানেলগুলো। যতটুকু সময় নাটক দেখানো হয়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সময় ধরে বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এ যেন নাটকের ফাঁকে বিজ্ঞাপন নয়, বিজ্ঞাপনের ফাঁকে নাটক প্রচার। এ কারণে দর্শক আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত নাটক দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন খুব সহজেই। স্বাভাবিকভাবে তারা ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালের প্রতি ঝুঁকছেন।

দেশীয় চ্যানেলগুলো ক্রমেই দর্শক হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে পড়ছে, অথচ এ নিয়ে চ্যানেলগুলোর যেন মাথাব্যাথা নেই, তাদের টনক নড়ছে নাÑযা দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। দর্শক হারানোর কারণ খুঁজে বের করে তার প্রতিকারে উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে না কোনো দেশি টিভি চ্যানেলকে। বাংলাদেশের টিভি নাটক এবং ধারাবাহিকের একসময় দারুণ সুনাম এবং বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল, যা দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়েছে বলা চলে। এখন দীর্ঘ দীর্ঘ বিজ্ঞাপন বিরতি দিয়ে বিভিন্ন চ্যানেলে নাটক-ধারাবাহিকের নামে যা দেখানো হয়, তা দেখার মতো ধৈর্য বেশির ভাগ দর্শকেরই নেই। নির্মাণের কাহিনী, দুর্বল অভিনয়, যাচ্ছেতাই নির্মিত, অহেতুক কাহিনীকে টেনে লম্বা করার প্রবণতা দর্শকদের ভিনদেশি সিরিয়াল দেখতে উৎসাহিত করেছেÑবললে অন্যায় হবে না।

একসময়ে বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক এবং ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখার জন্য দর্শক প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে যথাসময়ে ঘরে ফিরতেন, যখন এই ধারাবাহিক নাটক এবং অনুষ্ঠানগুলো দেখানো হতো রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত, অথচ এখন কোন টিভি চ্যানেলে কোন দিন কখন কী নাটক, ধারাবাহিক দেখানো হয় তার খোঁজ রাখেন না বেশির ভাগ দর্শক। এখনও যে মাঝেমধ্যে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে ভালো নাটক, ধারাবাহিক দেখানো হয় না, তা বলা যাবে না। তবে সেই নাটক কিংবা ধারাবাহিক দেখতে বসে দর্শক ক্রমাগত বিজ্ঞাপনের চাপে পিষ্ট হতে হতে একসময় রিমোটের বোতাম টিপে হাফ ছেড়ে বাঁচেন। বিজ্ঞাপনের আধিক্য দর্শকদের বাংলাদেশি চ্যানেল বিমুখ করে তুলছে। দীর্ঘসময় ধরে একটানা বিজ্ঞাপন প্রচার তো রয়েছেই, তাছাড়া যে কোন খবর বা অনুষ্ঠানের মধ্যে টিভি পর্দায় সেকেন্ডে ভেসে উঠছে নির্বাক বিজ্ঞাপন সিরিজ। টিভিতে নাটক অথবা খবর প্রচারকালীন সময়ে পর্দার চারপাশে অগণিত বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ির ফলে মূল অনুষ্ঠানটি চাপা পড়ে যায়, বিজ্ঞাপন মেলাই মুখ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। বিজ্ঞাপনের এত নির্যাতন সহ্য করে কোনো ভালো বোধসম্পন্ন দর্শক আমাদের দেশি টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান বা খবর দেখতে যাবে কোন দুঃখে? অনুষ্ঠানের ফাঁকে প্রায়ই বলা হয়, ‘এখন আমরা ছোট্ট বিরতিতে যাচ্ছি, খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি, কোথাও যাবেন না’। অথচ বাস্তবতা হলো, ঘোষিত ছোট্ট বিরতি আর ছোট্টটি থাকে না। একটানা ১৫-২০ মিনিট বিজ্ঞাপন প্রচারের উদাহরণ প্রতিদিনই লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন চ্যানেলে। বাধ্য হয়ে দর্শক অন্য চ্যানেলে চোখ রাখেন।

টিভি চ্যানেলের কর্তা ব্যক্তিরা দর্শকদের কী মনে করেন জানি না। তাদের এটা বোঝা উচিত, বিজ্ঞাপনের চাপে দর্শক যত বেশি পিষ্ট হবেন, ততই তারা টিভির অনুষ্ঠানমালা দেখা থেকে দূরে সরে যাবেন। আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর অতি বাণিজ্যিক মনোভাব তাদের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনছে। দেশি চ্যানেলগুলোর শোচনীয় ব্যর্থতা আমাদের দর্শকদের মনোযোগ, আগ্রহ কৌতূহলকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে। ফলে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন প্রকট আকার ধারণ করেছে। মাত্র কয়েকটি বিদেশি টিভি চ্যানেলের কাছে আমাদের প্রায় তিন ডজন চ্যানেলের পরাজয় দুঃখজনক। যে কোন বিবেকবান, দেশ প্রেমিক সচেতন মানুষ তাতে ব্যাথিত, আলোড়িত না হয়ে পারে না। অতি বাণিজ্যিক মানসিকতা ত্যাগ করে দর্শকদের কাছে দেয়া কমিটমেন্ট অনুযায়ী সময়োপযোগী বিনোদন সম্ভার টিভি পর্দায় আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে উৎসাহী দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে হবে। তা না হলে আমাদের সিনেমা শিল্পের মতো চরম বিপর্যয় নেমে আসবে টিভি অঙ্গনেও।

একসময়ে অধিকাংশ টিভি চ্যানেল পরিত্যক্ত হিসেবে বিবেচিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দিনে দিনে অনেক নতুন নতুন টিভি চ্যানেল চালু হয়ে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করে গেলেও সব দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারছে না দুর্বল এবং অনুন্নত মানের অনেকগুলো চ্যানেল। এমন অনেক দর্শক রয়েছেন যারা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলের মাত্র কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো একেবারেই দেখেন না। এসব চ্যানেলের প্রতি তাদের তেমন আকর্ষণ নেই। অথচ চ্যানেলগুলো নিয়মিতই ধারাবাহিক নাটক, টক শো, সংগীতানুষ্ঠান এবং ঘণ্টায় ঘণ্টায় সংবাদ প্রচার করে যাচ্ছে, যা দেখার মতো দর্শকের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। তাহলে এখন প্রশ্ন, এতো ঢাকঢোল পিটিয়ে নিত্য নতুন টিভি চ্যানেল চালুর যথার্থতা কোথায়?

এখন চাইলেই দর্শক ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে যখন তখন দেশি বিদেশি সব ধরনের সিনেমা দেখতে পারছেন। ফলে তাদের রুচি পছন্দ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখন ঘরোয়া বিনোদনে দর্শকদের বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। কিছুদিন আগেও দর্শক দেশি-বিদেশি বিভিন্ন টিভি চ্যানেল নির্ভর থাকলেও এই মুহূর্তে টিভি যেন দর্শকদের আগের মতো টানতে পারছে না, বরং দর্শক টিভিবিমুখ হয়ে পড়ছেন নানা সঙ্গত কারণে।

দেশি বিদেশি সব টিভি চ্যানেলের কন্টেন্টের বৈচিত্র্যহীনতা, একঘেয়ে পুরোনো ট্র্যাকের গল্প-কাহিনী পরিবেশন, ঘুরে ফিরে কিছু নির্দিষ্ট জনপ্রিয় তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীর পারফরমেন্স সর্বোপরি অনুষ্ঠান প্রচারকালীন সময়ে কিছুক্ষণ পর পর বিজ্ঞাপনের মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা দর্শকদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অনেক দিন ধরেই দর্শক বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্বেচ্ছাচারিতার কবল থেকে মুক্তি পেতে হাসফাঁস করছিলেন। দর্শকদের সেই অবস্থা থেকে বিকল্প ঘরোয়া বিনোদন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ওটিটি (ওভার দ্য টপ) স্বস্তির সুবাতাস বয়ে এনেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দর্শকরা এখন আমাজন প্রাইম ভিডিও, নেটফ্লিক্স, ডিজনি হটস্টার, জি ফাইভ, হইচই, সনি লিভ প্রভৃতি জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নিয়মিতভাবে নিত্যনতুন সিনেমা, ওয়েব সিরিজ এবং অন্যান্য কন্টেট দেখছেন।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]