লিটন চক্রবর্তী মিঠুন
২০১৬ সালে আরসি মজুমদার মিলনায়তনে এক কনফারেন্সে বক্তা অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচিত দিতে গিয়ে শেষের দিকে অধ্যাপক ফকরুল আলম বলেছিলেন: If you don’t know him, that’s your problem. সাথে সাথে চারদিকে হাসির রোল পড়ে। কিন্তু এ একই কথা খাটে অধ্যাপক আলমের ক্ষেত্রেও। অবশ্য ড. আলমের নাম ব্যাপক পরিচিত বঙ্গবন্ধুর আত্মকথাগুলোর অনুবাদক হিসেবে, বিশেষ করে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রত্যাশী লাখো যুবক-যুবতীর কাছে। কিন্তু, এটাই কি তাঁর একমাত্র বা চূড়ান্ত পরিচয়?
বিষয়টিতে যাবার আগে ফকরুল আলম স্যারের শিক্ষকজীবন নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করা যাক। প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে তিনি আমাদের Introduction to Prose and Drama নামের একটি কোর্সের prose (পদ্য) অংশটি পড়াতেন। খুব দরদ দিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে, জীবন থেকে নেয়া উদাহরণসহ পড়ালেও আমার মতো মফস্বল ব্যাকগ্রাউন্ডের অনেকেই তা কতটুকু বুঝতো তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অবশ্য মফস্বলের বা বাংলা মাধ্যমের হলেই কেউ ইংরেজি পড়া বুঝবে না, এতটা খোঁড়া দাবি আমি করছি না। তবে আমার মতো অনেককেই সংগ্রাম করতে হয়েছে ভাষার দেয়াল টপকে ধারণার জগতে প্রবেশ করতে গিয়ে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় বয়সোপযুক্ত ভাষাগত দক্ষতা ও সাহিত্যবোধ নিয়ে কজনই বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ব্যাপারটি নিয়ে খোদ ফকরুল স্যারকেও উষ্মা প্রকাশ করতে দেখেছি। দিনকে দিন ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজি লেখার মান-অবনমন নিয়ে তাঁর ছিল রাজ্যের বিরক্তি। পরবর্তীকালে, তাঁর লেখা পড়ে জেনেছি এর পেছনে ত্রূটিপূর্ণ ও বাস্তবজ্ঞানহীন ভাষানীতি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষার অকারণ মুখোমুখিকরণ এবং প্রচলিত কার্যকর ভাষাশিক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে বিদেশি ফরমায়েশে গৃহীত উটকো পদ্ধতির প্রয়োগ দায়ী।
যাহোক, সে সেমিস্টারে একদিন তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন কারা কারা পড়া পড়ে এসেছে। যদ্দুর মনে পড়ে, সেটা ছিল কোনও একটা লম্বা ছুটির পর ওনার সাথে প্রথম ক্লাস। ছুটির আগেই তিনি পড়াটা দিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু স্যারের প্রশ্নের জবাবে আমাদের পুরো সেকশানের প্রায় সবাই নিশ্চুপ ছিল। এদিকে আমি মাথা ঝুকিয়ে বসে আছি। স্যার খেয়াল করলেন ও রেগে গেলেন। রাগত স্বরেই বললেন, ‘মাথা ওঠাতে কষ্ট হয়? বই এনেছো?’ ভাগ্যিস বইটা ছিল। দেখিয়ে সে যাত্রায় রক্ষে। এ থেকে যদি মনে হয়, স্যার খুব রুক্ষ মেজাজের তা হলে ভুল করা হবে। বরং পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোসহীন। ঝামেলা ছিল আমার নিজের মধ্যেই। যথারীতি মিডটার্ম পরীক্ষা হলো। তিনি তাঁর অংশের ফলাফল টাঙিয়ে দিলেন নোটিশবোর্ডে আর করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘আমার এত বছরের শিক্ষকতা জীবনে তোমাদের ব্যাচের মতো বাজে লিখতে কাউকে দেখিনি। নিজের মার্ক দেখে আমার মুখের তোতা উড়ে গেল। বন্ধু শরীফের উৎসাহে সাহস নিয়ে স্যারের অফিসে যাই খাতা দেখার জন্য। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় লাল কালির অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা দেখে বাস্তবতা টের পেয়ে যাই। স্যার ভাষা ও ব্যাকরণগত দক্ষতা বাড়াবার উপদেশ দিলেন। তারিখটা ছিল ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২।
পরের বছর স্যারের কোনও কোর্স আর পাইনি। স্যারের ছায়াও মাড়াইনি। তৃতীয় বর্ষে এসে স্যারকে পেলাম নতুন এক কোর্সে, নাম English Prose from Bacon to Burke। এ প্রথম আমরা বুঝতে
পারলাম স্যারের পড়ানোর সৌন্দর্য ও মাধুর্য। বিশেষ করে, জোনাথন সুইফ্টের Gulliver’s Travels উপন্যাসটি পড়াতে গিয়ে স্যার আমাদের পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে উদাহরণ দিতেন। কাজেই তীব্র শ্লেষাত্মক, হাস্যরসপূর্ণ রচনাটি আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠত। এ উপন্যাসে ইয়াহু নামে এক ধরনের নোংরা স্বভাবের বিচ্ছিরি দর্শন প্রাণীর কথা উল্লেখ আছে মানুষের অন্ধকার দিকের প্রতীক হিসেবে। তো যখন তিনি এদের নিয়ে পড়াচ্ছিলেন, তখন বাইরের রাস্তায় কিছু উচ্ছৃঙ্খল তরুণ চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল। স্যার সাথে সাথেই ফুট কাটলেন, “ইয়াহুরা বেরিয়েছে।” আমরা ইয়াহু চিনলাম, বুঝলাম। এডমন্ড বার্ক পড়াতে গিয়ে স্যার আমাদের রেটোরিকের মাহাত্ম্য বোঝালেন। যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকে, আবেগের মিশেলে, স্বরের ওঠানামার দক্ষতায়, উদাহরণের সময়োচিত প্রয়োগে বক্তব্য পেশ করার যে শিল্পকৌশল, বার্কের Speech on the East India Bill-এর ব্যাখ্যায় তিনি তা আমাদের শেখালেন।
চতুর্থ বর্ষে আমাদের পড়িয়েছিলেন American Literature I Critical Theory-র মতো কোর্স। জে.ডি. স্যালিঞ্জারের The Catcher in the Rye উপন্যাসটি ছিল সবার প্রিয়। উপন্যাসের নায়ক আমাদের বয়সী একজন কৈশোর পেরোনো তরুণ, যে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে অস্থির ও উত্তাল সময় কাটাচ্ছে। তার বয়সসুলভ অপরিপক্বতা, রাগ-ক্ষোভ, অনিরাপদবোধ, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, সমবয়সী ও বয়স্কদের কাছে হেনস্থার শিকার হওয়া, আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা জীবনের সাথে আমাদের অনেকেরই ব্যক্তিজীবনের মিল চরিত্রটিকে আরও আপন করে তুলেছিল। ফকরুল স্যার খুব দক্ষতার সাথে উপন্যাসটিকে জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। স্যারের রসবোধ, অমায়িক হাসি আর ভাষার প্রাঞ্জলতা প্রতিটি টেক্সটকে করে তুলতো মোহনীয়। স্যারের বিশেষ প্রীতি ছিল বিভিন্ন সাহিত্যতত্ত্বের প্রতি। তিনি নিজে উত্তর-উপনিবেশবাদী তত্ত্বের একজন স্কলার, দেশে-বিদেশে সমাদৃত বিশেষজ্ঞ। তত্ত্বকে তিনি দেখেন পৃথিবীকে দেখার জানালা হিসেবে। ভিন্ন ভিন্ন জানালা দিয়ে যেমন একই দৃশ্যকে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখা যায়, তেমনি এক একটি তত্ত্বের বাস্তবতাকে বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়। তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে বিশাল সম্ভাবনা, তিনি চাইতেন আমরা সেটা উপলব্ধি করি।
এ তো গেল শিক্ষক ফকরুল আলমের গুণপনা। ব্যক্তি ফকরুল আলমও সমধিক জনপ্রিয় তাঁর উদারতা ও ছাত্রবাৎসল্যের জন্য। অনুমতিসাপেক্ষে তাঁর অফিস ও শ্রেণিকক্ষে আমাদের প্রায় অবাধ যাতায়াত ছিল। বিভিন্ন সময় আমরা স্যারের কাছে যেতে পারতাম ক্যারিয়ার, এমনকি ব্যক্তিগত বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য। তিনি আন্তরিকভাবেই আমাদের পরামর্শ দিতেন। মনে আছে, মাস্টার্সের শেষ সেমিস্টারে আমি অনুবাদের কোর্স না নিলেও তাঁর সদয় অনুমতি পেয়েছিলাম অন্তত ক্লাস লেকচার শোনার জন্য। বলা সমীচীন, পরবর্তীকালে আমি অনুবাদক হিসেবে বেশ কিছু কাজ করেছি, পেশাদারভাবে ও বিনি পয়সায়। অনুবাদক হিসেবে স্যারের অভিজ্ঞান ও দক্ষতার ছিটেফোঁটা আমার ওপরও পড়েছিল বৈকি সে কোর্সে ক্লাস করার সুবাদে। স্যার আমাদের লেখালেখি করার ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতেন, চোখ রাখতেন আমাদের ফেসবুক পোস্টেও। আমাদের বন্ধু সাফি উল্লাহ (বর্তমানে বিশ্বদ্যিালয় শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক) তার প্রথম বইয়ের কাজ করছিল সে মাস্টার্সে থাকতে। স্যার তার কাজের ভূয়সী প্রশংসাই করেননি আমাদের কাছে, সে বইয়ের ব্লার্বও লিখে দিয়েছিলেন। সে সাহস থেকে কিছুদিন আগে স্যারকে আমার প্রথম বইপ্রকল্পের কথা জানিয়ে ব্লার্ব লেখার অনুরোধ জানাতেই তিনি সদয় সম্মতি প্রদান করেন। ছাত্রজীবনে আমার বোম্বাস্টিক শব্দবহুল গদ্যকে “রসকসহীন” ও “কাষ্ঠল” বললেও এখন অবশ্য ভাল লিখি বলে মৌখিক সনদ দিয়েছেন, যা আমার জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি।
এবার আবার প্রথম অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ফকরুল আলম দীর্ঘদিন শিক্ষকতা ও একাডেমিক চর্চা করেছেন। বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, দেশে-বিদেশে পণ্ডিতমহলে সমাদর পেয়েছেন। কিন্তু, তাঁর কাজের বাহন ইংরেজি, যথারীতি আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজি। ফলে ইংরেজি কমজানা, সাধারণ বাঙালি পাঠকদের কাছে তাঁর লেখা পৌঁছায়নি। তাঁর বেশকিছু প্রবন্ধ ও নিবন্ধ আছে যা উপযুক্ত হাতের অনুবাদে পৌঁছাতে পারে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে। আর তাতে একজন শক্তিমান বুদ্ধিজীবীকে আরও নিবিড়ভাবে আবিষ্কার করতে পারবেন বাংলাভাষী জনগণ। পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর থেকে বেরিয়ে তিনি হয়ে উঠবেন জননন্দিত, বহুলপঠিত লেখক ও বুদ্ধিজীবী।
পরিশেষে, ২০ জুলাই ২০২২ তাঁর ৭১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ড. ফকরুল আলম, আমাদের প্রিয় ফকরুল স্যারের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। তিনি যেন আজীবন সৃষ্টিশীল ও কর্মোদ্যমী থেকে আমাদের দেশ ও জাতিকে আলোকিত করে যেতে পারেন, এটাই প্রার্থনা।
ফকরুল আলম / জন্ম: ২০ জুলাই ১৯৫১
আরও খবরবৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩
লিটন চক্রবর্তী মিঠুন
ফকরুল আলম / জন্ম: ২০ জুলাই ১৯৫১
২০১৬ সালে আরসি মজুমদার মিলনায়তনে এক কনফারেন্সে বক্তা অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচিত দিতে গিয়ে শেষের দিকে অধ্যাপক ফকরুল আলম বলেছিলেন: If you don’t know him, that’s your problem. সাথে সাথে চারদিকে হাসির রোল পড়ে। কিন্তু এ একই কথা খাটে অধ্যাপক আলমের ক্ষেত্রেও। অবশ্য ড. আলমের নাম ব্যাপক পরিচিত বঙ্গবন্ধুর আত্মকথাগুলোর অনুবাদক হিসেবে, বিশেষ করে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রত্যাশী লাখো যুবক-যুবতীর কাছে। কিন্তু, এটাই কি তাঁর একমাত্র বা চূড়ান্ত পরিচয়?
বিষয়টিতে যাবার আগে ফকরুল আলম স্যারের শিক্ষকজীবন নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করা যাক। প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে তিনি আমাদের Introduction to Prose and Drama নামের একটি কোর্সের prose (পদ্য) অংশটি পড়াতেন। খুব দরদ দিয়ে বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে, জীবন থেকে নেয়া উদাহরণসহ পড়ালেও আমার মতো মফস্বল ব্যাকগ্রাউন্ডের অনেকেই তা কতটুকু বুঝতো তা নিয়ে সন্দেহ আছে। অবশ্য মফস্বলের বা বাংলা মাধ্যমের হলেই কেউ ইংরেজি পড়া বুঝবে না, এতটা খোঁড়া দাবি আমি করছি না। তবে আমার মতো অনেককেই সংগ্রাম করতে হয়েছে ভাষার দেয়াল টপকে ধারণার জগতে প্রবেশ করতে গিয়ে। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় বয়সোপযুক্ত ভাষাগত দক্ষতা ও সাহিত্যবোধ নিয়ে কজনই বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। ব্যাপারটি নিয়ে খোদ ফকরুল স্যারকেও উষ্মা প্রকাশ করতে দেখেছি। দিনকে দিন ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজি লেখার মান-অবনমন নিয়ে তাঁর ছিল রাজ্যের বিরক্তি। পরবর্তীকালে, তাঁর লেখা পড়ে জেনেছি এর পেছনে ত্রূটিপূর্ণ ও বাস্তবজ্ঞানহীন ভাষানীতি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষার অকারণ মুখোমুখিকরণ এবং প্রচলিত কার্যকর ভাষাশিক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে বিদেশি ফরমায়েশে গৃহীত উটকো পদ্ধতির প্রয়োগ দায়ী।
যাহোক, সে সেমিস্টারে একদিন তিনি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন কারা কারা পড়া পড়ে এসেছে। যদ্দুর মনে পড়ে, সেটা ছিল কোনও একটা লম্বা ছুটির পর ওনার সাথে প্রথম ক্লাস। ছুটির আগেই তিনি পড়াটা দিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু স্যারের প্রশ্নের জবাবে আমাদের পুরো সেকশানের প্রায় সবাই নিশ্চুপ ছিল। এদিকে আমি মাথা ঝুকিয়ে বসে আছি। স্যার খেয়াল করলেন ও রেগে গেলেন। রাগত স্বরেই বললেন, ‘মাথা ওঠাতে কষ্ট হয়? বই এনেছো?’ ভাগ্যিস বইটা ছিল। দেখিয়ে সে যাত্রায় রক্ষে। এ থেকে যদি মনে হয়, স্যার খুব রুক্ষ মেজাজের তা হলে ভুল করা হবে। বরং পড়াশোনার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোসহীন। ঝামেলা ছিল আমার নিজের মধ্যেই। যথারীতি মিডটার্ম পরীক্ষা হলো। তিনি তাঁর অংশের ফলাফল টাঙিয়ে দিলেন নোটিশবোর্ডে আর করিডোর দিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘আমার এত বছরের শিক্ষকতা জীবনে তোমাদের ব্যাচের মতো বাজে লিখতে কাউকে দেখিনি। নিজের মার্ক দেখে আমার মুখের তোতা উড়ে গেল। বন্ধু শরীফের উৎসাহে সাহস নিয়ে স্যারের অফিসে যাই খাতা দেখার জন্য। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় লাল কালির অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা দেখে বাস্তবতা টের পেয়ে যাই। স্যার ভাষা ও ব্যাকরণগত দক্ষতা বাড়াবার উপদেশ দিলেন। তারিখটা ছিল ৩১ ডিসেম্বর, ২০১২।
পরের বছর স্যারের কোনও কোর্স আর পাইনি। স্যারের ছায়াও মাড়াইনি। তৃতীয় বর্ষে এসে স্যারকে পেলাম নতুন এক কোর্সে, নাম English Prose from Bacon to Burke। এ প্রথম আমরা বুঝতে
পারলাম স্যারের পড়ানোর সৌন্দর্য ও মাধুর্য। বিশেষ করে, জোনাথন সুইফ্টের Gulliver’s Travels উপন্যাসটি পড়াতে গিয়ে স্যার আমাদের পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে উদাহরণ দিতেন। কাজেই তীব্র শ্লেষাত্মক, হাস্যরসপূর্ণ রচনাটি আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠত। এ উপন্যাসে ইয়াহু নামে এক ধরনের নোংরা স্বভাবের বিচ্ছিরি দর্শন প্রাণীর কথা উল্লেখ আছে মানুষের অন্ধকার দিকের প্রতীক হিসেবে। তো যখন তিনি এদের নিয়ে পড়াচ্ছিলেন, তখন বাইরের রাস্তায় কিছু উচ্ছৃঙ্খল তরুণ চিৎকার-চেঁচামেচি করছিল। স্যার সাথে সাথেই ফুট কাটলেন, “ইয়াহুরা বেরিয়েছে।” আমরা ইয়াহু চিনলাম, বুঝলাম। এডমন্ড বার্ক পড়াতে গিয়ে স্যার আমাদের রেটোরিকের মাহাত্ম্য বোঝালেন। যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকে, আবেগের মিশেলে, স্বরের ওঠানামার দক্ষতায়, উদাহরণের সময়োচিত প্রয়োগে বক্তব্য পেশ করার যে শিল্পকৌশল, বার্কের Speech on the East India Bill-এর ব্যাখ্যায় তিনি তা আমাদের শেখালেন।
চতুর্থ বর্ষে আমাদের পড়িয়েছিলেন American Literature I Critical Theory-র মতো কোর্স। জে.ডি. স্যালিঞ্জারের The Catcher in the Rye উপন্যাসটি ছিল সবার প্রিয়। উপন্যাসের নায়ক আমাদের বয়সী একজন কৈশোর পেরোনো তরুণ, যে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে অস্থির ও উত্তাল সময় কাটাচ্ছে। তার বয়সসুলভ অপরিপক্বতা, রাগ-ক্ষোভ, অনিরাপদবোধ, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, সমবয়সী ও বয়স্কদের কাছে হেনস্থার শিকার হওয়া, আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগা জীবনের সাথে আমাদের অনেকেরই ব্যক্তিজীবনের মিল চরিত্রটিকে আরও আপন করে তুলেছিল। ফকরুল স্যার খুব দক্ষতার সাথে উপন্যাসটিকে জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। স্যারের রসবোধ, অমায়িক হাসি আর ভাষার প্রাঞ্জলতা প্রতিটি টেক্সটকে করে তুলতো মোহনীয়। স্যারের বিশেষ প্রীতি ছিল বিভিন্ন সাহিত্যতত্ত্বের প্রতি। তিনি নিজে উত্তর-উপনিবেশবাদী তত্ত্বের একজন স্কলার, দেশে-বিদেশে সমাদৃত বিশেষজ্ঞ। তত্ত্বকে তিনি দেখেন পৃথিবীকে দেখার জানালা হিসেবে। ভিন্ন ভিন্ন জানালা দিয়ে যেমন একই দৃশ্যকে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখা যায়, তেমনি এক একটি তত্ত্বের বাস্তবতাকে বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয়। তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যে বিশাল সম্ভাবনা, তিনি চাইতেন আমরা সেটা উপলব্ধি করি।
এ তো গেল শিক্ষক ফকরুল আলমের গুণপনা। ব্যক্তি ফকরুল আলমও সমধিক জনপ্রিয় তাঁর উদারতা ও ছাত্রবাৎসল্যের জন্য। অনুমতিসাপেক্ষে তাঁর অফিস ও শ্রেণিকক্ষে আমাদের প্রায় অবাধ যাতায়াত ছিল। বিভিন্ন সময় আমরা স্যারের কাছে যেতে পারতাম ক্যারিয়ার, এমনকি ব্যক্তিগত বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য। তিনি আন্তরিকভাবেই আমাদের পরামর্শ দিতেন। মনে আছে, মাস্টার্সের শেষ সেমিস্টারে আমি অনুবাদের কোর্স না নিলেও তাঁর সদয় অনুমতি পেয়েছিলাম অন্তত ক্লাস লেকচার শোনার জন্য। বলা সমীচীন, পরবর্তীকালে আমি অনুবাদক হিসেবে বেশ কিছু কাজ করেছি, পেশাদারভাবে ও বিনি পয়সায়। অনুবাদক হিসেবে স্যারের অভিজ্ঞান ও দক্ষতার ছিটেফোঁটা আমার ওপরও পড়েছিল বৈকি সে কোর্সে ক্লাস করার সুবাদে। স্যার আমাদের লেখালেখি করার ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতেন, চোখ রাখতেন আমাদের ফেসবুক পোস্টেও। আমাদের বন্ধু সাফি উল্লাহ (বর্তমানে বিশ্বদ্যিালয় শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক) তার প্রথম বইয়ের কাজ করছিল সে মাস্টার্সে থাকতে। স্যার তার কাজের ভূয়সী প্রশংসাই করেননি আমাদের কাছে, সে বইয়ের ব্লার্বও লিখে দিয়েছিলেন। সে সাহস থেকে কিছুদিন আগে স্যারকে আমার প্রথম বইপ্রকল্পের কথা জানিয়ে ব্লার্ব লেখার অনুরোধ জানাতেই তিনি সদয় সম্মতি প্রদান করেন। ছাত্রজীবনে আমার বোম্বাস্টিক শব্দবহুল গদ্যকে “রসকসহীন” ও “কাষ্ঠল” বললেও এখন অবশ্য ভাল লিখি বলে মৌখিক সনদ দিয়েছেন, যা আমার জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি।
এবার আবার প্রথম অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ফকরুল আলম দীর্ঘদিন শিক্ষকতা ও একাডেমিক চর্চা করেছেন। বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন, দেশে-বিদেশে পণ্ডিতমহলে সমাদর পেয়েছেন। কিন্তু, তাঁর কাজের বাহন ইংরেজি, যথারীতি আন্তর্জাতিক মানের ইংরেজি। ফলে ইংরেজি কমজানা, সাধারণ বাঙালি পাঠকদের কাছে তাঁর লেখা পৌঁছায়নি। তাঁর বেশকিছু প্রবন্ধ ও নিবন্ধ আছে যা উপযুক্ত হাতের অনুবাদে পৌঁছাতে পারে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে। আর তাতে একজন শক্তিমান বুদ্ধিজীবীকে আরও নিবিড়ভাবে আবিষ্কার করতে পারবেন বাংলাভাষী জনগণ। পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর থেকে বেরিয়ে তিনি হয়ে উঠবেন জননন্দিত, বহুলপঠিত লেখক ও বুদ্ধিজীবী।
পরিশেষে, ২০ জুলাই ২০২২ তাঁর ৭১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ড. ফকরুল আলম, আমাদের প্রিয় ফকরুল স্যারের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। তিনি যেন আজীবন সৃষ্টিশীল ও কর্মোদ্যমী থেকে আমাদের দেশ ও জাতিকে আলোকিত করে যেতে পারেন, এটাই প্রার্থনা।