গৌতম রায়
কলকাতার উত্তর শহরতলীতে দুটি জায়গায় হাইরাইজ করছে একটি সংস্থা। সংস্থার এক প্রতিনিধি ফোন করলেন, ফ্ল্যাট কেনবার প্রস্তাব দিয়ে। সেই হাইরাইজে কি কি সুবিধা থাকবে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বললেন, গোটা হাউজিংয়ে আপনি একটিও মুসলমান পরেবার পাবেন না। আমরা কোনো মুসলমানকে ফ্ল্যাট বিক্রি করছি না। অফিশিয়ালি কখনো ই বলছি না যে, মুসলমানকে ফ্ল্যাট বিক্রি করা হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তব যেটা, সেটা হলো, মুসলমান ক্রেতা এলে ছুতোয় নাতায় তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করা যাবে না, বলে দিচ্ছি। যদিও কখনোই মুসলমান বলে তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করা হবে না... এই কথাটা ফর্মালি বলছি না।
কলকাতা মহানগরীর কথা বললাম। মহানগরী এবং শহরতলীতে আয়া, পরিচারিকা সরবরাহের জন্যে যেসব আয়া সেন্টারগুলো চালু হয়েছে, সেইসব সেন্টারে অনেক ক্ষেত্রেই মুসলমান মহিলা এবং পুরুষ নিজেদের প্রকৃত নাম গোপন করে হিন্দু নাম নিয়ে যোগ দিচ্ছেন। কারণ, হিন্দু মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ বাড়িতে রোগীর সেবা বা পরিচারিকার কাজের জন্যে কোনো মুসলমানকে রাখতে চায় না।
এই ছবি কিন্তু আজ হঠাৎ করে তেরি হয়নি। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আমার দিদিমার বাড়ির পাশে থাকা ভোলা মিঞার বৌ হিন্দু নাম ভারতী নিয়ে তবেই ভাটপাড়ার পঞ্চানন তর্করতেœর এক নাতির বাড়িতে পরিচারিকার কাজ পেয়েছিল। যদিও সেই তর্করতেœর ই এক ছেলে নাকি বিধবা উদ্ধারের জন্যে তাদের কাশীবাসী করবার নাম করে পাচার করত বলে অভিযোগ আছে। ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে অভিযোগ- সেদিকে মন দেওয়ার সময় সদ্য স্বাধীন দেশের আইন আদালত, থানা- পুলিশ, রাজনীতির লোকজন কারোর ছিল না।
আজ কলকাতা মহানগরীর বুকে সব জায়গাতে ফ্ল্যাট বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতার ফ্ল্যাটের দাম দেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না, তা বিচার করা হচ্ছে না। বিচার করা হচ্ছে ক্রেতার ধর্ম পরিচয়। ফলে বাধ্য হয়েই একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে মুসলমানকে। সামাজিক আদান প্রদানটা থেকে যাচ্ছে কেতাবী দস্তুরেই। আর এর সুযোগ নিচ্ছে যৌন ক্ষুধা নিবারণকারী একদল লোক। এক শিল্পী শুধু যৌনক্ষুধা নিবারণ করতেই পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেকে ‘অতি মুসলমান’ হিসেবে তুলে ধরছে। আবার এক পারফর্ফিং আর্টের সঙ্গে যুক্ত লোকের কথা শুনলাম যে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সভায় ঈদের শুভেচ্ছে ঘিরে এত অতি উৎসাহী মানসিকতার পরিচয় রেখেছে, যা আয়োজকদেরই বিব্রত করেছে।
একদিকে যখন সম্প্রদায়িকতার নতুন প্রয়োগজনিত দিক করে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীরা ভারতে মুসলমানদের জীবনযাপন এবং জীবনধারণÑদুটিকেই খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে, তখনই কিছু অতি ধর্মনিরপেক্ষতার অভিনয় করা ব্যক্তিগত সুযোগ-সন্ধানী, যারা কিন্তু জন্মসূত্রে হিন্দু, তারাই লুঙ্গি পরা, ফেজ টুপি পরা, কথায় কথায় আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি ধর্মাশ্রয়ী শব্দ ব্যবহারের ভেতর দিয়ে নিজেদের ‘অতি মুসলমান’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। এদের কাছে মুসলমান মানেই লুঙ্গি পরা, দাঁড়ি রাখা, ফেজ টুপি পরিহিত, চোখে সুর্মা দেয়া, বোরখা পরা, হিজাব পরা ব্যক্তিত্বের বাইরে আর কিছু অস্তিত্ব নেই। এদের কাছে পবিত্র ঈদ, মুহররম মানে শুধু বিরিয়ানি খাওয়া। আর ‘গো-মাংস’ ভক্ষণের ভেতরেই এদের মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অধিকারের লড়াইটা একদম সীমাবদ্ধ।
সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীরা যেমন ভারতে মুসলমান সমাজের বাঁচবার অধিকারটুকু ও কেড়ে নিতে চায়, ঠিক তেমন ভাবেই মুসলমান প্রেমের ছদ্ম অভিনয় করা নীল হাজি সাহেব, হাজিবিবির দল সাধারণ মানুষের কাছে সংখ্যাগুরু হিন্দু আধিপত্যবাদীরা মুসলমান সমাজ সম্পর্কে যে ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করছে, সেই বাতাবরণকে আরো নগ্ন, আরও প্রকট করে তুলতে চায়।
মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হিন্দুদের অসূয়া ’৪৭ সালের পরে দীর্ঘকাল সাধারণ হিন্দুদের ভেতরে সেভাবে সঞ্চারিত হয়নি। ভারতে ক্ষমতাসীন বহৎবুর্জোয়াদের প্রতিনিধিরা বৃহৎ বা নব উদীয়মান বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সামন্ততন্ত্রের যে রমরমা ছিল, সেই সামন্ততন্ত্রের স্বার্থরক্ষার্থেও আত্মনিবেদিত ছিল। সামন্ততন্ত্রের স্বার্থ দেখতে গিয়েই কিন্তু ’৪৭-এর দেশভাগের পর ছিন্নমূল হিন্দুদের স্বার্থ না বিধান রায় দেখেছিলেন, না দেখেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু উভয়েই উচ্চ বর্ণের, উচ্চবিত্তের স্বার্থে দেশভাগ চেয়েছিলেন। বরংচ মুসলিম লীগের বাংলা শাখার একটা বড় অংশ সেই তখনই ‘ধর্ম’ কে জাতিসত্তা গঠনের সোপান বলে কখনোই মনে করেননি। জাতিসত্তা সৃষ্টির মূল ভিত্তি তাদের কাছে ছিল ভাষা এবং সংস্কৃতি। তাই তারা বাংলা ভাগ নয়, চেয়েছিলেন ‘অখ- বাংলা’।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভেতর দিয়ে, ধর্ম নিষ্ঠার নামে কেবলমাত্র আচারসর্বস্বতা, যাকে এককথায় ভড়ং বলা হয়, সেই ধর্মীয় লেবাস যুক্ত লোকদেখানো ভড়ংয়ের মাধ্যমে অপর ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের কেবল বিরুদ্ধাচরণ ই নয়, তাদের সর্বস্ব লুট করা, তাদের নারীদের ভোগ করা, হত্যা করা- এইসব বোধগুলোকেই প্রকট করে তোলা স্বাধীন ভারতে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অবলম্বন হয়ে ওঠে। তাই যে দীনদয়াল উপাধ্যায় তার রাজনৈতিক হিন্দু বোধের নতুন ব্যাখ্যা ‘একাত্ম মানবতাবাদে’ মনু সংহিতার অনুধ্যান অনুযায়ী নারী এবং দলিত কে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই নারাজ, সেই দীনদয়ালের ছবিতে কলকাতায় এসে মালা দেন বিজেপির রাষ্ট্রপতি পদ প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মী। আর এই দ্রৌপদী মহিলা এবং আদিবাসী সমাজ থেকে উঠে এসেছেন, তাই বিজেপি আগে জানালে তিনি দ্রৌপদীকেই সমর্থনের কথা বিবেচনা করতেন বলে জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত শতকের দুই, তিন এমন কি চারের দশক, যখন অবিভক্ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে হিন্দু- মুসলমান উভয় সমাজেরই উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্তের একটা বড় অংশের রাজনীতিকেরা সামনন্ততন্ত্র আর বিকাশমান ধনতন্ত্রের স্বার্থরক্ষায় নিজেদের রাজনীতিকে পরিচালিত করেছিলেন, যার অন্তিম পরিণতি ছিল দেশভাগ, সেইপর্বে সাম্প্রদায়িকতা প্রয়োগে ব্যক্তি বিশেষ খুব একটা লক্ষ্যবস্তু ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগে তখন টার্গেট ছিল সম্প্রদায়।
দেশভাগের অনেককাল পর পর্যন্ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগে এই টার্গেটের ধারা অব্যাহত ছিল। এই ধারায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিই প্রথম পরিবর্তন আনে গত শতকের নয়ের দশকে দিল্লিতে তিন দফায় মোট প্রায় সাড়ে ছয় বছর অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে। সেই সময় থেকেই সংখ্যালঘু মুসলমানের পক্ষে কথা বলা মানুষ, তিনি জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও লক্ষ্যবস্তু হয়ে যান সাম্প্রদায়িকদের। আর সাম্প্রদায়িকতার এই অভিমুখের সম্পূর্ণ বদল এখন আমরা ভারতবাসীরা দেখতে পাচ্ছি সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীতে পরিণত হওয়ার পর। যার পরিণতি এখন তিস্তা শীতলবাদ থেকে শুরু করে জুবেইর এর কারাবাস।
মোহন ভাগবত মোদি জুটি যেভাবে ধর্মকে একটা ‘পণ্যে’ পরিণত করেছেন, ধর্মের এই পণ্যায়নের সঙ্গে ভারতের চিরায়ত ধর্মবোধের এতটুকু সাদৃশ্য নেই। আরএসএস-বিজেপি এবং তার সঙ্গীসাথীদের মেলে ধরা বাহ্যিক আচারসর্বস্ব ধর্ম হল নিজের সম্প্রদায়ের এমন একটা গভীর আনুগত্য প্রকাশ যে আনুগত্যের জোরে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করবার দিকে নজর দেওয়া যায়। ধর্মনিষ্ঠায় বিশ্বাসী হিন্দুরা যে আত্মার মুক্তি কামনায় আত্মনিবেদন করতে চায়, সেই ‘পরকাল’ ঘিরে, ঈশ্বর লাভ ঘিরে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীদের কখনো কোনোরকম মাথাব্যথা আমরা লক্ষ্য করিনি। তাদের সমস্ত চিন্তাই ইহকালের সমস্যা ঘিরে। ধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে ইহকালের এতটুকু সম্পর্ক নেই। ইহকালের সঙ্গে সম্পর্ক হলো ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করতে চায় সেই সাম্প্রদায়িকদের। আর এই সাম্প্রদায়িকরা যে ধর্মেই অবস্থান করুক না কেন, তারাই সবথেকে বড় ধর্মবিরোধী এবং ধর্মবিদ্বেষী।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
শনিবার, ১৬ জুলাই ২০২২ , ০১ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৭ জিলহজ ১৪৪৩
গৌতম রায়
কলকাতার উত্তর শহরতলীতে দুটি জায়গায় হাইরাইজ করছে একটি সংস্থা। সংস্থার এক প্রতিনিধি ফোন করলেন, ফ্ল্যাট কেনবার প্রস্তাব দিয়ে। সেই হাইরাইজে কি কি সুবিধা থাকবে তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বললেন, গোটা হাউজিংয়ে আপনি একটিও মুসলমান পরেবার পাবেন না। আমরা কোনো মুসলমানকে ফ্ল্যাট বিক্রি করছি না। অফিশিয়ালি কখনো ই বলছি না যে, মুসলমানকে ফ্ল্যাট বিক্রি করা হচ্ছে না। কিন্তু বাস্তব যেটা, সেটা হলো, মুসলমান ক্রেতা এলে ছুতোয় নাতায় তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করা যাবে না, বলে দিচ্ছি। যদিও কখনোই মুসলমান বলে তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করা হবে না... এই কথাটা ফর্মালি বলছি না।
কলকাতা মহানগরীর কথা বললাম। মহানগরী এবং শহরতলীতে আয়া, পরিচারিকা সরবরাহের জন্যে যেসব আয়া সেন্টারগুলো চালু হয়েছে, সেইসব সেন্টারে অনেক ক্ষেত্রেই মুসলমান মহিলা এবং পুরুষ নিজেদের প্রকৃত নাম গোপন করে হিন্দু নাম নিয়ে যোগ দিচ্ছেন। কারণ, হিন্দু মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ বাড়িতে রোগীর সেবা বা পরিচারিকার কাজের জন্যে কোনো মুসলমানকে রাখতে চায় না।
এই ছবি কিন্তু আজ হঠাৎ করে তেরি হয়নি। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আমার দিদিমার বাড়ির পাশে থাকা ভোলা মিঞার বৌ হিন্দু নাম ভারতী নিয়ে তবেই ভাটপাড়ার পঞ্চানন তর্করতেœর এক নাতির বাড়িতে পরিচারিকার কাজ পেয়েছিল। যদিও সেই তর্করতেœর ই এক ছেলে নাকি বিধবা উদ্ধারের জন্যে তাদের কাশীবাসী করবার নাম করে পাচার করত বলে অভিযোগ আছে। ব্রাহ্মণের বিরুদ্ধে অভিযোগ- সেদিকে মন দেওয়ার সময় সদ্য স্বাধীন দেশের আইন আদালত, থানা- পুলিশ, রাজনীতির লোকজন কারোর ছিল না।
আজ কলকাতা মহানগরীর বুকে সব জায়গাতে ফ্ল্যাট বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতার ফ্ল্যাটের দাম দেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না, তা বিচার করা হচ্ছে না। বিচার করা হচ্ছে ক্রেতার ধর্ম পরিচয়। ফলে বাধ্য হয়েই একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে মুসলমানকে। সামাজিক আদান প্রদানটা থেকে যাচ্ছে কেতাবী দস্তুরেই। আর এর সুযোগ নিচ্ছে যৌন ক্ষুধা নিবারণকারী একদল লোক। এক শিল্পী শুধু যৌনক্ষুধা নিবারণ করতেই পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজেকে ‘অতি মুসলমান’ হিসেবে তুলে ধরছে। আবার এক পারফর্ফিং আর্টের সঙ্গে যুক্ত লোকের কথা শুনলাম যে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সভায় ঈদের শুভেচ্ছে ঘিরে এত অতি উৎসাহী মানসিকতার পরিচয় রেখেছে, যা আয়োজকদেরই বিব্রত করেছে।
একদিকে যখন সম্প্রদায়িকতার নতুন প্রয়োগজনিত দিক করে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীরা ভারতে মুসলমানদের জীবনযাপন এবং জীবনধারণÑদুটিকেই খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে, তখনই কিছু অতি ধর্মনিরপেক্ষতার অভিনয় করা ব্যক্তিগত সুযোগ-সন্ধানী, যারা কিন্তু জন্মসূত্রে হিন্দু, তারাই লুঙ্গি পরা, ফেজ টুপি পরা, কথায় কথায় আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি ধর্মাশ্রয়ী শব্দ ব্যবহারের ভেতর দিয়ে নিজেদের ‘অতি মুসলমান’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। এদের কাছে মুসলমান মানেই লুঙ্গি পরা, দাঁড়ি রাখা, ফেজ টুপি পরিহিত, চোখে সুর্মা দেয়া, বোরখা পরা, হিজাব পরা ব্যক্তিত্বের বাইরে আর কিছু অস্তিত্ব নেই। এদের কাছে পবিত্র ঈদ, মুহররম মানে শুধু বিরিয়ানি খাওয়া। আর ‘গো-মাংস’ ভক্ষণের ভেতরেই এদের মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অধিকারের লড়াইটা একদম সীমাবদ্ধ।
সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীরা যেমন ভারতে মুসলমান সমাজের বাঁচবার অধিকারটুকু ও কেড়ে নিতে চায়, ঠিক তেমন ভাবেই মুসলমান প্রেমের ছদ্ম অভিনয় করা নীল হাজি সাহেব, হাজিবিবির দল সাধারণ মানুষের কাছে সংখ্যাগুরু হিন্দু আধিপত্যবাদীরা মুসলমান সমাজ সম্পর্কে যে ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করছে, সেই বাতাবরণকে আরো নগ্ন, আরও প্রকট করে তুলতে চায়।
মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হিন্দুদের অসূয়া ’৪৭ সালের পরে দীর্ঘকাল সাধারণ হিন্দুদের ভেতরে সেভাবে সঞ্চারিত হয়নি। ভারতে ক্ষমতাসীন বহৎবুর্জোয়াদের প্রতিনিধিরা বৃহৎ বা নব উদীয়মান বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সামন্ততন্ত্রের যে রমরমা ছিল, সেই সামন্ততন্ত্রের স্বার্থরক্ষার্থেও আত্মনিবেদিত ছিল। সামন্ততন্ত্রের স্বার্থ দেখতে গিয়েই কিন্তু ’৪৭-এর দেশভাগের পর ছিন্নমূল হিন্দুদের স্বার্থ না বিধান রায় দেখেছিলেন, না দেখেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু উভয়েই উচ্চ বর্ণের, উচ্চবিত্তের স্বার্থে দেশভাগ চেয়েছিলেন। বরংচ মুসলিম লীগের বাংলা শাখার একটা বড় অংশ সেই তখনই ‘ধর্ম’ কে জাতিসত্তা গঠনের সোপান বলে কখনোই মনে করেননি। জাতিসত্তা সৃষ্টির মূল ভিত্তি তাদের কাছে ছিল ভাষা এবং সংস্কৃতি। তাই তারা বাংলা ভাগ নয়, চেয়েছিলেন ‘অখ- বাংলা’।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের ভেতর দিয়ে, ধর্ম নিষ্ঠার নামে কেবলমাত্র আচারসর্বস্বতা, যাকে এককথায় ভড়ং বলা হয়, সেই ধর্মীয় লেবাস যুক্ত লোকদেখানো ভড়ংয়ের মাধ্যমে অপর ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের কেবল বিরুদ্ধাচরণ ই নয়, তাদের সর্বস্ব লুট করা, তাদের নারীদের ভোগ করা, হত্যা করা- এইসব বোধগুলোকেই প্রকট করে তোলা স্বাধীন ভারতে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের অবলম্বন হয়ে ওঠে। তাই যে দীনদয়াল উপাধ্যায় তার রাজনৈতিক হিন্দু বোধের নতুন ব্যাখ্যা ‘একাত্ম মানবতাবাদে’ মনু সংহিতার অনুধ্যান অনুযায়ী নারী এবং দলিত কে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই নারাজ, সেই দীনদয়ালের ছবিতে কলকাতায় এসে মালা দেন বিজেপির রাষ্ট্রপতি পদ প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মী। আর এই দ্রৌপদী মহিলা এবং আদিবাসী সমাজ থেকে উঠে এসেছেন, তাই বিজেপি আগে জানালে তিনি দ্রৌপদীকেই সমর্থনের কথা বিবেচনা করতেন বলে জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত শতকের দুই, তিন এমন কি চারের দশক, যখন অবিভক্ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে হিন্দু- মুসলমান উভয় সমাজেরই উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্তের একটা বড় অংশের রাজনীতিকেরা সামনন্ততন্ত্র আর বিকাশমান ধনতন্ত্রের স্বার্থরক্ষায় নিজেদের রাজনীতিকে পরিচালিত করেছিলেন, যার অন্তিম পরিণতি ছিল দেশভাগ, সেইপর্বে সাম্প্রদায়িকতা প্রয়োগে ব্যক্তি বিশেষ খুব একটা লক্ষ্যবস্তু ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগে তখন টার্গেট ছিল সম্প্রদায়।
দেশভাগের অনেককাল পর পর্যন্ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতার প্রয়োগে এই টার্গেটের ধারা অব্যাহত ছিল। এই ধারায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিই প্রথম পরিবর্তন আনে গত শতকের নয়ের দশকে দিল্লিতে তিন দফায় মোট প্রায় সাড়ে ছয় বছর অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে। সেই সময় থেকেই সংখ্যালঘু মুসলমানের পক্ষে কথা বলা মানুষ, তিনি জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও লক্ষ্যবস্তু হয়ে যান সাম্প্রদায়িকদের। আর সাম্প্রদায়িকতার এই অভিমুখের সম্পূর্ণ বদল এখন আমরা ভারতবাসীরা দেখতে পাচ্ছি সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীতে পরিণত হওয়ার পর। যার পরিণতি এখন তিস্তা শীতলবাদ থেকে শুরু করে জুবেইর এর কারাবাস।
মোহন ভাগবত মোদি জুটি যেভাবে ধর্মকে একটা ‘পণ্যে’ পরিণত করেছেন, ধর্মের এই পণ্যায়নের সঙ্গে ভারতের চিরায়ত ধর্মবোধের এতটুকু সাদৃশ্য নেই। আরএসএস-বিজেপি এবং তার সঙ্গীসাথীদের মেলে ধরা বাহ্যিক আচারসর্বস্ব ধর্ম হল নিজের সম্প্রদায়ের এমন একটা গভীর আনুগত্য প্রকাশ যে আনুগত্যের জোরে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করবার দিকে নজর দেওয়া যায়। ধর্মনিষ্ঠায় বিশ্বাসী হিন্দুরা যে আত্মার মুক্তি কামনায় আত্মনিবেদন করতে চায়, সেই ‘পরকাল’ ঘিরে, ঈশ্বর লাভ ঘিরে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদীদের কখনো কোনোরকম মাথাব্যথা আমরা লক্ষ্য করিনি। তাদের সমস্ত চিন্তাই ইহকালের সমস্যা ঘিরে। ধর্মনিষ্ঠার সঙ্গে ইহকালের এতটুকু সম্পর্ক নেই। ইহকালের সঙ্গে সম্পর্ক হলো ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করতে চায় সেই সাম্প্রদায়িকদের। আর এই সাম্প্রদায়িকরা যে ধর্মেই অবস্থান করুক না কেন, তারাই সবথেকে বড় ধর্মবিরোধী এবং ধর্মবিদ্বেষী।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]