সংকটের কারণ জানালেন গোতাবায়া রাজাপাকসা

শ্রীলঙ্কার সদ্য পদত্যাগ করা সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতায়াবা রাজাপাকসা দাবি করেছেন, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। দেশটির পার্লামেন্টের মহাসচিব ধাম্মিকা দশানায়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টে রাজাপাকসার পদত্যাগপত্র পড়ে শোনান।

পদত্যাগ পত্রে রাজাপাকসা বলেছেন, শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের মূলে ছিল কয়েক বছরের অব্যবস্থাপনা, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে শ্রীলঙ্কায় পর্যটক আসা কমে যাওয়া এবং বিদেশি কর্মীদের থেকে রেমিট্যান্স আসাও কমে যাওয়া।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস যে আমি এই সংকট মোকাবিলায় সংসদ সদস্যদের নিয়ে সর্বদলীয় বা ঐক্যের সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানোসহ সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিয়েছি।’ এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে সিঙ্গাপুর থেকে রাজাপাকসার পাঠানো পদত্যাগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন দেশটির স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবিবর্ধনে। তার পদত্যাগের ফলে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। তবে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে রনিল বিক্রমাসিংহকে স্বাগত জানানো হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীরা রনিলের পদত্যাগও দাবি করেছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন রনিল। উল্টো তিনি পদত্যাগ না করে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষ থেকে তাকেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হবে।

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিকে নানা সংঘাত, সহিংসতা, সংকট, চড়াই-উতরাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চল ঘিরে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল লিবারেশন অব তামিল টাইগার্স ইলম (এলটিটিই) নামের সংগঠন। দেশটির সরকারকে বহু বছর ধরে এলটিটিইর সশস্ত্র তৎপরতার মোকাবিলা করতে হয়।

২০০৯ সালে রক্তক্ষয়ী এই লড়াইয়ের অবসান ঘটে। তামিল টাইগার গেরিলাদের দমনের অভিযান তত্ত্বাবধান করেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাবায়া। এই গৃহযুদ্ধে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। গৃহযুদ্ধের অবসানের পর ২০১৯ সালে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কা। ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার একাধিক স্থানে জঙ্গি হামলা হয়। এই হামলায় আড়াইশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে রাজাপক্ষে পরিবার। এই পরিবারের সদস্য মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট উভয় পদেই দায়িত্ব পালন করেন। মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া দেশটির সবশেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাদের আরেক ভাই বাসিল রাজাপাকসা ছিলেন অর্থমন্ত্রী। মাহিন্দা ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলে রাজনীতিতে নামেন গোতাবায়া। তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। তামিল টাইগার গেরিলাদের দমনের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। গৃহযুদ্ধ শেষ করায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধদের চোখে নায়ক বনে যান তিনি।

২০১৫ সালে মাহিন্দা ক্ষমতা হারান। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ ছাড়েন গোতাবায়া। ২০১৯ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর ক্ষমতায় ফেরে রাজাপাকসা পরিবার। একজন দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন নাÑনিয়মের কারণে মাহিন্দা তখন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট হন গোতাবায়া।

২০২০ সালে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাড়ে গোতাবায়ার দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি)। সংবিধান সংশোধনের সুযোগ পায় দলটি। প্রধানমন্ত্রী পদে ভাই মাহিন্দাকে বসান গোতাবায়া। আরেক ভাই বাসিলসহ আত্মীয়দের মন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন তিনি।

২০১৯ সালের শেষ দিকে গোতাবায়া জনতুষ্টিমূলক কর কর্তনের পদক্ষেপ নেন। এতে সরকারের রাজস্ব ব্যাপকভাবে কমে যায়। করোনা মহামারীতে দেশটির অর্থনীতি মারাত্মক ধাক্কা খায়। এতে দেশটির স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে।

শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেয়। আমদানি করা পণ্য ও ওষুধের ঘাটতি দেখা দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক ঋত পরিশোধে হিমশিম খেতে থাকে শ্রীলঙ্কা। এই ঋণের বড় অংশই ছিল উচ্চাভিলাষী অবকাঠামাগত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণ। এমনকি ভারতের মতো প্রতিবেশীর কাছেও দেনাদার হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা।

অর্থনৈতিক সংকটে প্রতিবাদ জানাতে চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশটির জনগণ রাজপথে নামে। সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ দমনে মাঠে নামেন রাজাপাকসের সমর্থকেরা। বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।

চলতি বছরের গত ৩১ মার্চ শত শত বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবনে হামলার চেষ্টা করেন।

রবিবার, ১৭ জুলাই ২০২২ , ০২ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৮ জিলহজ ১৪৪৩

সংকটের কারণ জানালেন গোতাবায়া রাজাপাকসা

image

রাজাপাকসা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগে জনতার উচ্ছ্বাস -বিবিসি

শ্রীলঙ্কার সদ্য পদত্যাগ করা সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতায়াবা রাজাপাকসা দাবি করেছেন, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। দেশটির পার্লামেন্টের মহাসচিব ধাম্মিকা দশানায়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টে রাজাপাকসার পদত্যাগপত্র পড়ে শোনান।

পদত্যাগ পত্রে রাজাপাকসা বলেছেন, শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের মূলে ছিল কয়েক বছরের অব্যবস্থাপনা, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে শ্রীলঙ্কায় পর্যটক আসা কমে যাওয়া এবং বিদেশি কর্মীদের থেকে রেমিট্যান্স আসাও কমে যাওয়া।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস যে আমি এই সংকট মোকাবিলায় সংসদ সদস্যদের নিয়ে সর্বদলীয় বা ঐক্যের সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানোসহ সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিয়েছি।’ এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে সিঙ্গাপুর থেকে রাজাপাকসার পাঠানো পদত্যাগপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন দেশটির স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবিবর্ধনে। তার পদত্যাগের ফলে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে। তবে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে রনিল বিক্রমাসিংহকে স্বাগত জানানো হয়নি। শ্রীলঙ্কার বিক্ষোভকারীরা রনিলের পদত্যাগও দাবি করেছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হচ্ছিল, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন রনিল। উল্টো তিনি পদত্যাগ না করে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষ থেকে তাকেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হবে।

দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিকে নানা সংঘাত, সহিংসতা, সংকট, চড়াই-উতরাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চল ঘিরে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল লিবারেশন অব তামিল টাইগার্স ইলম (এলটিটিই) নামের সংগঠন। দেশটির সরকারকে বহু বছর ধরে এলটিটিইর সশস্ত্র তৎপরতার মোকাবিলা করতে হয়।

২০০৯ সালে রক্তক্ষয়ী এই লড়াইয়ের অবসান ঘটে। তামিল টাইগার গেরিলাদের দমনের অভিযান তত্ত্বাবধান করেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোতাবায়া। এই গৃহযুদ্ধে লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। গৃহযুদ্ধের অবসানের পর ২০১৯ সালে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মুখে পড়ে শ্রীলঙ্কা। ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার একাধিক স্থানে জঙ্গি হামলা হয়। এই হামলায় আড়াইশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে রাজাপক্ষে পরিবার। এই পরিবারের সদস্য মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট উভয় পদেই দায়িত্ব পালন করেন। মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া দেশটির সবশেষ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাদের আরেক ভাই বাসিল রাজাপাকসা ছিলেন অর্থমন্ত্রী। মাহিন্দা ২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলে রাজনীতিতে নামেন গোতাবায়া। তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন। তামিল টাইগার গেরিলাদের দমনের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। গৃহযুদ্ধ শেষ করায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধদের চোখে নায়ক বনে যান তিনি।

২০১৫ সালে মাহিন্দা ক্ষমতা হারান। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ ছাড়েন গোতাবায়া। ২০১৯ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর ক্ষমতায় ফেরে রাজাপাকসা পরিবার। একজন দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন নাÑনিয়মের কারণে মাহিন্দা তখন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট হন গোতাবায়া।

২০২০ সালে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাড়ে গোতাবায়ার দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনার (এসএলপিপি)। সংবিধান সংশোধনের সুযোগ পায় দলটি। প্রধানমন্ত্রী পদে ভাই মাহিন্দাকে বসান গোতাবায়া। আরেক ভাই বাসিলসহ আত্মীয়দের মন্ত্রীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন তিনি।

২০১৯ সালের শেষ দিকে গোতাবায়া জনতুষ্টিমূলক কর কর্তনের পদক্ষেপ নেন। এতে সরকারের রাজস্ব ব্যাপকভাবে কমে যায়। করোনা মহামারীতে দেশটির অর্থনীতি মারাত্মক ধাক্কা খায়। এতে দেশটির স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে।

শ্রীলঙ্কায় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দেয়। আমদানি করা পণ্য ও ওষুধের ঘাটতি দেখা দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক ঋত পরিশোধে হিমশিম খেতে থাকে শ্রীলঙ্কা। এই ঋণের বড় অংশই ছিল উচ্চাভিলাষী অবকাঠামাগত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনের কাছ থেকে নেয়া ঋণ। এমনকি ভারতের মতো প্রতিবেশীর কাছেও দেনাদার হয়ে পড়ে শ্রীলঙ্কা।

অর্থনৈতিক সংকটে প্রতিবাদ জানাতে চলতি বছরের শুরুর দিকে দেশটির জনগণ রাজপথে নামে। সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ দমনে মাঠে নামেন রাজাপাকসের সমর্থকেরা। বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।

চলতি বছরের গত ৩১ মার্চ শত শত বিক্ষোভকারী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিতে তার বাসভবনে হামলার চেষ্টা করেন।