ইসির ‘রুটিন’ সংলাপ শুরু আজ

সংসদ নির্বাচনের আগে বিগত কয়েকটি নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল, সেই ধারা অব্যাহত রাখতে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনও সংলাপের আয়োজন করেছে। সংলাপে অংশ নিতে নিবন্ধিত দলগুলোকে চিঠি দেয়া হচ্ছে। এই কমিশনের অধীনেই আগামী বছর ডিসেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে (দ্বাদশ সংসদ) সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে চাইছে পশ্চিমা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক’ করার কথা বার বার বলছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মিত্র দলগুলো এই রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেবে বলে নিশ্চিত করেছে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সংলাপে যাবে বলে জানা গেছে। তবে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো এবং কয়েকটি বামদল এই সংলাপে যাচ্ছে না।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও অন্যান্য দল যারা সংলাপে অংশ নিতে চাচ্ছে না তাদের বিষয়ে কমিশনের বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই। কমিশন বলছে, ‘সব দলই তাদের কাছে সমান’।

সংলাপে অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন দলের বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা হয় সংবাদের। জাতীয় পার্টির এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘কমিশন সংলাপের ডাক দিয়েছে, এটা ওদের রুটিনওয়ার্ক। কে আসল, আর কে আসল না, এটা নিয়ে আসলে ওদের মাথাব্যথা নেই। তবে আমরা যাচ্ছি।’

তবে দায়িত্ব নেয়ার পর এই কমিশন একাধিকবার বলেছে, ‘সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই তাদের মূল লক্ষ্য।’ এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দলগুলোর সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আজ থেকে আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট ১১ দিনে (শুক্র ও শনিবার বাদে) নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। এর মধ্যে সাত দিন ৪টি করে দলের সঙ্গে, তিন দিন ৩টি করে এবং একদিন ২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।

আগামী ২০ জুলাই মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে এবং শেষ দিন সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ‘সুষ্ঠু ও সুন্দর’ করতে এর আগে শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ সাংবাদিকদের সঙ্গে কয়েক ধাপে সংলাপ করেছে ইসি। রাজনৈতিক দলগুলোর ‘আস্থা অর্জনের’ জন্য ইসি নানা উদ্যোগ নিলেও বিএনপি ও তার মিত্রদের ‘অনাস্থা ও অসহযোগিতায়’ সফলতা পাচ্ছে না।

প্রকৃতপক্ষে, এই নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই সব ধরনের সংলাপ বর্জন করে আসছে বিএনপি। নতুন ইসি গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আনুষ্ঠানিক সংলাপে দলটি অংশ নেয়নি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার বাড়াতে সব দলের মতামত ও সহযোগিতা চেয়েছিল নতুন (কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন) কমিশন। মেশিনের দোষ-ত্রুটি যাচাইয়ে জন্য দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ও তার মিত্ররা এবং কয়েকটি বাম দলসহ নিবন্ধিত ১১টি দল ওই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান ইসি সচেষ্ট এই ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপে বসতে চাইছে কমিশন। তবে এবারও বিএনপি ও তার মিত্ররা সংলাপে আসছে না বলে নিশ্চিত করেছে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র। বিএনপির দপ্তর সূত্র বলছে, নির্বাচনকালীন সরকারের বাইরে এই মুহূর্তে বিএনপি অন্য কোন আলোচনায় অংশ নেবে না। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম ইসির সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিএনপির জোটে নেই, তবে তাদেরও সংলাপে যাওয়ার আগ্রহ নেই।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আগের সংলাপে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। এবারের সংলাপে মনে করেছিলাম সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা দিয়ে ডাকবে। কিন্তু ইসির চিঠিতে তেমন কিছু পেলাম না। চিঠি পড়ে মনে হয়েছে উনারা (ইসি) সবকিছু ঠিক করে ফেলেছেন। সংলাপে যাওয়ার বিষয় নিয়ে আমরা বসব। প্রয়োজন মনে না করলে অযথা গিয়ে আমাদের সময়ও নষ্ট করব না, তাদের সময়ও নষ্ট করব না।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বিএনপির সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করার বিষয়ে আগ্রহী। দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘গত সংলাপে যাইনি। তবে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। আমরা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে না। ২০১৮ সালের মতো প্রচারসর্বস্ব সংলাপে লাভ নেই। সরকারের পদত্যাগ ও কীভাবে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এবার যাওয়ার ব্যাপারে দলীয় ফোরামে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। যা বলার গিয়েই বলব। তবুও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে আরেকবার বসব।’

এই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলোকে নিয়েই ইসিকে রাজনৈতিক সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে। তবে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশ না নিলে এই সংলাপ সফল হবে না বলে মনে করছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)। শুধু ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে সংবাদকে তিনি বলেন, ‘বার বার এক পক্ষের (ক্ষমতাসীন) দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করলে এ নিয়ে বরং প্রশ্নই উঠবে।’

গত ৬ জুলাই বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে সংলাপের বিস্তারিত সময়সূচি প্রকাশ করে ইসি। ওই দিন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংলাপে নির্ধারিত কোন আলোচ্যসূচি থাকছে না। আলোচ্যসূচি উন্মুক্ত।

বিগত কয়েকটি নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল। এ কমিশনও সেই ধারা অব্যাহত রাখছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন ইসির এই অতিরিক্ত সচিব। বিগত কমিশনের আমলে সংলাপে আসা সুপারিশগুলো বই আকারে প্রকাশ করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছিল ইসি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এবারও তেমনটি হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘সেটা সময় হলে দেখা যাবে।’

বিএনপিকে সংলাপে আনতে বিশেষ কোন উদ্যোগ নেয়ার কথা কমিশন ভাবছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব দলকেই চিঠি দেয়া হবে। সব দলই ইসির কাছে সমান।’ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘এজেন্ডা’ না থাকলেও এবারের সংলাপে ইভিএমসহ জাতীয় নির্বাচনের নানা বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানার চেষ্টা করবে ইসি। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ১০ জন করে সদস্য এ সংলাপে অংশ নিতে পারবেন। একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে করণীয় সম্পর্কে সব দলের পরামর্শ চাওয়া হবে সংলাপে।

অন্যান্য দলের সঙ্গে সংলাপের সময় এক ঘণ্টা নির্ধারণ করা হলেও আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি- এই তিনটি দলের সঙ্গে দুই ঘণ্টা করে সংলাপ হবে।

কোন দলের সঙ্গে কবে সংলাপ

আজ ১৭ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে সংলাপ শুরু হবে। এরপর, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশ কংগ্রেস এবং বিকেল ৪টায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগের-বিএমএল।

১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট), দুপুর আড়াইটায় খেলাফত মজলিস এবং বিকেল ৪টায় বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে সংলাপ হবে।

১৯ জুলাই হবে সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, দুপুর ১২টায় ইসলামী ঐক্যজোট, দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং বিকেল ৪টায় বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এমএল) সঙ্গে।

২০ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় গণতন্ত্রী পার্টি, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (আমিনা) এবং বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি।

২১ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মুকিত), দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এবং বিকেল ৪টায় গণফ্রন্ট; ২৪ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, দুপুর ১২টায় জাতীয় পার্টি-জেপি (মঞ্জু), দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি এবং বিকেল ৪টায় ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ; ২৫ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এবং বিকেল ৪টায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি; ২৬ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, দুপুর ১২টায় বিকল্পধারা বাংলাদেশ, দুপুর আড়াইটায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বিকেল ৪টায় ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) সঙ্গে সংলাপ হবে।

২৭ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (পার্থ), দুপুর ১২টায় জাকের পার্টি এবং দুপুর আড়াইটায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ; ২৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় গণফোরাম, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ (গাণি) এবং দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সঙ্গে সংলাপের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

শেষ দিন ৩১ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় পার্টি এবং বিকেল ৩টায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসবে নির্বাচন কমিশন।

রবিবার, ১৭ জুলাই ২০২২ , ০২ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৮ জিলহজ ১৪৪৩

ইসির ‘রুটিন’ সংলাপ শুরু আজ

ফয়েজ আহমেদ তুষার

সংসদ নির্বাচনের আগে বিগত কয়েকটি নির্বাচন কমিশন (ইসি) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল, সেই ধারা অব্যাহত রাখতে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনও সংলাপের আয়োজন করেছে। সংলাপে অংশ নিতে নিবন্ধিত দলগুলোকে চিঠি দেয়া হচ্ছে। এই কমিশনের অধীনেই আগামী বছর ডিসেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে (দ্বাদশ সংসদ) সব দলের অংশগ্রহণ দেখতে চাইছে পশ্চিমা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক’ করার কথা বার বার বলছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মিত্র দলগুলো এই রাজনৈতিক সংলাপে অংশ নেবে বলে নিশ্চিত করেছে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সংলাপে যাবে বলে জানা গেছে। তবে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো এবং কয়েকটি বামদল এই সংলাপে যাচ্ছে না।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও অন্যান্য দল যারা সংলাপে অংশ নিতে চাচ্ছে না তাদের বিষয়ে কমিশনের বিশেষ কোন উদ্যোগ নেই। কমিশন বলছে, ‘সব দলই তাদের কাছে সমান’।

সংলাপে অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন দলের বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা হয় সংবাদের। জাতীয় পার্টির এক নেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘কমিশন সংলাপের ডাক দিয়েছে, এটা ওদের রুটিনওয়ার্ক। কে আসল, আর কে আসল না, এটা নিয়ে আসলে ওদের মাথাব্যথা নেই। তবে আমরা যাচ্ছি।’

তবে দায়িত্ব নেয়ার পর এই কমিশন একাধিকবার বলেছে, ‘সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই তাদের মূল লক্ষ্য।’ এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দলগুলোর সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আজ থেকে আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট ১১ দিনে (শুক্র ও শনিবার বাদে) নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। এর মধ্যে সাত দিন ৪টি করে দলের সঙ্গে, তিন দিন ৩টি করে এবং একদিন ২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।

আগামী ২০ জুলাই মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে এবং শেষ দিন সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ‘সুষ্ঠু ও সুন্দর’ করতে এর আগে শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ সাংবাদিকদের সঙ্গে কয়েক ধাপে সংলাপ করেছে ইসি। রাজনৈতিক দলগুলোর ‘আস্থা অর্জনের’ জন্য ইসি নানা উদ্যোগ নিলেও বিএনপি ও তার মিত্রদের ‘অনাস্থা ও অসহযোগিতায়’ সফলতা পাচ্ছে না।

প্রকৃতপক্ষে, এই নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই সব ধরনের সংলাপ বর্জন করে আসছে বিএনপি। নতুন ইসি গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আনুষ্ঠানিক সংলাপে দলটি অংশ নেয়নি।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার বাড়াতে সব দলের মতামত ও সহযোগিতা চেয়েছিল নতুন (কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন) কমিশন। মেশিনের দোষ-ত্রুটি যাচাইয়ে জন্য দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ও তার মিত্ররা এবং কয়েকটি বাম দলসহ নিবন্ধিত ১১টি দল ওই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বর্তমান ইসি সচেষ্ট এই ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপে বসতে চাইছে কমিশন। তবে এবারও বিএনপি ও তার মিত্ররা সংলাপে আসছে না বলে নিশ্চিত করেছে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র। বিএনপির দপ্তর সূত্র বলছে, নির্বাচনকালীন সরকারের বাইরে এই মুহূর্তে বিএনপি অন্য কোন আলোচনায় অংশ নেবে না। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরাম ইসির সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিএনপির জোটে নেই, তবে তাদেরও সংলাপে যাওয়ার আগ্রহ নেই।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘আগের সংলাপে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। এবারের সংলাপে মনে করেছিলাম সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা দিয়ে ডাকবে। কিন্তু ইসির চিঠিতে তেমন কিছু পেলাম না। চিঠি পড়ে মনে হয়েছে উনারা (ইসি) সবকিছু ঠিক করে ফেলেছেন। সংলাপে যাওয়ার বিষয় নিয়ে আমরা বসব। প্রয়োজন মনে না করলে অযথা গিয়ে আমাদের সময়ও নষ্ট করব না, তাদের সময়ও নষ্ট করব না।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বিএনপির সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করার বিষয়ে আগ্রহী। দলটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘গত সংলাপে যাইনি। তবে আমাদের বক্তব্য জানিয়েছি। আমরা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে না। ২০১৮ সালের মতো প্রচারসর্বস্ব সংলাপে লাভ নেই। সরকারের পদত্যাগ ও কীভাবে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হবে এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এবার যাওয়ার ব্যাপারে দলীয় ফোরামে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। যা বলার গিয়েই বলব। তবুও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে আরেকবার বসব।’

এই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলোকে নিয়েই ইসিকে রাজনৈতিক সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে। তবে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশ না নিলে এই সংলাপ সফল হবে না বলে মনে করছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)। শুধু ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে সংবাদকে তিনি বলেন, ‘বার বার এক পক্ষের (ক্ষমতাসীন) দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করলে এ নিয়ে বরং প্রশ্নই উঠবে।’

গত ৬ জুলাই বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে সংলাপের বিস্তারিত সময়সূচি প্রকাশ করে ইসি। ওই দিন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংলাপে নির্ধারিত কোন আলোচ্যসূচি থাকছে না। আলোচ্যসূচি উন্মুক্ত।

বিগত কয়েকটি নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল। এ কমিশনও সেই ধারা অব্যাহত রাখছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন ইসির এই অতিরিক্ত সচিব। বিগত কমিশনের আমলে সংলাপে আসা সুপারিশগুলো বই আকারে প্রকাশ করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছিল ইসি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এবারও তেমনটি হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘সেটা সময় হলে দেখা যাবে।’

বিএনপিকে সংলাপে আনতে বিশেষ কোন উদ্যোগ নেয়ার কথা কমিশন ভাবছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব দলকেই চিঠি দেয়া হবে। সব দলই ইসির কাছে সমান।’ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘এজেন্ডা’ না থাকলেও এবারের সংলাপে ইভিএমসহ জাতীয় নির্বাচনের নানা বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানার চেষ্টা করবে ইসি। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ১০ জন করে সদস্য এ সংলাপে অংশ নিতে পারবেন। একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে করণীয় সম্পর্কে সব দলের পরামর্শ চাওয়া হবে সংলাপে।

অন্যান্য দলের সঙ্গে সংলাপের সময় এক ঘণ্টা নির্ধারণ করা হলেও আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি- এই তিনটি দলের সঙ্গে দুই ঘণ্টা করে সংলাপ হবে।

কোন দলের সঙ্গে কবে সংলাপ

আজ ১৭ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে সংলাপ শুরু হবে। এরপর, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশ কংগ্রেস এবং বিকেল ৪টায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগের-বিএমএল।

১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট), দুপুর আড়াইটায় খেলাফত মজলিস এবং বিকেল ৪টায় বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে সংলাপ হবে।

১৯ জুলাই হবে সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, দুপুর ১২টায় ইসলামী ঐক্যজোট, দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং বিকেল ৪টায় বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এমএল) সঙ্গে।

২০ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় গণতন্ত্রী পার্টি, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (আমিনা) এবং বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি।

২১ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মুকিত), দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এবং বিকেল ৪টায় গণফ্রন্ট; ২৪ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, দুপুর ১২টায় জাতীয় পার্টি-জেপি (মঞ্জু), দুপুর আড়াইটায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি এবং বিকেল ৪টায় ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ; ২৫ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এবং বিকেল ৪টায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি; ২৬ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, দুপুর ১২টায় বিকল্পধারা বাংলাদেশ, দুপুর আড়াইটায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং বিকেল ৪টায় ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) সঙ্গে সংলাপ হবে।

২৭ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (পার্থ), দুপুর ১২টায় জাকের পার্টি এবং দুপুর আড়াইটায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ; ২৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় গণফোরাম, দুপুর ১২টায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ (গাণি) এবং দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সঙ্গে সংলাপের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

শেষ দিন ৩১ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় পার্টি এবং বিকেল ৩টায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসবে নির্বাচন কমিশন।