অপরিকল্পিত উন্নয়নে প্রশ্নের মুখে সিলেটের মেয়র

চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারী বৃষ্টিতে সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ওই সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জলাবদ্ধতার জন্য নদীর পানি বৃদ্ধিকে দায়ী করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সুরমার পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকায় ছড়া-খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হতে না পেরে উল্টো নদীর পানি শহরে ঢুকছে। তবে এবার নদীর পানিতে নয় মাত্র দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেল সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মানুষ যখন বিপর্যস্ত ঠিক তখনই সামান্য বৃষ্টিতে বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতায় সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও বন্যার পর ড্রেনে জমা হওয়া আবর্জনা পরিষ্কার না করাকে দায়ী করা হচ্ছে। অথচ গত এক যুগে সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ আসে। জলের সমস্যা নিরসনে বরাদ্দকৃত সেই টাকা জলেই গেল কি না নগরবাসীর এমন প্রশ্নের মুখে এখন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

গত শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিলেটে শুরু হয় ভারী বর্ষণ। রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত চলে বৃষ্টিপাত। এতে তলিয়ে যায় নগরের বেশিরভাগ এলাকা। অনেক উঁচু এলাকাতেও পানি উঠে যায়। তবে বৃষ্টি থামার পর সকালে এই পানি নেমে গেছে।

রাতে নগরের সোবহানিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি জমে গেছে। এরমধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন।

সোবহানীঘাট ছাড়াও বৃষ্টিতে নগরীর জিন্দাবাজার, বারুতখানা, হাওয়াপাড়া, আম্বরখানা, চৌহাট্টা, লোহারপাড়া, বড়বাজার, লামাবাজার, মদিনামার্কেট, চারাদিঘিরপাড়, সওদাগরটুলা, যতরপুর, উপশহর, শিবগঞ্জ, শাপলাবাগ, তালতলা, সুবিদবাজার, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদ, জল্লারপাড়, ভাতালিয়া, কানিশাইল, মজুমদারপাড়া, মেন্দিবাগ, দরগামহল্লা, লালদিঘিরপার, দাড়িয়াপাড়া, কুয়ারপাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুপানি জমে।

এসব এলাকার বেশিরভাগ বাসাবাড়ির নিচতলায় পানি উঠে যায়। মধ্যরাতে ঘরে পানি ঢোকায় মানুষজন চরম দুর্ভোগে পড়েন।

নগরের রায়নগর এলাকার বাসিন্দা ফাহমিদা মাহমুদ বলেন, ‘বৃষ্টি শুরুর আধঘণ্টা পরই ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। একমাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার এমন দুর্ভোগে পড়তে হলো।’

উপশহর এলাকার বাসিন্দা রাতুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে বন্যার সময় প্রায় ১৫ দিন ঘরে পানি ছিল। পানি নামার পর সবকিছু পরিষ্কার করে কিছুদিন আগে মাত্র ঘরে উঠেছি। আবার পানি ঢুকে পড়ল। আমাদের দুর্ভোগ যেন শেষই হচ্ছে না।’

গত শনিবার রাতের বৃষ্টিতে পানি ঢুকে পড়ে সিলেটের বইয়ের বাজার হিসেবে পরিচিত জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশনেও।

এই মার্কেটের ব্যবসায়ী সুহেল আহমদ বলেন, ‘বৃষ্টিতে মার্কেটে পানি ঢুকে কয়েক লাখ টাকার বই ভিজে নষ্ট হয়েছে। এর আগে ১৮ জুন বন্যার পানি ঢুকে মার্কেটের কোটি টাকার বই নষ্ট হয়েছিল।’

গত ১৫ জুন থেকে তৃতীয় দফায় বন্যা শুরু হয় সিলেটে। এতে তলিয়ে যায় সিলেটের ৮০ শতাংশ এলাকা। নিম্নাঞ্চলে এখনও বন্যার পানি থাকলেও নগর থেকে পানি নেমেছে। এর আগে গত মে মাসে আরেক দফা বন্যায় পানি ঢুকে নগরের বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে।

নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রিপন চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাসায়ও পানি ঢুকে গেছে। নগরজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে বক্স কালভার্ট নির্মাণের ফলে এমনটি হচ্ছে।’

রিপন বলেন, ‘খোলা ড্রেন হলে আবর্জনা আটকে থাকত না, কিন্তু বক্স কালভার্টে আবর্জনা আটকে থাকছে। ফলে পানি কাটতে পারছে না। এতে অল্প বৃষ্টিতেই নগর তলিয়ে যাচ্ছে।’

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু বলেন, ‘বন্যায় বিভিন্ন স্থান থেকে ময়লা আবর্জনা এসে ড্রেনে জমা হয়েছে। সিসিকের উচিত ছিল বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা। কিন্তু তারা তা করেনি। তাদের দোষে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’

নগর তলিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান স্থপতি রাজন দাশ বলেন, ‘নগরের ড্রেনগুলো খুব সরু আকারে নির্মাণ করা হয়েছে, ছড়াগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি কাটতে পারছে না।’

ছড়া উদ্ধার ও ড্রেন নির্মাণে সিসিকের বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এই খাতে চার থেকে পাঁচশ’ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে কী কাজ হয়েছে তা প্রকাশ করা দরকার। কেন এত প্রকল্পের পরও এভাবে পানি জমে যাচ্ছে তা জানা দরকার।’

ড্রেনের নেটওয়ার্ক ঠিক আছে কি না তা খোঁজ নিয়ে দেখা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পানি ড্রেন দিয়ে যেখানে গিয়ে নামার কথা সেখানে নামছে কি না তা দেখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা দূর করতে হবে।’

এর আগে জুলাইয়ের শুরুর দিকেও ভারী বৃষ্টিতে সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ওই সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জলাবদ্ধতার জন্য নদীর পানি বৃদ্ধিকে দায়ী করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সুরমার পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকায় ছড়া-খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হতে না পেরে উল্টো নদীর পানি শহরে ঢুকছে। তবে এবার নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে। তবু জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হলো নগরবাসীকে।

এই জলাবদ্ধতার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে জলাবদ্ধতার জন্য মেয়রের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজকে অনেকেই দায়ী করেন।

অথচ সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ এসেছে। সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীতে ছোটবড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও (খাল) আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। নালা-নর্দমায় প্রায় সাড়ে ৬শ’ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে।

সিসিকের প্রকৌশল শাখা সূত্র জানায়, বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মেয়র থাকাবস্থায় ২০০৯ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে ছড়া-খাল খনন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১২ সালে ২৭টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় করা হয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে সিসিক মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ওই বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ অবধি ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।

২০১৯ সালে ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ আসে এক হাজার ২২৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; যা বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।

এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় করা হয় ২৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৯৮ কোটি ৪৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৬৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। প্রকল্পটির আওতায় অন্য কাজের সঙ্গে ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেন ও ৮ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। আরসিসি রাস্তা, আরসিসি ড্রেন ও আরসিসি ড্রেনসহ ফুটপাত নির্মাণ খাতে প্রকল্পটির সিংহভাগ বরাদ্দ ব্যয় হওয়ার কথা।

এ ব্যাপারে মেয়রের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ এই প্রকল্পটির কাজ এখনও শেষ হয়নি এবং চলমান আছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান।

তিনি ড্রেন পরিষ্কার না করার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বন্যার পর আমরা ছড়াগুলো পরিচ্ছন্নতার কাজে মনোযোগী ছিলাম। এরপরে কোরবানির বর্জ্য অপসারণে আমাদের টিমগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে ড্রেনের আবর্জনাগুলো সেভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ড্রেনে আবর্জনা জমেছে কি না তা এখন আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাব।’

ছড়া খাল উদ্ধার ও ড্রেন নির্মাণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় সত্ত্বেও জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই সব প্রকল্পের কারণে এখন আর আগের মতো নগরে পানি জমে না। তবে কালকেরটা ব্যতিক্রম।’

গত শনিবার রাতে সিটি মেয়রের বাসায়ও পানি ঢুকে পড়েছিল বলে জানান তিনি। প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘ড্রেনের ভেতরে যাতে ময়লা-আবর্জনা না জমে, সেজন্য আমরা ড্রেনের মুখে নেটের (জাল) ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, সেইসব নেট স্থানীয়রা খুলে ফেলেন। নেট থাকলে পানি চলে যেত, ময়লা-আবর্জনা আটকে যেত।’

মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২ , ০৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ২০ জিলহজ ১৪৪৩

অপরিকল্পিত উন্নয়নে প্রশ্নের মুখে সিলেটের মেয়র

আকাশ চৌধুরী, সিলেট

চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারী বৃষ্টিতে সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ওই সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জলাবদ্ধতার জন্য নদীর পানি বৃদ্ধিকে দায়ী করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সুরমার পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকায় ছড়া-খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হতে না পেরে উল্টো নদীর পানি শহরে ঢুকছে। তবে এবার নদীর পানিতে নয় মাত্র দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে গেল সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় মানুষ যখন বিপর্যস্ত ঠিক তখনই সামান্য বৃষ্টিতে বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতায় সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও বন্যার পর ড্রেনে জমা হওয়া আবর্জনা পরিষ্কার না করাকে দায়ী করা হচ্ছে। অথচ গত এক যুগে সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ আসে। জলের সমস্যা নিরসনে বরাদ্দকৃত সেই টাকা জলেই গেল কি না নগরবাসীর এমন প্রশ্নের মুখে এখন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

গত শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে সিলেটে শুরু হয় ভারী বর্ষণ। রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত চলে বৃষ্টিপাত। এতে তলিয়ে যায় নগরের বেশিরভাগ এলাকা। অনেক উঁচু এলাকাতেও পানি উঠে যায়। তবে বৃষ্টি থামার পর সকালে এই পানি নেমে গেছে।

রাতে নগরের সোবহানিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি জমে গেছে। এরমধ্যে ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন।

সোবহানীঘাট ছাড়াও বৃষ্টিতে নগরীর জিন্দাবাজার, বারুতখানা, হাওয়াপাড়া, আম্বরখানা, চৌহাট্টা, লোহারপাড়া, বড়বাজার, লামাবাজার, মদিনামার্কেট, চারাদিঘিরপাড়, সওদাগরটুলা, যতরপুর, উপশহর, শিবগঞ্জ, শাপলাবাগ, তালতলা, সুবিদবাজার, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদ, জল্লারপাড়, ভাতালিয়া, কানিশাইল, মজুমদারপাড়া, মেন্দিবাগ, দরগামহল্লা, লালদিঘিরপার, দাড়িয়াপাড়া, কুয়ারপাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুপানি জমে।

এসব এলাকার বেশিরভাগ বাসাবাড়ির নিচতলায় পানি উঠে যায়। মধ্যরাতে ঘরে পানি ঢোকায় মানুষজন চরম দুর্ভোগে পড়েন।

নগরের রায়নগর এলাকার বাসিন্দা ফাহমিদা মাহমুদ বলেন, ‘বৃষ্টি শুরুর আধঘণ্টা পরই ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। একমাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার এমন দুর্ভোগে পড়তে হলো।’

উপশহর এলাকার বাসিন্দা রাতুল ইসলাম বলেন, ‘এর আগে বন্যার সময় প্রায় ১৫ দিন ঘরে পানি ছিল। পানি নামার পর সবকিছু পরিষ্কার করে কিছুদিন আগে মাত্র ঘরে উঠেছি। আবার পানি ঢুকে পড়ল। আমাদের দুর্ভোগ যেন শেষই হচ্ছে না।’

গত শনিবার রাতের বৃষ্টিতে পানি ঢুকে পড়ে সিলেটের বইয়ের বাজার হিসেবে পরিচিত জিন্দাবাজারের রাজা ম্যানশনেও।

এই মার্কেটের ব্যবসায়ী সুহেল আহমদ বলেন, ‘বৃষ্টিতে মার্কেটে পানি ঢুকে কয়েক লাখ টাকার বই ভিজে নষ্ট হয়েছে। এর আগে ১৮ জুন বন্যার পানি ঢুকে মার্কেটের কোটি টাকার বই নষ্ট হয়েছিল।’

গত ১৫ জুন থেকে তৃতীয় দফায় বন্যা শুরু হয় সিলেটে। এতে তলিয়ে যায় সিলেটের ৮০ শতাংশ এলাকা। নিম্নাঞ্চলে এখনও বন্যার পানি থাকলেও নগর থেকে পানি নেমেছে। এর আগে গত মে মাসে আরেক দফা বন্যায় পানি ঢুকে নগরের বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে।

নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রিপন চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাসায়ও পানি ঢুকে গেছে। নগরজুড়ে অপরিকল্পিতভাবে বক্স কালভার্ট নির্মাণের ফলে এমনটি হচ্ছে।’

রিপন বলেন, ‘খোলা ড্রেন হলে আবর্জনা আটকে থাকত না, কিন্তু বক্স কালভার্টে আবর্জনা আটকে থাকছে। ফলে পানি কাটতে পারছে না। এতে অল্প বৃষ্টিতেই নগর তলিয়ে যাচ্ছে।’

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু বলেন, ‘বন্যায় বিভিন্ন স্থান থেকে ময়লা আবর্জনা এসে ড্রেনে জমা হয়েছে। সিসিকের উচিত ছিল বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা। কিন্তু তারা তা করেনি। তাদের দোষে নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’

নগর তলিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে লিডিং ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান স্থপতি রাজন দাশ বলেন, ‘নগরের ড্রেনগুলো খুব সরু আকারে নির্মাণ করা হয়েছে, ছড়াগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি কাটতে পারছে না।’

ছড়া উদ্ধার ও ড্রেন নির্মাণে সিসিকের বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এই খাতে চার থেকে পাঁচশ’ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই টাকা দিয়ে কী কাজ হয়েছে তা প্রকাশ করা দরকার। কেন এত প্রকল্পের পরও এভাবে পানি জমে যাচ্ছে তা জানা দরকার।’

ড্রেনের নেটওয়ার্ক ঠিক আছে কি না তা খোঁজ নিয়ে দেখা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পানি ড্রেন দিয়ে যেখানে গিয়ে নামার কথা সেখানে নামছে কি না তা দেখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা দূর করতে হবে।’

এর আগে জুলাইয়ের শুরুর দিকেও ভারী বৃষ্টিতে সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। ওই সময় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জলাবদ্ধতার জন্য নদীর পানি বৃদ্ধিকে দায়ী করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সুরমার পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকায় ছড়া-খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হতে না পেরে উল্টো নদীর পানি শহরে ঢুকছে। তবে এবার নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক নিচে রয়েছে। তবু জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হলো নগরবাসীকে।

এই জলাবদ্ধতার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে জলাবদ্ধতার জন্য মেয়রের অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজকে অনেকেই দায়ী করেন।

অথচ সিলেট নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে হাজার কোটি টাকারও বেশি বরাদ্দ এসেছে। সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরীতে ছোটবড় মিলিয়ে ১১টি ছড়া প্রবাহমান। এসব ছড়ার ১৬টি শাখা ছড়াও (খাল) আছে। এসব ছড়া-খাল সুরমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ছড়া-খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০ কিলোমিটার। এর বাইরে নালা-নর্দমা আছে ৯৭০ কিলোমিটার। নালা-নর্দমায় প্রায় সাড়ে ৬শ’ কিলোমিটার পাকা ড্রেন আছে।

সিসিকের প্রকৌশল শাখা সূত্র জানায়, বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মেয়র থাকাবস্থায় ২০০৯ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনে ছড়া-খাল খনন ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১২ সালে ২৭টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন নির্মাণে ব্যয় করা হয় ৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে সিসিক মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। ওই বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিভিন্ন খাতে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা, ২০১৪ সালে ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ অবধি ২৩৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।

২০১৯ সালে ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা নিরসন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ আসে এক হাজার ২২৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; যা বাস্তবায়ন করছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।

এই প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় করা হয় ২৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৯৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৯৮ কোটি ৪৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৬৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। প্রকল্পটির আওতায় অন্য কাজের সঙ্গে ৩২৭ কিলোমিটার ড্রেন ও ৮ কিলোমিটার রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। আরসিসি রাস্তা, আরসিসি ড্রেন ও আরসিসি ড্রেনসহ ফুটপাত নির্মাণ খাতে প্রকল্পটির সিংহভাগ বরাদ্দ ব্যয় হওয়ার কথা।

এ ব্যাপারে মেয়রের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সিলেট সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ এই প্রকল্পটির কাজ এখনও শেষ হয়নি এবং চলমান আছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান।

তিনি ড্রেন পরিষ্কার না করার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বন্যার পর আমরা ছড়াগুলো পরিচ্ছন্নতার কাজে মনোযোগী ছিলাম। এরপরে কোরবানির বর্জ্য অপসারণে আমাদের টিমগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে ড্রেনের আবর্জনাগুলো সেভাবে পরিষ্কার করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ড্রেনে আবর্জনা জমেছে কি না তা এখন আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাব।’

ছড়া খাল উদ্ধার ও ড্রেন নির্মাণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় সত্ত্বেও জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই সব প্রকল্পের কারণে এখন আর আগের মতো নগরে পানি জমে না। তবে কালকেরটা ব্যতিক্রম।’

গত শনিবার রাতে সিটি মেয়রের বাসায়ও পানি ঢুকে পড়েছিল বলে জানান তিনি। প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘ড্রেনের ভেতরে যাতে ময়লা-আবর্জনা না জমে, সেজন্য আমরা ড্রেনের মুখে নেটের (জাল) ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, সেইসব নেট স্থানীয়রা খুলে ফেলেন। নেট থাকলে পানি চলে যেত, ময়লা-আবর্জনা আটকে যেত।’