শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে বিশ্বকে সতর্ক করলো আইএমএফ

অর্থনীতিতে ধস নামা শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে সারা বিশ্বকে সতর্ক করলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিসটালিনা জর্জিভা বলেছেন, ‘যেসব দেশে উচ্চ মাত্রার ঋণ গ্রহণ ও এ সংক্রান্ত নীতিমালার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আছে, তাদের জন্য শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একটি অশনি সংকেত।’ গত শনিবার ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের এক সমন্বিত বৈঠকে জর্জিভা এই মন্তব্য করেন।

সেখানে তিনি আরও জানান, ইউক্রেনের যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে, যা খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দামের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে আগের পূর্বাভাষের তুলনায় আন্তর্জাতিক অর্থায়ন পরিস্থিতি আরও সংকুচিত হয়ে এসেছে। এর পাশাপাশি মহামারি সংক্রান্ত বাধা-বিপত্তি ও বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে চলমান সীমাবদ্ধতার কারণে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরও কমে আসার পূর্বাভাষও দেন ২০১৯ সাল থেকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা জর্জিভা।

বুলগেরিয়ার এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘এসব বিষয়কে বিবেচনায় রেখে এ মাসের শেষে প্রকাশিতব্য ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক আপডেট’ এ ২০২২ ও ২০২৩ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাষকে আরও কমিয়ে আনা হবে। মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকলে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। এতে বেশিরভাগ উন্নত দেশের নীতিমালায় সরকারি হস্তক্ষেপ বাড়বে, যার সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবে সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। এই প্রবণতা উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে।’

জানা গেছে, বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে টানা ৪ মাস ধরে রপ্তানি থেকে আসা অর্থের চেয়ে আমদানি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেশি হচ্ছে। এই দেশগুলো গত ৩ দশক ধরে চেষ্টা চালিয়ে উন্নত অর্থনীতির সমপর্যায়ে আসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তাদের পিছু হটতে বাধ্য করছে।

এছাড়া সরকারের চলমান আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায়। আইএমএফ স্টাফ মিশন নামে পাঁচ সদস্যের এই প্রতিনিধিদল এসেছে গত বৃহস্পতিবার। আজ থেকে সরকারের সঙ্গে আইএমএফ সফররত প্রতিনিধি দলের আসন্ন বৈঠকে রাজস্ব পরিস্থিতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইবে প্রতিনিধি দল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের কথা বলবে তারা। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ ও ভর্তুকিতে বিশাল বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে সংস্থাটি।

সফরকালে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবে। আজ থেকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করবে প্রতিনিধি দলটি। বাংলাদেশে এক সপ্তাহ অবস্থান করবে তারা।

অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থমন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের পর একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে আইএমএফ স্টাফ মিশন। সফর শেষে প্রতিবেদনটি সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে। এই মিশনের সফর শেষে দুই মাস পর আরেকটি দল আসবে। সেই বৈঠকে সংস্কার কর্মসূচি মূল্যায়ণ করে বাংলাদেশকে নতুন করে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে আইএমএফ।

এবারের বৈঠকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে রাজস্ব পরিস্থিতি। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মূলত ঋণ সংকটই দায়ী এ কথা বাংলাদেশ সরকারকে সর্তক করবে আইএমএফ। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো। বিদেশি ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধে যাতে কোন সমস্যা না হয়, সে জন্য রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে আরও জোর দেয়ার পরামর্শ দেবে আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা হবে।

আইএমএফ মনে করে, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে হলে অব্যশই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। অর্থমন্ত্রণায়ের সঙ্গে বৈঠকে মূলত বাজেট ঘাটতি ও ভর্তুকি বিষয় আলোচনা প্রাধান্য পাবে। এবারের বাজেটে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা এ যাবত কালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

আইএমএফ মনে করে, ভর্তুকি একটি অনুৎপাদনশীল খাত। বেশি ভর্তুকি দেয়ার অর্থ হচ্ছে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া। এতে করে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ব্যহত হয়, যা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়। বর্তমানে ভর্তুকি খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আড়াই শতাংশ। এ খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।

সোমবার, ১৮ জুলাই ২০২২ , ০৩ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৯ জিলহজ ১৪৪৩

শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে বিশ্বকে সতর্ক করলো আইএমএফ

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

image

অর্থনীতিতে ধস নামা শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে সারা বিশ্বকে সতর্ক করলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিসটালিনা জর্জিভা বলেছেন, ‘যেসব দেশে উচ্চ মাত্রার ঋণ গ্রহণ ও এ সংক্রান্ত নীতিমালার ব্যাপারে সীমাবদ্ধতা আছে, তাদের জন্য শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একটি অশনি সংকেত।’ গত শনিবার ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের এক সমন্বিত বৈঠকে জর্জিভা এই মন্তব্য করেন।

সেখানে তিনি আরও জানান, ইউক্রেনের যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে, যা খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দামের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। ফলে আগের পূর্বাভাষের তুলনায় আন্তর্জাতিক অর্থায়ন পরিস্থিতি আরও সংকুচিত হয়ে এসেছে। এর পাশাপাশি মহামারি সংক্রান্ত বাধা-বিপত্তি ও বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে চলমান সীমাবদ্ধতার কারণে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম আরও কমে আসার পূর্বাভাষও দেন ২০১৯ সাল থেকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা জর্জিভা।

বুলগেরিয়ার এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ‘এসব বিষয়কে বিবেচনায় রেখে এ মাসের শেষে প্রকাশিতব্য ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক আপডেট’ এ ২০২২ ও ২০২৩ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাষকে আরও কমিয়ে আনা হবে। মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকলে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি বাড়তে থাকবে। এতে বেশিরভাগ উন্নত দেশের নীতিমালায় সরকারি হস্তক্ষেপ বাড়বে, যার সম্ভাব্য পরিণতি হিসেবে সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। এই প্রবণতা উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে।’

জানা গেছে, বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে টানা ৪ মাস ধরে রপ্তানি থেকে আসা অর্থের চেয়ে আমদানি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেশি হচ্ছে। এই দেশগুলো গত ৩ দশক ধরে চেষ্টা চালিয়ে উন্নত অর্থনীতির সমপর্যায়ে আসার চেষ্টা করছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি তাদের পিছু হটতে বাধ্য করছে।

এছাড়া সরকারের চলমান আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায়। আইএমএফ স্টাফ মিশন নামে পাঁচ সদস্যের এই প্রতিনিধিদল এসেছে গত বৃহস্পতিবার। আজ থেকে সরকারের সঙ্গে আইএমএফ সফররত প্রতিনিধি দলের আসন্ন বৈঠকে রাজস্ব পরিস্থিতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইবে প্রতিনিধি দল। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের কথা বলবে তারা। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ ও ভর্তুকিতে বিশাল বরাদ্দ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে সংস্থাটি।

সফরকালে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবে। আজ থেকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করবে প্রতিনিধি দলটি। বাংলাদেশে এক সপ্তাহ অবস্থান করবে তারা।

অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, অর্থমন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের পর একটি প্রতিবেদন তৈরি করবে আইএমএফ স্টাফ মিশন। সফর শেষে প্রতিবেদনটি সরকারের কাছে জমা দেয়া হবে। এই মিশনের সফর শেষে দুই মাস পর আরেকটি দল আসবে। সেই বৈঠকে সংস্কার কর্মসূচি মূল্যায়ণ করে বাংলাদেশকে নতুন করে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেবে আইএমএফ।

এবারের বৈঠকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে রাজস্ব পরিস্থিতি। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য মূলত ঋণ সংকটই দায়ী এ কথা বাংলাদেশ সরকারকে সর্তক করবে আইএমএফ। যদিও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেক ভালো। বিদেশি ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধে যাতে কোন সমস্যা না হয়, সে জন্য রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে আরও জোর দেয়ার পরামর্শ দেবে আইএমএফ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আলোচনা হবে।

আইএমএফ মনে করে, সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে হলে অব্যশই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। অর্থমন্ত্রণায়ের সঙ্গে বৈঠকে মূলত বাজেট ঘাটতি ও ভর্তুকি বিষয় আলোচনা প্রাধান্য পাবে। এবারের বাজেটে প্রায় ৮৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা এ যাবত কালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

আইএমএফ মনে করে, ভর্তুকি একটি অনুৎপাদনশীল খাত। বেশি ভর্তুকি দেয়ার অর্থ হচ্ছে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া। এতে করে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ব্যহত হয়, যা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়। বর্তমানে ভর্তুকি খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আড়াই শতাংশ। এ খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।