শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২, ৩১ আষাঢ ১৪২৯ ১৬ জিলহজ ১৪৪৩

পশুর বর্জ্যে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে করণীয়

নাজমুল হুদা খান

পালিত হলো মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত এ ঈদে ধর্মপ্রাণ মুসলমান পশু কোরবানি করে থাকেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর কমবেশি ১ কোটি পশু কোরবানি হয়ে থাকে। এ বছরও অনুরূপ সংখ্যায় পশু কোরবানি হয়েছে। ধর্মীয় বিধানে কোরবানির পশুর লালন-পালন, সুস্থতা, কোরবানি করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে এতদসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। পশুর বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি দেশের পরিবেশসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের দেশে সারা বছর যে পরিমাণ পশু জবাই করা হয়, এর অর্ধেকেরও বেশি হয় ঈদুল আজহায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ কোটিরও বেশি পশু জবাই করা হয়। সাধারণত কোরবানির ঈদে ঢাকাসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশন এসব পশুর বর্জ্য দ্রুত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে সচেষ্ট থাকে। তবে বিশাল গ্রামীণ অঞ্চল, উপজেলা ও জেলা শহরে এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এসব এলাকায় আবাসস্থলের সন্নিকটের জলাশয়, ডোবা, খাল, নদীতে অপরিকল্পিতভাবে পশুর বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী সঠিক ব্যবস্থাপনার ঘাটতির ফলে এসব পশু বর্জ্য পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা বিশ্বে পশু সৃষ্ট বর্জ্য মনুষ্য সৃষ্ট বর্জ্যরে চেয়ে প্রায় ১৩০ গুণ বেশি। পশুসম্পদসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এ বর্জ্যরে পরিমাণ দাঁড়াবে বছরে ৫ বিলিয়ন টন। এসব বর্জ্য থেকে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেনসহ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু এবং জৈব ও অজৈব ধূলিকনা পরিবেশ দূষণ করে থাকে। অরক্ষিত বর্জ্য থেকে পানি ও মাটিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতব পদার্থ যথা ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, কপার, নিকেল ও লেড তৈরি হয় এবং নানা ধরনের নাইট্রোজেন তৈরি করে মাটিরও দূষণ করে। গবেষকরা বলছেন, বিশ্বের শতকরা ৩৫ ভাগ গ্রিন হাউজ গ্যাসের উৎস পশু বর্জ্য। পশু মোটাতাজাকরণে ব্যবহৃত অবৈধ হরমোন, স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক ও কেমিক্যালস পরিবেশ এবং মানবদেহের মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) এর মতে, মানবদেহের দুই-তৃতীয়াংশ রোগ জীবাণু ও তিন-চতুর্থাংশ ইমার্জিং জীবাণুর প্রধান উৎস হচ্ছে জীবজন্ত। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশে এসব বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা মানবদেহে সৃষ্ট পানি ও খাদ্যবাহিত রোগজীবাণু সংক্রমণের জন্য বহুলাংশে দায়ী। পশু বর্জ্যরে ওপর অণুজীব বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যায়, মানবদেহে সৃষ্ট অন্ত্রের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী Vibrio, Salmonella, Klebsiella, E-coli সহ প্রায় নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া; বিভিন্ন প্রকার কৃমি যথা গোল কৃমি, কেঁচো কৃমি, সুতা কৃমি, বক্র কৃমি, ফিতা কৃমিসহ নানা ধরনের রোগ সৃষ্টিকারী কৃমি; খাদ্যনালির বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী প্রোটোজোয়া এবং খাদ্য ও পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গে রোগ সৃষ্টিকারী হেপাটাইটিস, এডিনোভাইরাস, রোটা ভাইরাসসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। স্তূপকৃত বা ছড়ানো-ছিটানো পশু বর্জ্য থেকে মাছি, মশা ও নানা ধরনের পোকা-মাকড়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ ছড়ায়। পশু খাদ্যে অবৈধ ও অননুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং পরবর্তীতে এসব নিঃসরিত অ্যান্টিবায়োটিকস মাটি, পানিতে মিশে জীবাণুসমূহকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে।

পশু বর্জ্য সৃষ্ট রোগ ব্যাধির মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ, পরিপাক তন্ত্রের রোগ, পাকস্থলী ও খাদ্যনালির ক্যান্সার, স্নায়ুবিক বৈকল্য ও স্মৃতি শক্তি হ্রাস, গর্ভপাত, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, মানসিক বৈকল্যসহ নানাবিধ রোগ-ব্যাধি অন্যতম। গবেষকদের মতে, মানবদেহে প্রতি ১০টি সংক্রামক রোগের ৬ টি এবং নতুন ইমার্জিং সংক্রামক রোগের তিন চতুর্থাংশই জীব-জন্তু সৃষ্ট। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী শিশু মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশই ঘটে পশু বর্জ্য উৎসের জীবাণু সংক্রমণ থেকে।

আমাদের দেশে সারা বছরের অর্ধেকেরও বেশি পশু জবাই করা হয় ঈদুল আজহা উপলক্ষে; তাই এসব পশুর বর্জ্যরে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যবান্ধব ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রথমে মূলত ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক চার শতাধিক পশু কোরবানির স্থান নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে সারাদেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে প্রায় ৩ হাজার, সব জেলা শহরে তিন সহস্রাধিক এবং ঢাকার ২টি সিটি করপোরেশনে প্রায় ১২ শত স্থান নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এ বছর সব সিটি করপোরেশন বিশেষ করে রাজধানীর সিটি করপোরেশনদ্বয় বিপুলসংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মাধ্যমে ১২ ঘণ্টার মধ্যে এসব বর্জ্য পরিষ্কারের উদ্যোগ সফল হয়।

আমাদের দেশে পশু বর্জ্যরে উল্ল্যেখযোগ্য অংশের মধ্যে শিং, নাড়িভুঁড়ি, চর্বি, খুর, রক্ত ইত্যাদি অন্যতম। এসবের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব হলে পশুর এসব উচ্ছিষ্টাংশ সমূহকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। জবাইকৃত পশু থেকে প্রায় ১০-২৫ কেজি হাড় উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। শুধু হাড়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বছরে ২০০-৩০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। এসব হাড় থেকে ঔষধ, সিরামিক সামগ্রী, বোতাম, ডেকোরেশন সামগ্রী তৈরির বিশাল বাজার রয়েছে চীন ও থাইল্যান্ডসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

যেসব কারণে পশু বর্জ্যসমূহ থেকে মানবদেহে বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে, সেগুলো হচ্ছে-আবাসস্থলের আশপাশের জলাশয়ে পশু বর্জ্য ফেলে রাখা এবং সে পানি বিভিন্ন গৃহস্থালির কর্মকান্ডে ব্যবহার; যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যতিরেকে কৃষি জমিতে এসব বর্জ্যরে ব্যবহার, অনিরাপদ ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পশু বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা; উন্মুক্ত স্থানের বর্জ্য থেকে মাছি, মশা, পোকা মাকড়ের মাধ্যমে সংক্রামক জীবাণু ছড়িয়ে পড়া এবং ব্যক্তিগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতিরেকে এসব বর্জ্যের সংস্পর্শে আসা ইত্যাদি।

পশু বর্জ্যরে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এবং রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

পশু পালনকালে পশুকে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন, কৃমিনাশক ঔষধ এবং দরকারি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ।

পশু পালন কিংবা মোটাতাজাকরণে নিষিদ্ধ স্টেরয়েডস, হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।

সারাদেশের পশুর হাট কিংবা কোরবানির সময় বিশেষ হাটসমূহে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ।

সরকার গৃহীত নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাইয়ের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলা। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন, স্থানীয় প্রশাসন, ইসলামী ফাউন্ডেশন, পরিবেশবাদী সংগঠন, স্থানীয় জন প্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম ও পরিবেশ অধিদপ্তর বিশেষ প্রচারনা ব্যবস্থা ও ভূমিকা রাখতে পারে।

গ্রামেগঞ্জে পশু জবাইয়ের পর গর্ত করে পশুর রক্ত ও অন্যান্য বর্জ্য পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ।

সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন আয়োজিত পশু জবাইখানায় পর্যাপ্ত সংখ্যাক কসাই, পানির সু-ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুবিধা রাখা।

পশুর গোবর, উচ্ছিষ্ট খাদ্য নির্দিষ্ট স্থানে নিরাপদে সংগ্রহের মাধ্যমে তা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

পশুর হাড়, শিং, নাড়িভুঁড়ি, চর্বি ইত্যাদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে রপ্তানি কাজে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা।

মনুষ্য সৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নত বিশ্বসহ সব দেশই যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট। কিন্তু এর চেয়ে শতগুণ বেশি পশু বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা অনেকটাই অবহেলিত; উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে তা প্রকট। মানুষের দেহের সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের অধিকাংশের ঊৎস এসব বর্জ্য। আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকি মুক্ত রাখতে পশু বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনায় যথাযথ নজর দিতে হবে। এ বছর ঢাকার সিটি করপোরেশনদ্বয় কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দেশের জনগণকে এ বিষয়ে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ]

শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২ , ৩১ আষাঢ ১৪২৯ ১৬ জিলহজ ১৪৪৩

পশুর বর্জ্যে সৃষ্ট রোগ প্রতিরোধে করণীয়

নাজমুল হুদা খান

পালিত হলো মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত এ ঈদে ধর্মপ্রাণ মুসলমান পশু কোরবানি করে থাকেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর কমবেশি ১ কোটি পশু কোরবানি হয়ে থাকে। এ বছরও অনুরূপ সংখ্যায় পশু কোরবানি হয়েছে। ধর্মীয় বিধানে কোরবানির পশুর লালন-পালন, সুস্থতা, কোরবানি করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে এতদসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। পশুর বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি দেশের পরিবেশসহ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের দেশে সারা বছর যে পরিমাণ পশু জবাই করা হয়, এর অর্ধেকেরও বেশি হয় ঈদুল আজহায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ কোটিরও বেশি পশু জবাই করা হয়। সাধারণত কোরবানির ঈদে ঢাকাসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশন এসব পশুর বর্জ্য দ্রুত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে সচেষ্ট থাকে। তবে বিশাল গ্রামীণ অঞ্চল, উপজেলা ও জেলা শহরে এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এসব এলাকায় আবাসস্থলের সন্নিকটের জলাশয়, ডোবা, খাল, নদীতে অপরিকল্পিতভাবে পশুর বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিশ্বব্যাপী সঠিক ব্যবস্থাপনার ঘাটতির ফলে এসব পশু বর্জ্য পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা বিশ্বে পশু সৃষ্ট বর্জ্য মনুষ্য সৃষ্ট বর্জ্যরে চেয়ে প্রায় ১৩০ গুণ বেশি। পশুসম্পদসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে এ বর্জ্যরে পরিমাণ দাঁড়াবে বছরে ৫ বিলিয়ন টন। এসব বর্জ্য থেকে অতিরিক্ত অ্যামোনিয়া, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, মিথেনসহ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু এবং জৈব ও অজৈব ধূলিকনা পরিবেশ দূষণ করে থাকে। অরক্ষিত বর্জ্য থেকে পানি ও মাটিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতব পদার্থ যথা ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, কপার, নিকেল ও লেড তৈরি হয় এবং নানা ধরনের নাইট্রোজেন তৈরি করে মাটিরও দূষণ করে। গবেষকরা বলছেন, বিশ্বের শতকরা ৩৫ ভাগ গ্রিন হাউজ গ্যাসের উৎস পশু বর্জ্য। পশু মোটাতাজাকরণে ব্যবহৃত অবৈধ হরমোন, স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক ও কেমিক্যালস পরিবেশ এবং মানবদেহের মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ) এর মতে, মানবদেহের দুই-তৃতীয়াংশ রোগ জীবাণু ও তিন-চতুর্থাংশ ইমার্জিং জীবাণুর প্রধান উৎস হচ্ছে জীবজন্ত। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশে এসব বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা মানবদেহে সৃষ্ট পানি ও খাদ্যবাহিত রোগজীবাণু সংক্রমণের জন্য বহুলাংশে দায়ী। পশু বর্জ্যরে ওপর অণুজীব বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা যায়, মানবদেহে সৃষ্ট অন্ত্রের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী Vibrio, Salmonella, Klebsiella, E-coli সহ প্রায় নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া; বিভিন্ন প্রকার কৃমি যথা গোল কৃমি, কেঁচো কৃমি, সুতা কৃমি, বক্র কৃমি, ফিতা কৃমিসহ নানা ধরনের রোগ সৃষ্টিকারী কৃমি; খাদ্যনালির বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী প্রোটোজোয়া এবং খাদ্য ও পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গে রোগ সৃষ্টিকারী হেপাটাইটিস, এডিনোভাইরাস, রোটা ভাইরাসসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ জীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। স্তূপকৃত বা ছড়ানো-ছিটানো পশু বর্জ্য থেকে মাছি, মশা ও নানা ধরনের পোকা-মাকড়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ ছড়ায়। পশু খাদ্যে অবৈধ ও অননুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং পরবর্তীতে এসব নিঃসরিত অ্যান্টিবায়োটিকস মাটি, পানিতে মিশে জীবাণুসমূহকে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টি করে।

পশু বর্জ্য সৃষ্ট রোগ ব্যাধির মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ, পরিপাক তন্ত্রের রোগ, পাকস্থলী ও খাদ্যনালির ক্যান্সার, স্নায়ুবিক বৈকল্য ও স্মৃতি শক্তি হ্রাস, গর্ভপাত, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, মানসিক বৈকল্যসহ নানাবিধ রোগ-ব্যাধি অন্যতম। গবেষকদের মতে, মানবদেহে প্রতি ১০টি সংক্রামক রোগের ৬ টি এবং নতুন ইমার্জিং সংক্রামক রোগের তিন চতুর্থাংশই জীব-জন্তু সৃষ্ট। ২০১৫ সালে বিশ্বব্যাপী শিশু মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশই ঘটে পশু বর্জ্য উৎসের জীবাণু সংক্রমণ থেকে।

আমাদের দেশে সারা বছরের অর্ধেকেরও বেশি পশু জবাই করা হয় ঈদুল আজহা উপলক্ষে; তাই এসব পশুর বর্জ্যরে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যবান্ধব ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রথমে মূলত ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক চার শতাধিক পশু কোরবানির স্থান নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে সারাদেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে প্রায় ৩ হাজার, সব জেলা শহরে তিন সহস্রাধিক এবং ঢাকার ২টি সিটি করপোরেশনে প্রায় ১২ শত স্থান নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এ বছর সব সিটি করপোরেশন বিশেষ করে রাজধানীর সিটি করপোরেশনদ্বয় বিপুলসংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মাধ্যমে ১২ ঘণ্টার মধ্যে এসব বর্জ্য পরিষ্কারের উদ্যোগ সফল হয়।

আমাদের দেশে পশু বর্জ্যরে উল্ল্যেখযোগ্য অংশের মধ্যে শিং, নাড়িভুঁড়ি, চর্বি, খুর, রক্ত ইত্যাদি অন্যতম। এসবের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। যথাযথ ব্যবহার করা সম্ভব হলে পশুর এসব উচ্ছিষ্টাংশ সমূহকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। জবাইকৃত পশু থেকে প্রায় ১০-২৫ কেজি হাড় উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। শুধু হাড়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বছরে ২০০-৩০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। এসব হাড় থেকে ঔষধ, সিরামিক সামগ্রী, বোতাম, ডেকোরেশন সামগ্রী তৈরির বিশাল বাজার রয়েছে চীন ও থাইল্যান্ডসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

যেসব কারণে পশু বর্জ্যসমূহ থেকে মানবদেহে বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ে, সেগুলো হচ্ছে-আবাসস্থলের আশপাশের জলাশয়ে পশু বর্জ্য ফেলে রাখা এবং সে পানি বিভিন্ন গৃহস্থালির কর্মকান্ডে ব্যবহার; যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যতিরেকে কৃষি জমিতে এসব বর্জ্যরে ব্যবহার, অনিরাপদ ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পশু বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা; উন্মুক্ত স্থানের বর্জ্য থেকে মাছি, মশা, পোকা মাকড়ের মাধ্যমে সংক্রামক জীবাণু ছড়িয়ে পড়া এবং ব্যক্তিগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতিরেকে এসব বর্জ্যের সংস্পর্শে আসা ইত্যাদি।

পশু বর্জ্যরে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি এবং রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

পশু পালনকালে পশুকে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন, কৃমিনাশক ঔষধ এবং দরকারি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে সঠিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ।

পশু পালন কিংবা মোটাতাজাকরণে নিষিদ্ধ স্টেরয়েডস, হরমোন, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।

সারাদেশের পশুর হাট কিংবা কোরবানির সময় বিশেষ হাটসমূহে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ।

সরকার গৃহীত নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাইয়ের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলা। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন, স্থানীয় প্রশাসন, ইসলামী ফাউন্ডেশন, পরিবেশবাদী সংগঠন, স্থানীয় জন প্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম ও পরিবেশ অধিদপ্তর বিশেষ প্রচারনা ব্যবস্থা ও ভূমিকা রাখতে পারে।

গ্রামেগঞ্জে পশু জবাইয়ের পর গর্ত করে পশুর রক্ত ও অন্যান্য বর্জ্য পুঁতে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ।

সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসন আয়োজিত পশু জবাইখানায় পর্যাপ্ত সংখ্যাক কসাই, পানির সু-ব্যবস্থা ও অন্যান্য সুবিধা রাখা।

পশুর গোবর, উচ্ছিষ্ট খাদ্য নির্দিষ্ট স্থানে নিরাপদে সংগ্রহের মাধ্যমে তা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

পশুর হাড়, শিং, নাড়িভুঁড়ি, চর্বি ইত্যাদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে রপ্তানি কাজে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা।

মনুষ্য সৃষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নত বিশ্বসহ সব দেশই যথাসাধ্য ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট। কিন্তু এর চেয়ে শতগুণ বেশি পশু বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা অনেকটাই অবহেলিত; উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে তা প্রকট। মানুষের দেহের সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের অধিকাংশের ঊৎস এসব বর্জ্য। আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকি মুক্ত রাখতে পশু বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনায় যথাযথ নজর দিতে হবে। এ বছর ঢাকার সিটি করপোরেশনদ্বয় কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ ও ব্যবস্থাপনায় সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দেশের জনগণকে এ বিষয়ে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

[লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ]