জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে গোটা বিশ্ব। যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে শুরু করে ইরানের আহবাজেও এর প্রভাব পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বলছে, এ বছর জুন এবং জুলাই মাসে বৈশ্বিক তাপপ্রবাহে ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার অনেক স্থানেই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, এমনকি অনেক স্থানেই পূর্বের দীর্ঘস্থায়ী তাপমাত্রার রেকর্ডও ভেঙে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে স্পেনসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশ পর্তুগাল ও ফ্রান্সে দাবদাহে সৃষ্ট দাবানল ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। পর্তুগালের লেইরিয়া শহরে ১৩ জুলাই তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। দেশটিতে ৭ হাজার ৪০০ একর জমি দাবানলে পুড়ে গেছে। পর্তুগালের ১৪টি স্থানে দাবানলের বিরুদ্ধে লড়ছে দমকল বাহিনী। দেশের অর্ধেকেরও বেশি অংশে চলছে রেড এলার্ট। পর্তুগাল সরকার জানিয়েছে, তাপে গত সপ্তাহে ৬৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক।
এদিকে ইতালিতে রেকর্ড তাপে ৩ জুলাই ডলোমাইটসের মারমোলাডা হিমবাহের একটি অংশ ধসের ফলে ১১ পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি বলেছিলেন, সন্দেহ নেই যে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত জলবায়ু পরিবর্তন। আমি বলতে চাচ্ছি যে সামনের বছরগুলোতে তাপমাত্রা যে বাড়বে না, তা বলা যাচ্ছে না। মানে তাপ তরঙ্গের ঘটনাগুলো আরও বেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে... ইউরোপজুড়ে।
সে সময় উদ্ধারকারী সংস্থার মুখপাত্র ওয়াল্টার মিলান দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভিকে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এই অঞ্চলটি অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রার সম্মুখীন হচ্ছে। হিমবাহের চূড়ার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের চরম তাপমাত্রা সতর্কতা জারি করেছে কারণ তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। দাবদাহ ও দাবানল আঘাত করেছে উত্তর আফ্রিকাতেও। দাবানলে সেখানকার শস্য ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।
১৩ জুলাই উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করেছে যা ৪০ বছরে সর্বোচ্চ। ইরানে জুনের শেষদিকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করে। জুলাই মাসেও তাপমাত্রা বেশি।
চীনে এবারের গ্রীষ্মকালের দাবদাহে রাস্তার পিচ গলে গিয়েছিল, ছাদের টাইলস পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছিল। ১৩ জুলাই সাংহাইয়ের তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর সঙ্গে উচ্চ আর্দ্রতা মিলে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই ধরনের দাবদাহ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যুক্তরাজ্যে সাধারণ নাগরিকদের বিনা প্রয়োজনে ভ্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। লন্ডনের অনেক স্থানেই গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ক্লাস বন্ধ অনেক স্কুলেই।
উত্তর আমেরিকাও কয়েক বছর ধরে দাবানল দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন স্থানে দাবানল দেখা দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় গত ৭ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে দাবানল। তবে পরিস্থিতি এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহ ঘন ঘন, তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। শিল্প যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবী ইতোমধ্যেই প্রায় ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উষ্ণ হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে না পারলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে।
স্পেনের ক্যাস্টিলা-লা মাঞ্চা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রির ডিন এনরিক সানচেজ জানিয়েছেন, তাপপ্রবাহ শীঘ্রই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
‘আমি বলতে চাচ্ছি যে সামনের বছরগুলোতে তাপমাত্রা যে বাড়বে না, তা বলা যাচ্ছে না। মানে তাপ তরঙ্গের ঘটনাগুলো আরও বেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে... ইউরোপজুড়ে।’
আর্কটিক সার্কেলের উত্তরে সবচেয়ে শীতল জনবসতিপূর্ণ স্থান হিসেবে বিখ্যাত ছিল সাইবেরিয়ার গ্রাম ভারখোয়ানস্ক, যেখানে রেকর্ড সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৬৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছরের জুনে এ গ্রামটি আর্কটিক সার্কেলের উত্তরে উষ্ণতম স্থানে পরিণত হয়েছে। গ্রামটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে সাধারণ গ্রীষ্মে তাপমাত্রা থাকত ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে।
ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন প্রজেক্ট বলছে, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৬০০ গুণ বেড়েছে। ল্যানসেটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এই উষ্ণায়ন বন্যা, দূষণ, রোগের বিস্তারসহ নানা বিপদ ডেকে আনবে। তবে গবেষকরা এসবের মধ্যে তাপপ্রবাহকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
চলতি সপ্তাহে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, রেকর্ডের তিনটি উষ্ণতম বছরের মধ্যে একটি ২০২০ সাল; তখন গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প স্তর থেকে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি রেকর্ড হয়েছিল। ২০২৪ সালের মধ্যে এটি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বুধবার, ২০ জুলাই ২০২২ , ০৫ শ্রাবণ ১৪২৯ ২১ জিলহজ ১৪৪৩
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে গোটা বিশ্ব। যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে শুরু করে ইরানের আহবাজেও এর প্রভাব পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বলছে, এ বছর জুন এবং জুলাই মাসে বৈশ্বিক তাপপ্রবাহে ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার অনেক স্থানেই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, এমনকি অনেক স্থানেই পূর্বের দীর্ঘস্থায়ী তাপমাত্রার রেকর্ডও ভেঙে যাচ্ছে।
এরই মধ্যে স্পেনসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশ পর্তুগাল ও ফ্রান্সে দাবদাহে সৃষ্ট দাবানল ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। পর্তুগালের লেইরিয়া শহরে ১৩ জুলাই তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। দেশটিতে ৭ হাজার ৪০০ একর জমি দাবানলে পুড়ে গেছে। পর্তুগালের ১৪টি স্থানে দাবানলের বিরুদ্ধে লড়ছে দমকল বাহিনী। দেশের অর্ধেকেরও বেশি অংশে চলছে রেড এলার্ট। পর্তুগাল সরকার জানিয়েছে, তাপে গত সপ্তাহে ৬৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশির ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক।
এদিকে ইতালিতে রেকর্ড তাপে ৩ জুলাই ডলোমাইটসের মারমোলাডা হিমবাহের একটি অংশ ধসের ফলে ১১ পর্বতারোহীর মৃত্যু হয়। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি বলেছিলেন, সন্দেহ নেই যে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত জলবায়ু পরিবর্তন। আমি বলতে চাচ্ছি যে সামনের বছরগুলোতে তাপমাত্রা যে বাড়বে না, তা বলা যাচ্ছে না। মানে তাপ তরঙ্গের ঘটনাগুলো আরও বেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে... ইউরোপজুড়ে।
সে সময় উদ্ধারকারী সংস্থার মুখপাত্র ওয়াল্টার মিলান দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভিকে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে এই অঞ্চলটি অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রার সম্মুখীন হচ্ছে। হিমবাহের চূড়ার তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে।
এদিকে যুক্তরাজ্যের চরম তাপমাত্রা সতর্কতা জারি করেছে কারণ তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। দাবদাহ ও দাবানল আঘাত করেছে উত্তর আফ্রিকাতেও। দাবানলে সেখানকার শস্য ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।
১৩ জুলাই উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করেছে যা ৪০ বছরে সর্বোচ্চ। ইরানে জুনের শেষদিকে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করে। জুলাই মাসেও তাপমাত্রা বেশি।
চীনে এবারের গ্রীষ্মকালের দাবদাহে রাস্তার পিচ গলে গিয়েছিল, ছাদের টাইলস পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছিল। ১৩ জুলাই সাংহাইয়ের তাপমাত্রা ছিল ৪০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর সঙ্গে উচ্চ আর্দ্রতা মিলে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই ধরনের দাবদাহ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যুক্তরাজ্যে সাধারণ নাগরিকদের বিনা প্রয়োজনে ভ্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। লন্ডনের অনেক স্থানেই গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ক্লাস বন্ধ অনেক স্কুলেই।
উত্তর আমেরিকাও কয়েক বছর ধরে দাবানল দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিভিন্ন স্থানে দাবানল দেখা দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় গত ৭ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে দাবানল। তবে পরিস্থিতি এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপপ্রবাহ ঘন ঘন, তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। শিল্প যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবী ইতোমধ্যেই প্রায় ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় উষ্ণ হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে না পারলে তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে।
স্পেনের ক্যাস্টিলা-লা মাঞ্চা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রির ডিন এনরিক সানচেজ জানিয়েছেন, তাপপ্রবাহ শীঘ্রই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
‘আমি বলতে চাচ্ছি যে সামনের বছরগুলোতে তাপমাত্রা যে বাড়বে না, তা বলা যাচ্ছে না। মানে তাপ তরঙ্গের ঘটনাগুলো আরও বেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে... ইউরোপজুড়ে।’
আর্কটিক সার্কেলের উত্তরে সবচেয়ে শীতল জনবসতিপূর্ণ স্থান হিসেবে বিখ্যাত ছিল সাইবেরিয়ার গ্রাম ভারখোয়ানস্ক, যেখানে রেকর্ড সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৬৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছরের জুনে এ গ্রামটি আর্কটিক সার্কেলের উত্তরে উষ্ণতম স্থানে পরিণত হয়েছে। গ্রামটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে সাধারণ গ্রীষ্মে তাপমাত্রা থাকত ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে।
ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন প্রজেক্ট বলছে, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৬০০ গুণ বেড়েছে। ল্যানসেটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এই উষ্ণায়ন বন্যা, দূষণ, রোগের বিস্তারসহ নানা বিপদ ডেকে আনবে। তবে গবেষকরা এসবের মধ্যে তাপপ্রবাহকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
চলতি সপ্তাহে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, রেকর্ডের তিনটি উষ্ণতম বছরের মধ্যে একটি ২০২০ সাল; তখন গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প স্তর থেকে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি রেকর্ড হয়েছিল। ২০২৪ সালের মধ্যে এটি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।