রাজধানীর ১৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীর সংঘবদ্ধ দুর্নীতি

রাজধানীর দক্ষিণখানের আনোয়ারা মডেল ডিগ্রি কলেজে একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য এক বছর আগে অগ্রিম প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। সাধারণত সরকারি কাজের জন্য ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেয়া হয় না। কিন্তু একটি অর্থবছর চলে গেলেও ওই প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ এখনও পুরোপুরি শুরুই হয়নি।

আনোয়ারা মডেল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এ রহিম ১৯ জুলাই সংবাদকে বলেন, ‘এতদিন কোন কাজ হয়নি। বিল দেয়া হয়েছে কি না আমি জানি না। তবে কয়েকদিন ধরে গ্রেড বিম স্থাপনের জন্য সয়েল টেস্ট (মাঠি পরীক্ষা) হচ্ছে।’

একই অর্থবছরে মিরপুর এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো সংস্কারের নামে প্রায় ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম ব্যয় দেখানো হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানেও তেমন কাজ হয়নি। জানতে চাইলে এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন ১৮ জুলাই সংবাদকে জানান, প্রায় দেড় বছর আগে তার প্রতিষ্ঠানে একটি টিনশেট ঘর ভেঙে এর স্থলে একাডেমিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ‘ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট’ (ইইডি)। প্রথমে নিচের ‘গ্রেড বিম’ বসিয়েই কাজ থেমে যায়। এরপর থেকে ঠিকাদার তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেনি। ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্টের প্রকৌশলীরাও কোন খোঁজ নিচ্ছেন না।

টিনশেড ঘর ভেঙে ফেলায় শিক্ষার্থীদের জায়গার সংকুলান হচ্ছে না জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘তারা (ইইডি) নতুন ভবন নির্মাণের নামে আমাদের উল্টো বিপদে ফেলেছে। আমরা বারবার চেষ্টা করেও ঠিকাদারকে পাচ্ছি না; ফ্যাসিলিটিজ বিভাগের কর্মকর্তারাও কিছু জানাচ্ছেন না। তাদের খুঁজেও পাচ্ছি না। কাজ অব্যাহত রাখতে এলাকার এমপি ঠিকাদারকে ফোন করেছিলেন; ঠিকাদার দলীয় রাজনীতি করেন... ছাত্রলীগ-যুবলীগ করেন... এরপরও কাজ হচ্ছে না।’

শুধু আনোয়ারা মডেল কলেজ ও এমডিসি ইনস্টিটিউট নয়, ঢাকার অন্তত ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এভাবে আগাম টাকা বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে এক প্রতিবেদনে। এই অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি)‘ঢাকা মেট্রো’ জোন থেকে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সম্প্রতি ইইডি থেকে ‘ঢাকা মেট্রো’র নির্বাহী প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঠিকাদার ও জোন অফিসের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী সঙ্গবদ্ধভাবে এই অনিয়ম করেছে বলে জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীরা মনে করছেন।

এক অর্থবছর চলে গেলেও ওইসব প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণের তেমন কার্যক্রম হয়নি। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত কোন কাজই হয়নি। কাজ শুরু না করেই কোন কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নতুন করে আবারও টাকা চাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা সংবাদকে জানিয়েছেন।

এভাবে কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে অগ্রিম অর্থ ছাড় করা যায় কি না জানতে চাইলে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী শাহ নঈমুল কাদের সংবাদকে বলেন, ‘অগ্রিম টাকা দেয়ার নিয়ম নেই। ঠিকাদার কাজ করবেন, পর্যায়ক্রমে বিল পাবেন। কাজ শুরুর আগে কাকে কাকে আগাম টাকা দেয়া হয়েছে সেই বিষয়ে ঢাকা মেট্রোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ইইডির ঢাকা মেট্রো অফিস সূত্র জানিয়েছে, আরও যেসব প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণের নামে অগ্রীম টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে খিলক্ষেত থানার তলনা রুহুল আমিন খান উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে প্রায় ৪০ লাখ টাকা; তেজগাঁওয়ের বুটেক্সে (বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ^বিদ্যালয়) এসি লাগানোসহ অন্যান্য কাজে প্রায় ৩০ লাখ টাকা; মিরপুর-১০ নম্বরে আদর্শ স্কুলের নামে প্রায় দশ লাখ টাকা; দক্ষিণখানে বাউথার মোমেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে প্রায় ২৫ লাখ টাকা; উত্তরখানের মৈনারটেক উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে প্রায় ৩০ লাখ টাকা; দারুস সালামে সরকারি বাংলা কলেজে রাস্তা সংস্কারসহ বিভিন্ন মেরামতের কাজের নামে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও ওইসব প্রতিষ্ঠানে তেমন কাজ হয়নি বলে সম্প্রতি ইইডির প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে।

এছাড়া ঢাকার উত্তরার ‘গাওয়াইর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে’ নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য গত বছর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় এক কোটি দশ লাখ টাকা অগ্রিম দেয়া হয়। এক অর্থবছর অতিবাহিত হলেও অবকাঠামো নির্মাণের তেমন অগ্রগতি নেই।

পল্লবী বঙ্গবন্ধু কলেজের একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অগ্রিম ৩২ লাখ টাকা দেয়া হয় একই অর্থবছরে। এই প্রতিষ্ঠানে এখনও কাজই শুরু হয়নি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের অবকাঠামো নির্মাণের নামে প্রায় ৪০ লাখ টাকা; আদাবরে বেগম নুরজাহান স্কুলের নামে প্রায় ৬০ লাখ টাকা এবং দারুস সালামে বিএডিসি স্কুলের সংস্কার কাজের নামে প্রায় দশ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

ওই ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ৩-৪ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন সহকারী প্রকৌশলী মনজুরুল আলম শরীফ। তিনি বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী। অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল পরিশোধের বিষয়ে মনজুরুল আলম শরীফ সংবাদকে বলেন, ‘আমি ৩-৪টি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলাম। আমার মনে হয়, ওই সময় কাউকে অগ্রিম বিল দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন নির্বাহী প্রকৌশলী।’

আনোয়ারা মডেল ডিগ্রি কলেজসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা মেট্রোর সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। অগ্রিম টাকা দেয়ার পরও কাজ শুরু না হওয়ার বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘কাজ শুরু হয়নি, এখন হবে।’ তবে কাজ শুরু না হলে অগ্রিম টাক দেয়া যায় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজ না হলে বিল পরিশোধের নিয়ম নেই। বিল দেয়া হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’

ঠিকাদারদের ‘বিল’ ছাড়ের বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীদের উদ্দেশে গত ২৫ এপ্রিল ইইডির প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল হাসেম সরদার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ আর্থিক ক্ষমতা অর্পণসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র, নির্দেশনা অনুসরণে ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন মোতাবেক কাজের গুণগতমান নিশ্চিত হয়ে একচ্যুয়াল ওয়ার্কডানের ভিত্তিতে বিল প্রদান করতে হবে। নির্মাণ কাজের কোনরূপ ত্রুটি বিচ্যুতি অবস্থায় বিল পরিশোধ করা হলে অথবা যেকোন অনিয়মে বিল পরিশোধ করা হলে সব দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তাকেই (জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী) বহন করতে হবে।’

ঠিকাদারদের অগ্রিম টাকা দেয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইইডির ‘ঢাকা মেট্রো’র নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান শওকতের সঙ্গে একাধিকবার সেলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি তা ধরেননি। তবে তিনি তার সহকর্মীদের মাধ্যমে সংবাদকে জানিয়েছেন, ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেয়ার সময় এই জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন আবুল কালাম মো. আখতারুজামান।

আখতারুজামান বর্তমানে ইইডির রংপুর জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে আছেন। অগ্রিম টাকা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘অগ্রিম বিল পরিশোধ করা হয়েছিল কি না আমার মনে নেই। তবে এরকম সব জোনেই কম-বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু যারা জোনে কর্মরত থাকবেন তাদের দায়িত্ব কাজগুলো উঠিয়ে আনা।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দু’জন ঠিকাদার সংবাদকে বলেন, ‘এক বছরে রড, সিমেন্ট, বালু ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেক বেড়ে গেছে। এগুলোর পরিবহন খরচ ও নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। এ কারণে কাজ ঝুলে আছে। এসব সমস্যা প্রকৌশলীদের অবহিত করা হচ্ছে।’

জানতে চাইলে ‘শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো ঠিকাদার সমিতি’র সভাপতি মিজানুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘এ বছর কাউকে অগ্রিম বিল দেয়া হয়নি। গত বছর হয়ে থাকতে পারে। তবে বর্তমানে রড-সিমেন্টসহ অন্যান নির্মাণ সামগ্রীর দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে কাউকে অগ্রিম বিল দেয়া হয়ে থাকলেও তাকে একটু সময় দিয়ে কাজটি আদায় করে নেয়া উচিত। আর কেউ যদি অগ্রিম বিল নিয়ে কাজ না করতে চায় সেক্ষেত্রে ঠিকাদারের পানিশমেন্ট (শাস্তি) হওয়া উচিত।’

ঢাকা মেট্রোতে আরও যত অভিযোগ

কবি নজরুল সরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক সম্প্রতি ইইডির প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেছেন, সম্প্রতি তাদের কলেজে প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ‘প্যাটেন্ট’ ঢালাইয়ের নামে ‘হালকা ঘষা-মাঝা’র পর রং করেই কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে ঠিকাদার। ঠিকাদার সরকার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় শিক্ষকরা কোন কথা বলার সুযোগই পায়নি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরেও ইইডির ‘ঢাকা মেট্রো’ অফিসের পৌনে সাত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে। এ ঘটনার কোন তদন্ত হয়নি, কারো শাস্তিও হয়নি। প্রভাবশালী মহলের চাপে অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে জমা হওয়া একটি অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজ সমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইইডির ঢাকা জোন অফিসের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৩৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু জোন অফিস থেকে সিএও শিক্ষা অফিসে চেক দেয়া হয় ৪৬ কোটি টাকা।’

অর্থাৎ বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও ঢাকা জোনের কর্মকর্তারা ছয় কোটি ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন, যা আত্মসাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়েছিল অভিযোগপত্রে।

বুধবার, ২০ জুলাই ২০২২ , ০৫ শ্রাবণ ১৪২৯ ২১ জিলহজ ১৪৪৩

রাজধানীর ১৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীর সংঘবদ্ধ দুর্নীতি

রাকিব উদ্দিন

রাজধানীর দক্ষিণখানের আনোয়ারা মডেল ডিগ্রি কলেজে একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য এক বছর আগে অগ্রিম প্রায় এক কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। সাধারণত সরকারি কাজের জন্য ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেয়া হয় না। কিন্তু একটি অর্থবছর চলে গেলেও ওই প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ এখনও পুরোপুরি শুরুই হয়নি।

আনোয়ারা মডেল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ এ রহিম ১৯ জুলাই সংবাদকে বলেন, ‘এতদিন কোন কাজ হয়নি। বিল দেয়া হয়েছে কি না আমি জানি না। তবে কয়েকদিন ধরে গ্রেড বিম স্থাপনের জন্য সয়েল টেস্ট (মাঠি পরীক্ষা) হচ্ছে।’

একই অর্থবছরে মিরপুর এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো সংস্কারের নামে প্রায় ৩০ লাখ টাকা অগ্রিম ব্যয় দেখানো হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানেও তেমন কাজ হয়নি। জানতে চাইলে এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন ১৮ জুলাই সংবাদকে জানান, প্রায় দেড় বছর আগে তার প্রতিষ্ঠানে একটি টিনশেট ঘর ভেঙে এর স্থলে একাডেমিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ‘ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট’ (ইইডি)। প্রথমে নিচের ‘গ্রেড বিম’ বসিয়েই কাজ থেমে যায়। এরপর থেকে ঠিকাদার তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেনি। ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্টের প্রকৌশলীরাও কোন খোঁজ নিচ্ছেন না।

টিনশেড ঘর ভেঙে ফেলায় শিক্ষার্থীদের জায়গার সংকুলান হচ্ছে না জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘তারা (ইইডি) নতুন ভবন নির্মাণের নামে আমাদের উল্টো বিপদে ফেলেছে। আমরা বারবার চেষ্টা করেও ঠিকাদারকে পাচ্ছি না; ফ্যাসিলিটিজ বিভাগের কর্মকর্তারাও কিছু জানাচ্ছেন না। তাদের খুঁজেও পাচ্ছি না। কাজ অব্যাহত রাখতে এলাকার এমপি ঠিকাদারকে ফোন করেছিলেন; ঠিকাদার দলীয় রাজনীতি করেন... ছাত্রলীগ-যুবলীগ করেন... এরপরও কাজ হচ্ছে না।’

শুধু আনোয়ারা মডেল কলেজ ও এমডিসি ইনস্টিটিউট নয়, ঢাকার অন্তত ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এভাবে আগাম টাকা বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে এক প্রতিবেদনে। এই অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি)‘ঢাকা মেট্রো’ জোন থেকে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সম্প্রতি ইইডি থেকে ‘ঢাকা মেট্রো’র নির্বাহী প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঠিকাদার ও জোন অফিসের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী সঙ্গবদ্ধভাবে এই অনিয়ম করেছে বলে জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলীরা মনে করছেন।

এক অর্থবছর চলে গেলেও ওইসব প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণের তেমন কার্যক্রম হয়নি। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত কোন কাজই হয়নি। কাজ শুরু না করেই কোন কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নতুন করে আবারও টাকা চাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা সংবাদকে জানিয়েছেন।

এভাবে কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে অগ্রিম অর্থ ছাড় করা যায় কি না জানতে চাইলে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী শাহ নঈমুল কাদের সংবাদকে বলেন, ‘অগ্রিম টাকা দেয়ার নিয়ম নেই। ঠিকাদার কাজ করবেন, পর্যায়ক্রমে বিল পাবেন। কাজ শুরুর আগে কাকে কাকে আগাম টাকা দেয়া হয়েছে সেই বিষয়ে ঢাকা মেট্রোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ইইডির ঢাকা মেট্রো অফিস সূত্র জানিয়েছে, আরও যেসব প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণের নামে অগ্রীম টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে খিলক্ষেত থানার তলনা রুহুল আমিন খান উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে প্রায় ৪০ লাখ টাকা; তেজগাঁওয়ের বুটেক্সে (বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ^বিদ্যালয়) এসি লাগানোসহ অন্যান্য কাজে প্রায় ৩০ লাখ টাকা; মিরপুর-১০ নম্বরে আদর্শ স্কুলের নামে প্রায় দশ লাখ টাকা; দক্ষিণখানে বাউথার মোমেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে প্রায় ২৫ লাখ টাকা; উত্তরখানের মৈনারটেক উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে প্রায় ৩০ লাখ টাকা; দারুস সালামে সরকারি বাংলা কলেজে রাস্তা সংস্কারসহ বিভিন্ন মেরামতের কাজের নামে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হলেও ওইসব প্রতিষ্ঠানে তেমন কাজ হয়নি বলে সম্প্রতি ইইডির প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে।

এছাড়া ঢাকার উত্তরার ‘গাওয়াইর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে’ নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য গত বছর একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় এক কোটি দশ লাখ টাকা অগ্রিম দেয়া হয়। এক অর্থবছর অতিবাহিত হলেও অবকাঠামো নির্মাণের তেমন অগ্রগতি নেই।

পল্লবী বঙ্গবন্ধু কলেজের একটি রাস্তা নির্মাণের জন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অগ্রিম ৩২ লাখ টাকা দেয়া হয় একই অর্থবছরে। এই প্রতিষ্ঠানে এখনও কাজই শুরু হয়নি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের অবকাঠামো নির্মাণের নামে প্রায় ৪০ লাখ টাকা; আদাবরে বেগম নুরজাহান স্কুলের নামে প্রায় ৬০ লাখ টাকা এবং দারুস সালামে বিএডিসি স্কুলের সংস্কার কাজের নামে প্রায় দশ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।

ওই ১৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ৩-৪ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন সহকারী প্রকৌশলী মনজুরুল আলম শরীফ। তিনি বর্তমানে নেত্রকোনা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী। অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল পরিশোধের বিষয়ে মনজুরুল আলম শরীফ সংবাদকে বলেন, ‘আমি ৩-৪টি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলাম। আমার মনে হয়, ওই সময় কাউকে অগ্রিম বিল দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন নির্বাহী প্রকৌশলী।’

আনোয়ারা মডেল ডিগ্রি কলেজসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা মেট্রোর সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। অগ্রিম টাকা দেয়ার পরও কাজ শুরু না হওয়ার বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘কাজ শুরু হয়নি, এখন হবে।’ তবে কাজ শুরু না হলে অগ্রিম টাক দেয়া যায় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজ না হলে বিল পরিশোধের নিয়ম নেই। বিল দেয়া হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’

ঠিকাদারদের ‘বিল’ ছাড়ের বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীদের উদ্দেশে গত ২৫ এপ্রিল ইইডির প্রধান কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল হাসেম সরদার স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ আর্থিক ক্ষমতা অর্পণসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র, নির্দেশনা অনুসরণে ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন মোতাবেক কাজের গুণগতমান নিশ্চিত হয়ে একচ্যুয়াল ওয়ার্কডানের ভিত্তিতে বিল প্রদান করতে হবে। নির্মাণ কাজের কোনরূপ ত্রুটি বিচ্যুতি অবস্থায় বিল পরিশোধ করা হলে অথবা যেকোন অনিয়মে বিল পরিশোধ করা হলে সব দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তাকেই (জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী) বহন করতে হবে।’

ঠিকাদারদের অগ্রিম টাকা দেয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইইডির ‘ঢাকা মেট্রো’র নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান শওকতের সঙ্গে একাধিকবার সেলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি তা ধরেননি। তবে তিনি তার সহকর্মীদের মাধ্যমে সংবাদকে জানিয়েছেন, ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেয়ার সময় এই জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন আবুল কালাম মো. আখতারুজামান।

আখতারুজামান বর্তমানে ইইডির রংপুর জোনের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে আছেন। অগ্রিম টাকা দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংবাদকে বলেন, ‘অগ্রিম বিল পরিশোধ করা হয়েছিল কি না আমার মনে নেই। তবে এরকম সব জোনেই কম-বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু যারা জোনে কর্মরত থাকবেন তাদের দায়িত্ব কাজগুলো উঠিয়ে আনা।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দু’জন ঠিকাদার সংবাদকে বলেন, ‘এক বছরে রড, সিমেন্ট, বালু ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেক বেড়ে গেছে। এগুলোর পরিবহন খরচ ও নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। এ কারণে কাজ ঝুলে আছে। এসব সমস্যা প্রকৌশলীদের অবহিত করা হচ্ছে।’

জানতে চাইলে ‘শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো ঠিকাদার সমিতি’র সভাপতি মিজানুর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘এ বছর কাউকে অগ্রিম বিল দেয়া হয়নি। গত বছর হয়ে থাকতে পারে। তবে বর্তমানে রড-সিমেন্টসহ অন্যান নির্মাণ সামগ্রীর দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে কাউকে অগ্রিম বিল দেয়া হয়ে থাকলেও তাকে একটু সময় দিয়ে কাজটি আদায় করে নেয়া উচিত। আর কেউ যদি অগ্রিম বিল নিয়ে কাজ না করতে চায় সেক্ষেত্রে ঠিকাদারের পানিশমেন্ট (শাস্তি) হওয়া উচিত।’

ঢাকা মেট্রোতে আরও যত অভিযোগ

কবি নজরুল সরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক সম্প্রতি ইইডির প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেছেন, সম্প্রতি তাদের কলেজে প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ‘প্যাটেন্ট’ ঢালাইয়ের নামে ‘হালকা ঘষা-মাঝা’র পর রং করেই কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে ঠিকাদার। ঠিকাদার সরকার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় শিক্ষকরা কোন কথা বলার সুযোগই পায়নি।

২০১৮-১৯ অর্থবছরেও ইইডির ‘ঢাকা মেট্রো’ অফিসের পৌনে সাত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে। এ ঘটনার কোন তদন্ত হয়নি, কারো শাস্তিও হয়নি। প্রভাবশালী মহলের চাপে অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তেই রয়েছেন।

গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে জমা হওয়া একটি অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজ সমূহের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইইডির ঢাকা জোন অফিসের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৩৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু জোন অফিস থেকে সিএও শিক্ষা অফিসে চেক দেয়া হয় ৪৬ কোটি টাকা।’

অর্থাৎ বরাদ্দ না থাকা সত্ত্বেও ঢাকা জোনের কর্মকর্তারা ছয় কোটি ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন, যা আত্মসাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয়েছিল অভিযোগপত্রে।