ভারী বৃষ্টি না হলে গরম কমবে না

আষাঢ়-শ্রাবণে অবিরাম বৃষ্টি এখন বলতে গেলে স্মৃতি। বর্ষার বৃষ্টি যেন কেড়ে নিয়েছে জ্যৈষ্ঠ, হেমন্তের কার্তিক কখনো বা শীতের মাঘ মাস। আষাঢ়ের শেষে ও শ্রাবণের শুরুতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রার তাপপ্রবাহ চলছে। ভরা বর্ষা মৌসুম চললেও খরতাপে পুড়ছে প্রায় সর্বত্র। আকাশে মেঘ নেই। বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে হালকা সাদা মেঘের দেখা মেলে। বাংলাদেশে শরৎ ও হেমন্তকালের আকাশে এমন অবস্থা দেখা যায়। কিন্তু বর্তমানে শরতের অবস্থাই বিরাজ করছে। আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, আগামী দুই একদিন হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও ভারী বৃষ্টি না হলে এ তাপমাত্রা থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই।

দেশের উত্তরের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকের খেত পানিশূন্য। কৃষক ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না। সময় মতো বীজতলা তৈরি করতে না পারায় ধানও রোপণ করতে পারছে না। আগামী মৌসুমে খাদ্য নিরাপত্তায় এর প্রভাব পড়তে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্ষাকাল শুরুর আগে কখনো বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো বর্ষার পর বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে, সেটি স্বাভাবিকের চাইতে গড়ে অনেক কম। বাংলাদেশে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় আষাঢ় মাস, আর শ্রাবণ শেষ হয় আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত ২০২১ সালের চেয়ে গত বৃহস্পতিবার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। আর গতকালের তাপমাত্রা গতবছরের তুলনায় এক দশমিক ৫ ডিগ্রি বেশি ছিল।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ৪৪ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এভাবে চললে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর জলবায়ুর মান বৈশ্বিক উষ্ণতা যত বাড়ছে তত বদলে যাচ্ছে। এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসছে ঘন ঘন আর ধ্বংসের শক্তি নিয়ে। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উত্তরে গলছে বরফ, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণের অনেক দ্বীপ দেশ। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাও সেই ঝুঁকির মধ্যে চলে আসছে। এর মধ্যে দেশে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষ গ্রীষ্ম দীর্ঘায়িত হতে দেখছে, গরমও বাড়ছে। আবার শীতকালেও গড় তাপমাত্রা বেশি থাকছে। শীতকালে বৃষ্টির দেখা মিললেও বর্ষায় বৃষ্টির দেখা পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনে ঋতুবৈচিত্র্য যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

বর্ষাকালে কম বৃষ্টির জন্য জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন। আইপিসিসি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান বলেন, ‘আকাশে ক্লাউড ফরমেশন হয়। তবে সেই ক্লাউড ফরমেশন বা মেঘে যথেষ্ট পানি থাকে না। এটা উপরে চলে যায়। আর উপরে গিয়ে মেঘ বরফ হয়ে থাকে সেটা আর নিচে এসে পানি হয়। সেই পানি হতে সময় পায় না কারণ উষ্ণতা, নিচ থেকেও বায়ু গিয়ে থাক্কা দেয় যেটা আর মাটিতে পড়ার সুযোগ পায় না।

দেশের উত্তরের পুকুরগুলো শুকিয়ে গেছে। কারণ বাষ্পয়াণ হয়েছে সেই বাষ্পায়ণের ফলে মেঘ তো বৃষ্টিতে রূপান্তিত হয়ে পুকুর ভরেনি। এ সময় কেন বৃষ্টি হচ্ছে না কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের আকাশে মেঘ যে হয় না তা নয়, কিন্তু সেই মেঘে যে পানি থাকে তা ভূ-পৃষ্টে নামার আগেই গরমে বাষ্প হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা বৃষ্টি বেশি পেতাম আমাদের মেঘটা তৈরি হতো হিমালয়ের পাদদেশ থেকে। সেই মেঘ উপরে উঠে আস্তে আস্তে সেই মেঘ আমাদের এদিকে এসে ওজন বেড়ে যেত আর পানি হয়ে পড়ে যেত। সেটা কোন কারণে হতে পারছে না। সেই কারণ সঠিকভাবে বলা কঠিন।’

তিনি মনে করেন শ্রাবণের শেষের দিকে কিছুটা বৃষ্টির সম্ভবনা তৈরি হবে।

সম্প্রতি তাপমাত্রার এমন আচরণের বিষয়ে আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান জানান, ২০১৫ সালের পর থেকে দেশে উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়েছে বেশি। তবে চলতি বছর তা অনান্য বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা কমার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপাতত দুই-তিন দিন বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা নেই। যদিও বিছিন্নভাবে হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে তবে সেই বৃষ্টি বর্তমান তাপ কমার জন্য যথেষ্ট নয়। এই তাপ কমতে হলে ভারী বৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে।’ তবে উষ্ণতা বৃদ্ধির এই প্রবণতার মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর কিছুটা ব্যতিক্রম।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া সর্বশেষ তথ্য মতে, গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রংপুরেরর সৈয়দপুরে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনি¤œ তাপমাত্রা চট্টগ্রামের হাতিয়ায় ৩১. ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

শনিবার, ১৬ জুলাই ২০২২ , ০১ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৭ জিলহজ ১৪৪৩

ভারী বৃষ্টি না হলে গরম কমবে না

শাফিউল ইমরান

আষাঢ়-শ্রাবণে অবিরাম বৃষ্টি এখন বলতে গেলে স্মৃতি। বর্ষার বৃষ্টি যেন কেড়ে নিয়েছে জ্যৈষ্ঠ, হেমন্তের কার্তিক কখনো বা শীতের মাঘ মাস। আষাঢ়ের শেষে ও শ্রাবণের শুরুতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মাত্রার তাপপ্রবাহ চলছে। ভরা বর্ষা মৌসুম চললেও খরতাপে পুড়ছে প্রায় সর্বত্র। আকাশে মেঘ নেই। বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে হালকা সাদা মেঘের দেখা মেলে। বাংলাদেশে শরৎ ও হেমন্তকালের আকাশে এমন অবস্থা দেখা যায়। কিন্তু বর্তমানে শরতের অবস্থাই বিরাজ করছে। আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, আগামী দুই একদিন হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকলেও ভারী বৃষ্টি না হলে এ তাপমাত্রা থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই।

দেশের উত্তরের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকের খেত পানিশূন্য। কৃষক ধানের চারা রোপণ করতে পারছে না। সময় মতো বীজতলা তৈরি করতে না পারায় ধানও রোপণ করতে পারছে না। আগামী মৌসুমে খাদ্য নিরাপত্তায় এর প্রভাব পড়তে পারে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্ষাকাল শুরুর আগে কখনো বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো বর্ষার পর বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ়-শ্রাবণের সেই মুষলধারার বৃষ্টি এখন আর নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পরিমাণও কমে গেছে। এতটাই কমেছে যে, সেটি স্বাভাবিকের চাইতে গড়ে অনেক কম। বাংলাদেশে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় আষাঢ় মাস, আর শ্রাবণ শেষ হয় আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত ২০২১ সালের চেয়ে গত বৃহস্পতিবার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। আর গতকালের তাপমাত্রা গতবছরের তুলনায় এক দশমিক ৫ ডিগ্রি বেশি ছিল।

বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ৪৪ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এভাবে চললে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পৃথিবীর জলবায়ুর মান বৈশ্বিক উষ্ণতা যত বাড়ছে তত বদলে যাচ্ছে। এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসছে ঘন ঘন আর ধ্বংসের শক্তি নিয়ে। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে উত্তরে গলছে বরফ, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দক্ষিণের অনেক দ্বীপ দেশ। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাও সেই ঝুঁকির মধ্যে চলে আসছে। এর মধ্যে দেশে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষ গ্রীষ্ম দীর্ঘায়িত হতে দেখছে, গরমও বাড়ছে। আবার শীতকালেও গড় তাপমাত্রা বেশি থাকছে। শীতকালে বৃষ্টির দেখা মিললেও বর্ষায় বৃষ্টির দেখা পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনে ঋতুবৈচিত্র্য যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

বর্ষাকালে কম বৃষ্টির জন্য জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন। আইপিসিসি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস) নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান বলেন, ‘আকাশে ক্লাউড ফরমেশন হয়। তবে সেই ক্লাউড ফরমেশন বা মেঘে যথেষ্ট পানি থাকে না। এটা উপরে চলে যায়। আর উপরে গিয়ে মেঘ বরফ হয়ে থাকে সেটা আর নিচে এসে পানি হয়। সেই পানি হতে সময় পায় না কারণ উষ্ণতা, নিচ থেকেও বায়ু গিয়ে থাক্কা দেয় যেটা আর মাটিতে পড়ার সুযোগ পায় না।

দেশের উত্তরের পুকুরগুলো শুকিয়ে গেছে। কারণ বাষ্পয়াণ হয়েছে সেই বাষ্পায়ণের ফলে মেঘ তো বৃষ্টিতে রূপান্তিত হয়ে পুকুর ভরেনি। এ সময় কেন বৃষ্টি হচ্ছে না কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের আকাশে মেঘ যে হয় না তা নয়, কিন্তু সেই মেঘে যে পানি থাকে তা ভূ-পৃষ্টে নামার আগেই গরমে বাষ্প হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা বৃষ্টি বেশি পেতাম আমাদের মেঘটা তৈরি হতো হিমালয়ের পাদদেশ থেকে। সেই মেঘ উপরে উঠে আস্তে আস্তে সেই মেঘ আমাদের এদিকে এসে ওজন বেড়ে যেত আর পানি হয়ে পড়ে যেত। সেটা কোন কারণে হতে পারছে না। সেই কারণ সঠিকভাবে বলা কঠিন।’

তিনি মনে করেন শ্রাবণের শেষের দিকে কিছুটা বৃষ্টির সম্ভবনা তৈরি হবে।

সম্প্রতি তাপমাত্রার এমন আচরণের বিষয়ে আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান জানান, ২০১৫ সালের পর থেকে দেশে উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়েছে বেশি। তবে চলতি বছর তা অনান্য বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা কমার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপাতত দুই-তিন দিন বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা নেই। যদিও বিছিন্নভাবে হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে তবে সেই বৃষ্টি বর্তমান তাপ কমার জন্য যথেষ্ট নয়। এই তাপ কমতে হলে ভারী বৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে।’ তবে উষ্ণতা বৃদ্ধির এই প্রবণতার মধ্যে রাজশাহী ও রংপুর কিছুটা ব্যতিক্রম।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া সর্বশেষ তথ্য মতে, গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রংপুরেরর সৈয়দপুরে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনি¤œ তাপমাত্রা চট্টগ্রামের হাতিয়ায় ৩১. ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।