শিক্ষার দুরবস্থার দায় কার

মাছুম বিল্লাহ

ময়মনসিংহের একজন শিক্ষক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,‘ক্লাসরুম কন্ট্রোল করা যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্লাসের সামনের সারির অল্প কয়েকজন কিছু শিক্ষকদের কথা শুনলেও পেছনের দিকের সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ব্যস্ত থাকে। বারবার অনুরোধ করার পরেও এক দুই মিনিটের জন্য শান্ত হলেও শিক্ষক যখন আবার পড়াতে শুরু করেন, তারাও আবার পূর্বের মতো নিজেদের আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’ তিনি আরও লিখেছেন ‘আমরাও তো এক দিন ছাত্র ছিলাম। শিক্ষকগণ ক্লাসে এলে সবাই শান্ত হয়ে যেতাম। স্যার যা ক্লাসে বলতেন তাই করতাম। আজকের এই উল্টো চিত্রের জন্য দায়ী কে? শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে চায় না, এলেও ক্লাসরুমে যেতে চায় না, ক্লাসরুমে যারা যায় তারাও ক্লাস লেকচার শোনার প্রতি মনেযোগী হয় না। লেকচার শোনার পরিবর্তে স্মার্টফোন ও ফেসবুকে চ্যাটিংয়ে অনেক বেশি মনোযোগী।’

সমাজের অসংগতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার প্রভাব সবই উঠে এসেছে এই শিক্ষকের লেখায়। শিক্ষার্থীরা বর্তমানে পড়লেও পাস করে, না পড়লেও পাস করে উচ্চতর গ্রেডসহ। সেখানে তারা পড়বে কেন? আর শ্রেণীকক্ষে লেকচারের চেয়ে ফেসবুক ইউটিউবের আকর্ষণ অনেক বেশি ... ওই বয়সের এবং বর্তমান সমাজের বাসিন্দা হয়ে তারা কেন ক্লাস লেকচার শুনবে। তারা যদি জানে বা বুঝে যে, তাদের শ্রেণীকক্ষের পড়া না পড়লে, শিক্ষকের ক্লাস না করলে কোনভাবেই পাস করতে পারবে না। আবার পরীক্ষায় কোন ধরনের অসদুপায় অবলম্বন করা যাবে না। এগুলোর কোনটিই নেই। তাই তারা ক্লাস করে না, পড়ে না। পরীক্ষার জন্য মোটেই চিন্তিত নয়। এগুলোর সব সমাধান করা আলাদাভাবে একজন শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই উক্ত শিক্ষক এসব কথা লিখেছেন, যা আজ প্রায় সব শিক্ষকেরই কথা।

প্রকৃত অর্থে যদি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে ফলাফল যা হয় বা হবে, তা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে। ঢাবির ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নœাতক সম্মান প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। পাসের হার ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষার্থী আর উত্তীর্ণ হয়েছে ১১ হাজার ৪৬৬ জন। ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় কৃতকার্যের হার ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ আর অকৃতকার্য ৯১ দশমিক ৪২ শতাংশ। এটিই প্রকৃত চিত্র। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা সঠিকভাবে নেওয়া হলে ফল এরকমই দাঁড়াবে। কিন্তু এ নিয়ে কারুর কোন রা নেই। জুন মাসের ২৭ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা কয়কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো তা এ রকমই। দশম শ্রেণীর ৮৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনও যখন কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিল না, প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম এসএসসিতে তার বিদ্যালয়ের গতবারের ফল কি? তিনি বললেন শতভাগ পাস। কিছু না পারলেও, না পড়লেও যখন শতভাগ পাস, তখন শিক্ষার্থীরা পড়বে কেন?

অন্য একজন শিক্ষক লিখেছেন, ‘জীবনে অসংখ্যবার শিক্ষকের ধমক ও বকা খেয়েছি, জোড়া বেতের ঘা খেয়েছি, সবার সামনে কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে হয়েছে, দুই আঙুলের মধ্যে পেন্সিল ঢুকিয়ে চেপে হাতের আঙুল শিক্ষক ব্যথা করে দিয়েছেন, কান টেনে লাল করে দিয়েছেন, চুলের কলি ও পরের দিকে টেনে ধরে পুরো কান ও মাথাব্যথা করে দিয়েছেন। তারপরও শিক্ষকের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করিনি কখনো। এমনকি বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকেও শাস্তির কথা ভয়ে ও লজ্জায় বলতে পারিনি কখনো। কিন্তু আজ আমরা শিক্ষার্থীদের ধমকের সুরে কথা বলতে পারি না। অনুরোধ করে বললেও তারা আমাদের পাত্তা দেয় না।’ সম্প্রতি যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনার কিছু বিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি, শ্রেণীকক্ষে গিয়েছি। শিক্ষকদের কথা ‘আমাদের হাত থেকে বেত নিয়ে গেছে, তাই শিক্ষার্থীরা এতটা বেয়াদব হয়েছে।’

ওপরের কোন কথাই কিন্তু আদর্শিক নয়। যেমন পূর্বের শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের অনেক শাস্তি দিতেন, তারপর লেখাপড়া শেখাতেন। ওই সময়কার শিক্ষকদের নৈতিকতা ছিল অনেক উন্নত, তাই তারা শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি প্রদান করলেও সমাজের কেউ কিছু তাদের বলতেন না। আর শিক্ষার্থীরাও এতটা স্মার্ট কিংবা নিজেদের অধিকার নিয়ে এতটা সচেতন ছিল না। তাই মনে করা হতো পড়াশোনা শাস্তির মাধ্যমেই করাতে হয়। বিষয়টি ঠিক নয়। ছোট একজন শিক্ষার্থীরও আত্মসম্মান আছে, যা ওই যুগের শিক্ষকগণ বুঝতেন না। তারা মনে করতেন শাস্তি না দিয়ে শিক্ষা হয় না। তারা পেশার প্রতি অত্যন্ত ডেডিকেটেড ছিলেন কিন্তু শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়ে আধুনিককালের মতো এত স্মার্ট ছিলেন না। আর বর্তমানে শিক্ষার্থীদের যে অবস্থা হয়েছে সেটিও কোনভাবে কাম্য নয়।

আমরা দেখলাম নড়াইলের মির্জাপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ^াসকে জুতার মালা গলায় দিয়ে ঘোরানো হয়েছে। কাজটি যিনি সংগঠিত করতে ভূমিকা রেখেছেন তিন স্বপন কুমার বিশ^াসের এক সময়ের ছাত্র। নড়াইলে মির্জাপুরে ওই কলেজের অধ্যক্ষের পদটি নিয়ে লড়াই চলছিল অনেক দিন। এ দুই স্থানে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। রাজনীতিকে ব্যবহার করা হয়েছে। সাভারের আশুলিায়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই স্কুলের ছাত্র বখাটে জিতু। সে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত। তাকে শাসন করার অপরাধে প্রান হারিয়েছেন শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। তিনি তো একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্বই পালন করেছেন কিন্তু তার ফল হচ্ছে এই। উৎপল স্যার তার কলেজে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকায় সব ছাত্রছাত্রীর নিরাপত্তা, শিষ্টাচার, নৈতিকতা ও আদর্শ শিক্ষা নিশ্চিত করাতেন। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করা একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার শিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা ছিল অনেক আন্তরিক। শিক্ষার্থীদের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা তুঙ্গে।

কিন্তু এই সমাজ তাকে কি দিল? বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি, কলেজের অধ্যক্ষ জানেন তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী তারই শিক্ষাঙ্গনের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র-সংগঠনের সভাপতি। ইচ্ছা করলে ওই সভাপতি তাকে বিপদে ফেলতে পারেন। কাজেই ভিসি ও অধ্যক্ষদের ইদানীংকালে প্রধানশিক্ষকদেরও সেভাবেই প্রশাসন চালাতে হয়। তারপরেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানপ্রধান অনেক কষ্টে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এভাবে সবাইকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায়কারীদের রক্তচক্ষু দেখে ভীত হলে, হাল ছেড়ে দিলে কিংবা আশাহত হলে চলবে না। তাই বলছি যে শিক্ষক লিখেছেন যে, শিক্ষার্থীরা তাদের লেকচার শোনে না। এখন কিন্তু সেই লেকচারের দিন আর নেই। এখন শিক্ষার্থীদের কীভাবে, কতভাবে শ্রেণী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো যায়, সেটি করাতে হবে, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।

নড়াইলে দুংখজন ঘটনার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই মোবাইলফোন আনতে পারবে না বলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এভাবেই অথরিটি নিয়ে কাজ করতে হয়। তবে, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাদের টনক নড়ে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা... অনেককেই দেখেছি তাদের উৎসাহ শিক্ষক নিয়োগ, কমিটি গঠন ইত্যাদি বিষয়ে অর্থাৎ বৈষয়িক বিষয় যেখানে জড়িত ওনারাও সেখানে বেশি জড়িত। একাডেমিক বিষয় গোল্লায় যাচ্ছে, শিক্ষাদান কেমন হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। আর এগুলো করতে হলে তো নিজেদের পড়াশোনা করতে হবে, সেই সময় তাদের কই। আর পড়াশোনা করলে তো আর প্রশাসক বনে যায় না, তাই তারাও প্রশাসক হতে চান, একাডেমিক নয়। আর তাই সমাজও চলছে সেভাবে।

শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক লাঞ্জনার ঘটনাবলি সমাজ ও রাষ্ট্রে গভীর ক্ষতের বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্র রাজনীতি হয়ে ওঠে সহিংস। এখন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে শিক্ষক রাজনীতি। লাল, নীল, গোলাপি, সাদা-নানা বর্ণে বিভক্ত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জাতীয় রাজনীতির রাজনৈতিক দলে অঙ্গসংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচিত করছেন। কাজেই সমাজকে দোষ দিয়ে লাভ কী? পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় শিকড় গেড়েছে অনৈতিকতা, সেটি প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে কি হচ্ছে? বিশ^বিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, যে পেশিশক্তির মহড়া ও চড় দখলের খেলা চলছে সেগুলো কি কেউ কোনভাবে মেনে নিতে পারে? তবে, এসব বিষয়ে শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি বাদ দিয়ে। কখনো রাজনীতিবিদ কিংবা প্রভাবশালীদের দিকে তাকিয়ে শিক্ষাঙ্গনে প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কতটা কাজে দিবে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। কাজেই শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষ থেকে শুরু করতে হবে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা, আধুনিক শিক্ষা, আকর্ষণীয় শিক্ষাদান ও উন্নত ব্যক্তিত্ব।

আমাদের দেশের পিতামাতারা সন্তানকে মেধাবী হিসেবে দেখতে চান, সেটি তো সব মা-বাবাই চান এবং চাবেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের সন্তান একজন আদর্শ শিক্ষার্থী, আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছে কি না, সেটি দেখাও একান্ত কর্তব্য। কারণ, সমাজের যে পচন ধরেছে এটি শুধু রাজনীতি, শুধুমাত্র সমাজ কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা পুলিশকে দোষারোপ করলে হবেনা। সমাজের এখন যা অবস্থা হয়েছে, তা কিন্তু কারোরই নিয়ন্ত্রণে নেই। কাজেই যার যার অবস্থান থেকে, প্রতিটি পরিবার থেকে নৈতিকতার শিক্ষা, ধৈর্য ধরার শিক্ষা, মানবিকতা শেখাতে হবে। দোষ শুধু কারোর একার ঘাড়ে চাপালে আমরা মুক্তি পাব না।

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স

অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]

শনিবার, ১৬ জুলাই ২০২২ , ০১ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৭ জিলহজ ১৪৪৩

শিক্ষার দুরবস্থার দায় কার

মাছুম বিল্লাহ

ময়মনসিংহের একজন শিক্ষক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,‘ক্লাসরুম কন্ট্রোল করা যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্লাসের সামনের সারির অল্প কয়েকজন কিছু শিক্ষকদের কথা শুনলেও পেছনের দিকের সবাই নিজেদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ব্যস্ত থাকে। বারবার অনুরোধ করার পরেও এক দুই মিনিটের জন্য শান্ত হলেও শিক্ষক যখন আবার পড়াতে শুরু করেন, তারাও আবার পূর্বের মতো নিজেদের আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’ তিনি আরও লিখেছেন ‘আমরাও তো এক দিন ছাত্র ছিলাম। শিক্ষকগণ ক্লাসে এলে সবাই শান্ত হয়ে যেতাম। স্যার যা ক্লাসে বলতেন তাই করতাম। আজকের এই উল্টো চিত্রের জন্য দায়ী কে? শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসতে চায় না, এলেও ক্লাসরুমে যেতে চায় না, ক্লাসরুমে যারা যায় তারাও ক্লাস লেকচার শোনার প্রতি মনেযোগী হয় না। লেকচার শোনার পরিবর্তে স্মার্টফোন ও ফেসবুকে চ্যাটিংয়ে অনেক বেশি মনোযোগী।’

সমাজের অসংগতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার প্রভাব সবই উঠে এসেছে এই শিক্ষকের লেখায়। শিক্ষার্থীরা বর্তমানে পড়লেও পাস করে, না পড়লেও পাস করে উচ্চতর গ্রেডসহ। সেখানে তারা পড়বে কেন? আর শ্রেণীকক্ষে লেকচারের চেয়ে ফেসবুক ইউটিউবের আকর্ষণ অনেক বেশি ... ওই বয়সের এবং বর্তমান সমাজের বাসিন্দা হয়ে তারা কেন ক্লাস লেকচার শুনবে। তারা যদি জানে বা বুঝে যে, তাদের শ্রেণীকক্ষের পড়া না পড়লে, শিক্ষকের ক্লাস না করলে কোনভাবেই পাস করতে পারবে না। আবার পরীক্ষায় কোন ধরনের অসদুপায় অবলম্বন করা যাবে না। এগুলোর কোনটিই নেই। তাই তারা ক্লাস করে না, পড়ে না। পরীক্ষার জন্য মোটেই চিন্তিত নয়। এগুলোর সব সমাধান করা আলাদাভাবে একজন শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই উক্ত শিক্ষক এসব কথা লিখেছেন, যা আজ প্রায় সব শিক্ষকেরই কথা।

প্রকৃত অর্থে যদি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে ফলাফল যা হয় বা হবে, তা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় দেখানো হয়েছে। ঢাবির ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের স্নœাতক সম্মান প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ শতাংশ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। পাসের হার ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষার্থী আর উত্তীর্ণ হয়েছে ১১ হাজার ৪৬৬ জন। ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় কৃতকার্যের হার ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ আর অকৃতকার্য ৯১ দশমিক ৪২ শতাংশ। এটিই প্রকৃত চিত্র। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা সঠিকভাবে নেওয়া হলে ফল এরকমই দাঁড়াবে। কিন্তু এ নিয়ে কারুর কোন রা নেই। জুন মাসের ২৭ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা কয়কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো তা এ রকমই। দশম শ্রেণীর ৮৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনও যখন কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিল না, প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলাম এসএসসিতে তার বিদ্যালয়ের গতবারের ফল কি? তিনি বললেন শতভাগ পাস। কিছু না পারলেও, না পড়লেও যখন শতভাগ পাস, তখন শিক্ষার্থীরা পড়বে কেন?

অন্য একজন শিক্ষক লিখেছেন, ‘জীবনে অসংখ্যবার শিক্ষকের ধমক ও বকা খেয়েছি, জোড়া বেতের ঘা খেয়েছি, সবার সামনে কান ধরে বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে হয়েছে, দুই আঙুলের মধ্যে পেন্সিল ঢুকিয়ে চেপে হাতের আঙুল শিক্ষক ব্যথা করে দিয়েছেন, কান টেনে লাল করে দিয়েছেন, চুলের কলি ও পরের দিকে টেনে ধরে পুরো কান ও মাথাব্যথা করে দিয়েছেন। তারপরও শিক্ষকের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করিনি কখনো। এমনকি বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকেও শাস্তির কথা ভয়ে ও লজ্জায় বলতে পারিনি কখনো। কিন্তু আজ আমরা শিক্ষার্থীদের ধমকের সুরে কথা বলতে পারি না। অনুরোধ করে বললেও তারা আমাদের পাত্তা দেয় না।’ সম্প্রতি যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনার কিছু বিদ্যালয় ঘুরে দেখেছি, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি, শ্রেণীকক্ষে গিয়েছি। শিক্ষকদের কথা ‘আমাদের হাত থেকে বেত নিয়ে গেছে, তাই শিক্ষার্থীরা এতটা বেয়াদব হয়েছে।’

ওপরের কোন কথাই কিন্তু আদর্শিক নয়। যেমন পূর্বের শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের অনেক শাস্তি দিতেন, তারপর লেখাপড়া শেখাতেন। ওই সময়কার শিক্ষকদের নৈতিকতা ছিল অনেক উন্নত, তাই তারা শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি প্রদান করলেও সমাজের কেউ কিছু তাদের বলতেন না। আর শিক্ষার্থীরাও এতটা স্মার্ট কিংবা নিজেদের অধিকার নিয়ে এতটা সচেতন ছিল না। তাই মনে করা হতো পড়াশোনা শাস্তির মাধ্যমেই করাতে হয়। বিষয়টি ঠিক নয়। ছোট একজন শিক্ষার্থীরও আত্মসম্মান আছে, যা ওই যুগের শিক্ষকগণ বুঝতেন না। তারা মনে করতেন শাস্তি না দিয়ে শিক্ষা হয় না। তারা পেশার প্রতি অত্যন্ত ডেডিকেটেড ছিলেন কিন্তু শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়ে আধুনিককালের মতো এত স্মার্ট ছিলেন না। আর বর্তমানে শিক্ষার্থীদের যে অবস্থা হয়েছে সেটিও কোনভাবে কাম্য নয়।

আমরা দেখলাম নড়াইলের মির্জাপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ^াসকে জুতার মালা গলায় দিয়ে ঘোরানো হয়েছে। কাজটি যিনি সংগঠিত করতে ভূমিকা রেখেছেন তিন স্বপন কুমার বিশ^াসের এক সময়ের ছাত্র। নড়াইলে মির্জাপুরে ওই কলেজের অধ্যক্ষের পদটি নিয়ে লড়াই চলছিল অনেক দিন। এ দুই স্থানে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। রাজনীতিকে ব্যবহার করা হয়েছে। সাভারের আশুলিায়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই স্কুলের ছাত্র বখাটে জিতু। সে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করত। তাকে শাসন করার অপরাধে প্রান হারিয়েছেন শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। তিনি তো একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্বই পালন করেছেন কিন্তু তার ফল হচ্ছে এই। উৎপল স্যার তার কলেজে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকায় সব ছাত্রছাত্রীর নিরাপত্তা, শিষ্টাচার, নৈতিকতা ও আদর্শ শিক্ষা নিশ্চিত করাতেন। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে পাস করা একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার শিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা ছিল অনেক আন্তরিক। শিক্ষার্থীদের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা তুঙ্গে।

কিন্তু এই সমাজ তাকে কি দিল? বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি, কলেজের অধ্যক্ষ জানেন তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী তারই শিক্ষাঙ্গনের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র-সংগঠনের সভাপতি। ইচ্ছা করলে ওই সভাপতি তাকে বিপদে ফেলতে পারেন। কাজেই ভিসি ও অধ্যক্ষদের ইদানীংকালে প্রধানশিক্ষকদেরও সেভাবেই প্রশাসন চালাতে হয়। তারপরেও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানপ্রধান অনেক কষ্টে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এভাবে সবাইকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। অন্যায়কারীদের রক্তচক্ষু দেখে ভীত হলে, হাল ছেড়ে দিলে কিংবা আশাহত হলে চলবে না। তাই বলছি যে শিক্ষক লিখেছেন যে, শিক্ষার্থীরা তাদের লেকচার শোনে না। এখন কিন্তু সেই লেকচারের দিন আর নেই। এখন শিক্ষার্থীদের কীভাবে, কতভাবে শ্রেণী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করানো যায়, সেটি করাতে হবে, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।

নড়াইলে দুংখজন ঘটনার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা কোনভাবেই মোবাইলফোন আনতে পারবে না বলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নির্দেশ দিয়েছেন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এভাবেই অথরিটি নিয়ে কাজ করতে হয়। তবে, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাদের টনক নড়ে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা... অনেককেই দেখেছি তাদের উৎসাহ শিক্ষক নিয়োগ, কমিটি গঠন ইত্যাদি বিষয়ে অর্থাৎ বৈষয়িক বিষয় যেখানে জড়িত ওনারাও সেখানে বেশি জড়িত। একাডেমিক বিষয় গোল্লায় যাচ্ছে, শিক্ষাদান কেমন হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। আর এগুলো করতে হলে তো নিজেদের পড়াশোনা করতে হবে, সেই সময় তাদের কই। আর পড়াশোনা করলে তো আর প্রশাসক বনে যায় না, তাই তারাও প্রশাসক হতে চান, একাডেমিক নয়। আর তাই সমাজও চলছে সেভাবে।

শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক লাঞ্জনার ঘটনাবলি সমাজ ও রাষ্ট্রে গভীর ক্ষতের বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ছাত্র রাজনীতি হয়ে ওঠে সহিংস। এখন ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে শিক্ষক রাজনীতি। লাল, নীল, গোলাপি, সাদা-নানা বর্ণে বিভক্ত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জাতীয় রাজনীতির রাজনৈতিক দলে অঙ্গসংগঠন হিসেবে নিজেদের পরিচিত করছেন। কাজেই সমাজকে দোষ দিয়ে লাভ কী? পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় শিকড় গেড়েছে অনৈতিকতা, সেটি প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত। বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে কি হচ্ছে? বিশ^বিদ্যালয়ের পবিত্র অঙ্গনে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, যে পেশিশক্তির মহড়া ও চড় দখলের খেলা চলছে সেগুলো কি কেউ কোনভাবে মেনে নিতে পারে? তবে, এসব বিষয়ে শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি বাদ দিয়ে। কখনো রাজনীতিবিদ কিংবা প্রভাবশালীদের দিকে তাকিয়ে শিক্ষাঙ্গনে প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কতটা কাজে দিবে সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। কাজেই শিক্ষকদের শ্রেণীকক্ষ থেকে শুরু করতে হবে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা, আধুনিক শিক্ষা, আকর্ষণীয় শিক্ষাদান ও উন্নত ব্যক্তিত্ব।

আমাদের দেশের পিতামাতারা সন্তানকে মেধাবী হিসেবে দেখতে চান, সেটি তো সব মা-বাবাই চান এবং চাবেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের সন্তান একজন আদর্শ শিক্ষার্থী, আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছে কি না, সেটি দেখাও একান্ত কর্তব্য। কারণ, সমাজের যে পচন ধরেছে এটি শুধু রাজনীতি, শুধুমাত্র সমাজ কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা পুলিশকে দোষারোপ করলে হবেনা। সমাজের এখন যা অবস্থা হয়েছে, তা কিন্তু কারোরই নিয়ন্ত্রণে নেই। কাজেই যার যার অবস্থান থেকে, প্রতিটি পরিবার থেকে নৈতিকতার শিক্ষা, ধৈর্য ধরার শিক্ষা, মানবিকতা শেখাতে হবে। দোষ শুধু কারোর একার ঘাড়ে চাপালে আমরা মুক্তি পাব না।

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভলান্টিয়ার্স

অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]