দেবী মহাশ্বেতাকে ভেবে

মামুন হুসাইন

লেখার জীবনকে মহাশ্বেতা বলতেন ‘স্বেচ্ছাবৃত দায়িত্ব’। নব্বই বছর পর্যন্ত এই দায়িত্ব-যজ্ঞ প্রতিপালন শেষে শ্রাবণ মাসের এক বৃহস্পতিবার কলকাতা শহরের খ্যাতিমান শ্মশান ঘাটে তাঁকে আগুনে ডুবে যেতে দেখে আমাদের অনুভব হয়, আবারও তিনি সাক্ষাৎ অগ্নিগর্ভা হয়ে উঠলেন। স্মৃতি হাতড়ে আমি মহাশ্বেতার ‘জল’ গল্প দেখি- বন্যার তোড়ে চারপাশের জীবন মৃত-মুমূর্ষু ও নিশ্চল। আবদ্ধ জলরাশি দেখতে-দেখতে মহাশ্বেতা মৃত্যু-বর্ণনার উপায় তৈরি করেছেন,... ‘চোখের মৃত্যু যার ঘটেছে, সে লোকের অন্তরে পৌঁছান বড় কঠিন।’ আমরা দেখি মুণ্ডা-শবর পরিবারের প্রার্থনা উপেক্ষা করে, এইবেলা মহাশ্বেতা বেলভিউ ক্লিনিকে ঈষৎ খোলা চোখে প্যালিয়েটিভ-কেয়ার’-এর যাবতীয় যন্ত্রপাতি মজারু চোখে দেখছেন- আমাদের দুর্বলচিত্ত ভয় পায়; ... এই দৃশ্যই কী তবে চোখের মৃত্যু?... কারণ মৃত চোখের অন্তরে পৌঁছানো বড় কঠিন।

মহাশ্বেতার অন্তরে পৌঁছানোর জন্য ইতোমধ্যে বাংলামুলুকে বিস্তর আলোচনা প্রবন্ধ তৈরি হয়েছে; তাঁর গল্প অবলম্বনে নাটক হয়েছে, চলচ্চিত্র হয়েছে, অনুবাদ গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং সর্বোপরি রয়ে গেছে তাঁর শতাধিক অমূল্য সাহিত্য সম্ভার, তাঁর ‘বর্তিকা’, তাঁর চিঠিপত্র, রেডিওতে পঠিত ‘ভাত’ গল্পের রেকর্ড এবং চারপাশে তৈরি হওয়া তাঁকে নিয়ে বিপুল এক অ্যানেকডোটস-রাজ্য। মহাশ্বেতা দেবীকে যেমন দেখেছি, মহাশ্বেতা সম্পর্কে যেটুকু জানা, মহাশ্বেতা যখন ‘মারাংদাই’- এই শিরোনামে এক্ষণে ভারতবর্ষে যাঁরা সিরিজ আলোচনা লিখতে সক্ষম, তাঁদের কাউকে-কাউকে চাক্ষুষ করলেও, মহাশ্বেতার সামনে উপস্থিত হয়েছি, এমনটি কখনও হয়নি। এখন এই শ্রাবণ-জলে তাঁকে ডুবিয়ে দেয়ার কালে বেদনার্ত হচ্ছি- একবার এক ঝলক দেখা হতে পারতো কী? বরেন্দ্র শহরে একবার তিনি এসেছিলেন, সাঁওতাল জনপদ দেখেছিলেন, ঢাকায় পুরনো জন্মদাগ খুঁজতে নেমেছিলেন, ইলিয়াসের মৃত্যুকে আনন্দময় করার সমূহ আয়োজন করেছিলেন গান গাইতে-গাইতে- এ-সবই এখন ক্ষণে-ক্ষণে মনে হচ্ছে। একজন চিনিয়েছিলেন- ১৮ এ, কোলকাতা-বালিগঞ্জের, সরু লোহার সিঁড়ি বেয়ে ঐ ঘরটিতে পৌঁছালে আপনি মহাশ্বেতার সন্ধান পাবেন। কিন্তু সুবিখ্যাত-মানুষের অনেক দূর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার আবাল্য-অসুস্থতা আমাকে বালিগঞ্জ-তীর্থভূমি দর্শন থেকে বিরত রাখে, সে-যাত্রা। কাউকে সাথে নিয়ে, অথবা নিছক একা, অথবা যাঁরা তাঁর সঙ্গে নিরন্তর অন্ন-চা গ্রহণ করেছেন তাঁদের কাছ থেকে মহাশ্বেতা-মিউজিয়ামের চাবি সংগ্রহ করি। নোটবই পড়া-অপুষ্ট মন মহাশ্বেতার মৃত চোখ ছুঁয়ে মহাশ্বেতার অন্তরে পৌঁছানোর জন্য ভুলভাল পথঘাট ও মৃত গলির ভেতর দিকচিহ্নহীন হয়। দেখি- কিন্নর রায়, দিদির কাছ থেকে জণ্ডিস মোকাবেলার জন্য দুই শিশি টনিক পেয়ে ভারি খুশি।

আমি হাবাগোবা হয়ে বালিগঞ্জের সকল সরু লোহার সিঁড়িতে মহাশ্বেতা দেবীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। হয়ত ভেতরবাড়িতে বাংলাদেশ থেকে এইমাত্র ঋত্বিক ওরফে ভবা এসে হ্যাংওভার দূর করার ধ্যানে তীব্র নিমজ্জিত। এটি মহাশ্বেতার ‘লেখার ঘর’ - বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। তবে কখনও লুকিয়ে ঢুকে পড়লে ‘আদিম জাতি ঐক্য পরিষদ’-এর একটি লিফলেটের ওড়া-উড়ি দেখা সম্ভব। লোধা সম্প্রদায়ের অনামা স্বাধীনতা সংগ্রামী ইন্দুভূষণ মল্লিকের জন্য তৈরি বেদির ছবি এক দেয়ালে। টেবিলের ওপর চুনি কোটালের ‘আত্মকথা’, খেড়িয়া গ্রামে টিউবওয়েল বসানোর জন্য দরখাস্ত, সিসল ঘাসের দড়ি একটুকরো, বর্তিকা, ইনসুলিন নেয়ার সিরিঞ্জ, ইটভাঁটা মজদুর সমিতির ইস্তাহার এবং মুকেশের গান কয়েক ভল্যুম। মহাশ্বেতা ঝাড়খণ্ড আন্দোলন, বনডেড লেবার ও আদিবাসী নির্যাতন সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখার ফাঁকে কাউকে-কাউকে সুযোগ দেন তাঁকে ‘মারাং দাই’ সম্বোধনের। এই মানুষেরা মারাং দাইয়ের চিরুনি দিয়ে অনায়াসে চুল আঁচড়ানোর সাহস খুঁজে পায়, মারাং দাইয়ের সোয়েটার পরে

এবং বড়দিদির কাপড় পড়ে লুঙ্গির মতো।

বেদনা হয়- আমার এই গো-জীবনে মহাশ্বেতা দেবী নামক বড়দির চিরুণিতে চুল আঁচড়ানোর ঘটনা তৈরি হবে না কোনদিন, কিংবা ভেজা কাপড় ছেড়ে মহাশ্বেতার কাপড় পরেছি লুঙ্গির মতো, ঐ দৃশ্যও এখন অমূলক অবাস্তব। একটু গালমন্দ হজম করে, আর একটু সখ্যতা বাড়ানো গেলে, মহাশ্বেতাকে কী কখনও জিজ্ঞেস করতে পারতাম, বাবাকে ‘তুতুল’ নামে ডাকতেন কেন? আপনি একটি গল্প লিখেছিলেন গাই গরু নিয়ে- নাম ‘ন্যাদোশ’, এ রকম কী কোন আহ্লাদে গাই গরু আপনাদের গৃহে ছিল? জীবিকার জন্য রং, গুড়ো সাবান, টিউশনি, এমনকি আমেরিকায় বাঁদর সরবরাহের টেন্ডার পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন একসময়- বিষয়গুলি কী সত্যি, না নেহায়েৎ মজা?

মৃত চোখের মহাশ্বেতা সহসা জবাব দেয়ার ইচ্ছে আড়াল করে বইয়ের ঘরের দিকে ঠায়দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখেন। মহাশ্বেতার বিপুল গ্রন্থপঞ্জি পবিত্র-শবের মতো ফ্যাকাশে চোখে আমাদের মলিন পাঠচক্রকে ব্যঙ্গ করে। লক্ষ্য করি- মহাশ্বেতার ঢাকা শহর, ইডেন মন্তেসরি, মেদিনীপুর, শান্তি নিকেতন, বিজন ভট্টাচার্য, অসিতগুপ্ত, পদ্মশ্রী, ফুলব্রাইট লেকচারারশিপ, স্বর্ণপদক ইত্যাদি আদিকা- স্মৃতি-বিস্মৃতির জটায় আচ্ছন্ন হয়ে আবারও তাঁর ইষৎ ধুলোপড়া বইপত্রে আমাদের জীবন্মৃত চোখকে পুনঃস্থাপন করেছে। নিভু নিভু চোখে আমার খ্যাতিমান বন্ধুরা মহাশ্বেতার লেখায় নারী জগৎ খোঁজার প্রস্তুতি নেয়। তেভাগা আন্দোলন, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ ও ইতিহাস নিয়ে নোটস্ তৈরি হয়। মহাশ্বেতার দ্রৌপদী, চোটিমুণ্ডা, কৌরব, বেহুলা, লখিন্দ, কবিবন্দ্যঘটী ও অরণ্য নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচিত হয়; তর্ক হয় ওঁর গদ্য, ওঁর শিল্পচৈতন্য এবং ইতিহাস ও সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটানোর রসায়ন নিয়ে। আমার ঊনবুদ্ধি, দুর্বল মেধা এই তর্ক গবেষণা থেকে আবারও চিরকালীন পলাতক মানুষের কাতারে দ্রুত নাম নথিভুক্ত করে। মহাশ্বেতার শান্ত ঘুম-ঘুম চোখের পাহারা এড়িয়ে টেবিল থেকে আমি ওঁর লেখার কলম চুরি করার সংকল্প নিই, অথবা ‘দিকু’দের মতো হঠাৎ-ই ওঁর পুরনো চিরুনি পকেটে ঢুকিয়ে, বেরিয়ে আসি, যেন এক্ষুণি চুলগুলো বিন্যস্ত হওয়া দরকার।

স্নানের পর যে চিরুনিটি মুণ্ডা-পরিবারের মানুষটি একদিন বালিগঞ্জের বাড়িতে যথাস্থানে রেখে এসেছিল, সেই নিখোঁজ চিরুনিতে চুল বিন্যাস করতে-করতে, আমার সমূহ অযাচার ও পাপকর্ম বিস্মৃত হয়ে ‘মারাং দাই’-এর পবিত্র বাক্যসমূহ এবার উল্টে যাই, কোন প্রকারের যোগসূত্র ছাড়াই- ঝাঁসির রাণী হাতে নিয়ে আবার যথাস্থানে সরিয়ে রাখি। শতাধিক গ্রন্থ থেকে আমি আল টপকে-টপকে বাক্য-শব্দের উত্তাপ খুঁজতে বসি: ‘... হঠাৎ একসঙ্গে বাজল শত শত শাঁখ। আর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল হাজার কয়েক মানুষের এক আশ্চর্য মিছিল, ... মায়ের পেট অক্তে ঝোঁকাতেছে, গুলি লেগেছে তো, আর সঙ্গিন দে পেট পিরি দেচ্ছে, মা এক হাতে পেট চেপে আর এক হাতে কাস্তে নে ছুটে আসতেছে ক্যামন। ... দিকুজন কোলহানের সন্তানদের ধর্ম, গান-নাচ, ভাষা, জমি, বন, খনিজ সম্পদ কেড়ে নেয়।... কম্যুনিস্ট পরিবার। আলোর নিচে এত অন্ধকার।... তোমাকে দেখেই বুঝেছি এদেশের মনের অন্ধকার, প্রাচীনত্ব দূর করা কত কঠিন।... মার লেখা ছাপা হয়েছিল, প্রশংসা পেয়েছিল বলে বাবা ভীষণ রাগারাগি করেন মার ওপর।... ছাপা লেখা, না-ছাপা লেখা সব জ্বালিয়ে দেন, আর জীবনেও লিখলেন না।... শুধু কাঁদলে একরকম রেট। কেঁদে লুটোলে পাঁচ টাকা এক সিকে। কেঁদে লুটিয়ে মাথা ঠুকলে পাঁচ টাকা দু-সিকে। কেঁদে বুক চাপড়ে শ্মশানে গিয়ে শ্মশানে লুটোপুটি খেলে ছয় টাকা দিতে হবে।... মোরো বাঁচা বীরসা! আমি শুদ্ধ শুচি নিস্কলঙ্ক হব।... হা জঙ্গল! তুমি বল না কোন, তোমার দয়া কেড়ে নেয়ার হক, কারো নাই,... জঙ্গলে ছাই উড়ায়ে দিলে জঙ্গল জানবে বিরসা তাকে ভোলেনি। ছাই মাটিতে পড়বে, মাটিতে গাছ জন্মালে, সেই গাছ বড় হবে...।’

কলকাতা শহরের সুদৃশ্য-শ্মশান থেকে আমাদের প্রথম ও শেষ মারাং দাই-এর ছাই এবেলা উড়ে আসছে যেন। ছাই মাটিতে পড়লে গাছ জীবন্ত হয়। জীবন্ত গাছের নিচে মহাশ্বেতা জগৎ-সংসার শুচি হওয়ার প্রস্তাব তৈরি করে:

‘মোরে বাঁচা...! আমি শুদ্ধ শুচি নিস্কলঙ্ক হব।... শুচ করে দিব মা গো। হায় দেখ্, দিকুতে সাহেবে মিলে মোরে বারবার অশুচ করে। শুচ করে দিব তোকে।... মোর কান্না কেও শুনে না। আমি শুনাছি। মোরে চেয়ে দেখেনা কেও। কোথা তুমি মা গো? তোর বুকে। তোর রক্তে।...

এবার দেবী মহাশ্বেতার অন্তর্গত রক্তপাত দেখতে-দেখতে, তাঁর চোখের মৃত্যু দেখতে-দেখতে, তাঁর শীর্ণকায়া হাতের ভেতর আটকে থাকা কলম স্পর্শ করে শুচি হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিতে নিতে, অনুভব করি- আমাদের বুড়ো পৃথিবীতে বহুকাল আগে মহাশ্বেতা নামক এক মহীরুহের আবির্ভাব হয়েছিল, যাঁর বন্ধ ‘লেখার ঘর’ থেকে একটি চিরুনি ও কলম খোঁয়া গেছে অতিসম্প্রতি।

image

মহাশ্বেতা দেবী / জন্ম : ১৪ জানুয়ারি ১৯২৬; মৃত্যু : ২৮ জুলাই ২০১৬

আরও খবর
মানুষ ও শিক্ষক ফকরুল আলম
রাজা হতে হলে
সাময়িকী কবিতা
পৌরাণিক আকাশে রবির পুরাণ
হাইকু নিয়ে কিছু কথা
দাবাত

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

দেবী মহাশ্বেতাকে ভেবে

মামুন হুসাইন

image

মহাশ্বেতা দেবী / জন্ম : ১৪ জানুয়ারি ১৯২৬; মৃত্যু : ২৮ জুলাই ২০১৬

লেখার জীবনকে মহাশ্বেতা বলতেন ‘স্বেচ্ছাবৃত দায়িত্ব’। নব্বই বছর পর্যন্ত এই দায়িত্ব-যজ্ঞ প্রতিপালন শেষে শ্রাবণ মাসের এক বৃহস্পতিবার কলকাতা শহরের খ্যাতিমান শ্মশান ঘাটে তাঁকে আগুনে ডুবে যেতে দেখে আমাদের অনুভব হয়, আবারও তিনি সাক্ষাৎ অগ্নিগর্ভা হয়ে উঠলেন। স্মৃতি হাতড়ে আমি মহাশ্বেতার ‘জল’ গল্প দেখি- বন্যার তোড়ে চারপাশের জীবন মৃত-মুমূর্ষু ও নিশ্চল। আবদ্ধ জলরাশি দেখতে-দেখতে মহাশ্বেতা মৃত্যু-বর্ণনার উপায় তৈরি করেছেন,... ‘চোখের মৃত্যু যার ঘটেছে, সে লোকের অন্তরে পৌঁছান বড় কঠিন।’ আমরা দেখি মুণ্ডা-শবর পরিবারের প্রার্থনা উপেক্ষা করে, এইবেলা মহাশ্বেতা বেলভিউ ক্লিনিকে ঈষৎ খোলা চোখে প্যালিয়েটিভ-কেয়ার’-এর যাবতীয় যন্ত্রপাতি মজারু চোখে দেখছেন- আমাদের দুর্বলচিত্ত ভয় পায়; ... এই দৃশ্যই কী তবে চোখের মৃত্যু?... কারণ মৃত চোখের অন্তরে পৌঁছানো বড় কঠিন।

মহাশ্বেতার অন্তরে পৌঁছানোর জন্য ইতোমধ্যে বাংলামুলুকে বিস্তর আলোচনা প্রবন্ধ তৈরি হয়েছে; তাঁর গল্প অবলম্বনে নাটক হয়েছে, চলচ্চিত্র হয়েছে, অনুবাদ গ্রন্থ রচিত হয়েছে এবং সর্বোপরি রয়ে গেছে তাঁর শতাধিক অমূল্য সাহিত্য সম্ভার, তাঁর ‘বর্তিকা’, তাঁর চিঠিপত্র, রেডিওতে পঠিত ‘ভাত’ গল্পের রেকর্ড এবং চারপাশে তৈরি হওয়া তাঁকে নিয়ে বিপুল এক অ্যানেকডোটস-রাজ্য। মহাশ্বেতা দেবীকে যেমন দেখেছি, মহাশ্বেতা সম্পর্কে যেটুকু জানা, মহাশ্বেতা যখন ‘মারাংদাই’- এই শিরোনামে এক্ষণে ভারতবর্ষে যাঁরা সিরিজ আলোচনা লিখতে সক্ষম, তাঁদের কাউকে-কাউকে চাক্ষুষ করলেও, মহাশ্বেতার সামনে উপস্থিত হয়েছি, এমনটি কখনও হয়নি। এখন এই শ্রাবণ-জলে তাঁকে ডুবিয়ে দেয়ার কালে বেদনার্ত হচ্ছি- একবার এক ঝলক দেখা হতে পারতো কী? বরেন্দ্র শহরে একবার তিনি এসেছিলেন, সাঁওতাল জনপদ দেখেছিলেন, ঢাকায় পুরনো জন্মদাগ খুঁজতে নেমেছিলেন, ইলিয়াসের মৃত্যুকে আনন্দময় করার সমূহ আয়োজন করেছিলেন গান গাইতে-গাইতে- এ-সবই এখন ক্ষণে-ক্ষণে মনে হচ্ছে। একজন চিনিয়েছিলেন- ১৮ এ, কোলকাতা-বালিগঞ্জের, সরু লোহার সিঁড়ি বেয়ে ঐ ঘরটিতে পৌঁছালে আপনি মহাশ্বেতার সন্ধান পাবেন। কিন্তু সুবিখ্যাত-মানুষের অনেক দূর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার আবাল্য-অসুস্থতা আমাকে বালিগঞ্জ-তীর্থভূমি দর্শন থেকে বিরত রাখে, সে-যাত্রা। কাউকে সাথে নিয়ে, অথবা নিছক একা, অথবা যাঁরা তাঁর সঙ্গে নিরন্তর অন্ন-চা গ্রহণ করেছেন তাঁদের কাছ থেকে মহাশ্বেতা-মিউজিয়ামের চাবি সংগ্রহ করি। নোটবই পড়া-অপুষ্ট মন মহাশ্বেতার মৃত চোখ ছুঁয়ে মহাশ্বেতার অন্তরে পৌঁছানোর জন্য ভুলভাল পথঘাট ও মৃত গলির ভেতর দিকচিহ্নহীন হয়। দেখি- কিন্নর রায়, দিদির কাছ থেকে জণ্ডিস মোকাবেলার জন্য দুই শিশি টনিক পেয়ে ভারি খুশি।

আমি হাবাগোবা হয়ে বালিগঞ্জের সকল সরু লোহার সিঁড়িতে মহাশ্বেতা দেবীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। হয়ত ভেতরবাড়িতে বাংলাদেশ থেকে এইমাত্র ঋত্বিক ওরফে ভবা এসে হ্যাংওভার দূর করার ধ্যানে তীব্র নিমজ্জিত। এটি মহাশ্বেতার ‘লেখার ঘর’ - বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। তবে কখনও লুকিয়ে ঢুকে পড়লে ‘আদিম জাতি ঐক্য পরিষদ’-এর একটি লিফলেটের ওড়া-উড়ি দেখা সম্ভব। লোধা সম্প্রদায়ের অনামা স্বাধীনতা সংগ্রামী ইন্দুভূষণ মল্লিকের জন্য তৈরি বেদির ছবি এক দেয়ালে। টেবিলের ওপর চুনি কোটালের ‘আত্মকথা’, খেড়িয়া গ্রামে টিউবওয়েল বসানোর জন্য দরখাস্ত, সিসল ঘাসের দড়ি একটুকরো, বর্তিকা, ইনসুলিন নেয়ার সিরিঞ্জ, ইটভাঁটা মজদুর সমিতির ইস্তাহার এবং মুকেশের গান কয়েক ভল্যুম। মহাশ্বেতা ঝাড়খণ্ড আন্দোলন, বনডেড লেবার ও আদিবাসী নির্যাতন সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখার ফাঁকে কাউকে-কাউকে সুযোগ দেন তাঁকে ‘মারাং দাই’ সম্বোধনের। এই মানুষেরা মারাং দাইয়ের চিরুনি দিয়ে অনায়াসে চুল আঁচড়ানোর সাহস খুঁজে পায়, মারাং দাইয়ের সোয়েটার পরে

এবং বড়দিদির কাপড় পড়ে লুঙ্গির মতো।

বেদনা হয়- আমার এই গো-জীবনে মহাশ্বেতা দেবী নামক বড়দির চিরুণিতে চুল আঁচড়ানোর ঘটনা তৈরি হবে না কোনদিন, কিংবা ভেজা কাপড় ছেড়ে মহাশ্বেতার কাপড় পরেছি লুঙ্গির মতো, ঐ দৃশ্যও এখন অমূলক অবাস্তব। একটু গালমন্দ হজম করে, আর একটু সখ্যতা বাড়ানো গেলে, মহাশ্বেতাকে কী কখনও জিজ্ঞেস করতে পারতাম, বাবাকে ‘তুতুল’ নামে ডাকতেন কেন? আপনি একটি গল্প লিখেছিলেন গাই গরু নিয়ে- নাম ‘ন্যাদোশ’, এ রকম কী কোন আহ্লাদে গাই গরু আপনাদের গৃহে ছিল? জীবিকার জন্য রং, গুড়ো সাবান, টিউশনি, এমনকি আমেরিকায় বাঁদর সরবরাহের টেন্ডার পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন একসময়- বিষয়গুলি কী সত্যি, না নেহায়েৎ মজা?

মৃত চোখের মহাশ্বেতা সহসা জবাব দেয়ার ইচ্ছে আড়াল করে বইয়ের ঘরের দিকে ঠায়দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখেন। মহাশ্বেতার বিপুল গ্রন্থপঞ্জি পবিত্র-শবের মতো ফ্যাকাশে চোখে আমাদের মলিন পাঠচক্রকে ব্যঙ্গ করে। লক্ষ্য করি- মহাশ্বেতার ঢাকা শহর, ইডেন মন্তেসরি, মেদিনীপুর, শান্তি নিকেতন, বিজন ভট্টাচার্য, অসিতগুপ্ত, পদ্মশ্রী, ফুলব্রাইট লেকচারারশিপ, স্বর্ণপদক ইত্যাদি আদিকা- স্মৃতি-বিস্মৃতির জটায় আচ্ছন্ন হয়ে আবারও তাঁর ইষৎ ধুলোপড়া বইপত্রে আমাদের জীবন্মৃত চোখকে পুনঃস্থাপন করেছে। নিভু নিভু চোখে আমার খ্যাতিমান বন্ধুরা মহাশ্বেতার লেখায় নারী জগৎ খোঁজার প্রস্তুতি নেয়। তেভাগা আন্দোলন, ধর্মশাস্ত্র, পুরাণ ও ইতিহাস নিয়ে নোটস্ তৈরি হয়। মহাশ্বেতার দ্রৌপদী, চোটিমুণ্ডা, কৌরব, বেহুলা, লখিন্দ, কবিবন্দ্যঘটী ও অরণ্য নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচিত হয়; তর্ক হয় ওঁর গদ্য, ওঁর শিল্পচৈতন্য এবং ইতিহাস ও সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটানোর রসায়ন নিয়ে। আমার ঊনবুদ্ধি, দুর্বল মেধা এই তর্ক গবেষণা থেকে আবারও চিরকালীন পলাতক মানুষের কাতারে দ্রুত নাম নথিভুক্ত করে। মহাশ্বেতার শান্ত ঘুম-ঘুম চোখের পাহারা এড়িয়ে টেবিল থেকে আমি ওঁর লেখার কলম চুরি করার সংকল্প নিই, অথবা ‘দিকু’দের মতো হঠাৎ-ই ওঁর পুরনো চিরুনি পকেটে ঢুকিয়ে, বেরিয়ে আসি, যেন এক্ষুণি চুলগুলো বিন্যস্ত হওয়া দরকার।

স্নানের পর যে চিরুনিটি মুণ্ডা-পরিবারের মানুষটি একদিন বালিগঞ্জের বাড়িতে যথাস্থানে রেখে এসেছিল, সেই নিখোঁজ চিরুনিতে চুল বিন্যাস করতে-করতে, আমার সমূহ অযাচার ও পাপকর্ম বিস্মৃত হয়ে ‘মারাং দাই’-এর পবিত্র বাক্যসমূহ এবার উল্টে যাই, কোন প্রকারের যোগসূত্র ছাড়াই- ঝাঁসির রাণী হাতে নিয়ে আবার যথাস্থানে সরিয়ে রাখি। শতাধিক গ্রন্থ থেকে আমি আল টপকে-টপকে বাক্য-শব্দের উত্তাপ খুঁজতে বসি: ‘... হঠাৎ একসঙ্গে বাজল শত শত শাঁখ। আর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল হাজার কয়েক মানুষের এক আশ্চর্য মিছিল, ... মায়ের পেট অক্তে ঝোঁকাতেছে, গুলি লেগেছে তো, আর সঙ্গিন দে পেট পিরি দেচ্ছে, মা এক হাতে পেট চেপে আর এক হাতে কাস্তে নে ছুটে আসতেছে ক্যামন। ... দিকুজন কোলহানের সন্তানদের ধর্ম, গান-নাচ, ভাষা, জমি, বন, খনিজ সম্পদ কেড়ে নেয়।... কম্যুনিস্ট পরিবার। আলোর নিচে এত অন্ধকার।... তোমাকে দেখেই বুঝেছি এদেশের মনের অন্ধকার, প্রাচীনত্ব দূর করা কত কঠিন।... মার লেখা ছাপা হয়েছিল, প্রশংসা পেয়েছিল বলে বাবা ভীষণ রাগারাগি করেন মার ওপর।... ছাপা লেখা, না-ছাপা লেখা সব জ্বালিয়ে দেন, আর জীবনেও লিখলেন না।... শুধু কাঁদলে একরকম রেট। কেঁদে লুটোলে পাঁচ টাকা এক সিকে। কেঁদে লুটিয়ে মাথা ঠুকলে পাঁচ টাকা দু-সিকে। কেঁদে বুক চাপড়ে শ্মশানে গিয়ে শ্মশানে লুটোপুটি খেলে ছয় টাকা দিতে হবে।... মোরো বাঁচা বীরসা! আমি শুদ্ধ শুচি নিস্কলঙ্ক হব।... হা জঙ্গল! তুমি বল না কোন, তোমার দয়া কেড়ে নেয়ার হক, কারো নাই,... জঙ্গলে ছাই উড়ায়ে দিলে জঙ্গল জানবে বিরসা তাকে ভোলেনি। ছাই মাটিতে পড়বে, মাটিতে গাছ জন্মালে, সেই গাছ বড় হবে...।’

কলকাতা শহরের সুদৃশ্য-শ্মশান থেকে আমাদের প্রথম ও শেষ মারাং দাই-এর ছাই এবেলা উড়ে আসছে যেন। ছাই মাটিতে পড়লে গাছ জীবন্ত হয়। জীবন্ত গাছের নিচে মহাশ্বেতা জগৎ-সংসার শুচি হওয়ার প্রস্তাব তৈরি করে:

‘মোরে বাঁচা...! আমি শুদ্ধ শুচি নিস্কলঙ্ক হব।... শুচ করে দিব মা গো। হায় দেখ্, দিকুতে সাহেবে মিলে মোরে বারবার অশুচ করে। শুচ করে দিব তোকে।... মোর কান্না কেও শুনে না। আমি শুনাছি। মোরে চেয়ে দেখেনা কেও। কোথা তুমি মা গো? তোর বুকে। তোর রক্তে।...

এবার দেবী মহাশ্বেতার অন্তর্গত রক্তপাত দেখতে-দেখতে, তাঁর চোখের মৃত্যু দেখতে-দেখতে, তাঁর শীর্ণকায়া হাতের ভেতর আটকে থাকা কলম স্পর্শ করে শুচি হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিতে নিতে, অনুভব করি- আমাদের বুড়ো পৃথিবীতে বহুকাল আগে মহাশ্বেতা নামক এক মহীরুহের আবির্ভাব হয়েছিল, যাঁর বন্ধ ‘লেখার ঘর’ থেকে একটি চিরুনি ও কলম খোঁয়া গেছে অতিসম্প্রতি।