ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। প্রতিদিন সকাল ৬টা বাজতে না বাজতেই সূর্যের তাপ ছাড়িয়ে যাচ্ছে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ‘আগুন ছড়াতে’ থাকে সূর্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে বাতাসেও বেড়েছে জ্বলীয় বাষ্পের পরিমাণ। জলীয় বাষ্প বায়ুমন্ডলে থাকলে প্রচুর তাপমাত্রা ধরে রাখে আর এ কারণে গরমের অনুভূতিও বেশি হয়। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আরও দুই থেকে তিন দিন মৃদু তাপপ্রবাহ থাকতে পারে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে লঘুচাপ কমেছে বঙ্গোপসাগরে। সপ্তাহখানেক ধরে তাপমাত্রা থাকছে ৩৭ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এই তাপমাত্রাতেও সমস্যা হতো না যদি স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতো। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ভূপৃষ্ঠে পুঞ্জীভূত তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে গরমের অনুভূতি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল ৬টা বাজতে না বাজতেই সূর্যের তাপ ছাড়িয়ে যাচ্ছে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা গড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা, প্রখর হচ্ছে সূর্যের দাপট। রাজশাহী ও রংপুরসহ বেশকিছু জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। প্রখর সূর্য আর তীব্র দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। প্রচন্ড গরমে সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষেরা অস্বস্তিতে পড়েছেন। চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। তীব্র রোদের তাপে দিনমজুর, রিকশাচালক, ঠেলা ও ভ্যানচালকরা কাজ করতে পারছেন না। তবে জীবন-জীবিকার তাগিদে এর মধ্যেই কাজে বেরিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টি না থাকায় ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
গত কয়েক দিন তাপমাত্রার এই ঊর্ধ্বমুখী অবস্থানে হাঁসফাঁস জনজীবন। একই দশায় পড়েছে গবাদি পশু-পাখিও।
একটু প্রশান্তির আশায় শিশু-কিশোর সবাই পুকুর-নদী, বিলে ছোটাছুটি করছে। ওইসব অঞ্চলের হাট-বাজারগুলোতে মানুষের সমাগম কিছুটা কমেছে। অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধও রেখেছেন। অনেকে আবার ঘন ঘন ঠান্ডা পানিতে গোসল করছে। সামর্থ্যবান শহুরে বাসিন্দারা ঘরে দিনরাত এসি চালিয়ে পরিবারের শিশু সন্তান ও বয়োবৃদ্ধদের সুস্থ রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন।
রংপুর আদালতে আইন পেশায় জড়িত অ্যাডভোকেট আকতার জাহান বিথী। তার গ্রামের বাড়ি ওই জেলার পীরগঞ্জের চতরায়। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বিগত ১০/১৫ দিন যাবত রংপুর তথা উত্তরবঙ্গে তীব্র দাবদাহ চলছে। যা প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই এলাকার মানুষ এবং গবাদিপশুর জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বিদুৎতের ঘন ঘন আসা যাওয়ায় জনসাধারণের নির্ঘুম রাত আর দিনের তীব্র গরম সবাইকে অসুস্থ করে তুলছে।’ বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে একটু স্বস্তিতে থাকা যেত বলে মনে করেন।
মধ্য বর্ষায় আবহাওয়ার এমন বিরূপ আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রন (সিপিই) পরিচালক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ আবদুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘বিষয় হচ্ছে দুটো, কেন বর্ষা চলে যাচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে না আর কেন এ সময়ে তাপমাত্রা বেশি।’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘প্রথমটা হচ্ছে, ২০১০ সাল থেকে ‘এল নিনো আর লা নিনো’র প্রভাব বিস্তার শুরু করলে আমরা লা নিনোর প্রভাবে আছি। লা নিনোর প্রভাবে গত এক যুগে আমাদের দক্ষিণ পশ্চিমে যে মৌসুমি বায়ু আমাদের উপর দিয়ে প্রভাহিত হয় (আমাদের বৃষ্টি হয় দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর কারণে) ওই বায়ু তার গতিপথ বদলে ফেলছে।’
‘চলতি বছর পর্যন্ত সর্বমোট আট বার দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু তার গতি পথ বদলেছে। এটা এখন আমাদের উপর দিয়ে প্রভাহিত হচ্ছে না। এ কারণে আমাদের এখানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না।’ বলে জানান আবদুর রহমান। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু না পেলেও আমরা সাগরের বায়ু পাচ্ছি। সাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে ওয়াটার বাফার নিয়ে আসছে। তাই বর্তমানে আমাদের হিউমিনিডিটি লেভেল ৭০ শতাংশের ওপরে। তার মানে বায়ুমন্ডলে প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প আছে। জলীয় বাষ্প যখন বায়ুমন্ডলে থাকবে তখন সে প্রচুর তাপমাত্রা ধরে রাখবে।’ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মিথেন গ্যাস বৃদ্ধির কথাও বলেন আবদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২০১৯, ২০ ও ২১ সালে মিথেন গ্যাস নিয়ে গবেষণা করে জানা যায়, এটমোস্ফিয়ার লেভেলে আমাদের মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। যখন মিথেন গ্যাস আমাদের বায়ুমন্ডলে বাড়তে থাকবে তথন মিথেন গ্যাস প্রচুর পরিমাণে তাপ শুষে নেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দিনের সময়ের পরিমাণ বেশি হওয়া। দিন যেহেতু লম্বা আমরা সৌরশক্তি বেশি পাচ্ছি। দিন ছোট হলে সৌরশক্তি কম পেতাম, সেই সৌরশক্তি রিফ্লেক্ট হয়ে রাতের বেলা চলে যেত। আমরা মোটামুটি ঠান্ডা অনুভব করতাম। কিন্তু যেহেতু দিনের পরিমাণ বেশি আমরা তাপ পাচ্ছি বেশি পরিমাণে।’
সিপিই এবং কানাডিয়ান মডার্ন সাইন্টিস গ্লোবালের (এমএসজি) যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে মিথেনের ঘনত্ব ছিল ১৯৫০ পার্টস পার বিলিয়ন (পিপিবি) যা বেড়ে ২০২০ সালে বেড়ে হয় ২০২৬ পিপিবি, ২০২১ সালের একই সময়ে ২০১১ পিপিবি এবং ২০২২ সালে ২৩২৯ পিপিবি।
রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
রংপুর থেকে লিয়াকত আলী বাদল জানিয়েছেন, জেলায় স্মরণকালের প্রচন্ড গরম আর দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গত বুধবার রংপুরের তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা বিগত ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রংপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী ২-৩ দিন বৃষ্টিপাতের কোন লক্ষণ নেই। সে কারণে তাপমাত্রা এবার যেকোন দিন ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে।
এদিকে প্রচন্ড দাবদাহের কারণে নগরীর সড়কগুলোতে জনসমাগম খুই কম। বড় বড় শপিংমলগুলো খদ্দেরশূন্য হয়ে পড়েছে। রংপুর নগরীর অভিজাত শপিংমল জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সাহাদুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রচন্ড দাবদাহের কারণে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। অনেক দিন দুপুর পর্যন্ত কেনাবেচাই শুরু করতে পারিনি।
৪০ ছুঁই ছুঁই রাজশাহীর তাপমাত্রা
রাজশাহী জেলা বার্তা পরিবেশক জানিয়েছেন, কড়া রোদের সঙ্গে বইছে ভ্যাপসা গরম আবহাওয়া। জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এখন ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। দাবদাহ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা বলেন, ‘রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলাসহ রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।’
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে ‘মৃদু’, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে ‘মাঝারি’ এবং ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই হিসাবে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাজশাহীতে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গতকাল এর তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় তা এখন মাঝারি তাপপ্রবাহে রূপ নিতে শুরু করেছে।
গত বুধবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রাজশাহীতে ৩৮.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সৈয়দপুরে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর তৃতীয় সর্বোচ্চ দিনাজপুরে ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া সিলেটে ৩৭.৩ ডিগ্রি, শ্রীমঙ্গলে ৩৭.২ ডিগ্রি, রংপুর, বগুড়া ও ঈশ্বরদীতে ৩৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
সিলেটে টানা দাবদাহে হাঁপিয়ে উঠেছে জনজীবন
সিলেট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সিলেট অঞ্চলে তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। টানা দাবদাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরছে। ঈদের দিন সিলেটে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর গত সোমবার (থেকে সিলেটে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। ওইদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত মঙ্গলবার তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, গত বুধবার তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। গতকালও তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখী। এই তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস।
সিলেট আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ জানান, ঈদের আগে থেকে সিলেটে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এবার ঈদও কেটেছে বৃষ্টিহীন। বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও বৃষ্টি নেই সিলেটে। তাই তাপপ্রবাহ দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিয়েছে। মার্চ-এপ্রিলের তীব্র তাপপ্রবাহের পর থেকে সিলেটের ওপর দিয়ে কখনও মৃদু আবার কখনও মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে। ভারী বর্ষণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই তাপপ্রবাহ প্রশমিত হওয়ার আপত কোন সম্ভাবনা নেই।
দক্ষিণাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে গ্রীষ্মের দাবদাহ
বরিশাল থেকে মানবেন্দ্র বটব্যাল জানিয়েছেন, ঈদুল আজহার কয়েকদিন আগে দক্ষিণাঞ্চলে পরপর ২-৩ দিন বৃষ্টি হলেও এখন দক্ষিণাঞ্চলে আষাঢ় মাসের স্বভাবিক যে বৃষ্টি হওয়ার কথা তার ধারেকাছেও নেই। সকাল ১০-১১ টার পর থেকেই রাস্তাঘাট রৌদ্রের তেজে গরম হয়ে যাওয়ায় সহসা কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। আর এই দাবদাহ চলছে সন্ধ্যা পর্যন্ত। গতকাল জেলার তাপমাত্রা ছিল ৩৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কবে বৃষ্টিপাত হবে আবহাওয়া বিভাগ তা নিশ্চয়তা দিতে পারেননি।
যশোর অফিস জানিয়েছে, যশোর বিমানবাহিনী নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া অফিস জানায়, গতকাল যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ২৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ছিল ৬৬ শতাংশ।
প্রচন্ড গরমে পুকুরে নেমে শীতল হওয়ার চেষ্টা। গতকাল রাজধানীর একটি পুকুরের চিত্র -সংবাদ
আরও খবরশুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২ , ৩১ আষাঢ ১৪২৯ ১৬ জিলহজ ১৪৪৩
শাফিউল ইমরান
প্রচন্ড গরমে পুকুরে নেমে শীতল হওয়ার চেষ্টা। গতকাল রাজধানীর একটি পুকুরের চিত্র -সংবাদ
ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। প্রতিদিন সকাল ৬টা বাজতে না বাজতেই সূর্যের তাপ ছাড়িয়ে যাচ্ছে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ‘আগুন ছড়াতে’ থাকে সূর্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে বাতাসেও বেড়েছে জ্বলীয় বাষ্পের পরিমাণ। জলীয় বাষ্প বায়ুমন্ডলে থাকলে প্রচুর তাপমাত্রা ধরে রাখে আর এ কারণে গরমের অনুভূতিও বেশি হয়। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আরও দুই থেকে তিন দিন মৃদু তাপপ্রবাহ থাকতে পারে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে লঘুচাপ কমেছে বঙ্গোপসাগরে। সপ্তাহখানেক ধরে তাপমাত্রা থাকছে ৩৭ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এই তাপমাত্রাতেও সমস্যা হতো না যদি স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতো। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ভূপৃষ্ঠে পুঞ্জীভূত তাপ বাড়িয়ে দিয়েছে গরমের অনুভূতি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল ৬টা বাজতে না বাজতেই সূর্যের তাপ ছাড়িয়ে যাচ্ছে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলা গড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা, প্রখর হচ্ছে সূর্যের দাপট। রাজশাহী ও রংপুরসহ বেশকিছু জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। প্রখর সূর্য আর তীব্র দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। প্রচন্ড গরমে সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষেরা অস্বস্তিতে পড়েছেন। চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। তীব্র রোদের তাপে দিনমজুর, রিকশাচালক, ঠেলা ও ভ্যানচালকরা কাজ করতে পারছেন না। তবে জীবন-জীবিকার তাগিদে এর মধ্যেই কাজে বেরিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টি না থাকায় ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
গত কয়েক দিন তাপমাত্রার এই ঊর্ধ্বমুখী অবস্থানে হাঁসফাঁস জনজীবন। একই দশায় পড়েছে গবাদি পশু-পাখিও।
একটু প্রশান্তির আশায় শিশু-কিশোর সবাই পুকুর-নদী, বিলে ছোটাছুটি করছে। ওইসব অঞ্চলের হাট-বাজারগুলোতে মানুষের সমাগম কিছুটা কমেছে। অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধও রেখেছেন। অনেকে আবার ঘন ঘন ঠান্ডা পানিতে গোসল করছে। সামর্থ্যবান শহুরে বাসিন্দারা ঘরে দিনরাত এসি চালিয়ে পরিবারের শিশু সন্তান ও বয়োবৃদ্ধদের সুস্থ রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন।
রংপুর আদালতে আইন পেশায় জড়িত অ্যাডভোকেট আকতার জাহান বিথী। তার গ্রামের বাড়ি ওই জেলার পীরগঞ্জের চতরায়। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘বিগত ১০/১৫ দিন যাবত রংপুর তথা উত্তরবঙ্গে তীব্র দাবদাহ চলছে। যা প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এই এলাকার মানুষ এবং গবাদিপশুর জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বিদুৎতের ঘন ঘন আসা যাওয়ায় জনসাধারণের নির্ঘুম রাত আর দিনের তীব্র গরম সবাইকে অসুস্থ করে তুলছে।’ বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে একটু স্বস্তিতে থাকা যেত বলে মনে করেন।
মধ্য বর্ষায় আবহাওয়ার এমন বিরূপ আচরণের বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পিপল অ্যান্ড এনভায়রন (সিপিই) পরিচালক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ আবদুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘বিষয় হচ্ছে দুটো, কেন বর্ষা চলে যাচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে না আর কেন এ সময়ে তাপমাত্রা বেশি।’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘প্রথমটা হচ্ছে, ২০১০ সাল থেকে ‘এল নিনো আর লা নিনো’র প্রভাব বিস্তার শুরু করলে আমরা লা নিনোর প্রভাবে আছি। লা নিনোর প্রভাবে গত এক যুগে আমাদের দক্ষিণ পশ্চিমে যে মৌসুমি বায়ু আমাদের উপর দিয়ে প্রভাহিত হয় (আমাদের বৃষ্টি হয় দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর কারণে) ওই বায়ু তার গতিপথ বদলে ফেলছে।’
‘চলতি বছর পর্যন্ত সর্বমোট আট বার দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু তার গতি পথ বদলেছে। এটা এখন আমাদের উপর দিয়ে প্রভাহিত হচ্ছে না। এ কারণে আমাদের এখানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না।’ বলে জানান আবদুর রহমান। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু না পেলেও আমরা সাগরের বায়ু পাচ্ছি। সাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে ওয়াটার বাফার নিয়ে আসছে। তাই বর্তমানে আমাদের হিউমিনিডিটি লেভেল ৭০ শতাংশের ওপরে। তার মানে বায়ুমন্ডলে প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প আছে। জলীয় বাষ্প যখন বায়ুমন্ডলে থাকবে তখন সে প্রচুর তাপমাত্রা ধরে রাখবে।’ তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে মিথেন গ্যাস বৃদ্ধির কথাও বলেন আবদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২০১৯, ২০ ও ২১ সালে মিথেন গ্যাস নিয়ে গবেষণা করে জানা যায়, এটমোস্ফিয়ার লেভেলে আমাদের মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। যখন মিথেন গ্যাস আমাদের বায়ুমন্ডলে বাড়তে থাকবে তথন মিথেন গ্যাস প্রচুর পরিমাণে তাপ শুষে নেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দিনের সময়ের পরিমাণ বেশি হওয়া। দিন যেহেতু লম্বা আমরা সৌরশক্তি বেশি পাচ্ছি। দিন ছোট হলে সৌরশক্তি কম পেতাম, সেই সৌরশক্তি রিফ্লেক্ট হয়ে রাতের বেলা চলে যেত। আমরা মোটামুটি ঠান্ডা অনুভব করতাম। কিন্তু যেহেতু দিনের পরিমাণ বেশি আমরা তাপ পাচ্ছি বেশি পরিমাণে।’
সিপিই এবং কানাডিয়ান মডার্ন সাইন্টিস গ্লোবালের (এমএসজি) যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের বায়ুমন্ডলে মিথেনের ঘনত্ব ছিল ১৯৫০ পার্টস পার বিলিয়ন (পিপিবি) যা বেড়ে ২০২০ সালে বেড়ে হয় ২০২৬ পিপিবি, ২০২১ সালের একই সময়ে ২০১১ পিপিবি এবং ২০২২ সালে ২৩২৯ পিপিবি।
রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
রংপুর থেকে লিয়াকত আলী বাদল জানিয়েছেন, জেলায় স্মরণকালের প্রচন্ড গরম আর দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গত বুধবার রংপুরের তাপমাত্রা ছিল ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা বিগত ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রংপুর আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী ২-৩ দিন বৃষ্টিপাতের কোন লক্ষণ নেই। সে কারণে তাপমাত্রা এবার যেকোন দিন ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে।
এদিকে প্রচন্ড দাবদাহের কারণে নগরীর সড়কগুলোতে জনসমাগম খুই কম। বড় বড় শপিংমলগুলো খদ্দেরশূন্য হয়ে পড়েছে। রংপুর নগরীর অভিজাত শপিংমল জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী সাহাদুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রচন্ড দাবদাহের কারণে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। অনেক দিন দুপুর পর্যন্ত কেনাবেচাই শুরু করতে পারিনি।
৪০ ছুঁই ছুঁই রাজশাহীর তাপমাত্রা
রাজশাহী জেলা বার্তা পরিবেশক জানিয়েছেন, কড়া রোদের সঙ্গে বইছে ভ্যাপসা গরম আবহাওয়া। জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এখন ৪০ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। দাবদাহ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা বলেন, ‘রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলাসহ রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।’
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে ‘মৃদু’, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে ‘মাঝারি’ এবং ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই হিসাবে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে রাজশাহীতে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। গতকাল এর তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় তা এখন মাঝারি তাপপ্রবাহে রূপ নিতে শুরু করেছে।
গত বুধবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রাজশাহীতে ৩৮.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সৈয়দপুরে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর তৃতীয় সর্বোচ্চ দিনাজপুরে ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া সিলেটে ৩৭.৩ ডিগ্রি, শ্রীমঙ্গলে ৩৭.২ ডিগ্রি, রংপুর, বগুড়া ও ঈশ্বরদীতে ৩৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
সিলেটে টানা দাবদাহে হাঁপিয়ে উঠেছে জনজীবন
সিলেট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সিলেট অঞ্চলে তাপপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। টানা দাবদাহে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরছে। ঈদের দিন সিলেটে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর গত সোমবার (থেকে সিলেটে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করে। ওইদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত মঙ্গলবার তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, গত বুধবার তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। গতকালও তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখী। এই তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সিলেট আবহাওয়া অফিস।
সিলেট আবহাওয়া কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ জানান, ঈদের আগে থেকে সিলেটে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এবার ঈদও কেটেছে বৃষ্টিহীন। বর্ষা মৌসুম শুরু হলেও বৃষ্টি নেই সিলেটে। তাই তাপপ্রবাহ দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিয়েছে। মার্চ-এপ্রিলের তীব্র তাপপ্রবাহের পর থেকে সিলেটের ওপর দিয়ে কখনও মৃদু আবার কখনও মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে। ভারী বর্ষণ শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই তাপপ্রবাহ প্রশমিত হওয়ার আপত কোন সম্ভাবনা নেই।
দক্ষিণাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে গ্রীষ্মের দাবদাহ
বরিশাল থেকে মানবেন্দ্র বটব্যাল জানিয়েছেন, ঈদুল আজহার কয়েকদিন আগে দক্ষিণাঞ্চলে পরপর ২-৩ দিন বৃষ্টি হলেও এখন দক্ষিণাঞ্চলে আষাঢ় মাসের স্বভাবিক যে বৃষ্টি হওয়ার কথা তার ধারেকাছেও নেই। সকাল ১০-১১ টার পর থেকেই রাস্তাঘাট রৌদ্রের তেজে গরম হয়ে যাওয়ায় সহসা কেউ বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। আর এই দাবদাহ চলছে সন্ধ্যা পর্যন্ত। গতকাল জেলার তাপমাত্রা ছিল ৩৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কবে বৃষ্টিপাত হবে আবহাওয়া বিভাগ তা নিশ্চয়তা দিতে পারেননি।
যশোর অফিস জানিয়েছে, যশোর বিমানবাহিনী নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া অফিস জানায়, গতকাল যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ২৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ছিল ৬৬ শতাংশ।