শিক্ষক নিপীড়নে সাম্প্রদায়িকতার ছায়া

অমিত রায় চৌধুরী

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক নিগ্রহের বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। অপরাধ সংঘটনের প্যাটার্ন সাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিত বহন করে। বৃহত্তর শিক্ষক সমাজের তাৎক্ষণিক নিষ্ক্রিয়তাও ভাবনার খোরাক হয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ বলছেÑদায়ী ব্যক্তিরা শাস্তি না পাওয়ায় দুর্বৃত্তরা মদদ পেয়েছে। একদিকে সুস্থ রাজনীতির অনুপস্থিতি, অন্যদিকে তুষ্টিকরণ বা ভোট-কৌশলের মতো নানা সমীকরণ সব অপকর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছে। মনে হতে পারেÑসমাজ ও প্রচলিত ব্যবস্থা এই অনাচারকে অনুমোদনও করেছে। ফলে প্রকাশ্যে শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো, জুতার মালা পরানো কিংবা পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটছে। ন্যায়, সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার হোঁচট খাচ্ছে বারবার।

দেশে এখন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ভীষণ হৈচৈ। আমাদের চিরকালীন পরম্পরা দাবি করেÑগাঙ্গেয় এ ব-দ্বীপে-জনমানস শাসন করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। গণতন্ত্রের মর্মবস্তুই হলো সমতা। ভাবনা, চিন্তা, পছন্দ, ভাষা, ধর্ম-কর্ম-সবখানে স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক তার মৌলিক অধিকার ভোগ করবে। এখন যে সংশয় প্রবল হয়ে উঠছেÑতা হলো-আমরা সত্যিই কি সে আদর্শ বা চর্চাকে মান্যতা দিতে চাই? ব্যক্তি হতে দল,পরিবার থেকে সমাজ কিংবা প্রতিষ্ঠান হতে সংগঠন-সবখানে তার প্রতিফলন কি দেখতে চাই? সংখ্যাগুরুর রাজনীতি কিংবা ধর্মমত কতটা সহনশীল হবে বা অন্য মত বা পথকে কতটা জায়গা দেবেÑসে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। আমরা নিজের মত বা পথকে যতটা শ্রদ্ধা করি বলে অন্তত প্রদর্শন করতে চাইÑতার ভগ্নাংশ জায়গাও ভিন্ন মতের জন্য ছেড়ে দেই না। অথচ পৃথিবীর অন্য যে কোন প্রান্তের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কেমন আচরণ করছেÑতা নিয়ে আমাদের বিশ্লেষণ, উৎকণ্ঠা এমনকি প্রতিক্রিয়া কখনো কখনো ধারণাকে হার মানায়।

পার্শ্ববর্তী দেশে টিভি টক-শোতে একজন প্যানেলিস্টের অশিষ্ট ও অসংযত ভাষা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। একজন মহাপুরুষকে তর্কের টেবিলে আনাকেই অনুচিত ও অনভিপ্রেত মনে হয়েছে। বিশ্বের বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি এতে আহত হবেÑতাও স্বাভাবিক। কারও ধর্মমত বা মহাপুরুষের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হলে এমনকি দেশ বা জাতির যিনি আইকন, তিনিও যদি অশোভনভাবে আক্রান্ত হনÑসে ক্ষেত্রেও অনুসারীরা সংক্ষুব্ধ হন। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি অন্যের ধর্মবোধ বা জীবন-সম্পত্তি আক্রান্ত হয়, তাহলে কি ধর্ম, নৈতিকতা বা আইন তাকে মান্যতা দেয়? আসলে সেটাও তো ধর্ম অবমাননারই শামিল। খেয়াল করতে হবে-এমন আঘাত আমরা এ দেশে অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে হামেশাই দেখতে অভ্যস্ত।

একটি সমীক্ষা বলছেÑবিগত এক দশকেই তিন হাজারের বেশি সংখ্যালঘু বিনা উসকানিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হয়েছে। হাজার হাজার পূজাম-প ভাঙচুর হয়েছে। আর ধর্মীয় সভায় ভিন্নধর্মের দেব-দেবী বা মহাপুরুষকে নিয়ে কটাক্ষের বন্যা বয়ে চলেছে নির্বিঘেœ। প্রশ্ন ওঠে-সেখানে কি ধর্ম অবমাননার উপাদান দুর্লভ? নিশ্চয়ই যুক্তি আসবে-সংখ্যাগুরুর শক্তি বেশি। তাই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। তাহলে অন্য দেশে আমাদের প্রত্যাশা ভিন্ন হবে কেন? একবার কি ভেবে দেখেছিÑইউরোপ, আমেরিকা বা এশিয়াÑএসব দেশ যদি শুধু সংখ্যাগুরুর স্বার্থ বা আবেগকে গুরুত্ব দেয় বা ভিন্নমতকে সহ্য না করে, তাহলে পরিস্থিতিটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর দেশের রাজনীতিতেও যদি ভিন্নমতের জায়গা না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের প্রয়োজন কেন? শক্তি বেশি থাকলেই তো পেশি দুর্বলকে দখল করতে পারে। আর সেটা তো আমরা চাই না। অন্তত তেমন দাবিতেই আমরা দৃশ্যত উচ্চকণ্ঠ। তবে দৈনন্দিন অনুশীলনে এসব রেটরিকসের প্রতিফলন কোথায়?

এখন আসি শিক্ষক নিগ্রহের প্রসঙ্গে। কৌতূহল জাগে-সাম্প্রদায়িক হামলার লক্ষ্যবস্তু এখন শিক্ষক কেন? দেখা যাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সব সময় যে কোন আগ্রাসনের সফট টার্গেট। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যিÑবিভিন্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে শিক্ষক আজ সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। আর সে শিক্ষক যদি সংখ্যালঘু হন, তাহলে তো কথাই নেই। তাঁকে হেনস্থা করতে কোন ছুতোর অভাব হয় না। একদম ফাঁদ পেতে তাঁর জীবন, সম্পত্তি বা সামাজিক মর্যাদা নিমেষেই ধূলোয় লুটিয়ে দেয়া যায়। পার্শ্ববর্তী দেশে দাঙ্গা হয়। উভয়পক্ষ সেখানে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আর এখানে দেখেছি-হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রকাশ্যে নিজের নাম এমনকি পরিচয় জ্ঞাপক ভাষা ব্যবহারেও সংযত, সতর্ক; পাছে তার ধর্ম পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায়। আর সেই ব্যক্তি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সংখ্যাগুরুর ধর্ম অবমাননা করবেÑএটা অবিশ্বাস্য। তবুও ফেক আইডি ব্যবহার করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তৈরি করা হয়। পরিকল্পিতভাবে দুর্গামন্দিরে ধর্মগ্রন্থ ফেলে রেখে মন্দির লুট করা হয়, ভ-ুল হয় উৎসব, রক্তাক্ত হয় ভক্ত-পূজারি। তাৎপর্যপূর্ণ হলোÑলোকে তা জানে ও বোঝে। কিন্তু অপরাধী শাস্তি পায় না। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দূরে থাক, ন্যূনতম মানবিক সহিষ্ণুতাও সমাজ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক নিগ্রহের বিষয়টি বেশ নজরে এসেছে। আসলে স্বপন বিশ্বাস, হৃদয় ম-ল, মিঠুন বর্মন, আমোদিনী পাল, শ্যামল কান্তি ভক্ত বা উৎপল সরকারের প্রতি যে সামাজিক অবিচার হয়েছে, তা শুধু ব্যক্তি বা শিক্ষক সমাজের জন্য নয়, রীতিমতো শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের গলদ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কীভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তার উপস্থিতিতে একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে থানায় নেয়া যায়Ñতা কল্পনার বাইরে। জানি না-শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোয় একজন ক্ষমতাসীন ব্যক্তির কী শাস্তি হয়েছে?

হৃদয় ম-লের ঘটনাটি আরও উদ্বেগের। কারণ, এই ধরনের বিজ্ঞান বিদ্বেষী, পশ্চাৎপদ সমাজ তৈরির জন্য বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এই ঘটনা তাৎক্ষণিক নয়, সংগঠিত ও পরিকল্পিত। নড়াইল কলেজের যে শিক্ষককে টিভিতে প্রতিক্রিয়া দিতে দেখেছি, তাতে একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেই লজ্জা পেয়েছি। শিক্ষকের মান, রুচি ও মূল্যবোধ কতটা নেমে গেছে, তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষক সমাজ চুপ ছিল কেন? একটি সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ার মাঝেই সে জনসমষ্টির শক্তি ও গভীরতার উৎস নিহিত থাকে। একজন মানুষ তখনই মানবিক হয়ে ওঠে, যখন তার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। অবশ্যই তা শুধু সনদ নির্ভর নয়। এ শিক্ষা পুষ্ট হয় তার পরিবার, পরিবেশ ও দীর্ঘদিনের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ সমাজ কিছু নতুন মূল্যবোধ যুক্ত করে প্রস্তুত মননকে সমৃদ্ধ করে। দেখা যাবেÑযে জনগোষ্ঠী অবহেলা-নিগৃহ, উপেক্ষা-তাচ্ছিল্য কিংবা দ্বন্দ্ব-দ্বেষ-সংঘাতের মধ্যে বেড়ে ওঠে, প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে, তার মনের গড়ন আলাদা হয়, বিবেক, দায়িত্ববোধ বা সংবেদনশীলতা ভিন্ন আদলে গড়ে ওঠে। দেখা যায়, একটি জীবের প্রতি মানুষের আচরণও তার পারিবারিক ও শিক্ষাগত মাত্রাকে নির্দেশ করে। একজন সম্পূর্ণ মানুষ কখনো জীবের প্রতিও নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে না।

আবার দেখা যায়Ñনানা পেশাজীবী সংগঠন শ্রমিক থেকে শুরু করে চিকিৎসক এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও জোটবদ্ধ। তারা যে সবসময় বিবেক তাড়িত বা শিক্ষায় আলোকিত, তা নয়। তবে একটি সংগঠিত শক্তির সুবিধা তারা ভোগ করে এবং রেজিমেন্টেড শৃঙ্খলায় বেড়ে ওঠে; যা বৃহত্তর শিক্ষক সমাজে নেই। একদিকে এই পেশায় যারা আসে, তাদের অধিকাংশেরই এ পেশা পছন্দের নয়, শেষ আশ্রয়। নিজের বিবেকের সঙ্গে এতটাই আপস করে এসব জায়গায় আসতে বাধ্য হয় যে, সম্মান ও মর্যাদাবোধ-এসবের আকাক্সক্ষা অনেকটাই কমে যায়। অন্যদিকে বেড়ে ওঠে সুবিধাবাদ ও স্বার্থপরতা। তাঁরা ভুলতে বসে, সবাইকে নিয়ে না চললে সমাজ টেকে না। একা একা বাস করা যায় না। এমন বিপন্ন মনোজগতে সাম্প্রদায়িকতা যখন ঠাঁই পায়, তখন অন্যকে জব্দ করার মোক্ষম অস্ত্র তাদের হাতে চলে আসে। তাই তারা নীরব হয়ে থাকে। রাজনৈতিক দল, কর্মী, কর্মকর্তা-এদের লেজুড়বৃত্তি করতে একটুও কষ্ট হয় না। কিন্তু একজন সহকর্মী অপমানিত হলেÑতার কিছু এসে যায় না।

আসলে এ দেশে যে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এখনো টিকে আছেÑতাদের আচরণেও অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ হয়েছে। আগাগোড়াই এ সম্প্রদায় একটা বদনাম বয়ে নিয়ে চলেÑতাহলো এরা আপসকামী, নীরিহ ও তথাকথিত ‘শান্তিপ্রিয়’। সুনাম ছিলÑএরা কমবেশি নিষ্ঠাবান ও সৎ। বিশেষ করে শিক্ষক। সবাই তাদের মোটামুটি বিশ্বাস করত। এখন দেখি-চুরি, দুর্নীতি, অপরাধ-কোনটাতেই এরা কম যায় না। বরং সুবিধাবাদিতা ও স্বার্থপরতা আরও তীব্র হয়েছে। ফলে সামাজিক ঐক্য গঠনেও তাদের অবদান কমে আসছে। তীব্র অন্তঃকোন্দল, পরশ্রীকাতরতা ও সুবিধাবাদিতা সমাজের বন্ধনকে আলগা করছে। নিজেদের অস্তিত্বটাই বিপন্ন হয়ে উঠছে। তবে কারণ যাই হোক, যে কোন পর্যবেক্ষক, দেশি-বিদেশি যেই হোক, সবার কাছেই মনে হবেÑযে সমাজ দুর্বল, ক্ষুদ্র জাতি বা ধর্মমতের মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারে না; সে সমাজে সুশাসন নেই। দেশ আজ বিশ্বসভায় যে জায়গায় পৌঁছেছে, তার সঙ্গে এই অবস্থাটা কোনভাবেই মানানসই নয়।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]

সোমবার, ১৮ জুলাই ২০২২ , ০৩ শ্রাবণ ১৪২৯ ১৯ জিলহজ ১৪৪৩

শিক্ষক নিপীড়নে সাম্প্রদায়িকতার ছায়া

অমিত রায় চৌধুরী

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক নিগ্রহের বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। অপরাধ সংঘটনের প্যাটার্ন সাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিত বহন করে। বৃহত্তর শিক্ষক সমাজের তাৎক্ষণিক নিষ্ক্রিয়তাও ভাবনার খোরাক হয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ বলছেÑদায়ী ব্যক্তিরা শাস্তি না পাওয়ায় দুর্বৃত্তরা মদদ পেয়েছে। একদিকে সুস্থ রাজনীতির অনুপস্থিতি, অন্যদিকে তুষ্টিকরণ বা ভোট-কৌশলের মতো নানা সমীকরণ সব অপকর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছে। মনে হতে পারেÑসমাজ ও প্রচলিত ব্যবস্থা এই অনাচারকে অনুমোদনও করেছে। ফলে প্রকাশ্যে শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানো, জুতার মালা পরানো কিংবা পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা ঘটছে। ন্যায়, সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার হোঁচট খাচ্ছে বারবার।

দেশে এখন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ভীষণ হৈচৈ। আমাদের চিরকালীন পরম্পরা দাবি করেÑগাঙ্গেয় এ ব-দ্বীপে-জনমানস শাসন করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। গণতন্ত্রের মর্মবস্তুই হলো সমতা। ভাবনা, চিন্তা, পছন্দ, ভাষা, ধর্ম-কর্ম-সবখানে স্বাধীনতা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক তার মৌলিক অধিকার ভোগ করবে। এখন যে সংশয় প্রবল হয়ে উঠছেÑতা হলো-আমরা সত্যিই কি সে আদর্শ বা চর্চাকে মান্যতা দিতে চাই? ব্যক্তি হতে দল,পরিবার থেকে সমাজ কিংবা প্রতিষ্ঠান হতে সংগঠন-সবখানে তার প্রতিফলন কি দেখতে চাই? সংখ্যাগুরুর রাজনীতি কিংবা ধর্মমত কতটা সহনশীল হবে বা অন্য মত বা পথকে কতটা জায়গা দেবেÑসে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। আমরা নিজের মত বা পথকে যতটা শ্রদ্ধা করি বলে অন্তত প্রদর্শন করতে চাইÑতার ভগ্নাংশ জায়গাও ভিন্ন মতের জন্য ছেড়ে দেই না। অথচ পৃথিবীর অন্য যে কোন প্রান্তের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কেমন আচরণ করছেÑতা নিয়ে আমাদের বিশ্লেষণ, উৎকণ্ঠা এমনকি প্রতিক্রিয়া কখনো কখনো ধারণাকে হার মানায়।

পার্শ্ববর্তী দেশে টিভি টক-শোতে একজন প্যানেলিস্টের অশিষ্ট ও অসংযত ভাষা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। একজন মহাপুরুষকে তর্কের টেবিলে আনাকেই অনুচিত ও অনভিপ্রেত মনে হয়েছে। বিশ্বের বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি এতে আহত হবেÑতাও স্বাভাবিক। কারও ধর্মমত বা মহাপুরুষের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হলে এমনকি দেশ বা জাতির যিনি আইকন, তিনিও যদি অশোভনভাবে আক্রান্ত হনÑসে ক্ষেত্রেও অনুসারীরা সংক্ষুব্ধ হন। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি অন্যের ধর্মবোধ বা জীবন-সম্পত্তি আক্রান্ত হয়, তাহলে কি ধর্ম, নৈতিকতা বা আইন তাকে মান্যতা দেয়? আসলে সেটাও তো ধর্ম অবমাননারই শামিল। খেয়াল করতে হবে-এমন আঘাত আমরা এ দেশে অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে হামেশাই দেখতে অভ্যস্ত।

একটি সমীক্ষা বলছেÑবিগত এক দশকেই তিন হাজারের বেশি সংখ্যালঘু বিনা উসকানিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার হয়েছে। হাজার হাজার পূজাম-প ভাঙচুর হয়েছে। আর ধর্মীয় সভায় ভিন্নধর্মের দেব-দেবী বা মহাপুরুষকে নিয়ে কটাক্ষের বন্যা বয়ে চলেছে নির্বিঘেœ। প্রশ্ন ওঠে-সেখানে কি ধর্ম অবমাননার উপাদান দুর্লভ? নিশ্চয়ই যুক্তি আসবে-সংখ্যাগুরুর শক্তি বেশি। তাই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। তাহলে অন্য দেশে আমাদের প্রত্যাশা ভিন্ন হবে কেন? একবার কি ভেবে দেখেছিÑইউরোপ, আমেরিকা বা এশিয়াÑএসব দেশ যদি শুধু সংখ্যাগুরুর স্বার্থ বা আবেগকে গুরুত্ব দেয় বা ভিন্নমতকে সহ্য না করে, তাহলে পরিস্থিতিটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আর দেশের রাজনীতিতেও যদি ভিন্নমতের জায়গা না থাকে, তাহলে গণতন্ত্রের প্রয়োজন কেন? শক্তি বেশি থাকলেই তো পেশি দুর্বলকে দখল করতে পারে। আর সেটা তো আমরা চাই না। অন্তত তেমন দাবিতেই আমরা দৃশ্যত উচ্চকণ্ঠ। তবে দৈনন্দিন অনুশীলনে এসব রেটরিকসের প্রতিফলন কোথায়?

এখন আসি শিক্ষক নিগ্রহের প্রসঙ্গে। কৌতূহল জাগে-সাম্প্রদায়িক হামলার লক্ষ্যবস্তু এখন শিক্ষক কেন? দেখা যাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সব সময় যে কোন আগ্রাসনের সফট টার্গেট। দুর্ভাগ্যের হলেও সত্যিÑবিভিন্ন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে শিক্ষক আজ সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। আর সে শিক্ষক যদি সংখ্যালঘু হন, তাহলে তো কথাই নেই। তাঁকে হেনস্থা করতে কোন ছুতোর অভাব হয় না। একদম ফাঁদ পেতে তাঁর জীবন, সম্পত্তি বা সামাজিক মর্যাদা নিমেষেই ধূলোয় লুটিয়ে দেয়া যায়। পার্শ্ববর্তী দেশে দাঙ্গা হয়। উভয়পক্ষ সেখানে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আর এখানে দেখেছি-হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রকাশ্যে নিজের নাম এমনকি পরিচয় জ্ঞাপক ভাষা ব্যবহারেও সংযত, সতর্ক; পাছে তার ধর্ম পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায়। আর সেই ব্যক্তি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সংখ্যাগুরুর ধর্ম অবমাননা করবেÑএটা অবিশ্বাস্য। তবুও ফেক আইডি ব্যবহার করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তৈরি করা হয়। পরিকল্পিতভাবে দুর্গামন্দিরে ধর্মগ্রন্থ ফেলে রেখে মন্দির লুট করা হয়, ভ-ুল হয় উৎসব, রক্তাক্ত হয় ভক্ত-পূজারি। তাৎপর্যপূর্ণ হলোÑলোকে তা জানে ও বোঝে। কিন্তু অপরাধী শাস্তি পায় না। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দূরে থাক, ন্যূনতম মানবিক সহিষ্ণুতাও সমাজ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষক নিগ্রহের বিষয়টি বেশ নজরে এসেছে। আসলে স্বপন বিশ্বাস, হৃদয় ম-ল, মিঠুন বর্মন, আমোদিনী পাল, শ্যামল কান্তি ভক্ত বা উৎপল সরকারের প্রতি যে সামাজিক অবিচার হয়েছে, তা শুধু ব্যক্তি বা শিক্ষক সমাজের জন্য নয়, রীতিমতো শাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের গলদ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কীভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তার উপস্থিতিতে একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে থানায় নেয়া যায়Ñতা কল্পনার বাইরে। জানি না-শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোয় একজন ক্ষমতাসীন ব্যক্তির কী শাস্তি হয়েছে?

হৃদয় ম-লের ঘটনাটি আরও উদ্বেগের। কারণ, এই ধরনের বিজ্ঞান বিদ্বেষী, পশ্চাৎপদ সমাজ তৈরির জন্য বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এই ঘটনা তাৎক্ষণিক নয়, সংগঠিত ও পরিকল্পিত। নড়াইল কলেজের যে শিক্ষককে টিভিতে প্রতিক্রিয়া দিতে দেখেছি, তাতে একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেই লজ্জা পেয়েছি। শিক্ষকের মান, রুচি ও মূল্যবোধ কতটা নেমে গেছে, তা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষক সমাজ চুপ ছিল কেন? একটি সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ার মাঝেই সে জনসমষ্টির শক্তি ও গভীরতার উৎস নিহিত থাকে। একজন মানুষ তখনই মানবিক হয়ে ওঠে, যখন তার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। অবশ্যই তা শুধু সনদ নির্ভর নয়। এ শিক্ষা পুষ্ট হয় তার পরিবার, পরিবেশ ও দীর্ঘদিনের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ সমাজ কিছু নতুন মূল্যবোধ যুক্ত করে প্রস্তুত মননকে সমৃদ্ধ করে। দেখা যাবেÑযে জনগোষ্ঠী অবহেলা-নিগৃহ, উপেক্ষা-তাচ্ছিল্য কিংবা দ্বন্দ্ব-দ্বেষ-সংঘাতের মধ্যে বেড়ে ওঠে, প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে, তার মনের গড়ন আলাদা হয়, বিবেক, দায়িত্ববোধ বা সংবেদনশীলতা ভিন্ন আদলে গড়ে ওঠে। দেখা যায়, একটি জীবের প্রতি মানুষের আচরণও তার পারিবারিক ও শিক্ষাগত মাত্রাকে নির্দেশ করে। একজন সম্পূর্ণ মানুষ কখনো জীবের প্রতিও নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে না।

আবার দেখা যায়Ñনানা পেশাজীবী সংগঠন শ্রমিক থেকে শুরু করে চিকিৎসক এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও জোটবদ্ধ। তারা যে সবসময় বিবেক তাড়িত বা শিক্ষায় আলোকিত, তা নয়। তবে একটি সংগঠিত শক্তির সুবিধা তারা ভোগ করে এবং রেজিমেন্টেড শৃঙ্খলায় বেড়ে ওঠে; যা বৃহত্তর শিক্ষক সমাজে নেই। একদিকে এই পেশায় যারা আসে, তাদের অধিকাংশেরই এ পেশা পছন্দের নয়, শেষ আশ্রয়। নিজের বিবেকের সঙ্গে এতটাই আপস করে এসব জায়গায় আসতে বাধ্য হয় যে, সম্মান ও মর্যাদাবোধ-এসবের আকাক্সক্ষা অনেকটাই কমে যায়। অন্যদিকে বেড়ে ওঠে সুবিধাবাদ ও স্বার্থপরতা। তাঁরা ভুলতে বসে, সবাইকে নিয়ে না চললে সমাজ টেকে না। একা একা বাস করা যায় না। এমন বিপন্ন মনোজগতে সাম্প্রদায়িকতা যখন ঠাঁই পায়, তখন অন্যকে জব্দ করার মোক্ষম অস্ত্র তাদের হাতে চলে আসে। তাই তারা নীরব হয়ে থাকে। রাজনৈতিক দল, কর্মী, কর্মকর্তা-এদের লেজুড়বৃত্তি করতে একটুও কষ্ট হয় না। কিন্তু একজন সহকর্মী অপমানিত হলেÑতার কিছু এসে যায় না।

আসলে এ দেশে যে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এখনো টিকে আছেÑতাদের আচরণেও অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ হয়েছে। আগাগোড়াই এ সম্প্রদায় একটা বদনাম বয়ে নিয়ে চলেÑতাহলো এরা আপসকামী, নীরিহ ও তথাকথিত ‘শান্তিপ্রিয়’। সুনাম ছিলÑএরা কমবেশি নিষ্ঠাবান ও সৎ। বিশেষ করে শিক্ষক। সবাই তাদের মোটামুটি বিশ্বাস করত। এখন দেখি-চুরি, দুর্নীতি, অপরাধ-কোনটাতেই এরা কম যায় না। বরং সুবিধাবাদিতা ও স্বার্থপরতা আরও তীব্র হয়েছে। ফলে সামাজিক ঐক্য গঠনেও তাদের অবদান কমে আসছে। তীব্র অন্তঃকোন্দল, পরশ্রীকাতরতা ও সুবিধাবাদিতা সমাজের বন্ধনকে আলগা করছে। নিজেদের অস্তিত্বটাই বিপন্ন হয়ে উঠছে। তবে কারণ যাই হোক, যে কোন পর্যবেক্ষক, দেশি-বিদেশি যেই হোক, সবার কাছেই মনে হবেÑযে সমাজ দুর্বল, ক্ষুদ্র জাতি বা ধর্মমতের মানুষের নিরাপত্তা দিতে পারে না; সে সমাজে সুশাসন নেই। দেশ আজ বিশ্বসভায় যে জায়গায় পৌঁছেছে, তার সঙ্গে এই অবস্থাটা কোনভাবেই মানানসই নয়।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ]