ময়মনসিংহ সড়কে ৩ মৃত্যু

লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে ছিল ফিটনেসহীন ট্রাকের স্টিয়ারিং

ময়মনসিংহের ত্রিশালে যে ট্রাকের চাপায় অন্তঃসত্ত্বা নারী, তার স্বামী এবং আড়াই বছরের মেয়ে মারা গেছেন সেই ট্রাকের ছিল না ফিটনেস, ছিল না চালকের ডাইভিং লাইসেন্স। ৭ টন মাল বহনের জন্য ধারণক্ষমতার ট্রাকটিতে ক্রটি থাকার পরও দ্বিগুণ মালামাল পরিবহন হচ্ছিল। আর ওই অবস্থায় পেছনে থাকা আরেকটি গাড়িকে জায়গা দিতে গিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারটিকে পিষে মারে চালক।

‘আলোচিত ওই হত্যকা-ের ঘটনায় চালক মো. রাজু আহমেদ ওরফে শিপনকে গ্রেপ্তার করার পর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর আগেও শিপন গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছিলেন এবং মামলায় কারাগারেও ছিলেন। জামিনে এসে সে আবারও ট্রাক চালাতে শুরু করে।’ গত সোমবার রাতে সাভার থেকে র‌্যাব-১৪ এর একটি টিম শিপনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তাকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়। এর আগে এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ১৬ জুলাই ত্রিশালের রায়মনি গ্রামের জাহাঙ্গির তার ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রতœা বেগম এবং ৩ বছর বয়সী কন্যা সানজিদাকে নিয়ে ত্রিশাল শহরে আসে। তারা মহাসড়কের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার জন্য রাস্তা পার হওয়ার অপেক্ষায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। ওই অবস্থায় বেপরোয়া গতিতে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরো পরিবারটিকে চাপা দেয় চালক। অন্তঃসত্ত্বা রতœার পেট ফেটে গর্ভে থাকা সন্তান বেরিয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে ওই শিশুটি বেঁচে গেলেও পুরো পরিবার ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়।

খন্দকার মঈন জানান, কোন সড়কে কত পরিমাণ মালামাল বহন করে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করতে পারবে সে স্কেল অধিকাংশ সড়কে নেই। ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কে ওই ট্রাকটি তার ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি পণ্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রাকের গতি ছিল বেপরোয়া। ট্রাকটির পেছনে ঢাকাগামী একটি যাত্রীবাহী বাসও বেপরোয়া গতিতে আসছিল। ওই বাসটি বার বার জায়গা দেয়ার জন্য সামনে থাকা ট্রাকটি হর্ন দিচ্ছেলেন। বাসটিকে জায়গা দিতে গিয়ে ট্রাকটি পাশে টার্ন নিলে অতিরিক্ত ওজনের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারায়। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরো পরিবারটিকে চাপা দেয়। ট্রাকচালক দাবি করেছে, ‘সে পরিবারটিকে দেখতে পায়নি।’ এছাড়া তার ব্রেকও কাজ করেনি।

র‌্যাবের কাছে চালক দাবি করেছে, সে কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়েছে। তার পায়ে সমস্যা আছে। ৬ মাস বাড়িতে থাকার পর অসুস্থ শরীর নিয়ে ওই ট্রাকে গত ৬ মাস ধরে চালক হিসেবে কাজ করে আসছিল। গাড়িটির নানা ক্রটি থাকলেও সেই অবস্থায় সে গাড়িটি চালাচ্ছিল।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাজু গত ১১ জুলাই থেকে একটানা মালামাল পরিবহন করে আসছিল। এরই মধ্যে একবার রাজশাহী থেকে আম নিয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে মালামাল আনলোড করে পুনরায় রাজশাহী ফিরে আসে। গত ১৫ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট থেকে গাড়ির মালিকের আম বোঝাই করে এবং রাজশাহীর নৌহাটা থেকে আরেক দফায় আলু বোঝাই করে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের এক ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য রাত ১২টার দিকে রওয়ানা হয় রাজু। পথের মধ্যে হালকা বিরতি নিয়ে দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত একটানা গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন তিনি। কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছালে রাস্তা পারাপারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা নিহত জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী-সন্তানকে চাপা দেয়।

দুর্ঘটনার পর উপস্থিত লোকজন ট্রাকটি থামায়। তখন সুযোগ বুঝে রাজু ঢাকাগামী একটি বাসে উঠে পড়ে। পরে বাস থেকে চালক ময়মনসিংহ বাইপাসে নেমে সেখান থেকে একটি সিএনজি করে প্রথমে মুক্তাগাছা এবং পরে আরেকটি বাসে করে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পৌঁছায়। সেখান থেকে রাজু তার পরিচিত বিভিন্ন ট্রাকচালকের ট্রাকে উঠে আত্মগোপনে থাকে। গত সোমবার এমন একটি ট্রাক সাভারে পৌঁছালে সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ৬-৭ মাস আগে থেকে রাজু শতকরা ১০ শতাংশ কমিশনে বর্তমান ট্রাকটি চালিয়ে আসছিল। গাড়িটিতে করে সবসময় কাঁচামাল পরিবহন করা হতো। বর্তমানে ট্যাক্স-টোকেন এবং ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদউত্তীর্ণ গাড়িটিরধারণ ক্ষমতা ৭ টন হলেও দুর্ঘটনার সময় গাড়িটির ওজন সাড়ে ১৩ টন ছিল।

image

এই সেই ট্রাক, চাপা দিয়ে কেড়ে নিল অন্তঃসত্ত্বা মাসহ তিন প্রাণ। এমন ফিটনেসবিহীন জীর্ণশীর্ণ অসংখ্য ট্রাক সড়কে চলছে অবিরাম কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়, বেড়েই চলেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। নিয়ন্ত্রণের কোন পদক্ষেপ নেই -ফাইল ছবি

আরও খবর
রাজধানীর ১৩ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিকাদার ও প্রকৌশলীর সংঘবদ্ধ দুর্নীতি
বিদ্যুৎ ব্যবহারসহ সবক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর
সেই শিশুকে আপাতত ৫ লাখ টাকা দেয়ার নির্দেশ আদালতের
গত সাত বছরে এবারের ঈদযাত্রায় সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি সর্বোচ্চ
ডা. সাবরিনাসহ ৮ জনের ১১ বছর করে কারাদণ্ড
গণমাধ্যমকে দোষ দিয়ে ক্ষমা চাইলেন সিইসি
মেট্রোরেলের ব্যয় ও সময় বাড়ানো হয়েছে

বুধবার, ২০ জুলাই ২০২২ , ০৫ শ্রাবণ ১৪২৯ ২১ জিলহজ ১৪৪৩

ময়মনসিংহ সড়কে ৩ মৃত্যু

লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে ছিল ফিটনেসহীন ট্রাকের স্টিয়ারিং

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

এই সেই ট্রাক, চাপা দিয়ে কেড়ে নিল অন্তঃসত্ত্বা মাসহ তিন প্রাণ। এমন ফিটনেসবিহীন জীর্ণশীর্ণ অসংখ্য ট্রাক সড়কে চলছে অবিরাম কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়, বেড়েই চলেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। নিয়ন্ত্রণের কোন পদক্ষেপ নেই -ফাইল ছবি

ময়মনসিংহের ত্রিশালে যে ট্রাকের চাপায় অন্তঃসত্ত্বা নারী, তার স্বামী এবং আড়াই বছরের মেয়ে মারা গেছেন সেই ট্রাকের ছিল না ফিটনেস, ছিল না চালকের ডাইভিং লাইসেন্স। ৭ টন মাল বহনের জন্য ধারণক্ষমতার ট্রাকটিতে ক্রটি থাকার পরও দ্বিগুণ মালামাল পরিবহন হচ্ছিল। আর ওই অবস্থায় পেছনে থাকা আরেকটি গাড়িকে জায়গা দিতে গিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারটিকে পিষে মারে চালক।

‘আলোচিত ওই হত্যকা-ের ঘটনায় চালক মো. রাজু আহমেদ ওরফে শিপনকে গ্রেপ্তার করার পর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এর আগেও শিপন গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছিলেন এবং মামলায় কারাগারেও ছিলেন। জামিনে এসে সে আবারও ট্রাক চালাতে শুরু করে।’ গত সোমবার রাতে সাভার থেকে র‌্যাব-১৪ এর একটি টিম শিপনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তাকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়। এর আগে এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ১৬ জুলাই ত্রিশালের রায়মনি গ্রামের জাহাঙ্গির তার ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রতœা বেগম এবং ৩ বছর বয়সী কন্যা সানজিদাকে নিয়ে ত্রিশাল শহরে আসে। তারা মহাসড়কের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাওয়ার জন্য রাস্তা পার হওয়ার অপেক্ষায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিল। ওই অবস্থায় বেপরোয়া গতিতে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরো পরিবারটিকে চাপা দেয় চালক। অন্তঃসত্ত্বা রতœার পেট ফেটে গর্ভে থাকা সন্তান বেরিয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে ওই শিশুটি বেঁচে গেলেও পুরো পরিবার ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়।

খন্দকার মঈন জানান, কোন সড়কে কত পরিমাণ মালামাল বহন করে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করতে পারবে সে স্কেল অধিকাংশ সড়কে নেই। ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কে ওই ট্রাকটি তার ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি পণ্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রাকের গতি ছিল বেপরোয়া। ট্রাকটির পেছনে ঢাকাগামী একটি যাত্রীবাহী বাসও বেপরোয়া গতিতে আসছিল। ওই বাসটি বার বার জায়গা দেয়ার জন্য সামনে থাকা ট্রাকটি হর্ন দিচ্ছেলেন। বাসটিকে জায়গা দিতে গিয়ে ট্রাকটি পাশে টার্ন নিলে অতিরিক্ত ওজনের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারায়। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরো পরিবারটিকে চাপা দেয়। ট্রাকচালক দাবি করেছে, ‘সে পরিবারটিকে দেখতে পায়নি।’ এছাড়া তার ব্রেকও কাজ করেনি।

র‌্যাবের কাছে চালক দাবি করেছে, সে কিছুদিন আগে দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়েছে। তার পায়ে সমস্যা আছে। ৬ মাস বাড়িতে থাকার পর অসুস্থ শরীর নিয়ে ওই ট্রাকে গত ৬ মাস ধরে চালক হিসেবে কাজ করে আসছিল। গাড়িটির নানা ক্রটি থাকলেও সেই অবস্থায় সে গাড়িটি চালাচ্ছিল।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, রাজু গত ১১ জুলাই থেকে একটানা মালামাল পরিবহন করে আসছিল। এরই মধ্যে একবার রাজশাহী থেকে আম নিয়ে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে মালামাল আনলোড করে পুনরায় রাজশাহী ফিরে আসে। গত ১৫ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট থেকে গাড়ির মালিকের আম বোঝাই করে এবং রাজশাহীর নৌহাটা থেকে আরেক দফায় আলু বোঝাই করে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের এক ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য রাত ১২টার দিকে রওয়ানা হয় রাজু। পথের মধ্যে হালকা বিরতি নিয়ে দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত একটানা গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন তিনি। কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ডের কাছে পৌঁছালে রাস্তা পারাপারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা নিহত জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী-সন্তানকে চাপা দেয়।

দুর্ঘটনার পর উপস্থিত লোকজন ট্রাকটি থামায়। তখন সুযোগ বুঝে রাজু ঢাকাগামী একটি বাসে উঠে পড়ে। পরে বাস থেকে চালক ময়মনসিংহ বাইপাসে নেমে সেখান থেকে একটি সিএনজি করে প্রথমে মুক্তাগাছা এবং পরে আরেকটি বাসে করে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পৌঁছায়। সেখান থেকে রাজু তার পরিচিত বিভিন্ন ট্রাকচালকের ট্রাকে উঠে আত্মগোপনে থাকে। গত সোমবার এমন একটি ট্রাক সাভারে পৌঁছালে সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ৬-৭ মাস আগে থেকে রাজু শতকরা ১০ শতাংশ কমিশনে বর্তমান ট্রাকটি চালিয়ে আসছিল। গাড়িটিতে করে সবসময় কাঁচামাল পরিবহন করা হতো। বর্তমানে ট্যাক্স-টোকেন এবং ফিটনেস সার্টিফিকেটের মেয়াদউত্তীর্ণ গাড়িটিরধারণ ক্ষমতা ৭ টন হলেও দুর্ঘটনার সময় গাড়িটির ওজন সাড়ে ১৩ টন ছিল।