শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২, ৩১ আষাঢ ১৪২৯ ১৬ জিলহজ ১৪৪৩

ডলার সংকট

শঙ্কর প্রসাদ দে

একসঙ্গে বহু দেশ মুদ্রামান সংকটে নিপতিত হয়েছে। ইউক্রেন সংকটকে দায়ী করা হচ্ছে এ জন্য যে, আক্রমণকারী রাশিয়া তেল, গ্যাস ও খাদ্য সরবরাহে ইউরোপের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়ায় বহু পণ্যের অবাধ চলাচলে সংকট তৈরি হয়েছে। যেমন; রাশিয়ার তরল গ্যাস, ডলার দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধস সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া বলছে, ক্যাশ রুবেল দিয়ে তেল-গ্যাস কিনতে হবে। ফলে আগে যেখানে ৭০ রুবেলে ১ ডলার কিনতে হতো এখন ৫৫ রুবেল দিয়ে ১ ডলার পাওয়া যাচ্ছে। শ্রীলংকা, জিম্বাবুয়ের মতো যে সব দেশ খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল তারা বেশি ডলার দিয়েও তেল, গ্যাস, চাল গম ভুট্টা পাচ্ছে না। ভয় হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান পাকিস্তাণের জিম্বাবুয়ের মতো বহু দেশ বিদ্যুতের পাশাপাশি খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে।

সমস্যা হচ্ছে, ডলার হলো পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত একক মুদ্রা। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির যুগে কোন দেশের কোষাগারে যে পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ থাকত ওই দেশ, সে অনুপাতে টাকা ছাপাত, আরও সোজা কথায় ওই স্বর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করলে যে পরিমাণ টাকা পেতে পারত সে পরিমাণ টাকা ছাপাত। বেশি ছাপালেই জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো। এর নাম অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি।

১৯২৭ সালে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দার ধাক্কায়। লর্ড মেনার্ড কেইনস্ বললেন, সরকার তুমি ইচ্ছে টাকা ছাপাও, উন্নয়ন কাজ, বয়স্ক ও দুস্থদের ভাতা এবং বাজারে বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে হাজির হয়ে জিনিস কিনে নাগরিকের কাছে বণ্টন কর। কেইন্সের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার মানুষের হাতে দেদার টাকা পৌঁছে দিল। জিনিসের দাম বাড়ল, মুদ্রাস্ফীতি বা পণ্যের দাম বাড়ল তবে মানুষ খাদ্য কিনতে পেরে প্রাণে বাঁচল। এই ফাঁকে পৃথিবী মহামন্দা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেল।

দুটো বিশ^যুদ্ধের কোনটিই আমেরিকার মাটিতে হয়নি। ফলে আমেরিকান ডলার হাজির হলো দোর্দ- প্রতাপে। খুব দ্রুত ডলার আন্তর্জাতিক মুদ্রামানে পরিণত হলো। স্বর্ণমান চলে গেল অর্থনৈতিক জাদুঘরে। ইউক্রেন সংকটে ব্রিটেনসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ আক্রান্ত হলেও আমেরিকা নীরব দূরত্বে ছিল বহাল তবিয়তে। অথচ ইউক্রেনে ন্যাটো ঘাঁটি গড়তে গিয়ে আমেরিকাই সংকট সৃষ্টি করল। পাশের বাড়িতে ডাকাত আশ্রয় নিলে বন্দুক নিয়ে হাজির হওয়া ছাড়া আপনার উপায় থাকে না। রাশিয়ার কাছে সশস্ত্র আক্রমণ ছাড়া বিকল্প রইল না।

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের মুদ্রা ডলার মানে ১০০ টাকা অতিক্রম করেছে। পাকিস্তান অতিক্রম করেছে ২১০ রুপি। ভারত অতিক্রম করেছে আশি টাকা। আমেরিকান এক ডলার কিনতে জিম্বাবুয়ের ৩২২ টাকা (জিম্বাবুয়ে ডলার) লাগছে। সমস্যাটা হলো পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের টাকার মান অনবরত কমছে। অর্থাৎ ১টি ডলার আজ ভারত ৮০ টাকায় কিনতে পারছে। আগামীকাল কিনতে হবে ৮১ টাকায় পরশু কিনতে হবে ৮২ টাকায়। যতই ডলারের দাম বাড়ছে ততই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জিনিসের দাম বেশি পড়ছে। ফলে দেশে জিনিসের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আশঙ্কার দিক হলো, সংকটের কারণে কোন দেশই ডলার ছাড়তে চাইছে না। ডলার যদি কেউ বিক্রি করতে না চায় তবে আমাকে, আপনাকে বা জিম্বাবুয়ে সরকারকে দাম বাড়িয়ে দিয়েই কিনতে হবে এবং সেই ডলার দিয়ে খাদ্য কেনা ছাড়া বিকল্প থাকে না।

এ সংকট মোকাবিলায় জিম্বাবুয়ে সরকার স্বর্ণমুদ্রা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি মুদ্রা তত্বের আদিরূপ। স্বর্ণের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্য ধাতু। জিম্বাবুয়ের কেউ একজন ১ হাজার টাকা কাগুজে নোট নিয়ে বাজার থেকে প্রয়োজনে ৯০০ টাকার মোবাইল সেট ৯০০ টাকায় কিনে নিয়ে আসবেন। কিন্তু ১ হাজার টাকা স্বর্ণমুদ্রা সে সহজে হাত ছাড়া করতে চাইবে না। ভাবখানা এমন হবে দেখি না আরও কিছু দিন ৯০০ টাকার মোবাইল ৫-৬শ’ টাকায় নামে কিনা? মনে রাখতে হবে, বিশ^ব্যাপী অর্থনীতির ওপর ডলারের এই দাদাগিরি এখন রীতিমতো ভীতিকর অবস্থায় উপনীত হয়েছে। দেশে দেশে কাগুজে মুদ্রার বদলে স্বর্ণমুদ্রা চালু করা ছাড়া এ মুহূর্তে ভালো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না।

পৃথিবীর যে কোন মানুষ স্বর্ণমুদ্রা পেলেই রেখে দিতে চাইবে। কাগজের মুদ্রার প্রতি মানুষের এ রকম লোভ কম। বাংলাদেশেও যদি কাগজী মুদ্রার পাশাপাশি স্বর্ণমুদ্রা চালু হয় তখন দেখবেন বহু ধরনের বিলাসদ্রব্য কিনতে মানুষ সতর্ক হয়ে উঠবে। আর ভালো লাগছে না বলে, নতুন মোবাইল সেট কেনার প্রবণতা বাংলাদেশে প্রবল। স্বর্ণমুদ্রা চালু হলে মোবাইল সেট বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসবে। অন্যান্য বিলাসদ্রব্যে চাহিদাও কমবে। আমদানিও কমবে। মোবাইল সেট আমদানিতে বেঁচে যাবে অর্ধেক ডলার। মনে হচ্ছে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি বা মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশও স্বর্ণমুদ্রা প্রচলনের দিকে ধাবিত হবে। স্বর্ণমুদ্রা ডলারের বিরুদ্ধে হতে পারে এক কার্যকর পদক্ষেপ। অল্প দিন অপেক্ষা করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।

[ লেখক : অর্থশাস্ত্রের সাবেক প্রভাষক]

শুক্রবার, ১৫ জুলাই ২০২২ , ৩১ আষাঢ ১৪২৯ ১৬ জিলহজ ১৪৪৩

ডলার সংকট

শঙ্কর প্রসাদ দে

একসঙ্গে বহু দেশ মুদ্রামান সংকটে নিপতিত হয়েছে। ইউক্রেন সংকটকে দায়ী করা হচ্ছে এ জন্য যে, আক্রমণকারী রাশিয়া তেল, গ্যাস ও খাদ্য সরবরাহে ইউরোপের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়ায় বহু পণ্যের অবাধ চলাচলে সংকট তৈরি হয়েছে। যেমন; রাশিয়ার তরল গ্যাস, ডলার দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধস সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া বলছে, ক্যাশ রুবেল দিয়ে তেল-গ্যাস কিনতে হবে। ফলে আগে যেখানে ৭০ রুবেলে ১ ডলার কিনতে হতো এখন ৫৫ রুবেল দিয়ে ১ ডলার পাওয়া যাচ্ছে। শ্রীলংকা, জিম্বাবুয়ের মতো যে সব দেশ খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল তারা বেশি ডলার দিয়েও তেল, গ্যাস, চাল গম ভুট্টা পাচ্ছে না। ভয় হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান পাকিস্তাণের জিম্বাবুয়ের মতো বহু দেশ বিদ্যুতের পাশাপাশি খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে।

সমস্যা হচ্ছে, ডলার হলো পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত একক মুদ্রা। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির যুগে কোন দেশের কোষাগারে যে পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ থাকত ওই দেশ, সে অনুপাতে টাকা ছাপাত, আরও সোজা কথায় ওই স্বর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করলে যে পরিমাণ টাকা পেতে পারত সে পরিমাণ টাকা ছাপাত। বেশি ছাপালেই জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো। এর নাম অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি।

১৯২৭ সালে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দার ধাক্কায়। লর্ড মেনার্ড কেইনস্ বললেন, সরকার তুমি ইচ্ছে টাকা ছাপাও, উন্নয়ন কাজ, বয়স্ক ও দুস্থদের ভাতা এবং বাজারে বস্তাভর্তি টাকা নিয়ে হাজির হয়ে জিনিস কিনে নাগরিকের কাছে বণ্টন কর। কেইন্সের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার মানুষের হাতে দেদার টাকা পৌঁছে দিল। জিনিসের দাম বাড়ল, মুদ্রাস্ফীতি বা পণ্যের দাম বাড়ল তবে মানুষ খাদ্য কিনতে পেরে প্রাণে বাঁচল। এই ফাঁকে পৃথিবী মহামন্দা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ পেল।

দুটো বিশ^যুদ্ধের কোনটিই আমেরিকার মাটিতে হয়নি। ফলে আমেরিকান ডলার হাজির হলো দোর্দ- প্রতাপে। খুব দ্রুত ডলার আন্তর্জাতিক মুদ্রামানে পরিণত হলো। স্বর্ণমান চলে গেল অর্থনৈতিক জাদুঘরে। ইউক্রেন সংকটে ব্রিটেনসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ আক্রান্ত হলেও আমেরিকা নীরব দূরত্বে ছিল বহাল তবিয়তে। অথচ ইউক্রেনে ন্যাটো ঘাঁটি গড়তে গিয়ে আমেরিকাই সংকট সৃষ্টি করল। পাশের বাড়িতে ডাকাত আশ্রয় নিলে বন্দুক নিয়ে হাজির হওয়া ছাড়া আপনার উপায় থাকে না। রাশিয়ার কাছে সশস্ত্র আক্রমণ ছাড়া বিকল্প রইল না।

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশের মুদ্রা ডলার মানে ১০০ টাকা অতিক্রম করেছে। পাকিস্তান অতিক্রম করেছে ২১০ রুপি। ভারত অতিক্রম করেছে আশি টাকা। আমেরিকান এক ডলার কিনতে জিম্বাবুয়ের ৩২২ টাকা (জিম্বাবুয়ে ডলার) লাগছে। সমস্যাটা হলো পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের টাকার মান অনবরত কমছে। অর্থাৎ ১টি ডলার আজ ভারত ৮০ টাকায় কিনতে পারছে। আগামীকাল কিনতে হবে ৮১ টাকায় পরশু কিনতে হবে ৮২ টাকায়। যতই ডলারের দাম বাড়ছে ততই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জিনিসের দাম বেশি পড়ছে। ফলে দেশে জিনিসের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আশঙ্কার দিক হলো, সংকটের কারণে কোন দেশই ডলার ছাড়তে চাইছে না। ডলার যদি কেউ বিক্রি করতে না চায় তবে আমাকে, আপনাকে বা জিম্বাবুয়ে সরকারকে দাম বাড়িয়ে দিয়েই কিনতে হবে এবং সেই ডলার দিয়ে খাদ্য কেনা ছাড়া বিকল্প থাকে না।

এ সংকট মোকাবিলায় জিম্বাবুয়ে সরকার স্বর্ণমুদ্রা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি মুদ্রা তত্বের আদিরূপ। স্বর্ণের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্য ধাতু। জিম্বাবুয়ের কেউ একজন ১ হাজার টাকা কাগুজে নোট নিয়ে বাজার থেকে প্রয়োজনে ৯০০ টাকার মোবাইল সেট ৯০০ টাকায় কিনে নিয়ে আসবেন। কিন্তু ১ হাজার টাকা স্বর্ণমুদ্রা সে সহজে হাত ছাড়া করতে চাইবে না। ভাবখানা এমন হবে দেখি না আরও কিছু দিন ৯০০ টাকার মোবাইল ৫-৬শ’ টাকায় নামে কিনা? মনে রাখতে হবে, বিশ^ব্যাপী অর্থনীতির ওপর ডলারের এই দাদাগিরি এখন রীতিমতো ভীতিকর অবস্থায় উপনীত হয়েছে। দেশে দেশে কাগুজে মুদ্রার বদলে স্বর্ণমুদ্রা চালু করা ছাড়া এ মুহূর্তে ভালো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না।

পৃথিবীর যে কোন মানুষ স্বর্ণমুদ্রা পেলেই রেখে দিতে চাইবে। কাগজের মুদ্রার প্রতি মানুষের এ রকম লোভ কম। বাংলাদেশেও যদি কাগজী মুদ্রার পাশাপাশি স্বর্ণমুদ্রা চালু হয় তখন দেখবেন বহু ধরনের বিলাসদ্রব্য কিনতে মানুষ সতর্ক হয়ে উঠবে। আর ভালো লাগছে না বলে, নতুন মোবাইল সেট কেনার প্রবণতা বাংলাদেশে প্রবল। স্বর্ণমুদ্রা চালু হলে মোবাইল সেট বিক্রি অর্ধেকে নেমে আসবে। অন্যান্য বিলাসদ্রব্যে চাহিদাও কমবে। আমদানিও কমবে। মোবাইল সেট আমদানিতে বেঁচে যাবে অর্ধেক ডলার। মনে হচ্ছে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি বা মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশও স্বর্ণমুদ্রা প্রচলনের দিকে ধাবিত হবে। স্বর্ণমুদ্রা ডলারের বিরুদ্ধে হতে পারে এক কার্যকর পদক্ষেপ। অল্প দিন অপেক্ষা করলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।

[ লেখক : অর্থশাস্ত্রের সাবেক প্রভাষক]