কেন বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি সংকট?

ম. তামিম

সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। যদি আমরা ১৯৭৩ সালে আরবদের দেয়া তেল অবরোধের সময়কার সঙ্গেও তুলনা করি, দেখব এখনকার পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার কথা যদি ধরি, সে সময় জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়লেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারী এবং তার পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানির মূল্য বাড়তি। কোভিডের সময় ২০২০ এর দ্বিতীয়ার্ধে বিদ্যুতের চাহিদা ৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল। জ্বালানি চাহিদা কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। ওই বছর জুনে তরলায়িত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির প্রতি এমএমবিটিইউর (১০ লাখ বা এক মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট) বাজার মূল্য নেমে এসেছিল ২ দশমিক ০৫ মার্কিন ডলারে। নিউক্যাসলের কয়লার দাম ছিল টন প্রতি ৫০ মার্কিন ডলার। আর এপ্রিলের ২০ তারিখে পড়ে গিয়েছিল জ্বালানি তেলের দাম। এর ফলে একটি বড় সংখ্যক জ্বালানি সরবরাহ ক্ষেত্র, বিশেষ করে ছোট আকারের প্রতিষ্ঠানগুলো, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জ্বালানি তেলের বড় সরবরাহকারীরা তাদের কার্যক্রম কমিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ২০২১-এর শুরুতে এসে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল, দাম বাড়তে লাগল জ্বালানির। অর্থনীতির এই ঘুরে দাঁড়ানোটা আকস্মিকই ছিল। কিন্তু কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যবস্থা স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারল না বা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলো। অর্থনীতির এ বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লাগে গ্যাস খাতে। সরবরাহের ব্যাপক ঘাটতির কারণে ২০২১-এর অক্টোবরে এশিয়ার বাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৫ ডলারে পৌঁছে। গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে অন্যান্য জ্বালানির উৎস বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়লার ওপরে।

নিউক্যাসেলের বৈদ্যুতিক কয়লার দাম ওই সময়ে টনপ্রতি ২৬৬ মার্কিন ডলারে পৌঁছে। অর্থাৎ একেবারে পাঁচগুণ বৃদ্ধি। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি সহনীয় থাকলেও গ্যাসোলিন, ডিজেলের মতো জ্বালানি পণ্যের শোধনাগারের সীমাবদ্ধতার কারণে বাড়তেই থাকে। এই সংকটের মধ্যেই, রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে।

ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে এশিয়ার বাজারের এক এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল ২৮ মার্কিন ডলার, ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে প্রতিটন কয়লার দাম ছিল ২৩৭ মার্কিন ডলার, আর ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ছিল ৯৯ দশমিক ২৯ মার্কিন ডলার। এর আগের ৫ বছরের গড়ের তুলনায় যা ছিল অনেক বেশি। রাশিয়ার সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় ২০২২ সালের মার্চ মাসে গ্যাসের দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৭০ মার্কিন ডলার এবং কয়লার দাম প্রতিটন ৪১২ মার্কিন ডলারে ওঠে। বর্তমানে প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাসের বাজার মূল্য ৪০ মার্কিন ডলার, কয়লা (যরময ধংয বা উচ্চমানের ছাই যুক্ত কয়লা) টনপ্রতি ১৬০ মার্কিন ডলার এবং অপরিশোধিত ব্রেন্ট ব্যারেল প্রতি ১০৫ ডলার। এর মধ্যে দীর্ঘদিন দাম বাড়তি থাকার কারণে চাহিদারও পতন ঘটেছে।

বিশ্ব কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে : দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানির এই অভূতপূর্ব বেশি দাম এবং জোগানের ঘাটতি সব দেশের অর্থনীতিকেই চাপের মুখে ফেলেছে। উন্নত, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত- সব দেশেই জীবনযাত্রার ব্যয় বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাব থেকে অনেকখানি সুরক্ষিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিসহ খাদ্য সরবরাহ, জাহাজের সংকুলান, কনটেইনার স্বল্পতা এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় অন্যান্য সমস্যার কারণে আরও অনেক দেশ এখন মন্দার হুমকিতে। ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। এছাড়া বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের ১২ শতাংশ জোগান দেয় দেশটি, যার অর্ধেক যায় ইউরোপে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে জোগানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে ইউরোপে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ডস এবং অন্যান্য দেশ তাদের দেশের গরীব পরিবারগুলোকে ভর্তুকি দিচ্ছে। এ কারণে এগুলোর মধ্যে অনেক দেশেই প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে বিক্রেতাদের বহন করতে হচ্ছে ব্যায়ের একটি অংশ। এর মধ্যে স্পেন নিজ দেশের জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার ওপর কর বসিয়েছে এবং তারা পরিকল্পনা করছে এ থেকে পাওয়া ২৪০ কোটি ইউরো তারা সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে বণ্টন করবে। ইউরোপের জ্বালানির দামবৃদ্ধি সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছে।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও, যেখানে গ্যাসের জন্য বহির্বিশ্বের ওপর নির্ভর করতে হয়ে না, সেখানে গ্যাসের দাম অনেক বেড়েছে। তবে সবেচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়েছে আমদানি নির্ভরশীল উন্নয়নশীল দেশগুলো। চীন ২০২২ এর প্রথমার্ধে এক বছর আগের তুলনায় তাদের এলএনজি আমদানি কমিয়েছে ২০ শতাংশ, ভারত ১৪ শতাংশ। চীনের অনেকগুলো প্রদেশেই ‘সুশৃঙ্খলভাবে’ বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। ভারতের অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ বভ্রাট হয়েছে, এবং ২০১৫ সালের পর এই প্রথমবারের মতো তাদের রাষ্ট্রয়াত্ত কয়লা প্রতিষ্ঠান কোল ইন্ডিয়া কয়লা আমদানি করছে। পাকিস্তান তাদের কর্মদিবস কমিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন করেছে এবং বিদ্যুতের বাণিজ্যিক ব্যববহার বন্ধ করে দিচ্ছে। বর্তমানে তারা চাহিদার তুলনায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন করছে। জ্বালানি আমদানি করতে তাদের অতিরিক্ত ৬০০ কোটি ডলারের যে বোঝা, তার জন্য তাদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর প্রভাব পড়ছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ৬০ শতাংশ আমদানি করতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার সঙ্গে প্রায় শূন্য মুদ্রা রিজার্ভ দেশটিকে অস্থিরতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে।

এমনকি এশিয়ার উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো এবং ওশেনিয়া মহাদেশভুক্ত দেশগুলোও কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিনিময় হারের সামঞ্জস্য বিধানের পাশাপাশি জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে এলএনজি সংরক্ষণে তেলবাহী জাহাজ ভাড়া করেছে সিঙ্গাপুর। জাপান চাহিদার লাগাম টানতে তার নাগরিকদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার না করার নির্দেশনা দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার জ্বালানিমন্ত্রী নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের বাসিন্দাদের সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছে। শুধু তেল, কয়লা ও গ্যাস উৎপাদনকারী কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সবই দেশই এখন কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়াস গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের অবস্থা : বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা না বাড়ানোয় ২০০০ সালের পর থেকে বিদ্যুৎ ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি সামলাতে বিএনপি সরকার তখন জ্বালানি তেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদানে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে আসে। সেটাই পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রহণ করে বাস্তবায়নের জন্য। ২০০৮ সালেই প্রথম ১০টি প্রতিষ্ঠানকে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানোর অনুমোদন দেয়া হয়। প্রথমদিকে বিরোধিতা করলেও ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আরও তেলনির্ভর রেন্টাল প্ল্যান্টের অনুমোদন দেয়। কেননা মারাত্মক লোডশেডিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আর কোন উপায় ছিল না। লোডশেডিংয়ের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মারাত্মভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। এর মাঝেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমস্যার জায়গা নিল প্রাথমিক জ্বালানির স্বল্পতা। ২০০৭ এ প্রতিদিন ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি ছিল, যা মেটানোর আর কোন উপায় ছিল না। আজ সেই ঘাটতি দৈনিক ১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০২০ সালে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মহাপরিকল্পনা (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান বা পিএসএমপি) এবং ২০১৬ সালের পিএসএমপিতে এই ঘাটতির কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনাগুলোতেই অভ্যন্তরীণ উৎস হতে জ্বালানি গ্যাস অনুসন্ধানের বদলে বাইরে থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর অধিক নির্ভরশীলতার নীতি গৃহীত হয়। ২০১০ এর পরিকল্পনায় স্থানীয় খনিতে প্রাপ্ত কয়লার ওপর ৩০ শতাংশ নির্ভরতার কথা বলা হলেও ২০১৬ সালের পরিকল্পনায় তা বাদ দেয়া হয়। যদিও সরকার এসব পরিকল্পনা সেভাবে অনুসরণ করেনি, তার বদলে জ্বালানির আমদানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকেছে। এর ফলেই আন্তর্জাতিক বাজরের মূল্য ও জোগানের ওঠানামার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, প্রাথমিক জ্বালানির বিষয়টা তেমনভাবে সামনে আসেনি। প্রতিবার এই অতি আমদানি নির্ভরতার কথা যখন বলা হয়েছে, তখন অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সমাধান হিসেবে হাজির করা হয়েছে।

একমাত্র বাপেক্স নির্ভর অনুসন্ধানের নীতির ফলে দেখা যাচ্ছে গত ২০ বছরের মধ্যে কোনো বছরেরই একটির বেশি খনন হয়নি। আবার ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নির্ধারণর সত্ত্বেও সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানী কার্যক্রম ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। পেট্রোবাংলাও ২০১৬-১৭ সালে যতটুকু উৎপাদনে সক্ষম হয়েছিল, তা তারা ধরে রাখতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর স্থানীয় উৎস থেকে যে কোনো ধরনের কয়লা উৎপাদনের সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেছে ২০১২-তে। অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত গ্যাসের সদ্ব্যবহারের অভাবের কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি স্বনির্ভরতার পথ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গতিতে সরে গেছে। জ্বালানি ও তার উৎসের বৈচিত্র্য তথা জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে এলএনজি ও কয়লা আরো আগে থেকে আমদানি শুরু করার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাণিজ্যে আমাদের অনভিজ্ঞতা আরো প্রকাশিত হয় যখন আমরা ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টন (৭২ লাখ টন) এলএনজি সক্ষমতার জন্য আমরা চার মিলিয়ন (৪০ লাখ) টনের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করলাম। স্থায়ী সরবরাহ ঘাটতি পরিস্থিতির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে আমদানির জন্য তহবিল রাখার কোন সুপারিশ রাখা হয়নি।

অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সামর্থ্যরে সংকট একটি ফাঁদ, যা সরকারই তৈরি করেছে। ২৫৫০০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে ৩৫০০ মেগাওয়াটই অফগ্রিড (বাসাবাড়ির সৌরচালিত বিদ্যুৎ এবং স্থানীয়ভাবে শিল্প উৎপাদিত বিদ্যুৎ)। সেই সঙ্গে ৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধ্যবাধকতা ও যান্ত্রিক কারণ বা জ্বালানি স্বল্পতার জন্য বন্ধ হয়ে আছে। সক্ষমতার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং উৎপাদন কেন্দ্রের প্রাপ্যতা মিলিয়ে গ্রিডের সক্ষমতা ১৬ হাজার মেগাওয়াট।

যতক্ষণ সরকার অলস পড়ে থাকা কাগজে কলমের ৩০০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা থেকে হিসাব থেকে বাদ না দিবে ততক্ষণ বিদ্যুৎ উৎপদানের অতিসক্ষমতার ধন্দ কাটবে না। ক্যাপাসিটি পেমেন্টের (যে কোনো সুবিধা ব্যবহার করে ?উৎপাদিত সেবা ব্যবহারের সুযোগের মাধ্যমে পরিশোধ) আরেক দিক আরও জটিল। প্রতিটি পাওয়ার প্ল্যান্টকে কিলোওয়াট-ঘণ্টা ১.২৫ থেকে ২.৪০ টাকা পর্যন্ত ক্যাপাসিটি কস্ট বা সামর্থ্য ব্যয় দেয়া হয়। এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়েরই একটি অংশ এর মধ্যমে বিনিয়োগকারীরা প্রকল্প চলাকালে তাদের টাকা উঠিয়ে নিতে পারে। পুরোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলোর ব্যয় কম। যদি একটি ভারী জ্বালানি তেল চালিত কারখানার উৎপাদন ব্যয় প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় ১৫ টাকা হয়, তাহলে ২ টাকা হবে তার সামর্থ্য ব্যয় এবং ১৩ টাকা তার জ্বালানি ব্যয়। একইভাবে পুরোনো কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট এর গ্যাস চালিত বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীর (আিইপিপি) ব্যয় হবে কিলোওয়াট-ঘণ্টা প্রতি সাড়ে তিন টাকা এবং সামর্থ্য ব্যয় হবে ১ টাকা ২৫ পয়সা।

পুরো শীতের সময়, তেলনির্ভর বিদ্যুৎ কারখানাগুলোকে বসিয়ে রাখা হয়, কিন্তু তারা সামর্থ্য ব্যয় বা ক্যাপাসিটি কস্ট গ্রহণ করে। তীব্র গ্রীষ্মে যখন বিদ্যুতের চাহিদা ৫০০০ মেগাওয়াট বাড়ে, তাদের অধিকাংশকে কাজে লাগানো হয়। সেখানে কি দুর্নীতির কোন সুযোগ থাকে? কিছু দুর্নীতি অবশ্যই হয়। তবে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা সামর্থ্য সৃষ্টিতে যে টাকা দেয়া হয় তা নিয়ে যত কথা উঠছে তা কর্মহীন বসে থাকার ওই সময় নিয়ে। বেশ কিছু এরকম বসে থাকা প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য কদাচিৎ কাজে লাগে। এগুলোকে প্রথমেই বাদ দেয়া উচিত। তবে কয়লাভিত্তিক বড় উৎপাদনকারী না আসা পর্যন্ত তেলভিত্তিক সক্ষমতাকে এখনই বাতিল করে দেয়া যাবে না।

আমরা আমাদের আগের ভুলগুলোর জন্য এখন মাশুল দিচ্ছি। আমরা খুব সহজেই ছয় মিলিয়ন বা ৬০ লাখ টনের দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তি করতে পারতাম। আমরা একই সমান্তরালে আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাস খাতের উন্নয়নে অনেক বেশি মনোযোগ দিতে পারতাম। আমরা বড় কয়লাভিত্তিক প্রকল্প তৈরিতে সময় নিয়েছি। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প হাতে নেয়ার পর থেকে প্রায় ১২ বছর চলে গেলো। আরো অনেক সমস্যা আছে। আমরা বাস্তবায়নের বিলম্ব ও ভুল ছাড়াও নীতির ক্ষেত্রেও কিছু ভুল করেছি। এগুলো সহসাই পাল্টানো সম্ভব হবে না। তবে সেগুলো সংশোধনে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ভূমিতে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের সবগুলো পথ অন্বেষণের উদ্যোগ খুব দ্রুতই হাতে নেয়া দরকার। গ্যাসের নিশ্চিত উৎসের সঙ্গে ভূমিতে এলএনজি প্ল্যান্ট দরকার। এছাড়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে স্থানীয় কয়লার উন্নয়নের জন্য তৃতীয় কোন পক্ষ দিয়ে নিরপেক্ষ সমীক্ষা করানো দরকার।

অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করতে সরকারকে অবশ্যই সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কারখানাগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। কয়লা সরবরাহ ও আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ সংযোগের (ট্রান্সমিশন লাইনের) কাজ শেষ করতে হবে।

আমরা পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্টের এক ইউনিটের জন্য গত দেড় বছর ধরে প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছি। কেননা সরবরাহ লাইনগুলো এখনো অসম্পূর্ণ। অন্যান্য পাওয়ার প্লান্টের জন্য যেমন বিশেষ করে একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এটা করার সামর্থ্য আমাদের নেই।

বর্তমানে আমাদের যে জ্বালানি সংকট চলছে তা খুবই অন্যরকম। বর্তমান অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বর্তমান পর্যায়ে রাখার জন্য পরিকল্পিত লোডশেডিং সম্ভবত সর্বোত্তম পন্থা। এটি বিদেশি মুদ্রার চাহিদা সহনীয় পর্যায়ে রাখবে। এই পদ্ধতি গ্রহণের সেটাও আরেকটা কারণ। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল খাত যেমন শিল্প ও কৃষিতে আমাদের বিশেষ নজর দেয়া দরকার। আমাদের ছাদ, বাড়ি, সেচ, রাস্তার বাতি ইত্যাদিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিটি অংশকে আমাদের নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। আশা করা যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাহিদা কমানোর পদ্ধতি গ্রহণ করায় এবং সম্ভাব্য মন্দাবস্থার কারণে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসবে। তবে গ্যাসের ক্ষেত্রে তা হবে না। সঞ্চয়ের পাশাপাশি যতটা সম্ভব জ্বালানি সংরক্ষণ করাও দরকার নাগরিকদের।

[লেখক : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জ্বালানি তেল ও খনিজ সম্পদ

বিভাগের অধ্যাপক]

ইংরেজী থেকে অনুবাদ:

মোহাম্মাদ আবু বকর সিদ্দিক

সোমবার, ১৮ জুলাই ২০২২ , ০৩ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৯ জিলহজ ১৪৪৩

কেন বাংলাদেশের বর্তমান জ্বালানি সংকট?

ম. তামিম

সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। যদি আমরা ১৯৭৩ সালে আরবদের দেয়া তেল অবরোধের সময়কার সঙ্গেও তুলনা করি, দেখব এখনকার পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার কথা যদি ধরি, সে সময় জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মূল্য বাড়লেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারী এবং তার পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানির মূল্য বাড়তি। কোভিডের সময় ২০২০ এর দ্বিতীয়ার্ধে বিদ্যুতের চাহিদা ৩ শতাংশ কমে গিয়েছিল। জ্বালানি চাহিদা কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। ওই বছর জুনে তরলায়িত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির প্রতি এমএমবিটিইউর (১০ লাখ বা এক মিলিয়ন ব্রিটিশ থারমাল ইউনিট) বাজার মূল্য নেমে এসেছিল ২ দশমিক ০৫ মার্কিন ডলারে। নিউক্যাসলের কয়লার দাম ছিল টন প্রতি ৫০ মার্কিন ডলার। আর এপ্রিলের ২০ তারিখে পড়ে গিয়েছিল জ্বালানি তেলের দাম। এর ফলে একটি বড় সংখ্যক জ্বালানি সরবরাহ ক্ষেত্র, বিশেষ করে ছোট আকারের প্রতিষ্ঠানগুলো, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জ্বালানি তেলের বড় সরবরাহকারীরা তাদের কার্যক্রম কমিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু ২০২১-এর শুরুতে এসে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করল, দাম বাড়তে লাগল জ্বালানির। অর্থনীতির এই ঘুরে দাঁড়ানোটা আকস্মিকই ছিল। কিন্তু কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যবস্থা স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে পারল না বা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলো। অর্থনীতির এ বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লাগে গ্যাস খাতে। সরবরাহের ব্যাপক ঘাটতির কারণে ২০২১-এর অক্টোবরে এশিয়ার বাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে প্রতি এমএমবিটিইউ ৩৫ ডলারে পৌঁছে। গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে অন্যান্য জ্বালানির উৎস বিশেষ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত কয়লার ওপরে।

নিউক্যাসেলের বৈদ্যুতিক কয়লার দাম ওই সময়ে টনপ্রতি ২৬৬ মার্কিন ডলারে পৌঁছে। অর্থাৎ একেবারে পাঁচগুণ বৃদ্ধি। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি সহনীয় থাকলেও গ্যাসোলিন, ডিজেলের মতো জ্বালানি পণ্যের শোধনাগারের সীমাবদ্ধতার কারণে বাড়তেই থাকে। এই সংকটের মধ্যেই, রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে।

ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে এশিয়ার বাজারের এক এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ছিল ২৮ মার্কিন ডলার, ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে প্রতিটন কয়লার দাম ছিল ২৩৭ মার্কিন ডলার, আর ২৩ ফেব্রুয়ারিতে ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ছিল ৯৯ দশমিক ২৯ মার্কিন ডলার। এর আগের ৫ বছরের গড়ের তুলনায় যা ছিল অনেক বেশি। রাশিয়ার সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় ২০২২ সালের মার্চ মাসে গ্যাসের দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৭০ মার্কিন ডলার এবং কয়লার দাম প্রতিটন ৪১২ মার্কিন ডলারে ওঠে। বর্তমানে প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাসের বাজার মূল্য ৪০ মার্কিন ডলার, কয়লা (যরময ধংয বা উচ্চমানের ছাই যুক্ত কয়লা) টনপ্রতি ১৬০ মার্কিন ডলার এবং অপরিশোধিত ব্রেন্ট ব্যারেল প্রতি ১০৫ ডলার। এর মধ্যে দীর্ঘদিন দাম বাড়তি থাকার কারণে চাহিদারও পতন ঘটেছে।

বিশ্ব কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে : দীর্ঘ সময় ধরে জ্বালানির এই অভূতপূর্ব বেশি দাম এবং জোগানের ঘাটতি সব দেশের অর্থনীতিকেই চাপের মুখে ফেলেছে। উন্নত, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত- সব দেশেই জীবনযাত্রার ব্যয় বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাব থেকে অনেকখানি সুরক্ষিত হলেও যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিসহ খাদ্য সরবরাহ, জাহাজের সংকুলান, কনটেইনার স্বল্পতা এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় অন্যান্য সমস্যার কারণে আরও অনেক দেশ এখন মন্দার হুমকিতে। ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। এছাড়া বিশ্বের অপরিশোধিত তেলের ১২ শতাংশ জোগান দেয় দেশটি, যার অর্ধেক যায় ইউরোপে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে জোগানের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে ইউরোপে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফ্রান্স, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেন, নেদারল্যান্ডস এবং অন্যান্য দেশ তাদের দেশের গরীব পরিবারগুলোকে ভর্তুকি দিচ্ছে। এ কারণে এগুলোর মধ্যে অনেক দেশেই প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে বিক্রেতাদের বহন করতে হচ্ছে ব্যায়ের একটি অংশ। এর মধ্যে স্পেন নিজ দেশের জ্বালানি প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার ওপর কর বসিয়েছে এবং তারা পরিকল্পনা করছে এ থেকে পাওয়া ২৪০ কোটি ইউরো তারা সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে বণ্টন করবে। ইউরোপের জ্বালানির দামবৃদ্ধি সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছে।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও, যেখানে গ্যাসের জন্য বহির্বিশ্বের ওপর নির্ভর করতে হয়ে না, সেখানে গ্যাসের দাম অনেক বেড়েছে। তবে সবেচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়েছে আমদানি নির্ভরশীল উন্নয়নশীল দেশগুলো। চীন ২০২২ এর প্রথমার্ধে এক বছর আগের তুলনায় তাদের এলএনজি আমদানি কমিয়েছে ২০ শতাংশ, ভারত ১৪ শতাংশ। চীনের অনেকগুলো প্রদেশেই ‘সুশৃঙ্খলভাবে’ বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে। ভারতের অনেক জায়গাতেই বিদ্যুৎ বভ্রাট হয়েছে, এবং ২০১৫ সালের পর এই প্রথমবারের মতো তাদের রাষ্ট্রয়াত্ত কয়লা প্রতিষ্ঠান কোল ইন্ডিয়া কয়লা আমদানি করছে। পাকিস্তান তাদের কর্মদিবস কমিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন করেছে এবং বিদ্যুতের বাণিজ্যিক ব্যববহার বন্ধ করে দিচ্ছে। বর্তমানে তারা চাহিদার তুলনায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন করছে। জ্বালানি আমদানি করতে তাদের অতিরিক্ত ৬০০ কোটি ডলারের যে বোঝা, তার জন্য তাদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর প্রভাব পড়ছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ৬০ শতাংশ আমদানি করতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার সঙ্গে প্রায় শূন্য মুদ্রা রিজার্ভ দেশটিকে অস্থিরতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে।

এমনকি এশিয়ার উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো এবং ওশেনিয়া মহাদেশভুক্ত দেশগুলোও কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিনিময় হারের সামঞ্জস্য বিধানের পাশাপাশি জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে এলএনজি সংরক্ষণে তেলবাহী জাহাজ ভাড়া করেছে সিঙ্গাপুর। জাপান চাহিদার লাগাম টানতে তার নাগরিকদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার না করার নির্দেশনা দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার জ্বালানিমন্ত্রী নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের বাসিন্দাদের সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ রাখার অনুরোধ করেছে। শুধু তেল, কয়লা ও গ্যাস উৎপাদনকারী কয়েকটি দেশ ছাড়া প্রায় সবই দেশই এখন কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়াস গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের অবস্থা : বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা না বাড়ানোয় ২০০০ সালের পর থেকে বিদ্যুৎ ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি সামলাতে বিএনপি সরকার তখন জ্বালানি তেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদানে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নিয়ে আসে। সেটাই পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রহণ করে বাস্তবায়নের জন্য। ২০০৮ সালেই প্রথম ১০টি প্রতিষ্ঠানকে রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানোর অনুমোদন দেয়া হয়। প্রথমদিকে বিরোধিতা করলেও ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আরও তেলনির্ভর রেন্টাল প্ল্যান্টের অনুমোদন দেয়। কেননা মারাত্মক লোডশেডিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আর কোন উপায় ছিল না। লোডশেডিংয়ের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মারাত্মভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। এর মাঝেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমস্যার জায়গা নিল প্রাথমিক জ্বালানির স্বল্পতা। ২০০৭ এ প্রতিদিন ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি ছিল, যা মেটানোর আর কোন উপায় ছিল না। আজ সেই ঘাটতি দৈনিক ১৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০২০ সালে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মহাপরিকল্পনা (পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান বা পিএসএমপি) এবং ২০১৬ সালের পিএসএমপিতে এই ঘাটতির কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনাগুলোতেই অভ্যন্তরীণ উৎস হতে জ্বালানি গ্যাস অনুসন্ধানের বদলে বাইরে থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর অধিক নির্ভরশীলতার নীতি গৃহীত হয়। ২০১০ এর পরিকল্পনায় স্থানীয় খনিতে প্রাপ্ত কয়লার ওপর ৩০ শতাংশ নির্ভরতার কথা বলা হলেও ২০১৬ সালের পরিকল্পনায় তা বাদ দেয়া হয়। যদিও সরকার এসব পরিকল্পনা সেভাবে অনুসরণ করেনি, তার বদলে জ্বালানির আমদানি বৃদ্ধি অব্যাহত থেকেছে। এর ফলেই আন্তর্জাতিক বাজরের মূল্য ও জোগানের ওঠানামার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, প্রাথমিক জ্বালানির বিষয়টা তেমনভাবে সামনে আসেনি। প্রতিবার এই অতি আমদানি নির্ভরতার কথা যখন বলা হয়েছে, তখন অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সমাধান হিসেবে হাজির করা হয়েছে।

একমাত্র বাপেক্স নির্ভর অনুসন্ধানের নীতির ফলে দেখা যাচ্ছে গত ২০ বছরের মধ্যে কোনো বছরেরই একটির বেশি খনন হয়নি। আবার ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নির্ধারণর সত্ত্বেও সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধানী কার্যক্রম ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। পেট্রোবাংলাও ২০১৬-১৭ সালে যতটুকু উৎপাদনে সক্ষম হয়েছিল, তা তারা ধরে রাখতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর স্থানীয় উৎস থেকে যে কোনো ধরনের কয়লা উৎপাদনের সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেছে ২০১২-তে। অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ও প্রাপ্ত গ্যাসের সদ্ব্যবহারের অভাবের কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি স্বনির্ভরতার পথ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গতিতে সরে গেছে। জ্বালানি ও তার উৎসের বৈচিত্র্য তথা জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে এলএনজি ও কয়লা আরো আগে থেকে আমদানি শুরু করার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাণিজ্যে আমাদের অনভিজ্ঞতা আরো প্রকাশিত হয় যখন আমরা ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টন (৭২ লাখ টন) এলএনজি সক্ষমতার জন্য আমরা চার মিলিয়ন (৪০ লাখ) টনের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করলাম। স্থায়ী সরবরাহ ঘাটতি পরিস্থিতির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে আমদানির জন্য তহবিল রাখার কোন সুপারিশ রাখা হয়নি।

অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সামর্থ্যরে সংকট একটি ফাঁদ, যা সরকারই তৈরি করেছে। ২৫৫০০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে ৩৫০০ মেগাওয়াটই অফগ্রিড (বাসাবাড়ির সৌরচালিত বিদ্যুৎ এবং স্থানীয়ভাবে শিল্প উৎপাদিত বিদ্যুৎ)। সেই সঙ্গে ৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধ্যবাধকতা ও যান্ত্রিক কারণ বা জ্বালানি স্বল্পতার জন্য বন্ধ হয়ে আছে। সক্ষমতার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং উৎপাদন কেন্দ্রের প্রাপ্যতা মিলিয়ে গ্রিডের সক্ষমতা ১৬ হাজার মেগাওয়াট।

যতক্ষণ সরকার অলস পড়ে থাকা কাগজে কলমের ৩০০০ মেগাওয়াট সক্ষমতা থেকে হিসাব থেকে বাদ না দিবে ততক্ষণ বিদ্যুৎ উৎপদানের অতিসক্ষমতার ধন্দ কাটবে না। ক্যাপাসিটি পেমেন্টের (যে কোনো সুবিধা ব্যবহার করে ?উৎপাদিত সেবা ব্যবহারের সুযোগের মাধ্যমে পরিশোধ) আরেক দিক আরও জটিল। প্রতিটি পাওয়ার প্ল্যান্টকে কিলোওয়াট-ঘণ্টা ১.২৫ থেকে ২.৪০ টাকা পর্যন্ত ক্যাপাসিটি কস্ট বা সামর্থ্য ব্যয় দেয়া হয়। এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়েরই একটি অংশ এর মধ্যমে বিনিয়োগকারীরা প্রকল্প চলাকালে তাদের টাকা উঠিয়ে নিতে পারে। পুরোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলোর ব্যয় কম। যদি একটি ভারী জ্বালানি তেল চালিত কারখানার উৎপাদন ব্যয় প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় ১৫ টাকা হয়, তাহলে ২ টাকা হবে তার সামর্থ্য ব্যয় এবং ১৩ টাকা তার জ্বালানি ব্যয়। একইভাবে পুরোনো কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট এর গ্যাস চালিত বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীর (আিইপিপি) ব্যয় হবে কিলোওয়াট-ঘণ্টা প্রতি সাড়ে তিন টাকা এবং সামর্থ্য ব্যয় হবে ১ টাকা ২৫ পয়সা।

পুরো শীতের সময়, তেলনির্ভর বিদ্যুৎ কারখানাগুলোকে বসিয়ে রাখা হয়, কিন্তু তারা সামর্থ্য ব্যয় বা ক্যাপাসিটি কস্ট গ্রহণ করে। তীব্র গ্রীষ্মে যখন বিদ্যুতের চাহিদা ৫০০০ মেগাওয়াট বাড়ে, তাদের অধিকাংশকে কাজে লাগানো হয়। সেখানে কি দুর্নীতির কোন সুযোগ থাকে? কিছু দুর্নীতি অবশ্যই হয়। তবে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা সামর্থ্য সৃষ্টিতে যে টাকা দেয়া হয় তা নিয়ে যত কথা উঠছে তা কর্মহীন বসে থাকার ওই সময় নিয়ে। বেশ কিছু এরকম বসে থাকা প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য কদাচিৎ কাজে লাগে। এগুলোকে প্রথমেই বাদ দেয়া উচিত। তবে কয়লাভিত্তিক বড় উৎপাদনকারী না আসা পর্যন্ত তেলভিত্তিক সক্ষমতাকে এখনই বাতিল করে দেয়া যাবে না।

আমরা আমাদের আগের ভুলগুলোর জন্য এখন মাশুল দিচ্ছি। আমরা খুব সহজেই ছয় মিলিয়ন বা ৬০ লাখ টনের দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তি করতে পারতাম। আমরা একই সমান্তরালে আমদানির পাশাপাশি স্থানীয় গ্যাস খাতের উন্নয়নে অনেক বেশি মনোযোগ দিতে পারতাম। আমরা বড় কয়লাভিত্তিক প্রকল্প তৈরিতে সময় নিয়েছি। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প হাতে নেয়ার পর থেকে প্রায় ১২ বছর চলে গেলো। আরো অনেক সমস্যা আছে। আমরা বাস্তবায়নের বিলম্ব ও ভুল ছাড়াও নীতির ক্ষেত্রেও কিছু ভুল করেছি। এগুলো সহসাই পাল্টানো সম্ভব হবে না। তবে সেগুলো সংশোধনে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ভূমিতে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের সবগুলো পথ অন্বেষণের উদ্যোগ খুব দ্রুতই হাতে নেয়া দরকার। গ্যাসের নিশ্চিত উৎসের সঙ্গে ভূমিতে এলএনজি প্ল্যান্ট দরকার। এছাড়া চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে স্থানীয় কয়লার উন্নয়নের জন্য তৃতীয় কোন পক্ষ দিয়ে নিরপেক্ষ সমীক্ষা করানো দরকার।

অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করতে সরকারকে অবশ্যই সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কারখানাগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। কয়লা সরবরাহ ও আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় সরবরাহ সংযোগের (ট্রান্সমিশন লাইনের) কাজ শেষ করতে হবে।

আমরা পায়রা পাওয়ার প্ল্যান্টের এক ইউনিটের জন্য গত দেড় বছর ধরে প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছি। কেননা সরবরাহ লাইনগুলো এখনো অসম্পূর্ণ। অন্যান্য পাওয়ার প্লান্টের জন্য যেমন বিশেষ করে একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এটা করার সামর্থ্য আমাদের নেই।

বর্তমানে আমাদের যে জ্বালানি সংকট চলছে তা খুবই অন্যরকম। বর্তমান অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বর্তমান পর্যায়ে রাখার জন্য পরিকল্পিত লোডশেডিং সম্ভবত সর্বোত্তম পন্থা। এটি বিদেশি মুদ্রার চাহিদা সহনীয় পর্যায়ে রাখবে। এই পদ্ধতি গ্রহণের সেটাও আরেকটা কারণ। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল খাত যেমন শিল্প ও কৃষিতে আমাদের বিশেষ নজর দেয়া দরকার। আমাদের ছাদ, বাড়ি, সেচ, রাস্তার বাতি ইত্যাদিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিটি অংশকে আমাদের নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। আশা করা যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাহিদা কমানোর পদ্ধতি গ্রহণ করায় এবং সম্ভাব্য মন্দাবস্থার কারণে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসবে। তবে গ্যাসের ক্ষেত্রে তা হবে না। সঞ্চয়ের পাশাপাশি যতটা সম্ভব জ্বালানি সংরক্ষণ করাও দরকার নাগরিকদের।

[লেখক : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) জ্বালানি তেল ও খনিজ সম্পদ

বিভাগের অধ্যাপক]

ইংরেজী থেকে অনুবাদ:

মোহাম্মাদ আবু বকর সিদ্দিক