শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২, ৩১ আষাঢ ১৪২৯ ১৬ জিলহজ ১৪৪৩

শিশুর পাঠ কেন আনন্দময় হচ্ছে না

আব্দুল মান্নান খান

শৈশবের দু-তিনটা বছর কেন আমাদের শিশুরা ছবি আঁকা, গল্প বলা ও নাচ-গানের মধ্যে থেকে পার করতে পারছে না? পারছে যে না এটা আমরা সবাই দেখছি। কেন পারছে না এবং পারতে হলে কী করতে হবে সেদিকে কারও তেমন এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। দেশের প্রায় সব শিশুই এখন স্কুলমুখী। জাতীয় জীবনে এটা একটা বিরাট অর্জন নিঃসন্দেহে। যাদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং গ্রামে থেকে স্কুলজীবন শুরু করেছেন তারা নিজ নিজ গ্রামে কী দেখেছেন আর এখন গেলে কী দেখবেন। দেখবেন কোন শিশু আর ঘরে থাকছে না। কথা বলা শেখেনি তারাও স্কুলে যাবে বলে বায়না ধরছে দেখাদেখি। গ্রামের পথে ছোটদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার দৃশ্য নজর না কেড়ে যায় না। অবস্থা এমন যে মায়েরাও সন্তানদের পাঠাতে না পারলে যেন স্বস্তি পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে হবে এ সচেতনতা এসেছে সবার মাঝেই। নিজেরা যেটা পারেনি সন্তানরা সেটা পারবে এ আশা নিয়ে তারা দিনরাত হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। টাকা-পয়সার জোগান দিচ্ছেন। কিন্তু পাঠাচ্ছেন কোথায় কী শিখছে তারা সেখানে।

সরকারি স্কুল নেই এমন গ্রাম যেমন খুব কম আছে তেমন এক বা একাধিক মাদ্রাসা নেই এমন গ্রামও নেই বললে চলে। ছোটদের বড়দের অনুমোদিত-অননুমোদিত আবাসিক-অনাবাসিক সব রকমের মাদ্রাসা আছে। কিন্টারগার্ডেন শিক্ষার নামে খিচুড়ি মার্কা এক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই এমন গ্রামও কম আছে। এর মধ্যে সরকারি স্কুলগুলো চলছে অভিজাত স্টাইলে। একটা সরকারি স্কুলের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার শিশুগুলো স্কুলে আসছে কিনা, না আসলে কোথায় যাচ্ছে এসব নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। একটা ক্লাসে বা গোটা স্কুলে প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত আর কাগজে-কলমে কত এ শুধু তারাই জানেন। কয়েক বছর আগের একটা খবর বলি। ২০১৮ সালেই সম্ভবত প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষায় দেড় লাখ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল বলে খবর বেরিয়েছিল মানে তারা পরীক্ষা দিতে আসেনি। দেড় লাখ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় বসলো না এটা কম কথা নয়। তারা পরীক্ষায় বসলো না, না আদতে তারা ছিল না। না থাকলে পঞ্চম শ্রেণীতে ছিল না, না প্রথম শ্রেণী থেকেই ছিল না। এই বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই দিতে হয়েছে। সম্পূর্ণ অবৈতনিক অবকাঠামোর মধ্যে রেখে তাদের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আনতে হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় ছিল, কেউ কখনো বিষয়টি নিয়ে টুঁ শব্দটি করেছিল বলে শোনা যায়নি। মনে হয়েছিল যেন ‘গৌরী সেনকা মাল’ এর কোন হিসাব দেয়া লাগে না। কোন জবাবদিহিতারও প্রয়োজন পড়ে না। কাজেই ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কেতাবে আর গোয়ালে মিল থাকবে এ আশা করা বৃথা। শিক্ষক মহোদয়গনের কোন দায় নেই স্কুল ম্যানেজিং কমিটির কোন ঠেকা নেই স্কুল এরিয়ার শিশুরা কোথায় ভর্তি হচ্ছে কী পড়ছে কী শিখছে দেখার। আর সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তো ব্যস্ত ফাইলপত্র ঠিক রাখতে। এ তো গেল একদিকের কিছু কথা। আরেক দিকে কী হচ্ছে!

আরেক দিকে বাড়ি বাড়ি হেঁটে অভিভাবকদের নানাভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গ্রামের পথেঘাটে হাটবাজারে মাইকিং করে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের টানার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে এবং ফলও পাচ্ছে। ধর্মভীরু অনেক ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ সাধারণ খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী তাদের সন্তানদের ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিচ্ছেন। ইহকাল-পরকাল উভয়কালে ভালো থাকবেন এ আশ্বাস পাচ্ছেন। মুগ্ধ হচ্ছেন। সরকারের তালিকাভুক্ত মাদ্রাসাগুলোতে যায়-ই শেখানো হোক যায়-ই পড়ানো হোক সরকারের একটা কারিকুলাম তাদের হাতে আছে। এর বাইরে অসংখ্য মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে, বলা যায় যে কেউ ইচ্ছে হলেই একটা মাদ্রাসা একটা কেজি স্কুল খুলে বসতে পারেন বসছেনও। অগণিত এই শিশুরা কী শিখছে কী পড়ছে, কী তাদের পাঠ্যসূচি, কারা পড়াচ্ছেন কী তাদের যোগ্যতা এসব নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই হবে কিন্তু আছে কি? দু-একজন শিশু শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘হেফজো পড়ছি’ মানে পবিত্র কোরআন শরিফ মুখস্ত করছে হাফেজ হবে। আর হাতের একটা ছোট যন্ত্রে ওয়াজ শুনছে একদিন ওইভাবে ওয়াজ করবে বলে। এর সঙ্গে আর যেটা করছে, বাড়িবাড়ি ঘুরে মাদ্রাসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে। ধর্মপ্রাণ কৃষক কঠিন শ্রমের ফসল নিজ ঘরে তোলার আগেই ওদের চাহিদা মিটাতে হয়। মাঠের ফসল শেষ হলে গৃহস্থের ঝাড়ের বাঁশ ইত্যাদি ওই প্রতিষ্ঠানের নামে সংগ্রহ করে বেড়াতে হয় তাদের। আর শহরবাজারে রসিদ দিয়ে না দিয়ে দোকানগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো ওইসব শিক্ষার্থীরা কখনো ওদের নির্ধারিত পোশাক ছাড়া বের হয় না। গ্রামের পথেঘাটে শহরবন্দরে যেখানেই হোক।

বলতে চাচ্ছি একটা সরকারি স্কুল এরিয়ায় বিদ্যালয় গমনোপযোগী কতজন শিশু সরকারি স্কুলে পড়ে কতজন মাদ্রাসায় হাফেজি কওমি নূরানি যাহোক পড়ে কতজন কিন্টারগার্ডেনে যায় এ পরিসংখ্যানটা কি কোথাও আছে, হোক সে স্থানীয়ভাবে বা জাতীয় ভাবে? শুধু গ্রামের কথা বলছি না ছোট শহর বড় শহর সব শহরের অলিগলির বাসাবাড়িতে এমন কি দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া নিয়েও চালানো হচ্ছে এমন সব মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যক্রম।

একটা সময় যখন মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটছিল দেশে তখন অনেক সুধীজনকেই বলতে শোনা গেছে, ‘তবু তো ওরা কিছু শিখছে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর থেকে সেটা খারাপ কী।’ মোটেই খারাপ না কিন্তু যেটা করা হয়নি তখন তা হলো কোন সিলেবাস তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। কী শিখানো হয়েছে তার খবর কেউ রাখেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে ধর্মের নামে মৌলবাদ গভীরে শিকড় গেঁড়ে বসেছে।

আরও আছে, কিন্টারগার্ডেন স্কুল। এখানেও কেউ চাইলে দিয়ে বসতে পারেন একটা কেজি স্কুল। দুটোই ব্যবসা। চাইলেই খুলে বসতে পারেন। রমরমা বাণিজ্য। একাজেও ওই মাদ্রাসার মতো স্থানকাল দেখা লাগবে না। চাইলে বাড়িঘরের ভেতরই শুরু করতে পারেন। দেশের নাম উল্লেখ না করে একটা দেশের কিন্টারগার্ডেন শিক্ষার কথা একটু বলা যেতে পারে এখানে। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুরা সেখানে কেজিতে পড়ে যার কোন কারিকুলাম নেই। সেখানে শিশুরা নাচ-গান গল্প বলা ছবি আঁকা এসব শেখে। সেই দেশের সরকার এই তিন বছরের কেজি শিক্ষাটাকে সম্পূর্ণ বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দিয়েছে আর প্রথম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক এবং সম্পূর্ণ ব্যয়ভার ও নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রেখেছে। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে তাই বলে কোন শিক্ষার্থীকে কিন্ডারগার্টেনে পড়ে আসতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কেজিতে না পড়ে বা দু-এক বছর পড়ে এসেও একটা শিশু প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারে।

সেদিন পত্রিকায় দেখলাম পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি কৌতূহলপ্রবণ। পত্রিকাটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, চোখের সামনে যা থাকে, সেটা সম্পর্কেই থাকে তাদের রাজ্যের কৌতূহল। ফলে সারাক্ষণ তাদের প্রশ্ন থাকে, এটা কী, ওটা কীভাবে হলো... এসব। পাঁচ বছরের একটি শিশু কী কী করতে পারে, সেই তালিকাও দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের একটি বিশেষত্ব হলো, অসাধারণ গল্প বলার ক্ষমতা। এই যে তাদের অসাধারণ গল্প বলার ক্ষমতা আমরা কি তা কখনো ভেবে দেখেছি না তাদের উৎসাহিত করেছি এ কাজে? করিনি। বরং আমরা পদে পদে থামিয়ে দিয়েছি যাতে বেশি কথা না বলে। আমরা চেয়েছি শুধু পড়বে মুখস্থ করবে আর পরীক্ষা দেবে। গ্রামের কথা থাক দেশের বড় শহরের নামিদামি এক স্কুলের চলতি বছরের দ্বিতীয় শ্রেণীর অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষার বাংলা বিষয়ের প্রশ্নপত্রখানা যদি একটু দেখি তাহলে বোঝা যাবে আমাদের শিশুদের কী অবস্থা। প্রশ্ন ১. কবি ও কবিতার নামসহ অমুক কবিতার আট লাইন লিখ ২. শব্দার্থ লিখঃ ৫টি শব্দ দেয়া আছে ৩. শূন্যস্থানে ঠিক শব্দটি লিখঃ ৫টি লাইন দেয়া আছে ৪. বাক্য গঠন করঃ ৫টি শব্দ দেয়া আছে ৫. বাম পাশের সঙ্গে ডান পাশের মিল কর ঃ ৫টা বাক্য আছে ৬. যুক্ত বর্ণগুলি খাতায় লিখঃ ৫টা শব্দ দেয়া আছে ৭. প্রশ্নোত্তর লিখঃ ৫টি প্রশ্ন আছে ৮. বিপরীত শব্দ লিখঃ ৫টা শব্দ আছে যার একটা হলো ‘দুঃখে’ ৯. অনুচ্ছেদ লিখঃ একটা বিষয় আছে সে সম্পর্কে লিখতে হবে ১০. পঠন। সময় ২ ঘণ্টা। এবার বুঝুন, এসব শিশুরা কি ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে বলে আপনার মনে হয়। এ রকম আরও কয়েকটা বিষয় তো তার আছে যেগুলোতেও তাকে পরীক্ষা দিতে হবে। নাচ-গান গল্প বলা এসব তো পরে ঘুমানোর সময় তার কোথায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর অর্ধেক বছর গেছে মাত্র তার বয়স কত। শিশুদের প্রতি এগুলো জুলুম এবং কোনটাই ঠিকমতো করতে না দেয়া ছাড়া আর কিছু বলে ভাবা যায় না। নোট-গাইড ফলো করো কোচিং করো প্রস্তুতি পরীক্ষা দাও জিপিএ-৫, গোল্ডেন পাও না হলে জীবন বরবাদ এই তাদের ওপর আমাদের বাণী।

শোনা যাচ্ছে, নোট-গাইড বই মুদ্রণ, প্রকাশ, বেচাবিক্রি নিষিদ্ধ করে শিক্ষা আইন হতে যাচ্ছে কিন্তু বহুল আলোচিত কোচিং বাণিজ্য থাকছে, সহায়ক গ্রন্থ থাকছে। এতে ‘যে লাউ সেই কদু’ হতে যাচ্ছে কিনা তা সময়ে বলে দেবে। আরেক দিকে দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর শিশুরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ করে তাদের শৈশব-কৈশোর পার করে দিচ্ছে।

ইদানীং একটা কথা উঠেছে সুধীজনরা বলছেন, সংস্কৃতিতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এখানে বলতেই হয়, গভীর সংকটে পড়বেই তো খুব স্বাভাবিকভাবেই পড়বে। কেননা এসব চর্চা করার সময় কোথায় আমাদের শিশুদের। এর ভিত তো ওই শিশুরাই না কি বুড়োদের দিয়ে হবে! ওদের সময় সুযোগ দিতে হবে পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে অভিভাবকদের, সে মনমানসিকতা থাকতে হবে, সেসব কোথায়! এঅবস্থায় সংস্কৃতিতে পিছু হটবে না তো কি বিশ্ব জয় করবে!

শেষ করতে চাই যে কথা বলে, ওদের ওপর থেকে লেখাপড়ার চাপ কমাতে হবে। কমানো হয়েছে বলা হচ্ছে কিন্তু ওপরে দ্বিতীয় শ্রেণীর ষাণ¥াসিক পরীক্ষার বাংলা বিষয়ের যে প্রশ্নপত্রখানা সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে তাতে কি তা বলে? যাহোক, শৈশবের দু-তিনটা বছর অন্তত যেন আমাদের শিশুরা ছবি আঁকা, গল্প বলা ও নাচ-গানের মধ্যে থেকে পার করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর যেটা করতে হবে, সব শিশুর শিক্ষা অভিন্ন কারিকুলামের অধীনে আনতে হবে যেটা আমাদের ভাষারাষ্ট্রে করা অনেকটা সহজ।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২ , ৩১ আষাঢ ১৪২৯ ১৬ জিলহজ ১৪৪৩

শিশুর পাঠ কেন আনন্দময় হচ্ছে না

আব্দুল মান্নান খান

শৈশবের দু-তিনটা বছর কেন আমাদের শিশুরা ছবি আঁকা, গল্প বলা ও নাচ-গানের মধ্যে থেকে পার করতে পারছে না? পারছে যে না এটা আমরা সবাই দেখছি। কেন পারছে না এবং পারতে হলে কী করতে হবে সেদিকে কারও তেমন এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। দেশের প্রায় সব শিশুই এখন স্কুলমুখী। জাতীয় জীবনে এটা একটা বিরাট অর্জন নিঃসন্দেহে। যাদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং গ্রামে থেকে স্কুলজীবন শুরু করেছেন তারা নিজ নিজ গ্রামে কী দেখেছেন আর এখন গেলে কী দেখবেন। দেখবেন কোন শিশু আর ঘরে থাকছে না। কথা বলা শেখেনি তারাও স্কুলে যাবে বলে বায়না ধরছে দেখাদেখি। গ্রামের পথে ছোটদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার দৃশ্য নজর না কেড়ে যায় না। অবস্থা এমন যে মায়েরাও সন্তানদের পাঠাতে না পারলে যেন স্বস্তি পাচ্ছেন না। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে হবে এ সচেতনতা এসেছে সবার মাঝেই। নিজেরা যেটা পারেনি সন্তানরা সেটা পারবে এ আশা নিয়ে তারা দিনরাত হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন। টাকা-পয়সার জোগান দিচ্ছেন। কিন্তু পাঠাচ্ছেন কোথায় কী শিখছে তারা সেখানে।

সরকারি স্কুল নেই এমন গ্রাম যেমন খুব কম আছে তেমন এক বা একাধিক মাদ্রাসা নেই এমন গ্রামও নেই বললে চলে। ছোটদের বড়দের অনুমোদিত-অননুমোদিত আবাসিক-অনাবাসিক সব রকমের মাদ্রাসা আছে। কিন্টারগার্ডেন শিক্ষার নামে খিচুড়ি মার্কা এক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই এমন গ্রামও কম আছে। এর মধ্যে সরকারি স্কুলগুলো চলছে অভিজাত স্টাইলে। একটা সরকারি স্কুলের ক্যাচমেন্ট এরিয়ার শিশুগুলো স্কুলে আসছে কিনা, না আসলে কোথায় যাচ্ছে এসব নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। একটা ক্লাসে বা গোটা স্কুলে প্রকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত আর কাগজে-কলমে কত এ শুধু তারাই জানেন। কয়েক বছর আগের একটা খবর বলি। ২০১৮ সালেই সম্ভবত প্রাথমিকের সমাপনী পরীক্ষায় দেড় লাখ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল বলে খবর বেরিয়েছিল মানে তারা পরীক্ষা দিতে আসেনি। দেড় লাখ পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় বসলো না এটা কম কথা নয়। তারা পরীক্ষায় বসলো না, না আদতে তারা ছিল না। না থাকলে পঞ্চম শ্রেণীতে ছিল না, না প্রথম শ্রেণী থেকেই ছিল না। এই বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই দিতে হয়েছে। সম্পূর্ণ অবৈতনিক অবকাঠামোর মধ্যে রেখে তাদের পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আনতে হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় ছিল, কেউ কখনো বিষয়টি নিয়ে টুঁ শব্দটি করেছিল বলে শোনা যায়নি। মনে হয়েছিল যেন ‘গৌরী সেনকা মাল’ এর কোন হিসাব দেয়া লাগে না। কোন জবাবদিহিতারও প্রয়োজন পড়ে না। কাজেই ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কেতাবে আর গোয়ালে মিল থাকবে এ আশা করা বৃথা। শিক্ষক মহোদয়গনের কোন দায় নেই স্কুল ম্যানেজিং কমিটির কোন ঠেকা নেই স্কুল এরিয়ার শিশুরা কোথায় ভর্তি হচ্ছে কী পড়ছে কী শিখছে দেখার। আর সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তো ব্যস্ত ফাইলপত্র ঠিক রাখতে। এ তো গেল একদিকের কিছু কথা। আরেক দিকে কী হচ্ছে!

আরেক দিকে বাড়ি বাড়ি হেঁটে অভিভাবকদের নানাভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গ্রামের পথেঘাটে হাটবাজারে মাইকিং করে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিশুদের টানার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে এবং ফলও পাচ্ছে। ধর্মভীরু অনেক ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ সাধারণ খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী তাদের সন্তানদের ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিচ্ছেন। ইহকাল-পরকাল উভয়কালে ভালো থাকবেন এ আশ্বাস পাচ্ছেন। মুগ্ধ হচ্ছেন। সরকারের তালিকাভুক্ত মাদ্রাসাগুলোতে যায়-ই শেখানো হোক যায়-ই পড়ানো হোক সরকারের একটা কারিকুলাম তাদের হাতে আছে। এর বাইরে অসংখ্য মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে, বলা যায় যে কেউ ইচ্ছে হলেই একটা মাদ্রাসা একটা কেজি স্কুল খুলে বসতে পারেন বসছেনও। অগণিত এই শিশুরা কী শিখছে কী পড়ছে, কী তাদের পাঠ্যসূচি, কারা পড়াচ্ছেন কী তাদের যোগ্যতা এসব নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই হবে কিন্তু আছে কি? দু-একজন শিশু শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘হেফজো পড়ছি’ মানে পবিত্র কোরআন শরিফ মুখস্ত করছে হাফেজ হবে। আর হাতের একটা ছোট যন্ত্রে ওয়াজ শুনছে একদিন ওইভাবে ওয়াজ করবে বলে। এর সঙ্গে আর যেটা করছে, বাড়িবাড়ি ঘুরে মাদ্রাসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করছে। ধর্মপ্রাণ কৃষক কঠিন শ্রমের ফসল নিজ ঘরে তোলার আগেই ওদের চাহিদা মিটাতে হয়। মাঠের ফসল শেষ হলে গৃহস্থের ঝাড়ের বাঁশ ইত্যাদি ওই প্রতিষ্ঠানের নামে সংগ্রহ করে বেড়াতে হয় তাদের। আর শহরবাজারে রসিদ দিয়ে না দিয়ে দোকানগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো ওইসব শিক্ষার্থীরা কখনো ওদের নির্ধারিত পোশাক ছাড়া বের হয় না। গ্রামের পথেঘাটে শহরবন্দরে যেখানেই হোক।

বলতে চাচ্ছি একটা সরকারি স্কুল এরিয়ায় বিদ্যালয় গমনোপযোগী কতজন শিশু সরকারি স্কুলে পড়ে কতজন মাদ্রাসায় হাফেজি কওমি নূরানি যাহোক পড়ে কতজন কিন্টারগার্ডেনে যায় এ পরিসংখ্যানটা কি কোথাও আছে, হোক সে স্থানীয়ভাবে বা জাতীয় ভাবে? শুধু গ্রামের কথা বলছি না ছোট শহর বড় শহর সব শহরের অলিগলির বাসাবাড়িতে এমন কি দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া নিয়েও চালানো হচ্ছে এমন সব মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যক্রম।

একটা সময় যখন মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটছিল দেশে তখন অনেক সুধীজনকেই বলতে শোনা গেছে, ‘তবু তো ওরা কিছু শিখছে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর থেকে সেটা খারাপ কী।’ মোটেই খারাপ না কিন্তু যেটা করা হয়নি তখন তা হলো কোন সিলেবাস তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। কী শিখানো হয়েছে তার খবর কেউ রাখেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে ধর্মের নামে মৌলবাদ গভীরে শিকড় গেঁড়ে বসেছে।

আরও আছে, কিন্টারগার্ডেন স্কুল। এখানেও কেউ চাইলে দিয়ে বসতে পারেন একটা কেজি স্কুল। দুটোই ব্যবসা। চাইলেই খুলে বসতে পারেন। রমরমা বাণিজ্য। একাজেও ওই মাদ্রাসার মতো স্থানকাল দেখা লাগবে না। চাইলে বাড়িঘরের ভেতরই শুরু করতে পারেন। দেশের নাম উল্লেখ না করে একটা দেশের কিন্টারগার্ডেন শিক্ষার কথা একটু বলা যেতে পারে এখানে। তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুরা সেখানে কেজিতে পড়ে যার কোন কারিকুলাম নেই। সেখানে শিশুরা নাচ-গান গল্প বলা ছবি আঁকা এসব শেখে। সেই দেশের সরকার এই তিন বছরের কেজি শিক্ষাটাকে সম্পূর্ণ বেসরকারি পর্যায়ে ছেড়ে দিয়েছে আর প্রথম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা সব শিশুর জন্য বাধ্যতামূলক এবং সম্পূর্ণ ব্যয়ভার ও নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রেখেছে। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে তাই বলে কোন শিক্ষার্থীকে কিন্ডারগার্টেনে পড়ে আসতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কেজিতে না পড়ে বা দু-এক বছর পড়ে এসেও একটা শিশু প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারে।

সেদিন পত্রিকায় দেখলাম পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি কৌতূহলপ্রবণ। পত্রিকাটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, চোখের সামনে যা থাকে, সেটা সম্পর্কেই থাকে তাদের রাজ্যের কৌতূহল। ফলে সারাক্ষণ তাদের প্রশ্ন থাকে, এটা কী, ওটা কীভাবে হলো... এসব। পাঁচ বছরের একটি শিশু কী কী করতে পারে, সেই তালিকাও দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের একটি বিশেষত্ব হলো, অসাধারণ গল্প বলার ক্ষমতা। এই যে তাদের অসাধারণ গল্প বলার ক্ষমতা আমরা কি তা কখনো ভেবে দেখেছি না তাদের উৎসাহিত করেছি এ কাজে? করিনি। বরং আমরা পদে পদে থামিয়ে দিয়েছি যাতে বেশি কথা না বলে। আমরা চেয়েছি শুধু পড়বে মুখস্থ করবে আর পরীক্ষা দেবে। গ্রামের কথা থাক দেশের বড় শহরের নামিদামি এক স্কুলের চলতি বছরের দ্বিতীয় শ্রেণীর অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষার বাংলা বিষয়ের প্রশ্নপত্রখানা যদি একটু দেখি তাহলে বোঝা যাবে আমাদের শিশুদের কী অবস্থা। প্রশ্ন ১. কবি ও কবিতার নামসহ অমুক কবিতার আট লাইন লিখ ২. শব্দার্থ লিখঃ ৫টি শব্দ দেয়া আছে ৩. শূন্যস্থানে ঠিক শব্দটি লিখঃ ৫টি লাইন দেয়া আছে ৪. বাক্য গঠন করঃ ৫টি শব্দ দেয়া আছে ৫. বাম পাশের সঙ্গে ডান পাশের মিল কর ঃ ৫টা বাক্য আছে ৬. যুক্ত বর্ণগুলি খাতায় লিখঃ ৫টা শব্দ দেয়া আছে ৭. প্রশ্নোত্তর লিখঃ ৫টি প্রশ্ন আছে ৮. বিপরীত শব্দ লিখঃ ৫টা শব্দ আছে যার একটা হলো ‘দুঃখে’ ৯. অনুচ্ছেদ লিখঃ একটা বিষয় আছে সে সম্পর্কে লিখতে হবে ১০. পঠন। সময় ২ ঘণ্টা। এবার বুঝুন, এসব শিশুরা কি ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে বলে আপনার মনে হয়। এ রকম আরও কয়েকটা বিষয় তো তার আছে যেগুলোতেও তাকে পরীক্ষা দিতে হবে। নাচ-গান গল্প বলা এসব তো পরে ঘুমানোর সময় তার কোথায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর অর্ধেক বছর গেছে মাত্র তার বয়স কত। শিশুদের প্রতি এগুলো জুলুম এবং কোনটাই ঠিকমতো করতে না দেয়া ছাড়া আর কিছু বলে ভাবা যায় না। নোট-গাইড ফলো করো কোচিং করো প্রস্তুতি পরীক্ষা দাও জিপিএ-৫, গোল্ডেন পাও না হলে জীবন বরবাদ এই তাদের ওপর আমাদের বাণী।

শোনা যাচ্ছে, নোট-গাইড বই মুদ্রণ, প্রকাশ, বেচাবিক্রি নিষিদ্ধ করে শিক্ষা আইন হতে যাচ্ছে কিন্তু বহুল আলোচিত কোচিং বাণিজ্য থাকছে, সহায়ক গ্রন্থ থাকছে। এতে ‘যে লাউ সেই কদু’ হতে যাচ্ছে কিনা তা সময়ে বলে দেবে। আরেক দিকে দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর শিশুরা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ করে তাদের শৈশব-কৈশোর পার করে দিচ্ছে।

ইদানীং একটা কথা উঠেছে সুধীজনরা বলছেন, সংস্কৃতিতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এখানে বলতেই হয়, গভীর সংকটে পড়বেই তো খুব স্বাভাবিকভাবেই পড়বে। কেননা এসব চর্চা করার সময় কোথায় আমাদের শিশুদের। এর ভিত তো ওই শিশুরাই না কি বুড়োদের দিয়ে হবে! ওদের সময় সুযোগ দিতে হবে পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে অভিভাবকদের, সে মনমানসিকতা থাকতে হবে, সেসব কোথায়! এঅবস্থায় সংস্কৃতিতে পিছু হটবে না তো কি বিশ্ব জয় করবে!

শেষ করতে চাই যে কথা বলে, ওদের ওপর থেকে লেখাপড়ার চাপ কমাতে হবে। কমানো হয়েছে বলা হচ্ছে কিন্তু ওপরে দ্বিতীয় শ্রেণীর ষাণ¥াসিক পরীক্ষার বাংলা বিষয়ের যে প্রশ্নপত্রখানা সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে তাতে কি তা বলে? যাহোক, শৈশবের দু-তিনটা বছর অন্তত যেন আমাদের শিশুরা ছবি আঁকা, গল্প বলা ও নাচ-গানের মধ্যে থেকে পার করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর যেটা করতে হবে, সব শিশুর শিক্ষা অভিন্ন কারিকুলামের অধীনে আনতে হবে যেটা আমাদের ভাষারাষ্ট্রে করা অনেকটা সহজ।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]