ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত আফগানিস্তান

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

কিছুদিন আগে আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ছয় দশমিক এক মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে খোস্ত প্রদেশ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে; ধ্বংসস্তূপ থেকে ১১০০ মানুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এবং আহত ব্যক্তির সংখ্যাও দেড় হাজারের বেশি। ধ্বংসস্তূপের ভেতর আটকে ছিল শত শত লোক। বুভুক্ষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সামর্থ্যটুকু নেই তালেবান সরকারের, বিধ্বস্ত বাড়িঘরে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করার যন্ত্রপাতিও ছিল না তাদের। অনেক এলাকায় রাস্তা না থাকায় দেশটিতে উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাচ্ছিল না। দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। দেশটিতে সর্বদা খরা, অথচ ভূমিকম্পের এই মারাত্মক দুর্যোগের মধ্যে দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ বন্যা, বন্যার প্রকোপে প্রাণ হারিয়েছে চারশত মানুষ। ক্রমশ প্রতিকূল হচ্ছে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি, সংকটের পর সংকট তৈরি হচ্ছে। তালেবান সরকারের এমন অসহায়ত্ব বিশ্ব বিবেককে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে বলে মনে হয়নি। প্রকৃতির এই দুর্যোগ থেকে আফগান মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য ধনী মুসলিম দেশগুলোরও সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। এর পেছনেও কারণ রয়েছেÑ ইসলাম ধর্ম নিয়ে যত ফেরকা তত ফেরকা অন্য কোন ধর্মে আছে কি না সন্দেহ। তালেবানদের নীতি-আদর্শ অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশ পছন্দ করছে না। অন্যদিকে আফগানিস্তানের ভেতরে আইএস সমর্থিত আফগানেরা তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে অহর্নিশ বোমা ফুটাচ্ছে, তারা তালেবান সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে আইএস এবং তালেবান মিলে যুদ্ধ করেছে।

ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে আফগানিস্তান; অতি দরিদ্র পরিবারগুলো খাবারের জন্য তাদের শিশু সন্তান ও কিডনি বিক্রি করে দিচ্ছে। এমন সংকটময় মুহূর্তে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আফগানিস্তানের হাজার হাজার মানুষ। প্রয়োজন জরুরি মানবিক সহায়তা। আফগান সরকারও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে আহ্বান করেছে। আফগান সরকারের আহ্বানে মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে পাকিস্তান, ইরান, চীন, কুয়েত, জাপান, কোরিয়া, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ। এসবের সমন্বয় করছে ইউনিসেফসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা। তবে যে সহায়তা পাঠানো হচ্ছে, তা বিশাল অভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য একেবারেই অপ্রতুল।

আফগানিস্তানে আছেন একজন ‘ইসলামিক’ রিলিফের প্রধান, নাম মোহাম্মাদ গোলাম সরোয়ার। রিলিফ আসছে ইহুদি, নাসারা, পৌত্তলিক আর নাস্তিকদের দেশ থেকে, এই রিলিফ ‘ইসলামিক রিলিফ’ হয় কী করে! প্রায় ৪০ বছর পূর্বে সাংবাদিক বন্ধু শফিকুল ইসলাম ইউনুসের বিয়েতে যাচ্ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দীন মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি রাস্তার পাশে ‘ইসলামিক ইলেকট্রিক দোকান’ দেখে গাড়ি থামিয়ে দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার দোকানে বিদ্যুতের কোন জিনিসটি ইসলামিক?’ এমন প্রশ্ন শুনে স্বল্প শিক্ষিত দোকানদার হতভম্ব, মনে হলো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন তিনি আগে কখনো হননি। দোকানদার শুধু তাকিয়ে থাকলেন, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, শুভ্র লম্বা দাঁড়ি, টুপি পরা এমন একজন আলেমের কথা দোকানদার কিছু বুঝতে পেরেছে বলে আমার মনে হলো না। বিয়ের আসরে পৌঁছা পর্যন্ত স্যার প্রাসঙ্গিক আরও অনেক কথা বলেছেনÑআমি, ইউনুস আর গাড়ির চালক নীরবে শুনেছি। ‘ইসলামিক রিলিফে’র মতো তালেবান সরকারের ‘পুণ্যের প্রচার এবং পাপের প্রতিরোধ’ মন্ত্রণালয়ও রয়েছে, এই মন্ত্রণালয় থেকে নারীদের ওপর নানাবিধ বিধিনিষেধ এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়ে থাকে।

তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে ত্রাণ তৎপরতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছিল আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো; তাদের অভিযোগ দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ না দিয়ে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তালেবান মতাদর্শের লোকদের। এই অভিযোগ আমাদের দেশসহ ভারত, পাকিস্তানে অহরহ শোনা যায়,- প্রকৃত দুর্গত লোকদের মধ্যে ত্রাণ না দিয়ে দলীয় সমর্থকদের ত্রাণ দিয়ে দেয়ার অভিযোগ অহর্নিশ শুনে আসছি। সমাজ থেকে স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ করা কঠিন, সব রাজনৈতিক দল এবং সব সরকারের আমলেই এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে থাকে। কিন্তু তালেবানেরা তো ইসলামিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত, তাদের এই স্বজনপ্রীতি থাকার কথা নয়। যে রিলিফ নিয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ সেই রিলিফ এসেছে ইহুদি, নাসারা, নাস্তিক এবং পৌত্তলিকদের কাছ থেকে। কোরআন, হাদিসে মুসলিম ব্যতীত অন্য ধর্মের কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে মুসলিমদের নিষেধ করা হয়েছে; অন্য কোন ধর্মাবলম্বীকে বন্ধু করা না গেলে তাদের অনুদান গ্রহণ করা যাবে কি না, তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।

আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলেছে। আমেরিকা এবং ন্যাটোর সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে এক যুগ ধরে তালেবানেরা যুদ্ধ করেছে। আমেরিকা অনবরত ড্রোন হামলা করেও তালেবানদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার সাম্প্রতিক কালের একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি নতুন করে কোন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধাননি, বরং তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যুদ্ধগুলোর ইতি টানার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আফগানিস্তান থেকে সরে আসার জন্য তিনি তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি করেছেন, তালেবানেরা সেই চুক্তি ভঙ্গ করে একতরফা ক্ষমতা দখল করে নেয়। তালেবানদের একতরফা সরকার গঠন আমেরিকাকে ক্রুদ্ধ করে তোলে, আমেরিকা আফগানিস্তানের ৯ বিলিয়ন ডলার আটক করে। আমেরিকার সঙ্গে এক হয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোও আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে এগিয়ে আসেনি।

আফগানিস্তানে ভূমিকম্পের ঘটনা নতুন নয়; ভৌগোলিক কারণেই আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ, ইতোমধ্যে অনেকগুলো ভূমিকম্প হয়ে গেছে, ওই সব ভূমিকম্পে প্রাণহানি হয়েছে অসংখ্য এবং সম্পদ ধ্বংস হয়েছে বিপুল পরিমাণ। তালেবানেরা ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে শরিয়াহ্ আইন চালু করেছে। শরিয়াহ্ আইন নিয়ে নানাবিধ ব্যাখ্যা থাকলেও সব ব্যাখ্যাই নারী সমাজের প্রতি কঠোর এবং বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর শরিয়াহ্ আইনের ব্যাখ্যাগুলো তালেবানেরা গ্রহণ করেছে। প্রবর্তিত শরিয়াহ্ আইন জনজীবন থেকে নারীদের প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, মাহরাম বা অনুমোদিত পুরুষ ছাড়া নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ। এছাড়া মেয়েদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা এবং বার বছরের ঊর্ধ্বে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। নারীদের খেলাধুলায় অংশ নেওয়া হারাম করা হয়েছে। নারী শিক্ষার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ এবং কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করায় নারীদের ক্ষমতা পদ্ধতিগতভাবেই খর্ব হয়ে গেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে নারী শিক্ষা নিয়ে তালেবানদের রক্ষণশীল নীতি। জার্মানি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, তালেবানেরা তাদের অনুসৃত ভুল পথ থেকে সরে না এলে স্বাভাবিক সম্পর্ক হবে না এবং তালেবান সরকারকে স্বীকৃতিও দেওয়া যাবে না।

লাখ লাখ আফগানের হাতে এখন কোন কাজ নেই, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তবে আফগানিস্তানে এমন দুরবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটার ব্যাপারে ধর্মীয় ব্যাখ্যাও রয়েছে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী ভূমিকম্প হলো মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা, ভূমিকম্প দিয়ে আল্লাহ মানুষকে সাবধান করেন, সতর্ক করেন। মনে হচ্ছে, তালেবানদের কর্মকা-ে সৃষ্টিকর্তা নাখোশ; তাই ভূমিকম্প আর বন্যা দিয়ে তাদের সতর্ক ও সাবধান করা হচ্ছে। ধর্মের কথা অনুযায়ী ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে, তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মোনাজাত করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে বাঁচার জন্য আমাদের ইসলাম ধর্মে দান-খয়রাত করার কথাও বলা আছে। কিন্তু তালেবান সরকার নিজেরাই দেউলিয়া, দান খয়রাত করবে কী করে! চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা সমর্থিত আফগান সরকারের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিলে পশ্চিমাদের এত রোষানলে তালেবানদের পড়তে হতো না। তালেবানদের বাঁচার দুটি পথ খোলা আছে; এক-আফগান নারীর শিক্ষা এবং তাদের চলাফেরায় কিছুটা স্বাধীনতা দিয়ে অমুসলিম পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতা করা; দুই-কৃতকর্মের জন্য তালেবানদের অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করা এবং পাপকর্ম থেকে ফিরে আসার ওয়াদা করে বেশি বেশি মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে সমর্পিত হওয়া। অবশ্য ইচ্ছে করলে তারা দুটোই করতে পারে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুলাই ২০২২ , ৩০ আষাঢ় ১৪২৯ ১৫ জিলহজ ১৪৪৩

ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত আফগানিস্তান

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

কিছুদিন আগে আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ছয় দশমিক এক মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে খোস্ত প্রদেশ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে; ধ্বংসস্তূপ থেকে ১১০০ মানুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে এবং আহত ব্যক্তির সংখ্যাও দেড় হাজারের বেশি। ধ্বংসস্তূপের ভেতর আটকে ছিল শত শত লোক। বুভুক্ষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সামর্থ্যটুকু নেই তালেবান সরকারের, বিধ্বস্ত বাড়িঘরে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করার যন্ত্রপাতিও ছিল না তাদের। অনেক এলাকায় রাস্তা না থাকায় দেশটিতে উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাচ্ছিল না। দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। দেশটিতে সর্বদা খরা, অথচ ভূমিকম্পের এই মারাত্মক দুর্যোগের মধ্যে দেখা দিয়েছিল ভয়াবহ বন্যা, বন্যার প্রকোপে প্রাণ হারিয়েছে চারশত মানুষ। ক্রমশ প্রতিকূল হচ্ছে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি, সংকটের পর সংকট তৈরি হচ্ছে। তালেবান সরকারের এমন অসহায়ত্ব বিশ্ব বিবেককে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে বলে মনে হয়নি। প্রকৃতির এই দুর্যোগ থেকে আফগান মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য ধনী মুসলিম দেশগুলোরও সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। এর পেছনেও কারণ রয়েছেÑ ইসলাম ধর্ম নিয়ে যত ফেরকা তত ফেরকা অন্য কোন ধর্মে আছে কি না সন্দেহ। তালেবানদের নীতি-আদর্শ অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশ পছন্দ করছে না। অন্যদিকে আফগানিস্তানের ভেতরে আইএস সমর্থিত আফগানেরা তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে অহর্নিশ বোমা ফুটাচ্ছে, তারা তালেবান সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অথচ ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে আইএস এবং তালেবান মিলে যুদ্ধ করেছে।

ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে আফগানিস্তান; অতি দরিদ্র পরিবারগুলো খাবারের জন্য তাদের শিশু সন্তান ও কিডনি বিক্রি করে দিচ্ছে। এমন সংকটময় মুহূর্তে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আফগানিস্তানের হাজার হাজার মানুষ। প্রয়োজন জরুরি মানবিক সহায়তা। আফগান সরকারও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে আহ্বান করেছে। আফগান সরকারের আহ্বানে মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছে পাকিস্তান, ইরান, চীন, কুয়েত, জাপান, কোরিয়া, বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ। এসবের সমন্বয় করছে ইউনিসেফসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা। তবে যে সহায়তা পাঠানো হচ্ছে, তা বিশাল অভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য একেবারেই অপ্রতুল।

আফগানিস্তানে আছেন একজন ‘ইসলামিক’ রিলিফের প্রধান, নাম মোহাম্মাদ গোলাম সরোয়ার। রিলিফ আসছে ইহুদি, নাসারা, পৌত্তলিক আর নাস্তিকদের দেশ থেকে, এই রিলিফ ‘ইসলামিক রিলিফ’ হয় কী করে! প্রায় ৪০ বছর পূর্বে সাংবাদিক বন্ধু শফিকুল ইসলাম ইউনুসের বিয়েতে যাচ্ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. দীন মোহাম্মদের সঙ্গে। তিনি রাস্তার পাশে ‘ইসলামিক ইলেকট্রিক দোকান’ দেখে গাড়ি থামিয়ে দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার দোকানে বিদ্যুতের কোন জিনিসটি ইসলামিক?’ এমন প্রশ্ন শুনে স্বল্প শিক্ষিত দোকানদার হতভম্ব, মনে হলো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন তিনি আগে কখনো হননি। দোকানদার শুধু তাকিয়ে থাকলেন, সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা, শুভ্র লম্বা দাঁড়ি, টুপি পরা এমন একজন আলেমের কথা দোকানদার কিছু বুঝতে পেরেছে বলে আমার মনে হলো না। বিয়ের আসরে পৌঁছা পর্যন্ত স্যার প্রাসঙ্গিক আরও অনেক কথা বলেছেনÑআমি, ইউনুস আর গাড়ির চালক নীরবে শুনেছি। ‘ইসলামিক রিলিফে’র মতো তালেবান সরকারের ‘পুণ্যের প্রচার এবং পাপের প্রতিরোধ’ মন্ত্রণালয়ও রয়েছে, এই মন্ত্রণালয় থেকে নারীদের ওপর নানাবিধ বিধিনিষেধ এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়ে থাকে।

তালেবান সরকারের বিরুদ্ধে ত্রাণ তৎপরতায় হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছিল আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো; তাদের অভিযোগ দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ না দিয়ে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তালেবান মতাদর্শের লোকদের। এই অভিযোগ আমাদের দেশসহ ভারত, পাকিস্তানে অহরহ শোনা যায়,- প্রকৃত দুর্গত লোকদের মধ্যে ত্রাণ না দিয়ে দলীয় সমর্থকদের ত্রাণ দিয়ে দেয়ার অভিযোগ অহর্নিশ শুনে আসছি। সমাজ থেকে স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ করা কঠিন, সব রাজনৈতিক দল এবং সব সরকারের আমলেই এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে থাকে। কিন্তু তালেবানেরা তো ইসলামিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত, তাদের এই স্বজনপ্রীতি থাকার কথা নয়। যে রিলিফ নিয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ সেই রিলিফ এসেছে ইহুদি, নাসারা, নাস্তিক এবং পৌত্তলিকদের কাছ থেকে। কোরআন, হাদিসে মুসলিম ব্যতীত অন্য ধর্মের কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে মুসলিমদের নিষেধ করা হয়েছে; অন্য কোন ধর্মাবলম্বীকে বন্ধু করা না গেলে তাদের অনুদান গ্রহণ করা যাবে কি না, তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।

আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলেছে। আমেরিকা এবং ন্যাটোর সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে এক যুগ ধরে তালেবানেরা যুদ্ধ করেছে। আমেরিকা অনবরত ড্রোন হামলা করেও তালেবানদের মনোবল ভাঙতে পারেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার সাম্প্রতিক কালের একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি নতুন করে কোন দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধাননি, বরং তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যুদ্ধগুলোর ইতি টানার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আফগানিস্তান থেকে সরে আসার জন্য তিনি তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি করেছেন, তালেবানেরা সেই চুক্তি ভঙ্গ করে একতরফা ক্ষমতা দখল করে নেয়। তালেবানদের একতরফা সরকার গঠন আমেরিকাকে ক্রুদ্ধ করে তোলে, আমেরিকা আফগানিস্তানের ৯ বিলিয়ন ডলার আটক করে। আমেরিকার সঙ্গে এক হয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোও আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে এগিয়ে আসেনি।

আফগানিস্তানে ভূমিকম্পের ঘটনা নতুন নয়; ভৌগোলিক কারণেই আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ, ইতোমধ্যে অনেকগুলো ভূমিকম্প হয়ে গেছে, ওই সব ভূমিকম্পে প্রাণহানি হয়েছে অসংখ্য এবং সম্পদ ধ্বংস হয়েছে বিপুল পরিমাণ। তালেবানেরা ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে শরিয়াহ্ আইন চালু করেছে। শরিয়াহ্ আইন নিয়ে নানাবিধ ব্যাখ্যা থাকলেও সব ব্যাখ্যাই নারী সমাজের প্রতি কঠোর এবং বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর শরিয়াহ্ আইনের ব্যাখ্যাগুলো তালেবানেরা গ্রহণ করেছে। প্রবর্তিত শরিয়াহ্ আইন জনজীবন থেকে নারীদের প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, মাহরাম বা অনুমোদিত পুরুষ ছাড়া নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ। এছাড়া মেয়েদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা এবং বার বছরের ঊর্ধ্বে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। নারীদের খেলাধুলায় অংশ নেওয়া হারাম করা হয়েছে। নারী শিক্ষার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ এবং কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করায় নারীদের ক্ষমতা পদ্ধতিগতভাবেই খর্ব হয়ে গেছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হচ্ছে নারী শিক্ষা নিয়ে তালেবানদের রক্ষণশীল নীতি। জার্মানি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, তালেবানেরা তাদের অনুসৃত ভুল পথ থেকে সরে না এলে স্বাভাবিক সম্পর্ক হবে না এবং তালেবান সরকারকে স্বীকৃতিও দেওয়া যাবে না।

লাখ লাখ আফগানের হাতে এখন কোন কাজ নেই, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তবে আফগানিস্তানে এমন দুরবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটার ব্যাপারে ধর্মীয় ব্যাখ্যাও রয়েছে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী ভূমিকম্প হলো মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা, ভূমিকম্প দিয়ে আল্লাহ মানুষকে সাবধান করেন, সতর্ক করেন। মনে হচ্ছে, তালেবানদের কর্মকা-ে সৃষ্টিকর্তা নাখোশ; তাই ভূমিকম্প আর বন্যা দিয়ে তাদের সতর্ক ও সাবধান করা হচ্ছে। ধর্মের কথা অনুযায়ী ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে, তারা মহান আল্লাহর নিকট তাওবা করে, পাপ কর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপ কর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মোনাজাত করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে বাঁচার জন্য আমাদের ইসলাম ধর্মে দান-খয়রাত করার কথাও বলা আছে। কিন্তু তালেবান সরকার নিজেরাই দেউলিয়া, দান খয়রাত করবে কী করে! চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা সমর্থিত আফগান সরকারের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিলে পশ্চিমাদের এত রোষানলে তালেবানদের পড়তে হতো না। তালেবানদের বাঁচার দুটি পথ খোলা আছে; এক-আফগান নারীর শিক্ষা এবং তাদের চলাফেরায় কিছুটা স্বাধীনতা দিয়ে অমুসলিম পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতা করা; দুই-কৃতকর্মের জন্য তালেবানদের অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করা এবং পাপকর্ম থেকে ফিরে আসার ওয়াদা করে বেশি বেশি মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে সমর্পিত হওয়া। অবশ্য ইচ্ছে করলে তারা দুটোই করতে পারে।

[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]