দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হোক

রেজাউল করিম খোকন

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) আমদানির অর্থ পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে গেছে। এদিকে আমদানির অর্থ ব্যাংকগুলো নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করে, এর দুই মাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে বিল পরিশোধ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ গত সপ্তাহে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আমদানি দায় শোধ করেছে। ফলে প্রায় দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মজুতে চাপ আছে। রিজার্ভ এভাবে কমতে শুরু করার কারণ, রপ্তানি আয় বাড়লেও অস্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। একই সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে রেমিট্যান্সও কমেছে। ফলে ডলারের ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় রিজার্ভে প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে পরিদর্শন প্রায় বন্ধ ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি গ্রুপের কাছে একাধিক ব্যাংক চলে গেছে। নানা অনিয়মও হচ্ছে। বেশকিছু ব্যাংক ও নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান নড়বড়ে অবস্থায় আছে এসব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিদর্শনও হচ্ছে না। এ রকম আরও বহু উল্লেখযোগ্য সমস্যা রয়েছে দেশের অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকে, যা নিয়ে সব সময় সভা-সেমিনারে নানা কথা আলোচিত হয়ে থাকে।

তবে নতুন গভর্নরকে ঘিরে দেশের অর্থনৈতিক খাতে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। নতুন গভর্নর বলেছেন, আমাদের প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এটাই এখন বেশি গুরুত্ব পাবে। দ্বিতীয় কাজ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা। এজন্য আমদানি-রপ্তানি যে ব্যবধানটা আছে, তা কীভাবে কমিয়ে এনে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে চেষ্টা করব। তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করব। একসময় রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। মহামারী করোনা ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে তা এখন নিচে নেমে এসেছে। রিজার্ভকে একটা সন্তোষজনক অবস্থায় নিয়ে যাব, যা দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে। এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অর্থাৎ আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হবে।

কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নজিরবিহীন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে। মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ অধিকতর সাফল্য দেখাতে পেরেছে। করোনাকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে দেশের ব্যাংকিং খাতের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাত নিজেই ধুকছে। যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক আর্থিক খাতের ওপরেই পড়েছিল। এর মধ্যে দেশের অর্থনীতির জন্য বড়সড় ধাক্কা হয়ে আসে করোনা মহামারীর প্রকোপ। করোনা এখনো বিদায় নেয়নি পৃথিবী থেকে। কিন্তু তারপরও একে মোকাবিলা করেই আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তেমন পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাংকিং খাতকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে সামনের দিকে। করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি দেশীয় অর্থনীতিতে চরম স্থবিরতা নেমে এসেছিল। এর ফলে আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একদিকে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণের জন্য চাপ দেওয়া হলেও খেলাপি কিংবা নিয়মিত ঋণ কোনোটিরই আদায় হয়নি। ফলে ব্যাংকের আয় অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট, মুনাফা কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।

একটি দেশের ব্যাংকিং খাত যদি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তাহলে গোটা অর্থনীতিতেই চরম বিপর্যয় নেমে আসে অবশ্যম্ভাবীভাবে। করোনা মহামারীর মত বড় ধরনের সংকটে দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের জন্য শক্তিশালী ব্যাংকিং খাতের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর ও নতুন গভর্নর দুজনেই পদস্থ আমলা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব। দুজনেরই পথ এক। তবে মত বা দৃষ্টিভঙ্গি এক কি না, এখনও বলা যাচ্ছে না। না হলেই ভালো। একজন মন্ত্রীর অধীন অর্থসচিব হওয়া আর দেশের সার্বিক অর্থব্যবস্থার নেতৃত্বের দায়িত্বে গভর্নর হওয়া এক কথা নয়। নদী থেকে সমুদ্রে পড়ার মতো। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় কাজ বাজেট, যা জিডিপির ১৫ ভাগ। আর ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি ঋণ জিডিপির ৪০ ভাগের বেশি, জাতীয় মুদ্রায়ণ ৫০ ভাগের বেশি। ওদিকে বাজেট ঘাটতির ৪৪ ভাগ জুগিয়ে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অঙ্ক বাদেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুণগত দায়িত্ব বিশাল। তা হলো জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ও নিয়োগ যথাসম্ভব সর্বোচ্চ করার দায়িত্ব। এটি করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতিকে ২ থেকে ৪ ভাগের মধ্যে সহনীয় বা আরামদায়ক পর্যায়ে রাখা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং শাস্ত্রের ভাষায় এর নাম ‘ডুয়েল ম্যান্ডেট’ বা অধিকারসংবলিত দ্বৈত দায়িত্ব। যুক্তরাষ্ট্রে এ জন্য প্রেসিডেন্টের পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৭-০৯ সালের বড় মন্দা থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য যোগ্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন সেদেশের ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ার বেন বারনানকে। ২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ বানায়। বলা হয়, তিনি দেশ ও বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মন্দা থেকে উদ্ধার করে প্রবৃৃদ্ধির পথে স্থাপন করেছিলেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালানোর জন্য চাই প্রজ্ঞা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা। শুধু প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা আর আনুগত্য নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাপে বড় লুটেরাকে বড় ছাড় দেয়া ভালো কাজ নয়। বারবার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলিয়ে এতে মাধুর্যম-িত করা নীতিশাস্ত্রের শুভ কাজ নয়। ৬৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণকে ৬ বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে দেয়া দক্ষ প্রশাসকের লক্ষণ নয়। হোটেলে বসে ব্যবসায়ীদের চাপে রিজার্ভ হার কমানোর ওয়াদা করে আসা দৃঢ়তার কাজ নয়। একটা ব্যাংকের ঋণের প্রায় ৯০ ভাগ খেলাপি হয়ে গেল, তা দেখতে না পাওয়া ভালো নিরীক্ষার নজির নয়। মাঝেমধ্যেই হাইকোর্ট থেকে শুধরে নেওয়ার নোটিশ পাওয়া ভালো নেতৃত্বের উদাহরণ নয়। আমরা ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।

কি জ্ঞান, কি উদ্ভাবন, কি গবেষণা- আমাদের সব প্রতিষ্ঠানেই এগুলোর রাষ্ট্রীয় কদর নেই বা থাকলেও তা কিঞ্চিৎ, তা পরিকল্পিতভাবেই অবজ্ঞার শিকার। তাই জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনÑএ দুই সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এগুলো করা লোকেরা নাকি একটু স্বাধীনচেতা হয়। মেধা আর অকাতর আনুগত্য এক পথে যায় না। তারপরও অনেক উন্নয়নশীল দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোপরি একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর রউফ তালুকদার এই দিকনির্দেশনায় প্রাণিত হয়ে তার প্রতিষ্ঠানকেও একটি জ্ঞানভিত্তিক নীতি কেন্দ্রে পরিণত করবেনÑএটা আমাদের প্রত্যাশা। জাতীয় অর্থনীতি হবে সমৃদ্ধতর। দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হোক তার হাত ধরে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২ , ০৪ শ্রাবণ ১৪২৯ ২০ জিলহজ ১৪৪৩

দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হোক

রেজাউল করিম খোকন

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) আমদানির অর্থ পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে গেছে। এদিকে আমদানির অর্থ ব্যাংকগুলো নিয়মিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করে, এর দুই মাস পরপর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে বিল পরিশোধ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ গত সপ্তাহে ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আমদানি দায় শোধ করেছে। ফলে প্রায় দুই বছরের মধ্যে এই প্রথম রিজার্ভ ৩৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার।

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মজুতে চাপ আছে। রিজার্ভ এভাবে কমতে শুরু করার কারণ, রপ্তানি আয় বাড়লেও অস্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। একই সঙ্গে অস্বাভাবিকভাবে রেমিট্যান্সও কমেছে। ফলে ডলারের ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় রিজার্ভে প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে পরিদর্শন প্রায় বন্ধ ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি গ্রুপের কাছে একাধিক ব্যাংক চলে গেছে। নানা অনিয়মও হচ্ছে। বেশকিছু ব্যাংক ও নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান নড়বড়ে অবস্থায় আছে এসব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পরিদর্শনও হচ্ছে না। এ রকম আরও বহু উল্লেখযোগ্য সমস্যা রয়েছে দেশের অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকে, যা নিয়ে সব সময় সভা-সেমিনারে নানা কথা আলোচিত হয়ে থাকে।

তবে নতুন গভর্নরকে ঘিরে দেশের অর্থনৈতিক খাতে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। নতুন গভর্নর বলেছেন, আমাদের প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এটাই এখন বেশি গুরুত্ব পাবে। দ্বিতীয় কাজ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা। এজন্য আমদানি-রপ্তানি যে ব্যবধানটা আছে, তা কীভাবে কমিয়ে এনে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে চেষ্টা করব। তৃতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করব। একসময় রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। মহামারী করোনা ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে তা এখন নিচে নেমে এসেছে। রিজার্ভকে একটা সন্তোষজনক অবস্থায় নিয়ে যাব, যা দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে। এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি অর্থাৎ আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হবে।

কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নজিরবিহীন বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, যা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে চলেছে। মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ অধিকতর সাফল্য দেখাতে পেরেছে। করোনাকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারসহ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে আমাদের ব্যাংক ব্যবস্থা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে দেশের ব্যাংকিং খাতের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংকিং খাত নিজেই ধুকছে। যার নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক আর্থিক খাতের ওপরেই পড়েছিল। এর মধ্যে দেশের অর্থনীতির জন্য বড়সড় ধাক্কা হয়ে আসে করোনা মহামারীর প্রকোপ। করোনা এখনো বিদায় নেয়নি পৃথিবী থেকে। কিন্তু তারপরও একে মোকাবিলা করেই আমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তেমন পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যাংকিং খাতকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে সামনের দিকে। করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি দেশীয় অর্থনীতিতে চরম স্থবিরতা নেমে এসেছিল। এর ফলে আমাদের ব্যাংকিং খাত অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একদিকে ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণের জন্য চাপ দেওয়া হলেও খেলাপি কিংবা নিয়মিত ঋণ কোনোটিরই আদায় হয়নি। ফলে ব্যাংকের আয় অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট, মুনাফা কমে যাওয়াসহ নানা ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।

একটি দেশের ব্যাংকিং খাত যদি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তাহলে গোটা অর্থনীতিতেই চরম বিপর্যয় নেমে আসে অবশ্যম্ভাবীভাবে। করোনা মহামারীর মত বড় ধরনের সংকটে দেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের জন্য শক্তিশালী ব্যাংকিং খাতের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী গভর্নর ও নতুন গভর্নর দুজনেই পদস্থ আমলা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব। দুজনেরই পথ এক। তবে মত বা দৃষ্টিভঙ্গি এক কি না, এখনও বলা যাচ্ছে না। না হলেই ভালো। একজন মন্ত্রীর অধীন অর্থসচিব হওয়া আর দেশের সার্বিক অর্থব্যবস্থার নেতৃত্বের দায়িত্বে গভর্নর হওয়া এক কথা নয়। নদী থেকে সমুদ্রে পড়ার মতো। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে বড় কাজ বাজেট, যা জিডিপির ১৫ ভাগ। আর ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি ঋণ জিডিপির ৪০ ভাগের বেশি, জাতীয় মুদ্রায়ণ ৫০ ভাগের বেশি। ওদিকে বাজেট ঘাটতির ৪৪ ভাগ জুগিয়ে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অঙ্ক বাদেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুণগত দায়িত্ব বিশাল। তা হলো জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ও নিয়োগ যথাসম্ভব সর্বোচ্চ করার দায়িত্ব। এটি করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতিকে ২ থেকে ৪ ভাগের মধ্যে সহনীয় বা আরামদায়ক পর্যায়ে রাখা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং শাস্ত্রের ভাষায় এর নাম ‘ডুয়েল ম্যান্ডেট’ বা অধিকারসংবলিত দ্বৈত দায়িত্ব। যুক্তরাষ্ট্রে এ জন্য প্রেসিডেন্টের পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০০৭-০৯ সালের বড় মন্দা থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য যোগ্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন সেদেশের ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ার বেন বারনানকে। ২০১০ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ বানায়। বলা হয়, তিনি দেশ ও বৈশ্বিক অর্থনীতিকে মন্দা থেকে উদ্ধার করে প্রবৃৃদ্ধির পথে স্থাপন করেছিলেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালানোর জন্য চাই প্রজ্ঞা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা। শুধু প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা আর আনুগত্য নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের চাপে বড় লুটেরাকে বড় ছাড় দেয়া ভালো কাজ নয়। বারবার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা বদলিয়ে এতে মাধুর্যম-িত করা নীতিশাস্ত্রের শুভ কাজ নয়। ৬৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণকে ৬ বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকায় পৌঁছে দেয়া দক্ষ প্রশাসকের লক্ষণ নয়। হোটেলে বসে ব্যবসায়ীদের চাপে রিজার্ভ হার কমানোর ওয়াদা করে আসা দৃঢ়তার কাজ নয়। একটা ব্যাংকের ঋণের প্রায় ৯০ ভাগ খেলাপি হয়ে গেল, তা দেখতে না পাওয়া ভালো নিরীক্ষার নজির নয়। মাঝেমধ্যেই হাইকোর্ট থেকে শুধরে নেওয়ার নোটিশ পাওয়া ভালো নেতৃত্বের উদাহরণ নয়। আমরা ভবিষ্যতে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।

কি জ্ঞান, কি উদ্ভাবন, কি গবেষণা- আমাদের সব প্রতিষ্ঠানেই এগুলোর রাষ্ট্রীয় কদর নেই বা থাকলেও তা কিঞ্চিৎ, তা পরিকল্পিতভাবেই অবজ্ঞার শিকার। তাই জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনÑএ দুই সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। এগুলো করা লোকেরা নাকি একটু স্বাধীনচেতা হয়। মেধা আর অকাতর আনুগত্য এক পথে যায় না। তারপরও অনেক উন্নয়নশীল দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জ্ঞানভিত্তিক নেতৃত্ব নিশ্চিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোপরি একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর রউফ তালুকদার এই দিকনির্দেশনায় প্রাণিত হয়ে তার প্রতিষ্ঠানকেও একটি জ্ঞানভিত্তিক নীতি কেন্দ্রে পরিণত করবেনÑএটা আমাদের প্রত্যাশা। জাতীয় অর্থনীতি হবে সমৃদ্ধতর। দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হোক তার হাত ধরে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]