আপাতত একঘণ্টা লোডশেডিং, জ্বালানি সংকটে আরও সিদ্ধান্ত

বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ব্যয়বহুল ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর ফলে যে বিদ্যুৎ ঘাটতি হবে, তা লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দশ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও, গ্যাস সংকটের কারণে দৈনিক সোয়া পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ব্যয়বহুল তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা হচ্ছিল।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের বহু দেশ জ্বালানি সংকটে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ এ মাসের শুরু থেকেই স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এখন জ্বালানির আমদানি খরচের রাশ টানতে ডিজেলের দিকে নজর দিয়েছে সরকার।

ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হলে প্রায় এক হাজার তিনশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তাই আপাতত দিনে একঘণ্টা করে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যা আজ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়ে এক সপ্তাহ চলবে। পরিস্থিতি সামলানো না গেলে দিনে ২ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের দিকে যাবে সরকার।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় কমাতে বা ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে লোডশেডিংয়ের পাশপাশি সাশ্রয়ী ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে।

গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সরকারি যানবাহনের খরচ কমাতে ভার্চুয়াল সভা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মসজিদ ও অন্য উপাসনালয়ে নামাজ বা প্রার্থনার সময় ব্যতিত এসি বন্ধ রাখার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্তও আসে বৈঠকে।

বিকেলে সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সংবাদ সম্মেলনে জানান, আজ থেকে সারাদেশে প্রতিদিন সূচি ধরে একঘণ্টা করে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হবে। এক সপ্তাহ এভাবে চলার পর ‘অবস্থা দেখে’ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

গ্যাসের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য ‘পিক ও অফ পিকের’ জায়গা বেছে নেয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক আমরা সারাবাংলাদেশে যদি একঘণ্টা লোড শেডিং দিই, আমার মনে হয় না তেমন সমস্যা হবে।

আমরা আগামীকাল থেকে শুরু করব। এক সপ্তাহ দেখব। আমরা যদি দেখি পিকের জায়গায় একঘণ্টা দিলে কভার করতে পারব, ফাইন। আর যদি দেখি, অফ পিকের জায়গায় একঘণ্টা দিলে কভার হচ্ছে, তাহলে সেটাই করব।’

বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পিক আওয়ার ধরা হয়, মানে এই সময়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে। এভাবে এক সপ্তাহ দেখে পরের সপ্তাহে লোডশেডিং বাড়বে কি বাড়বে না সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি। তবে শিল্প ও বাণিজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী।

বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারের লক্ষ্যে নামাজের সময় ছাড়া মসজিদে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ব্যবহার না করার অনুরোধ করেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পেট্রল পাম্প সপ্তাহে একদিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কবে থেকে কার্যকর হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে পাম্প মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাবে, বর্তমানে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্থাপিত ক্ষমতা ১২৯০ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদন সক্ষমতার (২২৩৪৮ মেগাওয়াট- ক্যাপটিভ ও অফগ্রিড নাবয়নযোগ্য জ্বালানি ছাড়া) ৬ শতাংশ। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৫১ শতাংশ, কয়লা থেকে ৮ শতাংশ, ফার্নেস তেল থেকে ২৮ শতাংশ, জলবিদ্যুৎ ১ শতাংশ, অন-গ্রিড সৌর ১ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ আমদানি হয় প্রায় ৫ শতাংশ।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, দেশে স্থাপিত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ৯৯৫ মেগাওয়াট। তবে পেট্রোবাংলা চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় ৫ হাজার ২৫০ মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

গত রোববার দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে (আমদানিসহ) প্রায় ৩০০ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা)।

এরমধ্যে গ্যাস থেকে উৎপাদন হয়েছে ১৫৮ দশমিক ২৬৭ মিলিয়ন ইউনিট। খরচ পড়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। তেল (ডিজেল ও ফার্নেস) দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ৮৬ দশমিক ৩০৩ মিলিয়ন ইউনিট। খরচ হয়েছে প্রায় ১১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

আগের দিন শনিবার প্রায় ১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকার গ্যাসে উৎপাদিত হয়েছে ১৬৭ দশমিক ৫২৫ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ। ৯১ কোটি ৯৮ লাখ টাকার তেল (ডিজেল ও ফার্নেস) পুড়িয়ে উৎপাদন কর হয়েছে ৬৯ দশমিক ১০৫ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ।

ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হয় ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা, ফার্নেস তেলে ব্যয় হয় ১৭ দশমিক ৪১ টাকা। তবে সরকার গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৫ দশমিক শূন্য ৮ টাকা দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বলে গত ৬ জুলাই এক অনুষ্ঠানে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করে তিনি। গ্যাস সংকটের কারণে লোডশেডিং যাতে না হয়, সেজন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখাতে এলএনজি আমদানিতে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথাও উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে ফার্নেস অয়েলের মূল্য ছিল মাত্র ৭০৮ টাকা। সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের পর হয়ে গেছে এক হাজার ৮০ টাকা, অর্থাৎ ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজেলের লিটার ৮০ মার্কিন ডলার ছিল তা এখন ১৩০ এ চলে আসছে।’ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ^ব্যাপী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারকে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে জানিয়ে এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতাও প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রী।

সারাদেশে যে ডিজেল ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে ১০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং বাকি ৯০ শতাংশ পরিবহনসহ অন্য খাতে।

গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিদ্যুতের ১০ শতাংশ এবং অন্য খাত থেকে আরও ১০ শতাংশ, মোট এই ২০ শতাংশ ডিজেল সাশ্রয় করতে পারলে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আমরা সেভ করতে পারব, এটা অনেক বড় বিষয় হবে। এ সিদ্ধান্ত আমরা না নিলে, সারাবছর এই ১০ শতাংশ ডিজেলের যে দাম দেই সেই মূল্যতো আমরা বিদ্যুৎ থেকে পাব না।’ ডিজেল আমদানি কমালে ভর্তুকির খরচও কমবে হবে বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।

দেশের পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ তেল নির্ভর। জ্বালানি তেলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয়। বর্তমানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। চাপ পড়েছে রিজার্ভে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে পেট্রলিয়াম পণ্য আমদানিতে পরিশোধ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন; শতকরা হারে বেড়েছে ১০৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের এটা অনুভব করতে হবে যে, বিশ্বের সব দেশই কোন কোনভাবে জ্বালানি সংকটের শিকার হচ্ছে।’

তবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।

এদিকে গতকাল সকালে জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুষ্ঠিত বৈঠকে অফিসের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, ভার্চুয়ালি অফিস করা, এসি ব্যবহারে সংযমী হওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (বীরবিক্রম) বলেন, ‘কীভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো যায় বৈঠকে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। রাত ৮টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করা, অফিসে কর্মঘণ্টা এক-দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনা, প্রয়োজনে বাসা থেকে ভার্চুয়ালি অফিস করা, সরকারি গাড়িতে বেশি লোক পরিবহন করাসহ অন্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, আমরা আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে, যাতে আমাদের খরচ কম হয়, সেই পর্যায়ে, যেটা সহনশীল হয়, সেই পর্যায়ে নিয়ে আসা। এবং ডিজেলে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাতত স্থগিত করলাম। তাতে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সরকারি অফিসগুলোয় কীভাবে সময় কমিয়ে আনা যায়, সেটাও ভাবা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

রাত ৮টার পর দোকানপাট, বিপণিবিতান বন্ধ রাখার পুরনো সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।

মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২ , ০৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ২০ জিলহজ ১৪৪৩

আপাতত একঘণ্টা লোডশেডিং, জ্বালানি সংকটে আরও সিদ্ধান্ত

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ব্যয়বহুল ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর ফলে যে বিদ্যুৎ ঘাটতি হবে, তা লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

দেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দশ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও, গ্যাস সংকটের কারণে দৈনিক সোয়া পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ব্যয়বহুল তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা হচ্ছিল।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের বহু দেশ জ্বালানি সংকটে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ এ মাসের শুরু থেকেই স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এখন জ্বালানির আমদানি খরচের রাশ টানতে ডিজেলের দিকে নজর দিয়েছে সরকার।

ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হলে প্রায় এক হাজার তিনশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তাই আপাতত দিনে একঘণ্টা করে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যা আজ থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়ে এক সপ্তাহ চলবে। পরিস্থিতি সামলানো না গেলে দিনে ২ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের দিকে যাবে সরকার।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় কমাতে বা ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে লোডশেডিংয়ের পাশপাশি সাশ্রয়ী ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে।

গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সরকারি যানবাহনের খরচ কমাতে ভার্চুয়াল সভা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মসজিদ ও অন্য উপাসনালয়ে নামাজ বা প্রার্থনার সময় ব্যতিত এসি বন্ধ রাখার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্তও আসে বৈঠকে।

বিকেলে সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সংবাদ সম্মেলনে জানান, আজ থেকে সারাদেশে প্রতিদিন সূচি ধরে একঘণ্টা করে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হবে। এক সপ্তাহ এভাবে চলার পর ‘অবস্থা দেখে’ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

গ্যাসের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য ‘পিক ও অফ পিকের’ জায়গা বেছে নেয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক আমরা সারাবাংলাদেশে যদি একঘণ্টা লোড শেডিং দিই, আমার মনে হয় না তেমন সমস্যা হবে।

আমরা আগামীকাল থেকে শুরু করব। এক সপ্তাহ দেখব। আমরা যদি দেখি পিকের জায়গায় একঘণ্টা দিলে কভার করতে পারব, ফাইন। আর যদি দেখি, অফ পিকের জায়গায় একঘণ্টা দিলে কভার হচ্ছে, তাহলে সেটাই করব।’

বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পিক আওয়ার ধরা হয়, মানে এই সময়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে। এভাবে এক সপ্তাহ দেখে পরের সপ্তাহে লোডশেডিং বাড়বে কি বাড়বে না সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি। তবে শিল্প ও বাণিজ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী।

বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারের লক্ষ্যে নামাজের সময় ছাড়া মসজিদে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ব্যবহার না করার অনুরোধ করেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পেট্রল পাম্প সপ্তাহে একদিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কবে থেকে কার্যকর হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে পাম্প মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাবে, বর্তমানে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্থাপিত ক্ষমতা ১২৯০ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদন সক্ষমতার (২২৩৪৮ মেগাওয়াট- ক্যাপটিভ ও অফগ্রিড নাবয়নযোগ্য জ্বালানি ছাড়া) ৬ শতাংশ। এছাড়া গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ৫১ শতাংশ, কয়লা থেকে ৮ শতাংশ, ফার্নেস তেল থেকে ২৮ শতাংশ, জলবিদ্যুৎ ১ শতাংশ, অন-গ্রিড সৌর ১ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ আমদানি হয় প্রায় ৫ শতাংশ।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, দেশে স্থাপিত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার ৯৯৫ মেগাওয়াট। তবে পেট্রোবাংলা চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় ৫ হাজার ২৫০ মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

গত রোববার দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে (আমদানিসহ) প্রায় ৩০০ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা)।

এরমধ্যে গ্যাস থেকে উৎপাদন হয়েছে ১৫৮ দশমিক ২৬৭ মিলিয়ন ইউনিট। খরচ পড়েছে প্রায় ১৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। তেল (ডিজেল ও ফার্নেস) দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে ৮৬ দশমিক ৩০৩ মিলিয়ন ইউনিট। খরচ হয়েছে প্রায় ১১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

আগের দিন শনিবার প্রায় ১৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকার গ্যাসে উৎপাদিত হয়েছে ১৬৭ দশমিক ৫২৫ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ। ৯১ কোটি ৯৮ লাখ টাকার তেল (ডিজেল ও ফার্নেস) পুড়িয়ে উৎপাদন কর হয়েছে ৬৯ দশমিক ১০৫ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ।

ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হয় ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা, ফার্নেস তেলে ব্যয় হয় ১৭ দশমিক ৪১ টাকা। তবে সরকার গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৫ দশমিক শূন্য ৮ টাকা দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করে বলে গত ৬ জুলাই এক অনুষ্ঠানে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করে তিনি। গ্যাস সংকটের কারণে লোডশেডিং যাতে না হয়, সেজন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখাতে এলএনজি আমদানিতে ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথাও উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে ফার্নেস অয়েলের মূল্য ছিল মাত্র ৭০৮ টাকা। সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের পর হয়ে গেছে এক হাজার ৮০ টাকা, অর্থাৎ ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিজেলের লিটার ৮০ মার্কিন ডলার ছিল তা এখন ১৩০ এ চলে আসছে।’ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ^ব্যাপী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারকে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে জানিয়ে এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতাও প্রত্যাশা করেন প্রধানমন্ত্রী।

সারাদেশে যে ডিজেল ব্যবহার করা হয় তারমধ্যে ১০ শতাংশ যায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং বাকি ৯০ শতাংশ পরিবহনসহ অন্য খাতে।

গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিদ্যুতের ১০ শতাংশ এবং অন্য খাত থেকে আরও ১০ শতাংশ, মোট এই ২০ শতাংশ ডিজেল সাশ্রয় করতে পারলে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আমরা সেভ করতে পারব, এটা অনেক বড় বিষয় হবে। এ সিদ্ধান্ত আমরা না নিলে, সারাবছর এই ১০ শতাংশ ডিজেলের যে দাম দেই সেই মূল্যতো আমরা বিদ্যুৎ থেকে পাব না।’ ডিজেল আমদানি কমালে ভর্তুকির খরচও কমবে হবে বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।

দেশের পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ তেল নির্ভর। জ্বালানি তেলের চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানি করা হয়। বর্তমানে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। চাপ পড়েছে রিজার্ভে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে পেট্রলিয়াম পণ্য আমদানিতে পরিশোধ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন; শতকরা হারে বেড়েছে ১০৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

নসরুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের এটা অনুভব করতে হবে যে, বিশ্বের সব দেশই কোন কোনভাবে জ্বালানি সংকটের শিকার হচ্ছে।’

তবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।

এদিকে গতকাল সকালে জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুষ্ঠিত বৈঠকে অফিসের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, ভার্চুয়ালি অফিস করা, এসি ব্যবহারে সংযমী হওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (বীরবিক্রম) বলেন, ‘কীভাবে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো যায় বৈঠকে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। রাত ৮টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করা, অফিসে কর্মঘণ্টা এক-দুই ঘণ্টা কমিয়ে আনা, প্রয়োজনে বাসা থেকে ভার্চুয়ালি অফিস করা, সরকারি গাড়িতে বেশি লোক পরিবহন করাসহ অন্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, আমরা আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে, যাতে আমাদের খরচ কম হয়, সেই পর্যায়ে, যেটা সহনশীল হয়, সেই পর্যায়ে নিয়ে আসা। এবং ডিজেলে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাতত স্থগিত করলাম। তাতে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সরকারি অফিসগুলোয় কীভাবে সময় কমিয়ে আনা যায়, সেটাও ভাবা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

রাত ৮টার পর দোকানপাট, বিপণিবিতান বন্ধ রাখার পুরনো সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় বৈঠকে।