উচ্চশিক্ষার গুণগত পরিবর্তন ও আমাদের করণীয়

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বর্তমান বিশ্বে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং উচ্চতর শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং মানোন্নয়নের জন্য বিশেষত: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে একটি মূল শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় মান অর্জনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পশাসন সম্পর্কিত সমস্যা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে অনেক প্রতিষ্ঠানে যথাযথ প্রশাসনিক নিয়মনীতি থাকা সত্ত্বেও সেখানে কার্যকর নীতি ও পেশাদারিত্বের অভাবে ওই নীতিগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না শিক্ষক, অনুষদের ডিন, ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর এসব পদগুলোর নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন, রাজনৈতিক বা দলীয়ভাবে নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশির ভাগ দেশে উচ্চশিক্ষার সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেমগুলো একটি ব্যাপক রূপান্তরকরণের মধ্যে রয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যকারিতা ও কর্মদক্ষতা উন্নত করার জন্য ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক চাপের মধ্যে রয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে, উচ্চশিক্ষা লাভের ব্যাপকতা সীমাহীন বৃদ্ধি পাবার কারণে উচ্চশিক্ষাকে বেসরকারি খাতে একটি উদীয়মান ব্যবসায়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে, যেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং সমাজে জনহিতকর অবদানের চেয়ে ব্যবসায়িক মনোভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে উচ্চশিক্ষাকে বাণিজ্যকরণের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। উপরন্তু, ইউজিসি নীতিমালার কঠোর বাস্তবায়ন এবং নজরদারি বাড়ানো, গবেষণা বৃত্তি ও গবেষণা অনুদানসহ গবেষণা খাতে অধিকতর অর্থায়ন, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাবস্থাপনা পরিষদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলগত পরিকল্পনা, IQAC কার্যক্রমকে গতিশীল করা ও গুণগত মানের নিশ্চয়তা নির্ধারণ এবং সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গবেষণা-সংস্কৃতি প্রবর্তন ব্যতিরেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।

২০৩০-এর মধ্যে মানসম্মত ও সর্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য এসডিজি-৪-এ উল্লেখ আছে। যত দ্রুত সম্ভব অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা জরুরি। একটি বিশেষ শিক্ষা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মেধাবী, নিবেদিত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া অপরিহার্য। শিক্ষকতা পেশা যাতে মেধাবীদের প্রথম পছন্দ হয়, সে লক্ষ্যে তাদের বেতন প্রাপ্য মর্যাদার সঙ্গে মানানসই হওয়া বাঞ্ছনীয়। নিয়োগকৃত শিক্ষকদের নিরন্তর প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের গবেষণা ও দক্ষতা মূল্যায়ন করে পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে। বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় অযৌক্তিক অনুপাতভিত্তিক পদোন্নতি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া উচিত। সব শিক্ষকের চাকরি নির্দিষ্ট মেয়াদাণ্ডে বদলিযোগ্য হওয়া উচিত। শিক্ষা প্রশাসনে, বিশেষ করে অধিদপ্তর বা শিক্ষা বোর্ডে পদায়নের জন্য শিক্ষকদের মধ্যে কোন অনৈতিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে কি না, ভেবে দেখতে হবে। সমকালীন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথাগত শিক্ষার পরম্পরাগত ঝোঁককে জীবনমুখী কারিগরি শিক্ষার ধারায় চালিত করা জরুরি। ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত অথচ নিষ্ক্রিয় তারুণ্যকে প্রযুক্তিনির্ভর পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে প্রয়োজন মাফিক আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। শিক্ষিত বেকার উৎপাদক গতানুগতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামে বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রয়োজনমুখী সংস্কার আনলে শিক্ষা কাঠামোয় গুণগত পরিবর্তন আসবে।

দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানকারী ভাষা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিষয়ে উপযুক্ত শিক্ষকের চাহিদা মেটাতে সক্ষম জনবল তৈরির লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে অন্তত ১০০টি মানসম্পন্ন ডিগ্রি কলেজ স্থাপন বা উন্নীতকরণ শিক্ষার মানোন্নয়নে নির্ণায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় মানবিক, নৈতিক, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যুক্তিবাদী ও দেশপ্রেমে আলোকিত নাগরিক হিসেবে একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার মহৎ লক্ষ্যে একটি কার্যকর, আধুনিক, বৈষম্যহীন ও জবাবদিহিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিংয়ে তলানিতে বাংলাদেশ! উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন শুধু একাডেমিক কারিকুলাম আর পাঠদানের ওপর নির্ভর করে না। এ ভুবনে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করতে হয়। বায়বীয়ভাবে জ্ঞান সৃষ্টি করা যায় না। এজন্য শিক্ষক-গবেষকদের আর্থিকসহ গবেষণা সহায়ক নানা রকম সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হলে র‌্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছতে হলে গৎবাঁধা নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অগ্রসর হতে হবে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সৃজনীশক্তি দিয়ে নতুনত্ব উপহার দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভর পড়ালেখা, চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখাকে একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে সৃজনশীলতার দিকে মনোনিবেশ করতে পারেন, তা শিক্ষকদের বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক গন্ডির বাইরের বিশাল নতুনত্বের স্বাদ উপভোগে ব্যর্থ হবেন। উন্নত বিশ্বে উচ্চশিক্ষার গুণগতমান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স কাউন্সিল বা এজেন্সি রয়েছে, যেমন ব্রিটেনে Quality Assurance Agency, অস্ট্রেলিয়ায় The Tertiary Education Quality and Standards Agency,সিঙ্গাপুরে Council for Private Education এবং ইউরোপের অনেক দেশেই এরকম মানদণ্ড রয়েছে। এমনকি, আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যেও আসিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্কের গুণগতমানের AUNQA কাঠামো তৈরি করে তাদের দেশগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষার একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছে এবং ২০১৬ সালে SAARC- র একটি সম্মেলনে একইভাবে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য সমমানের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সম্মেলন না হবার কারণে তা বান্তবায়িত হয়নি।

এছাড়া, মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বে, এমনকি এশিয়া মহাদেশের মধ্যেও, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে বর্তমান অবস্থান তার থেকে উত্তরণের জন্য কমপক্ষে এশিয়া মহাদেশের, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার শিক্ষা এবং গবেষণা নীতিমালাকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করা যেতে পারে। QS র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রথম সারিতে ওই তিনটি দেশের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের উচ্চতর মান বজায় রেখেছে, যেখানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি এশিয়ার মধ্যে যথাক্রমে ১ম এবং ২য় স্থানে রয়েছে। যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৪১তম স্থান অর্জন করতে পেরেছে এবং লন্ডনভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক পলিসি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষণ অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে পেরেছে সেখানে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও অগ্রগামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার মান প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত ক’রে বাংলাদেশকে একটি মেধাসম্পন্ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সম্মৃদ্ধ উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে যথাযথ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই পরিকল্পিত ও আধুনিক মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্ত অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক নতুন বিভাগ চালু করছে দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি অনুমোদন ছাড়াই কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কয়েকটি বিভাগ খোলার চেষ্টা করার অভিযোগ পাওয়ার পর ইউজিসি তা নাকচ করে দিয়েছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ থেকে দুই, তিন এমনকি চারটি বিভাগও খোলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু শিক্ষকের দ্রুত চেয়ারম্যান হওয়ার আকাক্সক্ষা পূরণ এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য পদ সৃষ্টির মতো বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেয়েছে এসব বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে। কাউকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার জন্য কিংবা কয়েকজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ব্যক্তিস্বার্থে এগুলো করা হয়েছে। এসব বিভাগের সিলেবাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একটি বিভাগই যথেষ্ট। যেসব বিষয়ে পাঠদানের জন্য একটি কোর্সই যথেষ্ট, সে বিষয়েও বিভাগ খোলা হয়েছে। চাকরির বাজারে চাহিদা নেই এমন বিভাগও খোলা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খোলায় শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তথা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

রবিবার, ১৭ জুলাই ২০২২ , ০২ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৮ জিলহজ ১৪৪৩

উচ্চশিক্ষার গুণগত পরিবর্তন ও আমাদের করণীয়

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

বর্তমান বিশ্বে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং উচ্চতর শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং মানোন্নয়নের জন্য বিশেষত: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে একটি মূল শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় মান অর্জনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পশাসন সম্পর্কিত সমস্যা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে অনেক প্রতিষ্ঠানে যথাযথ প্রশাসনিক নিয়মনীতি থাকা সত্ত্বেও সেখানে কার্যকর নীতি ও পেশাদারিত্বের অভাবে ওই নীতিগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না শিক্ষক, অনুষদের ডিন, ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর এসব পদগুলোর নিয়োগ ও পদোন্নতি যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন, রাজনৈতিক বা দলীয়ভাবে নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশির ভাগ দেশে উচ্চশিক্ষার সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিস্টেমগুলো একটি ব্যাপক রূপান্তরকরণের মধ্যে রয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যকারিতা ও কর্মদক্ষতা উন্নত করার জন্য ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতামূলক চাপের মধ্যে রয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে, উচ্চশিক্ষা লাভের ব্যাপকতা সীমাহীন বৃদ্ধি পাবার কারণে উচ্চশিক্ষাকে বেসরকারি খাতে একটি উদীয়মান ব্যবসায়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে, যেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবন এবং সমাজে জনহিতকর অবদানের চেয়ে ব্যবসায়িক মনোভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে উচ্চশিক্ষাকে বাণিজ্যকরণের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। উপরন্তু, ইউজিসি নীতিমালার কঠোর বাস্তবায়ন এবং নজরদারি বাড়ানো, গবেষণা বৃত্তি ও গবেষণা অনুদানসহ গবেষণা খাতে অধিকতর অর্থায়ন, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাবস্থাপনা পরিষদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশলগত পরিকল্পনা, IQAC কার্যক্রমকে গতিশীল করা ও গুণগত মানের নিশ্চয়তা নির্ধারণ এবং সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গবেষণা-সংস্কৃতি প্রবর্তন ব্যতিরেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।

২০৩০-এর মধ্যে মানসম্মত ও সর্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য এসডিজি-৪-এ উল্লেখ আছে। যত দ্রুত সম্ভব অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা জরুরি। একটি বিশেষ শিক্ষা সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে মেধাবী, নিবেদিত ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া অপরিহার্য। শিক্ষকতা পেশা যাতে মেধাবীদের প্রথম পছন্দ হয়, সে লক্ষ্যে তাদের বেতন প্রাপ্য মর্যাদার সঙ্গে মানানসই হওয়া বাঞ্ছনীয়। নিয়োগকৃত শিক্ষকদের নিরন্তর প্রশিক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের গবেষণা ও দক্ষতা মূল্যায়ন করে পদোন্নতি দেওয়া যেতে পারে। বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় অযৌক্তিক অনুপাতভিত্তিক পদোন্নতি প্রথা বিলুপ্ত হওয়া উচিত। সব শিক্ষকের চাকরি নির্দিষ্ট মেয়াদাণ্ডে বদলিযোগ্য হওয়া উচিত। শিক্ষা প্রশাসনে, বিশেষ করে অধিদপ্তর বা শিক্ষা বোর্ডে পদায়নের জন্য শিক্ষকদের মধ্যে কোন অনৈতিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে কি না, ভেবে দেখতে হবে। সমকালীন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথাগত শিক্ষার পরম্পরাগত ঝোঁককে জীবনমুখী কারিগরি শিক্ষার ধারায় চালিত করা জরুরি। ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত অথচ নিষ্ক্রিয় তারুণ্যকে প্রযুক্তিনির্ভর পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে প্রয়োজন মাফিক আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। শিক্ষিত বেকার উৎপাদক গতানুগতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলামে বিজ্ঞানভিত্তিক ও প্রয়োজনমুখী সংস্কার আনলে শিক্ষা কাঠামোয় গুণগত পরিবর্তন আসবে।

দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাদানকারী ভাষা, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিষয়ে উপযুক্ত শিক্ষকের চাহিদা মেটাতে সক্ষম জনবল তৈরির লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে অন্তত ১০০টি মানসম্পন্ন ডিগ্রি কলেজ স্থাপন বা উন্নীতকরণ শিক্ষার মানোন্নয়নে নির্ণায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় মানবিক, নৈতিক, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যুক্তিবাদী ও দেশপ্রেমে আলোকিত নাগরিক হিসেবে একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার মহৎ লক্ষ্যে একটি কার্যকর, আধুনিক, বৈষম্যহীন ও জবাবদিহিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিংয়ে তলানিতে বাংলাদেশ! উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন শুধু একাডেমিক কারিকুলাম আর পাঠদানের ওপর নির্ভর করে না। এ ভুবনে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির দায়িত্ব পালন করতে হয়। বায়বীয়ভাবে জ্ঞান সৃষ্টি করা যায় না। এজন্য শিক্ষক-গবেষকদের আর্থিকসহ গবেষণা সহায়ক নানা রকম সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হলে র‌্যাঙ্কিংয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছতে হলে গৎবাঁধা নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অগ্রসর হতে হবে। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সৃজনীশক্তি দিয়ে নতুনত্ব উপহার দিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভর পড়ালেখা, চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখাকে একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় না নিয়ে সৃজনশীলতার দিকে মনোনিবেশ করতে পারেন, তা শিক্ষকদের বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক গন্ডির বাইরের বিশাল নতুনত্বের স্বাদ উপভোগে ব্যর্থ হবেন। উন্নত বিশ্বে উচ্চশিক্ষার গুণগতমান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স কাউন্সিল বা এজেন্সি রয়েছে, যেমন ব্রিটেনে Quality Assurance Agency, অস্ট্রেলিয়ায় The Tertiary Education Quality and Standards Agency,সিঙ্গাপুরে Council for Private Education এবং ইউরোপের অনেক দেশেই এরকম মানদণ্ড রয়েছে। এমনকি, আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যেও আসিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্কের গুণগতমানের AUNQA কাঠামো তৈরি করে তাদের দেশগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষার একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছে এবং ২০১৬ সালে SAARC- র একটি সম্মেলনে একইভাবে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য সমমানের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সম্মেলন না হবার কারণে তা বান্তবায়িত হয়নি।

এছাড়া, মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিশ্বে, এমনকি এশিয়া মহাদেশের মধ্যেও, বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে বর্তমান অবস্থান তার থেকে উত্তরণের জন্য কমপক্ষে এশিয়া মহাদেশের, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার শিক্ষা এবং গবেষণা নীতিমালাকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করা যেতে পারে। QS র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রথম সারিতে ওই তিনটি দেশের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের উচ্চতর মান বজায় রেখেছে, যেখানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি এশিয়ার মধ্যে যথাক্রমে ১ম এবং ২য় স্থানে রয়েছে। যেখানে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৪১তম স্থান অর্জন করতে পেরেছে এবং লন্ডনভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক পলিসি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষণ অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হতে পেরেছে সেখানে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও অগ্রগামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার মান প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত ক’রে বাংলাদেশকে একটি মেধাসম্পন্ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে সম্মৃদ্ধ উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে যথাযথ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই পরিকল্পিত ও আধুনিক মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্ত অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক নতুন বিভাগ চালু করছে দেশের কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি অনুমোদন ছাড়াই কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কয়েকটি বিভাগ খোলার চেষ্টা করার অভিযোগ পাওয়ার পর ইউজিসি তা নাকচ করে দিয়েছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগ থেকে দুই, তিন এমনকি চারটি বিভাগও খোলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কিছু শিক্ষকের দ্রুত চেয়ারম্যান হওয়ার আকাক্সক্ষা পূরণ এবং নতুন শিক্ষক নিয়োগের জন্য পদ সৃষ্টির মতো বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেয়েছে এসব বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে। কাউকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার জন্য কিংবা কয়েকজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ব্যক্তিস্বার্থে এগুলো করা হয়েছে। এসব বিভাগের সিলেবাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে একটি বিভাগই যথেষ্ট। যেসব বিষয়ে পাঠদানের জন্য একটি কোর্সই যথেষ্ট, সে বিষয়েও বিভাগ খোলা হয়েছে। চাকরির বাজারে চাহিদা নেই এমন বিভাগও খোলা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খোলায় শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তথা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]