দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে, দূর করা যায়নি পুষ্টিহীনতা

দেশে বিভিন্ন মাইলস্টোন তৈরি হচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশের উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ইমারত। এরই মাঝে দেশের মানুষের পরিস্থিতি তুলে ধরে জাতিসংঘ জানালো দেশের বেশিরভাগ মানুষই স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারে না, ভুগছে পুষ্টিহীনতায়।

গত দুই দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। কিন্তু দূর করা যায়নি পুষ্টিহীনতা। জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে যে গবেষণা করে, সেই গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ মানুষের পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। এই স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য একজন মানুষের দৈনিক খরচ পড়ে প্রায় ২৭৬ টাকা। এই গবেষণাতেই বলা হয়, বাংলাদেশের থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ভুটান।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (ইফাদ), ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে ‘বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে । জাতিসংঘের সদস্য প্রায় সব দেশের তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে এই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মোট জনসংখ্যার হার স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্যরে দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে নেপাল, তারপরই পাকিস্তান। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের অবস্থান কিছুটা ভালো। আরও ভালো অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা ও ভুটান।

কোভিড-১৯ মহামারী বৈশ্বিক ক্ষুধা ও খাদ্য অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। অনেক উন্নতির পরও শিশুদের অপুষ্টি বড় উদ্বেগের কারণ ও স্বাস্থ্যকর খাবারের একটি লম্বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। তাতে বিভিন্ন ধরনের তালিকা থেকে সুষম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা নির্মূল, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সব ধরনের অপুষ্টি দূর করার চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। এ বিষয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ফলমূল কম খাচ্ছি। ফলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাচ্ছে, থাকছে পুষ্টি ঘাটতি। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় শাকসবজি নিশ্চিত করা গেলে পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রোগ-ব্যাধিও শরীরে বাসা বাঁধতে পারবে না।’ ডা. সোহেল বলেন, ‘সুস্থ থাকার জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে প্রতিদিন। এগুলো ঠিকমতো না পেলে শরীরের সঠিক বিকাশ হয় না। প্রয়োজনীয় ক্যালোরি পেতে ৮ পুষ্টি উপাদানের সবগুলোই পাওয়া যায় বিভিন্ন খাবার থেকে। যেমন, প্রোটিন, ভিটামিন ডি, আয়রন, ভিটামিন সি, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন বি, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান করার বিকল্প নেই। তাই খাবারে রাখতে হবে সচেতনভাবে।’

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, ‘অর্থনীতির রূপান্তরের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটছে। এখনকার খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যতালিকায় যে জিনিসটির ঘাটতি সবচেয়ে বেশি তা হচ্ছে ফলমূল। পুষ্টি চাহিদা পূরণে একজন মানুষের দৈনিক ১০০ গ্রাম ফল খেতে হয়। কিন্তু দেশে মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ৩৬ গ্রাম। অস্বাস্থ্যকর হলেও বিশ্বের অন্য যেকোন অঞ্চলের চেয়ে বেশি মসলা ব্যবহার করছি আমরা। আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক সবজি গ্রহণের কাক্সিক্ষত মাত্রা ৩০০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১৬৭ গ্রাম। প্রয়োজনের তুলনায় কম ভোগ হচ্ছে সবজিও।’

ড. শামসুল আরও বলেন, ‘প্রয়োজনের তুলনায় কম ভোগ হচ্ছে ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি-গুড় ও প্রাণিজ উৎসের খাদ্যও। আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক ডাল গ্রহণের কাক্সিক্ষত মাত্রা ৫০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১৬ গ্রাম। মাথাপিছু ভোজ্যতেল প্রয়োজন ৩০ গ্রাম, প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ২৮ গ্রাম। প্রাণিজ উৎসের খাদ্য প্রয়োজন ২৬০ গ্রাম, প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১২৯ গ্রাম। মাথাপিছু চিনি-গুড়ের প্রয়োজন ২০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ মাত্র সাত গ্রাম।’

জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪-১৬ সময়কালে তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ছিল ৫ কোটি ৪ লাখ মানুষ। তিন বছর পর অর্থাৎ ২০১৯-২১ সময়কালে একই ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ৫ কোটি ২৩ লাখ মানুষ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ এ অনিশ্চয়তায় বসবাস করছিল। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাস্থ্যকর খাবার খায় না বা খেতে পারে না। পাঁচটি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য একজন মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হতো ২৭২ টাকা ১৬ পয়সা।

ওই সময় দেশের ১১ কোটি ৯৮ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। ২০২০ সালে দৈনিক স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য খরচ বেড়ে হয় ২৭৫ টাকা ৭৬ পয়সা। কিন্তু দেশের ১২ কোটি ১১ লাখ মানুষের দৈনিক ওই পরিমাণ টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। এই সামর্থ্যহীন মানুষ মোট জনসংখ্যার ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪টি উপকরণ নিয়ে প্রতিদিনের একটি খাদ্যতালিকা রয়েছে। উন্নত দেশে এটি ১৮-২০ ধরনের হতে পারে। সেখান থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচটি উপকরণ দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় থাকা প্রয়োজন। আর্থিক সামর্থ্যরে বিচারে অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে সেটি। আবার এ বিষয়ে সচেতনতারও অভাব রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, ‘দেশের মানুষের উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হলেও প্রাণিজ প্রোটিনের ঘাটতি আছে। আবার ফ্যাটযুক্ত খাবার যাদের প্রয়োজন, তারা খেতে পারছে না। যাদের প্রয়োজন নেই, তারা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে এমন অনেক অসংগতি রয়েছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০ শতাংশ শিশু কৃশকায় অর্থাৎ এরা তীব্র অপুষ্টির শিকার। পাশাপাশি একই বয়সী ৩০ শতাংশ শিশু খর্বকায়, অর্থাৎ বয়সের তুলনায় এদের উচ্চতা কম। অন্যদিকে ২ শতাংশের বেশি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বিভিন্ন সময়ের শিশু পুষ্টির যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, কৃশকায় ও খর্বকায় শিশুর হার দিন দিন কমছে, তবে অস্বাভাবিক বেশি ওজনের শিশুর হার বাড়ছে।

বয়স্ক মানুষের মধ্যেও বেশি ওজনের প্রবণতা বাড়ছে। ২০১২ সালে অস্বাভাবিক ওজনের মানুষ ছিল মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা বেড়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়।

নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতির কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৩৬ শতাংশের মধ্যে রক্তস্বল্পতা ছিল। ২০১৯ সালে একই বয়সী নারীদের ৩৭ শতাংশের এ সমস্যা ছিল।

ডব্লিউএইচওর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, খাবারে বৈচিত্র্যের উপস্থিতি কম ও পুষ্টিকর পরিপূরক খাবারের অপর্যাপ্ততাকে দুর্বল ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চাইল্ড ফিডিং (আইওয়াইসিএফ) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এটিকে শিশুর খর্বাকৃতির প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতিরিক্ত যেকোন খাবারই শরীরের জন্য খারাপ। পুষ্টিকর খাবারও বেশি পরিমাণে খেলে সেটা সমস্যার কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার গ্রহণ না করাই ভালো। স্থ’ূলতা, হৃদরোগ, গ্যাস্ট্রিক আলসার ও ক্যান্সারের মতো রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস অনেকাংশেই দায়ী।

তবে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নিজেদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।

শনিবার, ১৬ জুলাই ২০২২ , ০১ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৭ জিলহজ ১৪৪৩

দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে, দূর করা যায়নি পুষ্টিহীনতা

জাহিদা পারভেজ ছন্দা

দেশে বিভিন্ন মাইলস্টোন তৈরি হচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দেশের উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ইমারত। এরই মাঝে দেশের মানুষের পরিস্থিতি তুলে ধরে জাতিসংঘ জানালো দেশের বেশিরভাগ মানুষই স্বাস্থ্যকর খাবার কিনতে পারে না, ভুগছে পুষ্টিহীনতায়।

গত দুই দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে অর্ধেকেরও বেশি। কিন্তু দূর করা যায়নি পুষ্টিহীনতা। জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে যে গবেষণা করে, সেই গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ মানুষের পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। এই স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য একজন মানুষের দৈনিক খরচ পড়ে প্রায় ২৭৬ টাকা। এই গবেষণাতেই বলা হয়, বাংলাদেশের থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ভুটান।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (ইফাদ), ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে ‘বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে । জাতিসংঘের সদস্য প্রায় সব দেশের তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে এই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মোট জনসংখ্যার হার স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্যরে দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে নেপাল, তারপরই পাকিস্তান। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের অবস্থান কিছুটা ভালো। আরও ভালো অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা ও ভুটান।

কোভিড-১৯ মহামারী বৈশ্বিক ক্ষুধা ও খাদ্য অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। অনেক উন্নতির পরও শিশুদের অপুষ্টি বড় উদ্বেগের কারণ ও স্বাস্থ্যকর খাবারের একটি লম্বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। তাতে বিভিন্ন ধরনের তালিকা থেকে সুষম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা নির্মূল, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সব ধরনের অপুষ্টি দূর করার চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। এ বিষয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ফলমূল কম খাচ্ছি। ফলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাচ্ছে, থাকছে পুষ্টি ঘাটতি। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় শাকসবজি নিশ্চিত করা গেলে পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রোগ-ব্যাধিও শরীরে বাসা বাঁধতে পারবে না।’ ডা. সোহেল বলেন, ‘সুস্থ থাকার জন্য পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে প্রতিদিন। এগুলো ঠিকমতো না পেলে শরীরের সঠিক বিকাশ হয় না। প্রয়োজনীয় ক্যালোরি পেতে ৮ পুষ্টি উপাদানের সবগুলোই পাওয়া যায় বিভিন্ন খাবার থেকে। যেমন, প্রোটিন, ভিটামিন ডি, আয়রন, ভিটামিন সি, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন বি, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান করার বিকল্প নেই। তাই খাবারে রাখতে হবে সচেতনভাবে।’

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, ‘অর্থনীতির রূপান্তরের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটছে। এখনকার খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যতালিকায় যে জিনিসটির ঘাটতি সবচেয়ে বেশি তা হচ্ছে ফলমূল। পুষ্টি চাহিদা পূরণে একজন মানুষের দৈনিক ১০০ গ্রাম ফল খেতে হয়। কিন্তু দেশে মাথাপিছু ফল গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ৩৬ গ্রাম। অস্বাস্থ্যকর হলেও বিশ্বের অন্য যেকোন অঞ্চলের চেয়ে বেশি মসলা ব্যবহার করছি আমরা। আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক সবজি গ্রহণের কাক্সিক্ষত মাত্রা ৩০০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১৬৭ গ্রাম। প্রয়োজনের তুলনায় কম ভোগ হচ্ছে সবজিও।’

ড. শামসুল আরও বলেন, ‘প্রয়োজনের তুলনায় কম ভোগ হচ্ছে ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি-গুড় ও প্রাণিজ উৎসের খাদ্যও। আদর্শ খাদ্যতালিকা অনুযায়ী, মাথাপিছু দৈনিক ডাল গ্রহণের কাক্সিক্ষত মাত্রা ৫০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১৬ গ্রাম। মাথাপিছু ভোজ্যতেল প্রয়োজন ৩০ গ্রাম, প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ২৮ গ্রাম। প্রাণিজ উৎসের খাদ্য প্রয়োজন ২৬০ গ্রাম, প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ ১২৯ গ্রাম। মাথাপিছু চিনি-গুড়ের প্রয়োজন ২০ গ্রাম হলেও প্রকৃত গ্রহণের পরিমাণ মাত্র সাত গ্রাম।’

জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪-১৬ সময়কালে তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ছিল ৫ কোটি ৪ লাখ মানুষ। তিন বছর পর অর্থাৎ ২০১৯-২১ সময়কালে একই ধরনের খাদ্য অনিশ্চয়তায় ৫ কোটি ২৩ লাখ মানুষ। অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ এ অনিশ্চয়তায় বসবাস করছিল। তবে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ স্বাস্থ্যকর খাবার খায় না বা খেতে পারে না। পাঁচটি সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য একজন মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হতো ২৭২ টাকা ১৬ পয়সা।

ওই সময় দেশের ১১ কোটি ৯৮ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না। ২০২০ সালে দৈনিক স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য খরচ বেড়ে হয় ২৭৫ টাকা ৭৬ পয়সা। কিন্তু দেশের ১২ কোটি ১১ লাখ মানুষের দৈনিক ওই পরিমাণ টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই। এই সামর্থ্যহীন মানুষ মোট জনসংখ্যার ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৪টি উপকরণ নিয়ে প্রতিদিনের একটি খাদ্যতালিকা রয়েছে। উন্নত দেশে এটি ১৮-২০ ধরনের হতে পারে। সেখান থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচটি উপকরণ দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় থাকা প্রয়োজন। আর্থিক সামর্থ্যরে বিচারে অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে সেটি। আবার এ বিষয়ে সচেতনতারও অভাব রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বলেন, ‘দেশের মানুষের উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হলেও প্রাণিজ প্রোটিনের ঘাটতি আছে। আবার ফ্যাটযুক্ত খাবার যাদের প্রয়োজন, তারা খেতে পারছে না। যাদের প্রয়োজন নেই, তারা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে এমন অনেক অসংগতি রয়েছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ১০ শতাংশ শিশু কৃশকায় অর্থাৎ এরা তীব্র অপুষ্টির শিকার। পাশাপাশি একই বয়সী ৩০ শতাংশ শিশু খর্বকায়, অর্থাৎ বয়সের তুলনায় এদের উচ্চতা কম। অন্যদিকে ২ শতাংশের বেশি শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বিভিন্ন সময়ের শিশু পুষ্টির যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, কৃশকায় ও খর্বকায় শিশুর হার দিন দিন কমছে, তবে অস্বাভাবিক বেশি ওজনের শিশুর হার বাড়ছে।

বয়স্ক মানুষের মধ্যেও বেশি ওজনের প্রবণতা বাড়ছে। ২০১২ সালে অস্বাভাবিক ওজনের মানুষ ছিল মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা বেড়ে ৩ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়।

নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতির কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৩৬ শতাংশের মধ্যে রক্তস্বল্পতা ছিল। ২০১৯ সালে একই বয়সী নারীদের ৩৭ শতাংশের এ সমস্যা ছিল।

ডব্লিউএইচওর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, খাবারে বৈচিত্র্যের উপস্থিতি কম ও পুষ্টিকর পরিপূরক খাবারের অপর্যাপ্ততাকে দুর্বল ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চাইল্ড ফিডিং (আইওয়াইসিএফ) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এটিকে শিশুর খর্বাকৃতির প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতিরিক্ত যেকোন খাবারই শরীরের জন্য খারাপ। পুষ্টিকর খাবারও বেশি পরিমাণে খেলে সেটা সমস্যার কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার গ্রহণ না করাই ভালো। স্থ’ূলতা, হৃদরোগ, গ্যাস্ট্রিক আলসার ও ক্যান্সারের মতো রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাস অনেকাংশেই দায়ী।

তবে পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নিজেদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।