বাংলাদেশ শুধু মানুষের হোক

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

১৮ জুন নড়াইলে শিক্ষক নির্যাতন, ২৫ জুন সাভারে শিক্ষক হত্যাসহ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষকদের অপমান-অপদস্থ করার ঘটনা দেশকে কিছুটা হলেও নাড়া দিয়েছে। ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্র আশরাফুল আহসান জিতুকে গ্রেপ্তার করেছে র?্যাব। কিছুদিন পূর্বে শিক্ষক অবমাননার আরেকটি ঘটনা ঘটেছে নড়াইলে- ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নড়াইলে পুলিশের উপস্থিতিতে কলেজশিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পরানো হয়েছে জুতার মালা। এই ঘটনার অন্যতম আসামি রহমতুল্লাহ বিশ্বাস রনিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও গলায় জুতার মালা পরে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের পাশে নির্লিপ্ত পুলিশ সদস্যদের যে ছবি প্রকাশ পেয়েছে, তা সমগ্র পুলিশ সমাজকে উপহাস করছে।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সাবেক মুখপাত্র নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র রাহুল দেব রায় একটি পোস্ট দেয়; ইত্যবসরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস পোস্টদাতা শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন। এমন কথা শোনা মাত্রই মুসলমান ছাত্র-জনতা জোটবদ্ধ হয়ে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরায়। অথচ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে পোস্টদাতাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঢাকার উত্তরার ড. রতন সিদ্দিকীর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, তিনি ও তার শিক্ষক স্ত্রী কিছু মতলববাজ মুসলমানের হাতে কীভাবে নাজেহাল হয়েছেন, তা তিনি উক্ত ভিডিওতে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের অবস্থা পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কোথাও ভিন্ন কারণে তর্ক-বিতর্ক হলেই ‘নাস্তিক’ আর ‘মালাউন’ আখ্যা দিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দলবদ্ধ আক্রমন চালানো হচ্ছে এবং উগ্র জনতার রোষ থেকে বাঁচাতে পুলিশকে বিনা অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ধরে থানায় নিয়ে যেতে হচ্ছে।

ছাত্ররা যত বেশি ধর্ম ‘সচেতন’ হচ্ছে শিক্ষকদের লাঞ্ছনা তত বেশি বাড়ছে। মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র ম-লকে চলতি বছরের মার্চ মাসে একই স্কুলের ছাত্ররা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ দিয়ে ক্লাসে নাজেহাল করার পর ১৯ দিন তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। ২০১৬ সনে বাগেরহাট চিতলমারির হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষালের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠে এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী তার পক্ষ নিয়েছেন বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের তাৎক্ষণিক বিচারে তাদের ছয় মাসের জেল হয়। ২০১৬ সনে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলে সাংসদ সেলিম ওসমান তাকে ছাত্র-জনতার সম্মুখে কানে ধরে ওঠবস করতে বাধ্য করেন। কপালে টিপ পরার কারণে কলেজ শিক্ষিকা লতা সমাদ্দারকে রাস্তার ওপর হেনস্তা করা হয়েছে, নওগাঁর স্কুলশিক্ষিকা আমোদিনী পালকে হিজাববিরোধী আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কিছুটা প্রশ্রয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা যেভাবে বেড়েছে, তা আওয়ামী লীগের সব অর্জনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ধর্মের নামে অঘটন তত বেশি হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে তা সামাল দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ধর্ম অবমাননার জিগির তোলা উগ্র লোকগুলো মনস্টারের রূপ নেয়, আশ্রয়দাতাকে পরিশেষে বিনাশ করে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে; নতুবা একজন ছাত্র তার শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে পারে না, একজন শিক্ষাগুরুকে তারই ছাত্র জুতার মালা পরাতে পারে না। দেশের ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, স্কুলের অপ্রাপ্তবয়ষ্ক ছাত্ররাও ধর্ম রক্ষায় নেমেছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া মাত্রই স্কুলের ছাত্ররা উত্তেজিত হচ্ছে, সেøাগান দিচ্ছে, সংঘবদ্ধ হয়ে নিজের শিক্ষককে লাঞ্ছিত করছে। এই অস্বাভাবিক পরিবেশটি আগে ছিল না, সাম্প্রতিক কালের সৃষ্টি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মের অপপ্রচার শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। সমাজের মানসগঠনে এত বেশি নেতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে যে ধর্মের জন্য ছাত্রদের মিছিল আর সেøাগান সমাজে প্রসংশিত হচ্ছে। এই ব্যাধি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে, কারণ, ধর্ম অপ্রতিরোধ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহজলভ্য হওয়ায় কিছু ছাত্র নিজেদের বাহাদুরির প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ পেয়েছে। প্রেমিকাকে নিজের ক্ষমতা বা বাহাদুরি দেখানোর প্রবল আগ্রহে আশরাফুল আহসান তার শিক্ষককে সবার সম্মুখে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

ধর্ম রক্ষার কথা বলে রাজনৈতিক নেতারা ধর্মযোদ্ধা তৈরি করেন, এই ধর্মযোদ্ধারা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সমাজে বীরোচিত সংবর্ধনা পায়। ধর্মীয় অজুহাতে মানুষ যেভাবে জোটবদ্ধ হয়, অন্য কোন মহৎ কাজে সেভাবে মানুষকে একতাবদ্ধ করা যায় না। তাই অধিকতর হেনস্তা থেকে শিক্ষকদের বাঁচাতে পুলিশকেও কৌশলী হতে হয়, নিরীহ ও নিরপরাধ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে হাজতে আবদ্ধ করে রাখতে হয়। লালন সাঁই, হাসান রাজা, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম অনেক আগেই জন্ম নিয়েছিলেন, এখন জন্ম নিলে তাদের অবস্থা হৃদয় ম-ল, স্বপন কুমার বিশ্বাস, অশোক কুমার ঘোষাল, কৃষ্ণপদ মহলী, শ্যামল কান্তি ভক্তের চেয়েও খারাপ হতো।

বর্তমানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে মনে হয় কোন শিক্ষক স্বেচ্ছায় আর বিজ্ঞান পড়াতে চাইবেন না। বিজ্ঞান পড়াতে গেলেই ধর্ম অবমাননার সম্ভাবনা তৈরি হবে, কারণ, বহু ক্ষেত্রে ধর্ম এবং বিজ্ঞান সাংঘর্ষিক। ছাত্র আর জনতার আক্রমণাত্মক কর্মকা- যেভাবে বিস্তার লাভ করছে, তাতে শুধু বিজ্ঞান নয়, ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক কোন চর্চাও এখন আর নিরাপদ নয়। কিছু মুসলমানের ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে, ধর্ম বিরোধীদের শাস্তি নিজ হাতের তলোয়ার দিয়ে করতে চায়। এই অবস্থা ইসলাম ধর্মের জন্য শুভ নয়। ধর্ম চর্চায় এত ভীতি থাকলে ইসলামের ইতিহাস চর্চাও সীমিত হয়ে যেতে পারে। আমরাই বলি, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান সবাই মুসলমানদের শত্রু; তাহলে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ৭৮৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৬০০ কোটি মানুষই ইসলামবিরোধী। ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করার সামর্থ খুশির খবর মনে হলেও এক সময় তা বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। ধর্মের প্রচার-প্রসার হয় অনুসারীদের বিনয়, নম্রতা ও আচার-আচরণে। ভারতবর্ষে সুফিদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে হাজার হাজার হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু এখন কিছু মুসলমানের জেহাদি আচরণে সমগ্র পৃথিবীতে উগ্রতাই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ বা ধর্ম রক্ষার নামে এখন যা করা হচ্ছে, তা অবশ্যই ইসলাম ধর্মের শান্তির বার্তাকে কলুষিত করছে।

শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো, তাদের জেলে পাঠানো, জুতার মালা গলায় পরিয়ে জনসমক্ষে হাঁটিয়ে নেয়া, শিক্ষককে দিগম্বর করে আনন্দ করা, শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলা, চড় মারা সবই হচ্ছে। এগুলোর চেয়েও ঘৃণ্যতর কাজ হচ্ছে তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়া। কারণ, প্রতিটি ক্লাসে কিছু ছাত্র ওঁৎ পেতে আছে কোন শিক্ষক কখন ধর্মের ‘অবমাননামূলক’ কথা বলেন। এমন ভীতি বিরাজ করলে গুণগত শিক্ষা দেওয়ার তাগিদ, শক্তি বা সদিচ্ছা কোনটাই আর অবশিষ্ট থাকবে না। মাথা নিচু করে বড় বড় আমলা হওয়া যায়, মন্ত্রী হওয়া যায়, কিন্তু শিক্ষক নয়। ইচ্ছেমতো যত্রতত্র যেমন তেমন শাস্তি আরোপ করার এই প্রবণতা রোধ করা না হলে শিক্ষকদের শাস্তি প্রদানের ভয়াবহ রূপ অচিরে দেশের সর্বত্র আশঙ্কাজনকভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এমন প্রত্যাশা করে না, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ চায় এই দেশ হোক শুধু মানুষের।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল]

রবিবার, ১৭ জুলাই ২০২২ , ০২ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৮ জিলহজ ১৪৪৩

বাংলাদেশ শুধু মানুষের হোক

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

১৮ জুন নড়াইলে শিক্ষক নির্যাতন, ২৫ জুন সাভারে শিক্ষক হত্যাসহ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষকদের অপমান-অপদস্থ করার ঘটনা দেশকে কিছুটা হলেও নাড়া দিয়েছে। ঢাকার সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্র আশরাফুল আহসান জিতুকে গ্রেপ্তার করেছে র?্যাব। কিছুদিন পূর্বে শিক্ষক অবমাননার আরেকটি ঘটনা ঘটেছে নড়াইলে- ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নড়াইলে পুলিশের উপস্থিতিতে কলেজশিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পরানো হয়েছে জুতার মালা। এই ঘটনার অন্যতম আসামি রহমতুল্লাহ বিশ্বাস রনিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও গলায় জুতার মালা পরে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের পাশে নির্লিপ্ত পুলিশ সদস্যদের যে ছবি প্রকাশ পেয়েছে, তা সমগ্র পুলিশ সমাজকে উপহাস করছে।

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সাবেক মুখপাত্র নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র রাহুল দেব রায় একটি পোস্ট দেয়; ইত্যবসরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস পোস্টদাতা শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন। এমন কথা শোনা মাত্রই মুসলমান ছাত্র-জনতা জোটবদ্ধ হয়ে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরায়। অথচ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে পোস্টদাতাকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঢাকার উত্তরার ড. রতন সিদ্দিকীর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, তিনি ও তার শিক্ষক স্ত্রী কিছু মতলববাজ মুসলমানের হাতে কীভাবে নাজেহাল হয়েছেন, তা তিনি উক্ত ভিডিওতে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের অবস্থা পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কোথাও ভিন্ন কারণে তর্ক-বিতর্ক হলেই ‘নাস্তিক’ আর ‘মালাউন’ আখ্যা দিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দলবদ্ধ আক্রমন চালানো হচ্ছে এবং উগ্র জনতার রোষ থেকে বাঁচাতে পুলিশকে বিনা অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ধরে থানায় নিয়ে যেতে হচ্ছে।

ছাত্ররা যত বেশি ধর্ম ‘সচেতন’ হচ্ছে শিক্ষকদের লাঞ্ছনা তত বেশি বাড়ছে। মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র ম-লকে চলতি বছরের মার্চ মাসে একই স্কুলের ছাত্ররা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ দিয়ে ক্লাসে নাজেহাল করার পর ১৯ দিন তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। ২০১৬ সনে বাগেরহাট চিতলমারির হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষালের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠে এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী তার পক্ষ নিয়েছেন বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের তাৎক্ষণিক বিচারে তাদের ছয় মাসের জেল হয়। ২০১৬ সনে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠলে সাংসদ সেলিম ওসমান তাকে ছাত্র-জনতার সম্মুখে কানে ধরে ওঠবস করতে বাধ্য করেন। কপালে টিপ পরার কারণে কলেজ শিক্ষিকা লতা সমাদ্দারকে রাস্তার ওপর হেনস্তা করা হয়েছে, নওগাঁর স্কুলশিক্ষিকা আমোদিনী পালকে হিজাববিরোধী আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কিছুটা প্রশ্রয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা যেভাবে বেড়েছে, তা আওয়ামী লীগের সব অর্জনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ধর্মের নামে অঘটন তত বেশি হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে তা সামাল দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ধর্ম অবমাননার জিগির তোলা উগ্র লোকগুলো মনস্টারের রূপ নেয়, আশ্রয়দাতাকে পরিশেষে বিনাশ করে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি নৈতিকতার অবক্ষয় হয়েছে; নতুবা একজন ছাত্র তার শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে পারে না, একজন শিক্ষাগুরুকে তারই ছাত্র জুতার মালা পরাতে পারে না। দেশের ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, স্কুলের অপ্রাপ্তবয়ষ্ক ছাত্ররাও ধর্ম রক্ষায় নেমেছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া মাত্রই স্কুলের ছাত্ররা উত্তেজিত হচ্ছে, সেøাগান দিচ্ছে, সংঘবদ্ধ হয়ে নিজের শিক্ষককে লাঞ্ছিত করছে। এই অস্বাভাবিক পরিবেশটি আগে ছিল না, সাম্প্রতিক কালের সৃষ্টি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মের অপপ্রচার শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করছে। সমাজের মানসগঠনে এত বেশি নেতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে যে ধর্মের জন্য ছাত্রদের মিছিল আর সেøাগান সমাজে প্রসংশিত হচ্ছে। এই ব্যাধি প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে, কারণ, ধর্ম অপ্রতিরোধ্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহজলভ্য হওয়ায় কিছু ছাত্র নিজেদের বাহাদুরির প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ পেয়েছে। প্রেমিকাকে নিজের ক্ষমতা বা বাহাদুরি দেখানোর প্রবল আগ্রহে আশরাফুল আহসান তার শিক্ষককে সবার সম্মুখে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে।

ধর্ম রক্ষার কথা বলে রাজনৈতিক নেতারা ধর্মযোদ্ধা তৈরি করেন, এই ধর্মযোদ্ধারা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সমাজে বীরোচিত সংবর্ধনা পায়। ধর্মীয় অজুহাতে মানুষ যেভাবে জোটবদ্ধ হয়, অন্য কোন মহৎ কাজে সেভাবে মানুষকে একতাবদ্ধ করা যায় না। তাই অধিকতর হেনস্তা থেকে শিক্ষকদের বাঁচাতে পুলিশকেও কৌশলী হতে হয়, নিরীহ ও নিরপরাধ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে হাজতে আবদ্ধ করে রাখতে হয়। লালন সাঁই, হাসান রাজা, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম অনেক আগেই জন্ম নিয়েছিলেন, এখন জন্ম নিলে তাদের অবস্থা হৃদয় ম-ল, স্বপন কুমার বিশ্বাস, অশোক কুমার ঘোষাল, কৃষ্ণপদ মহলী, শ্যামল কান্তি ভক্তের চেয়েও খারাপ হতো।

বর্তমানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে মনে হয় কোন শিক্ষক স্বেচ্ছায় আর বিজ্ঞান পড়াতে চাইবেন না। বিজ্ঞান পড়াতে গেলেই ধর্ম অবমাননার সম্ভাবনা তৈরি হবে, কারণ, বহু ক্ষেত্রে ধর্ম এবং বিজ্ঞান সাংঘর্ষিক। ছাত্র আর জনতার আক্রমণাত্মক কর্মকা- যেভাবে বিস্তার লাভ করছে, তাতে শুধু বিজ্ঞান নয়, ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক কোন চর্চাও এখন আর নিরাপদ নয়। কিছু মুসলমানের ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে, ধর্ম বিরোধীদের শাস্তি নিজ হাতের তলোয়ার দিয়ে করতে চায়। এই অবস্থা ইসলাম ধর্মের জন্য শুভ নয়। ধর্ম চর্চায় এত ভীতি থাকলে ইসলামের ইতিহাস চর্চাও সীমিত হয়ে যেতে পারে। আমরাই বলি, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি, খ্রিস্টান সবাই মুসলমানদের শত্রু; তাহলে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর ৭৮৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৬০০ কোটি মানুষই ইসলামবিরোধী। ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করার সামর্থ খুশির খবর মনে হলেও এক সময় তা বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। ধর্মের প্রচার-প্রসার হয় অনুসারীদের বিনয়, নম্রতা ও আচার-আচরণে। ভারতবর্ষে সুফিদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে হাজার হাজার হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু এখন কিছু মুসলমানের জেহাদি আচরণে সমগ্র পৃথিবীতে উগ্রতাই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগ বা ধর্ম রক্ষার নামে এখন যা করা হচ্ছে, তা অবশ্যই ইসলাম ধর্মের শান্তির বার্তাকে কলুষিত করছে।

শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো, তাদের জেলে পাঠানো, জুতার মালা গলায় পরিয়ে জনসমক্ষে হাঁটিয়ে নেয়া, শিক্ষককে দিগম্বর করে আনন্দ করা, শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলা, চড় মারা সবই হচ্ছে। এগুলোর চেয়েও ঘৃণ্যতর কাজ হচ্ছে তাদের মুখ বন্ধ করে দেয়া। কারণ, প্রতিটি ক্লাসে কিছু ছাত্র ওঁৎ পেতে আছে কোন শিক্ষক কখন ধর্মের ‘অবমাননামূলক’ কথা বলেন। এমন ভীতি বিরাজ করলে গুণগত শিক্ষা দেওয়ার তাগিদ, শক্তি বা সদিচ্ছা কোনটাই আর অবশিষ্ট থাকবে না। মাথা নিচু করে বড় বড় আমলা হওয়া যায়, মন্ত্রী হওয়া যায়, কিন্তু শিক্ষক নয়। ইচ্ছেমতো যত্রতত্র যেমন তেমন শাস্তি আরোপ করার এই প্রবণতা রোধ করা না হলে শিক্ষকদের শাস্তি প্রদানের ভয়াবহ রূপ অচিরে দেশের সর্বত্র আশঙ্কাজনকভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এমন প্রত্যাশা করে না, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ চায় এই দেশ হোক শুধু মানুষের।

[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল]