বড়দের রূপকথা

রাজা হতে হলে

শাহ্জাহান কিবরিয়া

সৃষ্টির আদিকালে পৃথিবীতে কেবল একটি মাত্র দেশ ছিল। সে দেশে সব মানুষ এক সঙ্গে বাস করতো। সবাই এক জাতির মানুষ। সে জাতির নাম মানবজাতি। তাদের ধর্ম এক- মানবধর্ম। নারী পুরুষ সবাই সমান অধিকার এবং সমান মর্যাদা ভোগ করতো। কেউ ছোট বড়ো ছিল না। কর্ম ছিল তাদের যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। সবাই মিলে কৃষিকাজ করতো, খাদ্য উৎপাদন করতো। পুরুষরা দলবদ্ধ হয়ে শিকারে যেত। মেয়েরা শিকারে যেত না। তারা ঘরসংসার সামলাতো, সন্তান লালন পালন করতো। মেয়েদের এসব কাজেরও মূল্যায়ন করা হতো। উৎপাদিত ফসল এবং শিকারের পশুপাখি চাহিদা অনুযায়ী প্রত্যেকে ভাগ করে খেত। একে অপরকে ঠকাতো না, ঠকাবার চেষ্টাও করতো না।

দেশবাসীর একজন রাজা থাকতো। সবাই মিলে তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে জ্ঞানী, অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান এবং সাহসী ব্যক্তিকে রাজা নির্বাচন করতো। রাজা দেশবাসীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন। রাজাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য একটি মন্ত্রী পরিষদ বা উপদেষ্টামণ্ডলী থাকতো। তারাও একইভাবে নির্বাচিত হতো। রাজার নির্দেশ মন্ত্রী এবং রাজকর্মচারীরা মেনে চলতো। রাজা মন্ত্রীদের দায়িত্ব বণ্টন করে দিতেন। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাজা এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না। রাজা জানতেন, মানুষ মাত্রই ভুল করে। একজনের ভুলের জন্য গোটা জাতির ক্ষতি হয় এমন কাজ রাজা করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।’ দশজনের মতামত নিয়ে কাজ করার সুবিধা হলো, দশজনের মাথায় দশ করমের চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধি থাকে। আলাপ আলোচনা শেষে সবাই মিলে একমত হলে সে অনুযায়ী কাজ হতো। পশু শিকার কিংবা বিপদ আপদে রাজা সব সময় সবার সামনে থাকতেন। পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল জনগণের সুখ শান্তির উৎস। একই গোত্রভুক্ত থাকার ফলে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ বা বিবাদ ছিল না। তারা এক সঙ্গে নাচতো, গান গাইতো, ঢোল বাজাতো এবং বাঁশি বাজাতো। জাতীয় ঐক্যই ছিল তাদের প্রধান শক্তি।

ক্রমে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। দেশের লোকসংখ্যাও বাড়তে থাকে। এক এলাকায় সবার স্থান সংকুলান হয় না। ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। আরো ভালো থাকার জন্য কিছু মানুষ নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যেতে থাকে। তারা এত দূরে সরে যায় যে, একে অপরের খোঁজখবরও ঠিকমতো নিতে পারে না।

সমস্যা সমাধানের জন্য রাজা একদিন মন্ত্রী ও দেশের সব মানুষকে নিয়ে এক সভা করলেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা তাদের মতামত জানালো। সকলের অসুবিধার কথা শুনে রাজা বললেন, আমি পৃথিবীকে পাঁচটি দেশে ভাগ করে দেব। এই পাঁচ দেশে পাঁচ জন রাজা থাকবে। তারা তাদের প্রজাদের সুখসুবিধা দেখবে। আমার বয়স হয়েছে। আমার মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরাও বৃদ্ধ হয়েছেন। আমরা অবসরে যাবো। নতুন রাজারা তাদের দেশ চালাবেন। তোমরা পাঁচজন রাজার নাম প্রস্তাব করো।

প্রজারা আলোচনায় বসলো। সে সময় এক পরিবারে পাঁচ ভাই ছিল। বুদ্ধিমান, জ্ঞানী এবং কর্মঠ হিসাবে দেশে তাদের খুব সুনাম ছিল। সবাই রাজা হিসাবে সেই পাঁচ ভাইয়ের নাম বলল। এরা হচ্ছে ইন্দ্রজীত, বিশ^জীত, সমরজীত, রণজীত এবং চন্দ্রজীত।

রাজাসহ উপস্থিত সকলে পাঁচ ভাইকে অভিনন্দন জানালো। রাজা দেশবাসীকে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে পাঁচ দেশে পাঠিয়ে দিলেন। পাঁচ ভাইয়ের নামানুসারে পাঁচ রাজ্যের নামকরণ করা হলো।

এবার বিদায়ের পালা। আসন্ন বিচ্ছেদ ব্যথায় দেশবাসী কাতর হয়ে পড়লো। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো। কতদিন তারা সুখ-দুঃখে একসঙ্গে কাটিয়েছে। সহজে কি কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারে! আপন জনকে ছেড়ে যাওয়া যে কত কষ্টকর এই প্রথম তারা তা উপলব্ধি করলো। উপায় নেই, যেতে তাদের হবেই। বড়ো সুখের আশায় ছোট সুখকে বিসর্জন দিতে হয়।

ইন্দ্রজীত আর বিশ^জীতের রাজ্য ছিল পাশাপাশি। বেশ সুখেই তাদের দিন কাটছিলো। রাজা সুখী, প্রজারাও সুখী। কিন্তু মানুষের এই সুখ শয়তানের সহ্য হলো না। সে সব সময় মানুষে মানুষে বিরোধ বাঁধিয়ে দেয়। ‘শয়তান হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’। দুর্বল চিত্তের লোকের উপর সে ভর করে বেশি। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বিশ^জীত একটু আরামে আয়াসে থাকতে ভালোবাসতো। পৃথক রাজ্য পেয়ে সে ভোগ বিলাসে মত্ত হলো। প্রজাদের খোঁজ খবর বিশেষ নেয় না। কাজ না করে খেয়ে খেয়ে দিন দিন মোটা হতে থাকে। রাজকর্মচারী এবং মন্ত্রীদের হাতে রাজ্যভার ছেড়ে দিয়ে আরাম আয়াসে দিন কাটাতে থাকে। এই সুযোগে মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীরা দেশবাসীর উপর অত্যাচার চালায়, তাদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে টাকাপয়সা আদায় করে। ফলে অবিচার আর অনাচারে দেশ ভরে যায়। দেশ থেকে শান্তিশৃঙ্খলা বিদায় নেয়। প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অলস রাজা কি করবে ভেবে পায় না।

শয়তান এতদিন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে একদিন সেজেগুজে বিশ^জীতের কাছে এসে হাজির। জনগণের অসন্তোষের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য রাজা বিশ^জীত শয়তানের সাহায্য চাইলো। শয়তান দেশের সব খবর জানতো। শয়তানের বুদ্ধিতেই আমলা ও মন্ত্রীরা দেশে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। শয়তান বললো, প্রজাদের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতে হবে। আপনি শীঘ্রই আপনার বড়ো ভাই রাজা ইন্দ্রজীতের রাজ্য আক্রমণ করুন। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে প্রজারা চুপ করে যাবে। তখন তার দেশটাও আপনার দখলে আসবে।

রাজা হবার পর বিশ^জীত কাজ না করে অলস হয়ে পড়েছিল। সবাই জানে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। অলসরা স্বভাবে লোভী হয়। পররাজ্য দখলের লোভে বিশ^জীত শয়তানের পরামর্শে ইন্দ্রজীতের রাজ্য আক্রমণ করে বসলো।

রাজা ইন্দ্রজীত সুশাসক, বুদ্ধিমান আর সাহসী ছিলেন। তিনি প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন। প্রজারাও তাঁকে খুব ভালোবাসতো। তারা রাজার খুব অনুগত ছিল।

ইন্দ্রজীতের কোনো সেনাবাহিনী ছিল না। সেনাবাহিনীর কোনো দরকারও তাঁর ছিল না। সেনাবাহিনী রাখা হয় শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য। রাজার কোনো শত্রু ছিল না। তিনি কাউকে শত্রু ভাবতে পারতেন না। পাশের রাজ্যের রাজা তাঁর সহোদর। বিশ^জীত কখনো তাঁর রাজ্য আক্রমণ করতে পারে এ কথা তিনি ভাবতে পারেননি। তাঁর প্রজারা ছিল খুব বিশ^স্ত। তাদের উপর তিনি সবসময় ভরসা করতেন। তিনি জানতেন, প্রজারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ দেশের ক্ষতি করতে পারবে না।

যুদ্ধ শুরু হলে দেশবাসী প্রাণপণ যুদ্ধ করে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করলো এবং রাজা ইন্দ্রজীত ও দেশকে রক্ষা করলো। উভয় পক্ষের বেশ লোক হতাহত হয়। বিশ^জীতের লোক বেশি ক্ষয় হয়। পরাজিত হয়ে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সে পালিয়ে যায়। আক্রমণকারীরা অন্যায় যুদ্ধ করে বলে তাদের ক্ষতি হয়ে বেশি। দেশ রক্ষার জন্য যারা যুদ্ধ করে তাদের ক্ষতি হয় কম। তাদের হৃদয়ে থাকে দেশপ্রেমের প্রেরণা।

ইন্দ্রজীতের লোকেরা যুদ্ধে জয়লাভ করে বিশ^জীতের রাজ্য দখল করতে চাইলে ইন্দ্রজীত তাদের বাধা দিয়ে বললেন, পররাজ্য দখল করার ইচ্ছা আমার নেই। আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম। আক্রমণ প্রতিহত করেছি। আত্মরক্ষা করেছি। তোমাদের নিয়ে আমি সুখে থাকতে চাই। অন্যের রাজ্যের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। লোভ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।

শত্রুদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য রাজা ইন্দ্রজীত তাঁর প্রজাদের সাহসের প্রশংসা করলেন। তিনি বললেন, আমাদের একটি সুদক্ষ সেনাদল থাকলে আমাদের এত লোক প্রাণ হারাতো না। আমাদের একটি সেনাবাহিনী থাকা দরকার।

ইন্দ্রজীতের কথা শুনে প্রজাদের একটি বড়ো অংশ তাঁর কথার বিরোধিতা করে বললো, সৈন্যরা অস্ত্রধারী হয়। অস্ত্রকে বিশ^াস করা যায় না। অস্ত্র দুই ধারে কাটে। অস্ত্রধারী বিশ^াসঘাতক হলে দেশের সমূহ বিপদের আশংকা থাকে। আমরা সকল দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আলাদা অস্ত্রধারী সেনাবাহিনী দরকার নেই।

কথাটা রাজার মনঃপুত হলো না। তিনি জানেন, অস্ত্র দিয়েই অস্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু তিনি দেশবাসীর কথা মেনে নিলেন। কেননা, প্রজাদের মতামত নিয়েই রাজাকে রাজ্য শাসন করতে হয়।

পরাজিত হয়েও বিশ^জীতের শিক্ষা হলো না। শয়তান তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললো, যুদ্ধে হার-জিত থাকবেই। “একবার না পারিলে দেখ শতবার”। আপনাকে এত সকাল হতাশ হলে চলবে না। আপনার নাম বিশ^জীত। বিশ^ আপনাকে জয় করতেই হবে। এরপর বাকি তিন ভাইয়ের রাজ্যও জয় করতে হবে। সে সক্ষমতা আপনার আছে।

লোভী এবং অলস মানুষ কখনো নিজের সক্ষমতা যাচাই করতে পারে না। রাজা বিশ^জীত শয়তানের কুপরামর্শে আরো উৎসাহিত হলো। শয়তান বলে, সম্মুখ যুদ্ধে আপনি কখনো রাজা ইন্দ্রজীতকে পরাজিত করতে পারবেন না। আপনার সৈন্যরা পেশাদারী। তারা বেতনভোগী কর্মচারী। ইন্দ্রজীতের প্রজাদের রয়েছে প্রগাঢ় দেশপ্রেম। অস্ত্র দিয়ে কারো দেশপ্রেমকে কিছু দিনের জন্য ঠেকিয়ে রাখা যায়, পরাজিত করা যায় না, বিশেষ করে সে জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে। যুদ্ধ জয়ের জন্য আপনাকে শক্তির বদলে কৌশলী হতে হবে। ইন্দ্রজীতের প্রজাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে হবে। দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে বিনা যুদ্ধেও পরাজিত করা যায়। আপনারও কোনো লোকক্ষয় হবে না।

শয়তানের কথা বিশ^জীতের মনে ধরলো। শয়তান বলতে থাকে, লোভ হলো সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র। লোভের চেয়ে বড়ো অস্ত্র আজও আবিষ্কৃত হয়নি। লোভের কাছে কোনো মানুষ পরাজিত হয়নি এমন দৃষ্টান্ত বিরল। আপনি গোপনে আপনার কিছু বিশ^স্ত লোককে প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে ইন্দ্রজীতের দেশে পাঠিয়ে দিন। অর্থের লোভে, বিত্তের লোভে ইন্দ্রজীতের প্রজারা তাদের রাজার বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে আপনার পক্ষ হয়ে কাজ করবে।

শয়তানের কুপরামর্শে কাজ হলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিশ^জীতের গুপ্তচরেরা প্রচুর ধনরতœ দিয়ে ইন্দ্রজীতের প্রজাদের একটি বড়ো অংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। তারা দেশের ক্ষতি সাধান করতে থাকে, ইন্দ্রজীতের নিন্দা করে গুজব ছড়িয়ে প্রজাদের কানো ভারি করতে থাকে। দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই তাদের কাছে বড়ো হয়ে ওঠে। ইন্দ্রজীত তার এতকালের বিশ^স্ত লোকদের এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পান না। যে মানুষগুলোর উপর তিনি এতদিন ভরসা করতেন আজ তারা তাঁর জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে!

রাজা ইন্দ্রজীত যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন তখন একদিন বিশ^জীত লোকজন নিয়ে আবার তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলো। এবার ইন্দ্রজীতের সাহায্যে কেউ এগিয়ে এলো না। গোটা জাতি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। রাজা অসহায় হয়ে পড়েন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন, কেউ কোথাও নেই। শত্রু সৈন্যের সহায়তায় বিশ^াসঘাতকের দল রাজা ইন্দ্রজীতকে সপরিবারে হত্যা করে এবং একই সঙ্গে দেশব্যাপী চালাতে থাকে হত্যাকা- ও লুটতরাজ। চারিদিকে অন্যায়, অবিচার আর অত্যাচারে গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যায় দেশ।

অত্যাচারিত, নির্যাতীত মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন তাদের মধ্যে জ¦লে ওঠে প্রতিরোধের, প্রতিশোধের আগুন। দীর্ঘদিন পর রাজা ইন্দ্রজীতের একমাত্র জীবিত বংশধর গুরুজীতের নেতৃত্বে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ^জীতের বিরুদ্ধে শুরু করে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এবারও পরাজিত হয়ে বিশ^জীত তার দলবল নিয়ে ইন্দ্রজীতের রাজ্য ছেড়ে পালায়। পালাবার সময় শয়তানের পরামর্শে বিশ^জীত তার কিছু গুপ্তচরকে ইন্দ্রজীতের রাজ্যে রেখে যায়। গুপ্তচরের দল ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রজাদের সাথে মিশে যায় এবং সুযোগ বুঝে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

শত্রুরা বিতাড়িত হবার পর এবার দেশ গড়ার পালা। নতুন রাজা গুরুজীত জানগণকে সাথে নিয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দেশবাসীও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে দেশে সুখ সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে। খুব অল্প সময়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের ব্যাপক উন্নতি দেখে অন্যান্য দেশের রাজারা অবাক হয়। গুরুজীতের সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তাঁর সুশাসনে দেশে সুখ শান্তি ফিরে আসে।

পৃথিবীতে মানুষ সুখে শান্তিতে বাস করুক এটা কখনো শয়তান চায় না। তার কাজ হলো মানুষের ক্ষতি করা। সে একদিন বিশ^জীতকে বললো, গুরুজীতকে ধ্বংস করতে হলে আরো কৌশলী হতে হবে। তার জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে হবে। জনপ্রিয়তা হারিয়ে কোনো রাজা ক্ষমতায় থাকতে পারে না। বিশ^জীত বললো, সেটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। শয়তান বললো, এবার আপনাকে আর যুদ্ধ করতে হবে না। রাজা গুরুজীতের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করতে হবে। যোগ্যতার অতিরিক্ত গুণকীর্তন করলে মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। আপনার গুপ্তচরদের প্ররোচনায় গুরুজীতের ঘনিষ্ঠরা এ কাজ করবে। তারা প্রকাশ্যে রাজার প্রশংসা করবে আর গোপনে তার ক্ষতি সাধন করবে। অতি প্রশংসায় রাজা বিভ্রান্ত হবে, তার বিচার বুদ্ধিও লোপ পাবে। ভুল সংশোধনের সুযোগ পাবে না। প্রশংসা পাওয়ার লোভ মানুষের জন্মগত। স্বাভাবিক প্রশংসায় মানুষ ভালো কাজের উৎসাহ পায়। অতি প্রশংসা মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। একে স্তুতি বলে। মানুষ তখন অহংকারী হয় এবং অহংকার পতনের মূল।

গুরুজীতের মন ভালো নেই। তাঁর মনে পড়ে রাজা ইন্দ্রজীতের কথা। তাঁর অতি বিশ^স্তরা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। গুরুজীত ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান। একদিকে কিছু লোক অকারণে তাঁর স্তুতি করে, অপরদিকে দেশে অনাচার বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজকোষাগার থেকে অর্থ লোপাট হয়। ভেজাল খাদ্য দ্রব্য ও ঔষধে দেশ ভরে যায়। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিছু লোক অতিরিক্ত ধনী হতে থাকে। অপরাধীরা ধরা পড়ে না। স্তাবকের দলে রাজসভা পরিপূর্ণ থাকে। তাদের ভিড়ে ভালো মানুষেরা রাজার কাছে আসতে পারে না। তারা দূরে সরে যায়। রাজার ভুলভ্রান্তি সংশোধনের পথ রুদ্ধ হতে থাকে।

গুরুজীত বুঝতে পারেন একটা বিপদ আসন্ন। বিপদ কোন্ দিক থেকে আসছে তা স্পষ্ট নয়। রাজা ইন্দ্রজীত তাঁর চেয়ে অনেক যোগ্য, সাহসী ও জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও আত্মরক্ষা করতে পারেননি। তাঁর করুণ পরিণতির কথা মনে পড়লে গুরুজীতের মন বিষণœ হয়ে পড়ে। তাঁর চারপাশে এত লোক থাকা সত্ত্বেও তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করেন। নিজেকে সব সময় একা মনে হয়। তিনি কার কাছে আশ্রয় চাইবেন? মনে হয় তাঁর কেউ নেই। এই পৃথিবীতে তিনি সম্পূর্ণ একা। এসব ভাবতে ভাবতে রাজা একদিন বিকেলে রাজউদ্যানে পায়চারী করছেন এমন সময় তিনি দেখতে পান, এক জটাধারী সন্ন্যাসী উদ্যানের এক প্রান্তে বসে ধ্যান করছেন। তিনি সন্ন্যাসীর কাছে যেতেই সন্ন্যাসী ধ্যান ভঙ্গ করে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, রাজা আপনি কী ভাবছেন তা আমি জানি। রাজা ইন্দ্রজীতের করুণ পরিণতির জন্য তিনি নিজেই দায়ী ছিলেন। শত্রুকে মিত্র এবং মিত্রকে শত্রু ভাবলে ধ্বংস অনিবার্য। বোকার মতো প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তিনি ভালো কাজ করেননি। তিনি নিজের জীবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। গুরুজীত বললেন, রাজা ইন্দ্রজীত খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি প্রজাদের ভালোবাসতেন, তাদের বিশ^াস করতেন। আপনারাই তো বলেন, মানুষের উপর বিশ^াস হারানো পাপ। সন্ন্যাসী বললেন, প্রত্যেক মানুষের প্রধান ও প্রাথমিক কর্তব্য নিজেকে রক্ষা করা। যে লোক নিজেকে রক্ষা করতে পারে না সে অপরকে রক্ষা করবে কেমন করে। তাদের বাঁচাবার জন্য নিজের বেঁচে থাকা জরুরি ছিল। মানুষ যখন বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পায় না, তখন সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। রাজার জীবন সার্থক ছিল। এ জন্যে প্রত্যেক মানুষের সার্থক জীবন কাম্য হওয়া উচিত। তবে তাঁর জানা উচিত ছিল, পরাজিত শত্রু সব সময় প্রতিহিংসা পরায়ণ ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়। আপনি আজ দেশকে উন্নতির যে পর্যায়ে এনেছেন রাজা ইন্দ্রজীত বেঁচে থাকলে তা অনেক আগেই সম্পন্ন করতে পারতেন। এতগুলো বছর মানুষকে দুঃখকষ্ট আর নির্যাতন ভোগ করতে হতো না। যে আত্মত্যাগ মানুষের কল্যাণে আসে তা ভালো, আর যে আত্মত্যাগ মানুষের কষ্ট বাড়ায় তা কারো কাম্য হতে পারে না। যুদ্ধ জয়কে স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে। রাজাকে দেশে সুশাসনের জন্য কঠোর এবং নির্মোহ হতে হয়। এতে অনেকের স্বার্থে আঘাত লাগে। তারা ক্ষুব্ধ হয়। তাদের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা প্রবল হয়। তাই রাজার নিরাপত্তা বিশেষ জরুরি। বেশি আবেগপ্রবণ হওয়া রাজাকে মানায় না। রাজার চোখে জল বেমানান। এ জন্যে রাজা আর প্রজায় এত ব্যবধান।

গুরুজীত বললেন, আমাকে কী করতে হবে?

সন্ন্যাসী বললেন, বিধাতা মানুষ সৃষ্টির সময় প্রত্যেক মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য তার উপযোগী সক্ষমতা দান করে থাকেন। রাজাকে রাজার উপযোগী, প্রজাকে প্রজার উপযোগী। এই সক্ষমতার সদ্ব্যবহার করলে কোনো অঘটন ঘটেনা। রাজার বেঁচে থাকার উপর আনেক মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। এজন্য রাজাকে সর্ব্বোচ্চ নিরাপত্তা নিতে হয়। রাজার ভালো মন্দের উপর দেশের মানুষের ভালো-মন্দ নির্ভর করে। প্রজাকে রক্ষা করা রাজার ধর্ম। প্রজার প্রতি রাজার দরদকে কেউ যেন তার দুর্বলতা না ভাবে। প্রজার ভালোর জন্য আপনি কঠোর হবেন, কিন্তু নির্মম বা নিষ্ঠুর হবেন না। রাজার সুশাসনের সবচেয়ে বড়ো বাধা তার বিশেষ সুবিধাভোগী মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীরা। তাদের স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলে তারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা দেশপ্রেমিক বা জনদরদী না হলে দেশে সুশাসন আসবে না। তাদের বেশিরভাগ শয়তানের দ্বারা প্রভাবিত। শয়তানের প্ররোচণাতেই পৃথিবীতে যত অপকর্ম হয়। চাটুকার মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীদের সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকবেন।

গুরুজীত বললেন, আমি প্রজাদের খুব ভালোবাসি। সব সময় তাদের মঙ্গল কামনা করি।

সন্ন্যাসী বললেন, রাজাকে সব সময় প্রজাদের দুঃখ কষ্টের অংশীদার হতে হয়, প্রজাদের আস্থা অর্জন করতে হয়। তাদের আস্থা একবার নষ্ট হলে তা পুনরুদ্ধারের সুযোগ থাকে না। জনপ্রিয়তায় বিভ্রান্ত হবেন না। জনপ্রিয়তা আর আস্থা এক নয়। লক্ষ্যে স্থির থেকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে মানুষ কখনো পরাজিত হয় না।

গুরুজীত বললেন, আমি আমার সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠা দিয়ে প্রজাদের আস্থা ধরে রাখবো। আস্থাহীন রাজার রাজ্য শাসনের অধিকার থাকে না।

সন্ন্যাসী বললেন, রাজা হচ্ছেন জাতির বাতিঘর। রাজা ইন্দ্রজীতের মতোই আপনাকে গোটা জাতির স্বপ্নকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। আপনার পিছুটান নেই, আপনার হারাবার কিছু নেই। আপনি পারবেন। যার হারাবার ভয় থাকে না, সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। সে কারো কাছ থেকে কোনো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করে না। বিবেকবান মানুষেরা আত্মবিশ^াসী হয়। গভীর আত্মবিশ^াস একজন মানুষকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যায়। কিন্তু অহংকার মানুষের আত্মবিশ^াসে ফাটল ধরিয়ে দেয়। এই বলে সন্ন্যাসী রাজার বাম বাহুতে একটি রক্ষাকবচ বেঁধে দিয়ে বললেন, আত্মবিশ^াস মানুষকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে। তারপর সন্ন্যাসী নির্দেশের সুরে রাজাকে বললেন, আগামী তিন দিন আপনি আত্মগোপনে থাকবেন। কাক-পক্ষীও যেন আপনার খোঁজ না পায়। আপনি জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান রাজা। আপনাকে আমার আর বলার কিছু নেই। আত্মগোপন শেষে তিন দিন পর আপনি রাজদরবারে ফিরে এসে যে সিদ্ধান্ত নেবেন সে অনুযায়ী কাজ করবেন। রক্ষা কবচটি কখনো আপনার হাত থেকে খুলবেন না। আপনার বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, বিবেক এবং অভিজ্ঞতা আপনাকে নতুন পথের সন্ধান দেবে। শত্রুকে কখনো দুর্বল ভাববেন না। একজন আত্মসচেতন মানুষ মনের আয়নায় তার ভবিষ্যত দেখতে পায়। কোনো একক সিদ্ধান্ত নেবার আগে প্রজাদের মনোভাব জেনে নেবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, আপনার পতন আপনার হাতে। বিবেকের বিপক্ষে কাজ করলে আপনার পতন অনিবার্য। আপনার হৃদয়ে সব সময় একজন সাধারণ প্রজার অনুভুতি ধারণ করবেন। চাটুকারের কথায় আস্থা না রেখে সমালোচকের কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন।

সন্ন্যাসীর পরামর্শ অনুযায়ী রাজা গুরুজীত আত্মগোপনে চলে গেলেন। সন্ন্যাসী রটিয়ে দিলেন, রাজা গুরুজীত বিশ^াসঘাতক প্রহরীদের হাতে নিহত হয়েছেন। রাজপ্রাসাদে কেউ বেঁচে নেই।

রাজা নিহত হয়েছেন শুনে মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীসহ রাজসভার লোকজন ভয়ে পালাতে শুরু করে। প্রজারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। রাজার সাহায্যে কেউ এগিয়ে এলো না।

তিন দিন পর গুরুজীত রাজসভায় ফিরে এলেন। তিনি দেখেন, রাজসভা জনশূন্য। কেউ কোথাও নেই। রাজা বিস্মিত হলেন। মানসিক আঘাত পেলেন। কিন্তু ভেঙ্গে পড়লেন না। রক্ষাকবচটি স্পর্শ করে সিংহাসনে বসলেন। সন্ন্যাসীর সব কথা স্মরণ করলেন। রাজা হতে হলে তাকে রাজার মতো রাজা হতে হবে। শত্রু মিত্র চিনতে হবে। লক্ষ্যে স্থির থেকে তাকে প্রজাদের কল্যাণে নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

বড়দের রূপকথা

রাজা হতে হলে

শাহ্জাহান কিবরিয়া

image

সৃষ্টির আদিকালে পৃথিবীতে কেবল একটি মাত্র দেশ ছিল। সে দেশে সব মানুষ এক সঙ্গে বাস করতো। সবাই এক জাতির মানুষ। সে জাতির নাম মানবজাতি। তাদের ধর্ম এক- মানবধর্ম। নারী পুরুষ সবাই সমান অধিকার এবং সমান মর্যাদা ভোগ করতো। কেউ ছোট বড়ো ছিল না। কর্ম ছিল তাদের যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। সবাই মিলে কৃষিকাজ করতো, খাদ্য উৎপাদন করতো। পুরুষরা দলবদ্ধ হয়ে শিকারে যেত। মেয়েরা শিকারে যেত না। তারা ঘরসংসার সামলাতো, সন্তান লালন পালন করতো। মেয়েদের এসব কাজেরও মূল্যায়ন করা হতো। উৎপাদিত ফসল এবং শিকারের পশুপাখি চাহিদা অনুযায়ী প্রত্যেকে ভাগ করে খেত। একে অপরকে ঠকাতো না, ঠকাবার চেষ্টাও করতো না।

দেশবাসীর একজন রাজা থাকতো। সবাই মিলে তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে জ্ঞানী, অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান এবং সাহসী ব্যক্তিকে রাজা নির্বাচন করতো। রাজা দেশবাসীর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন। রাজাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য একটি মন্ত্রী পরিষদ বা উপদেষ্টামণ্ডলী থাকতো। তারাও একইভাবে নির্বাচিত হতো। রাজার নির্দেশ মন্ত্রী এবং রাজকর্মচারীরা মেনে চলতো। রাজা মন্ত্রীদের দায়িত্ব বণ্টন করে দিতেন। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও রাজা এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না। রাজা জানতেন, মানুষ মাত্রই ভুল করে। একজনের ভুলের জন্য গোটা জাতির ক্ষতি হয় এমন কাজ রাজা করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ।’ দশজনের মতামত নিয়ে কাজ করার সুবিধা হলো, দশজনের মাথায় দশ করমের চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধি থাকে। আলাপ আলোচনা শেষে সবাই মিলে একমত হলে সে অনুযায়ী কাজ হতো। পশু শিকার কিংবা বিপদ আপদে রাজা সব সময় সবার সামনে থাকতেন। পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসা ছিল জনগণের সুখ শান্তির উৎস। একই গোত্রভুক্ত থাকার ফলে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ বা বিবাদ ছিল না। তারা এক সঙ্গে নাচতো, গান গাইতো, ঢোল বাজাতো এবং বাঁশি বাজাতো। জাতীয় ঐক্যই ছিল তাদের প্রধান শক্তি।

ক্রমে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বছরের পর বছর পার হয়ে যায়। দেশের লোকসংখ্যাও বাড়তে থাকে। এক এলাকায় সবার স্থান সংকুলান হয় না। ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। আরো ভালো থাকার জন্য কিছু মানুষ নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যেতে থাকে। তারা এত দূরে সরে যায় যে, একে অপরের খোঁজখবরও ঠিকমতো নিতে পারে না।

সমস্যা সমাধানের জন্য রাজা একদিন মন্ত্রী ও দেশের সব মানুষকে নিয়ে এক সভা করলেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা তাদের মতামত জানালো। সকলের অসুবিধার কথা শুনে রাজা বললেন, আমি পৃথিবীকে পাঁচটি দেশে ভাগ করে দেব। এই পাঁচ দেশে পাঁচ জন রাজা থাকবে। তারা তাদের প্রজাদের সুখসুবিধা দেখবে। আমার বয়স হয়েছে। আমার মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরাও বৃদ্ধ হয়েছেন। আমরা অবসরে যাবো। নতুন রাজারা তাদের দেশ চালাবেন। তোমরা পাঁচজন রাজার নাম প্রস্তাব করো।

প্রজারা আলোচনায় বসলো। সে সময় এক পরিবারে পাঁচ ভাই ছিল। বুদ্ধিমান, জ্ঞানী এবং কর্মঠ হিসাবে দেশে তাদের খুব সুনাম ছিল। সবাই রাজা হিসাবে সেই পাঁচ ভাইয়ের নাম বলল। এরা হচ্ছে ইন্দ্রজীত, বিশ^জীত, সমরজীত, রণজীত এবং চন্দ্রজীত।

রাজাসহ উপস্থিত সকলে পাঁচ ভাইকে অভিনন্দন জানালো। রাজা দেশবাসীকে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে পাঁচ দেশে পাঠিয়ে দিলেন। পাঁচ ভাইয়ের নামানুসারে পাঁচ রাজ্যের নামকরণ করা হলো।

এবার বিদায়ের পালা। আসন্ন বিচ্ছেদ ব্যথায় দেশবাসী কাতর হয়ে পড়লো। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো। কতদিন তারা সুখ-দুঃখে একসঙ্গে কাটিয়েছে। সহজে কি কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে পারে! আপন জনকে ছেড়ে যাওয়া যে কত কষ্টকর এই প্রথম তারা তা উপলব্ধি করলো। উপায় নেই, যেতে তাদের হবেই। বড়ো সুখের আশায় ছোট সুখকে বিসর্জন দিতে হয়।

ইন্দ্রজীত আর বিশ^জীতের রাজ্য ছিল পাশাপাশি। বেশ সুখেই তাদের দিন কাটছিলো। রাজা সুখী, প্রজারাও সুখী। কিন্তু মানুষের এই সুখ শয়তানের সহ্য হলো না। সে সব সময় মানুষে মানুষে বিরোধ বাঁধিয়ে দেয়। ‘শয়তান হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’। দুর্বল চিত্তের লোকের উপর সে ভর করে বেশি। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বিশ^জীত একটু আরামে আয়াসে থাকতে ভালোবাসতো। পৃথক রাজ্য পেয়ে সে ভোগ বিলাসে মত্ত হলো। প্রজাদের খোঁজ খবর বিশেষ নেয় না। কাজ না করে খেয়ে খেয়ে দিন দিন মোটা হতে থাকে। রাজকর্মচারী এবং মন্ত্রীদের হাতে রাজ্যভার ছেড়ে দিয়ে আরাম আয়াসে দিন কাটাতে থাকে। এই সুযোগে মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীরা দেশবাসীর উপর অত্যাচার চালায়, তাদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে টাকাপয়সা আদায় করে। ফলে অবিচার আর অনাচারে দেশ ভরে যায়। দেশ থেকে শান্তিশৃঙ্খলা বিদায় নেয়। প্রজারা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অলস রাজা কি করবে ভেবে পায় না।

শয়তান এতদিন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সে একদিন সেজেগুজে বিশ^জীতের কাছে এসে হাজির। জনগণের অসন্তোষের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য রাজা বিশ^জীত শয়তানের সাহায্য চাইলো। শয়তান দেশের সব খবর জানতো। শয়তানের বুদ্ধিতেই আমলা ও মন্ত্রীরা দেশে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। শয়তান বললো, প্রজাদের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতে হবে। আপনি শীঘ্রই আপনার বড়ো ভাই রাজা ইন্দ্রজীতের রাজ্য আক্রমণ করুন। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে প্রজারা চুপ করে যাবে। তখন তার দেশটাও আপনার দখলে আসবে।

রাজা হবার পর বিশ^জীত কাজ না করে অলস হয়ে পড়েছিল। সবাই জানে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। অলসরা স্বভাবে লোভী হয়। পররাজ্য দখলের লোভে বিশ^জীত শয়তানের পরামর্শে ইন্দ্রজীতের রাজ্য আক্রমণ করে বসলো।

রাজা ইন্দ্রজীত সুশাসক, বুদ্ধিমান আর সাহসী ছিলেন। তিনি প্রজাদের খুব ভালোবাসতেন। প্রজারাও তাঁকে খুব ভালোবাসতো। তারা রাজার খুব অনুগত ছিল।

ইন্দ্রজীতের কোনো সেনাবাহিনী ছিল না। সেনাবাহিনীর কোনো দরকারও তাঁর ছিল না। সেনাবাহিনী রাখা হয় শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার জন্য। রাজার কোনো শত্রু ছিল না। তিনি কাউকে শত্রু ভাবতে পারতেন না। পাশের রাজ্যের রাজা তাঁর সহোদর। বিশ^জীত কখনো তাঁর রাজ্য আক্রমণ করতে পারে এ কথা তিনি ভাবতে পারেননি। তাঁর প্রজারা ছিল খুব বিশ^স্ত। তাদের উপর তিনি সবসময় ভরসা করতেন। তিনি জানতেন, প্রজারা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ দেশের ক্ষতি করতে পারবে না।

যুদ্ধ শুরু হলে দেশবাসী প্রাণপণ যুদ্ধ করে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করলো এবং রাজা ইন্দ্রজীত ও দেশকে রক্ষা করলো। উভয় পক্ষের বেশ লোক হতাহত হয়। বিশ^জীতের লোক বেশি ক্ষয় হয়। পরাজিত হয়ে অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সে পালিয়ে যায়। আক্রমণকারীরা অন্যায় যুদ্ধ করে বলে তাদের ক্ষতি হয়ে বেশি। দেশ রক্ষার জন্য যারা যুদ্ধ করে তাদের ক্ষতি হয় কম। তাদের হৃদয়ে থাকে দেশপ্রেমের প্রেরণা।

ইন্দ্রজীতের লোকেরা যুদ্ধে জয়লাভ করে বিশ^জীতের রাজ্য দখল করতে চাইলে ইন্দ্রজীত তাদের বাধা দিয়ে বললেন, পররাজ্য দখল করার ইচ্ছা আমার নেই। আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম। আক্রমণ প্রতিহত করেছি। আত্মরক্ষা করেছি। তোমাদের নিয়ে আমি সুখে থাকতে চাই। অন্যের রাজ্যের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। লোভ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।

শত্রুদের দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য রাজা ইন্দ্রজীত তাঁর প্রজাদের সাহসের প্রশংসা করলেন। তিনি বললেন, আমাদের একটি সুদক্ষ সেনাদল থাকলে আমাদের এত লোক প্রাণ হারাতো না। আমাদের একটি সেনাবাহিনী থাকা দরকার।

ইন্দ্রজীতের কথা শুনে প্রজাদের একটি বড়ো অংশ তাঁর কথার বিরোধিতা করে বললো, সৈন্যরা অস্ত্রধারী হয়। অস্ত্রকে বিশ^াস করা যায় না। অস্ত্র দুই ধারে কাটে। অস্ত্রধারী বিশ^াসঘাতক হলে দেশের সমূহ বিপদের আশংকা থাকে। আমরা সকল দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আলাদা অস্ত্রধারী সেনাবাহিনী দরকার নেই।

কথাটা রাজার মনঃপুত হলো না। তিনি জানেন, অস্ত্র দিয়েই অস্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু তিনি দেশবাসীর কথা মেনে নিলেন। কেননা, প্রজাদের মতামত নিয়েই রাজাকে রাজ্য শাসন করতে হয়।

পরাজিত হয়েও বিশ^জীতের শিক্ষা হলো না। শয়তান তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললো, যুদ্ধে হার-জিত থাকবেই। “একবার না পারিলে দেখ শতবার”। আপনাকে এত সকাল হতাশ হলে চলবে না। আপনার নাম বিশ^জীত। বিশ^ আপনাকে জয় করতেই হবে। এরপর বাকি তিন ভাইয়ের রাজ্যও জয় করতে হবে। সে সক্ষমতা আপনার আছে।

লোভী এবং অলস মানুষ কখনো নিজের সক্ষমতা যাচাই করতে পারে না। রাজা বিশ^জীত শয়তানের কুপরামর্শে আরো উৎসাহিত হলো। শয়তান বলে, সম্মুখ যুদ্ধে আপনি কখনো রাজা ইন্দ্রজীতকে পরাজিত করতে পারবেন না। আপনার সৈন্যরা পেশাদারী। তারা বেতনভোগী কর্মচারী। ইন্দ্রজীতের প্রজাদের রয়েছে প্রগাঢ় দেশপ্রেম। অস্ত্র দিয়ে কারো দেশপ্রেমকে কিছু দিনের জন্য ঠেকিয়ে রাখা যায়, পরাজিত করা যায় না, বিশেষ করে সে জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে। যুদ্ধ জয়ের জন্য আপনাকে শক্তির বদলে কৌশলী হতে হবে। ইন্দ্রজীতের প্রজাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে হবে। দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে বিনা যুদ্ধেও পরাজিত করা যায়। আপনারও কোনো লোকক্ষয় হবে না।

শয়তানের কথা বিশ^জীতের মনে ধরলো। শয়তান বলতে থাকে, লোভ হলো সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র। লোভের চেয়ে বড়ো অস্ত্র আজও আবিষ্কৃত হয়নি। লোভের কাছে কোনো মানুষ পরাজিত হয়নি এমন দৃষ্টান্ত বিরল। আপনি গোপনে আপনার কিছু বিশ^স্ত লোককে প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে ইন্দ্রজীতের দেশে পাঠিয়ে দিন। অর্থের লোভে, বিত্তের লোভে ইন্দ্রজীতের প্রজারা তাদের রাজার বিরুদ্ধে, দেশের বিরুদ্ধে আপনার পক্ষ হয়ে কাজ করবে।

শয়তানের কুপরামর্শে কাজ হলো। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিশ^জীতের গুপ্তচরেরা প্রচুর ধনরতœ দিয়ে ইন্দ্রজীতের প্রজাদের একটি বড়ো অংশকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলে। তারা দেশের ক্ষতি সাধান করতে থাকে, ইন্দ্রজীতের নিন্দা করে গুজব ছড়িয়ে প্রজাদের কানো ভারি করতে থাকে। দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থই তাদের কাছে বড়ো হয়ে ওঠে। ইন্দ্রজীত তার এতকালের বিশ^স্ত লোকদের এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পান না। যে মানুষগুলোর উপর তিনি এতদিন ভরসা করতেন আজ তারা তাঁর জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে!

রাজা ইন্দ্রজীত যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন তখন একদিন বিশ^জীত লোকজন নিয়ে আবার তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলো। এবার ইন্দ্রজীতের সাহায্যে কেউ এগিয়ে এলো না। গোটা জাতি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। রাজা অসহায় হয়ে পড়েন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন, কেউ কোথাও নেই। শত্রু সৈন্যের সহায়তায় বিশ^াসঘাতকের দল রাজা ইন্দ্রজীতকে সপরিবারে হত্যা করে এবং একই সঙ্গে দেশব্যাপী চালাতে থাকে হত্যাকা- ও লুটতরাজ। চারিদিকে অন্যায়, অবিচার আর অত্যাচারে গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যায় দেশ।

অত্যাচারিত, নির্যাতীত মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন তাদের মধ্যে জ¦লে ওঠে প্রতিরোধের, প্রতিশোধের আগুন। দীর্ঘদিন পর রাজা ইন্দ্রজীতের একমাত্র জীবিত বংশধর গুরুজীতের নেতৃত্বে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ^জীতের বিরুদ্ধে শুরু করে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এবারও পরাজিত হয়ে বিশ^জীত তার দলবল নিয়ে ইন্দ্রজীতের রাজ্য ছেড়ে পালায়। পালাবার সময় শয়তানের পরামর্শে বিশ^জীত তার কিছু গুপ্তচরকে ইন্দ্রজীতের রাজ্যে রেখে যায়। গুপ্তচরের দল ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রজাদের সাথে মিশে যায় এবং সুযোগ বুঝে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

শত্রুরা বিতাড়িত হবার পর এবার দেশ গড়ার পালা। নতুন রাজা গুরুজীত জানগণকে সাথে নিয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দেশবাসীও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে দেশে সুখ সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে। খুব অল্প সময়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের ব্যাপক উন্নতি দেখে অন্যান্য দেশের রাজারা অবাক হয়। গুরুজীতের সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তাঁর সুশাসনে দেশে সুখ শান্তি ফিরে আসে।

পৃথিবীতে মানুষ সুখে শান্তিতে বাস করুক এটা কখনো শয়তান চায় না। তার কাজ হলো মানুষের ক্ষতি করা। সে একদিন বিশ^জীতকে বললো, গুরুজীতকে ধ্বংস করতে হলে আরো কৌশলী হতে হবে। তার জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে হবে। জনপ্রিয়তা হারিয়ে কোনো রাজা ক্ষমতায় থাকতে পারে না। বিশ^জীত বললো, সেটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। শয়তান বললো, এবার আপনাকে আর যুদ্ধ করতে হবে না। রাজা গুরুজীতের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করতে হবে। যোগ্যতার অতিরিক্ত গুণকীর্তন করলে মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। আপনার গুপ্তচরদের প্ররোচনায় গুরুজীতের ঘনিষ্ঠরা এ কাজ করবে। তারা প্রকাশ্যে রাজার প্রশংসা করবে আর গোপনে তার ক্ষতি সাধন করবে। অতি প্রশংসায় রাজা বিভ্রান্ত হবে, তার বিচার বুদ্ধিও লোপ পাবে। ভুল সংশোধনের সুযোগ পাবে না। প্রশংসা পাওয়ার লোভ মানুষের জন্মগত। স্বাভাবিক প্রশংসায় মানুষ ভালো কাজের উৎসাহ পায়। অতি প্রশংসা মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। একে স্তুতি বলে। মানুষ তখন অহংকারী হয় এবং অহংকার পতনের মূল।

গুরুজীতের মন ভালো নেই। তাঁর মনে পড়ে রাজা ইন্দ্রজীতের কথা। তাঁর অতি বিশ^স্তরা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। গুরুজীত ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান। একদিকে কিছু লোক অকারণে তাঁর স্তুতি করে, অপরদিকে দেশে অনাচার বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজকোষাগার থেকে অর্থ লোপাট হয়। ভেজাল খাদ্য দ্রব্য ও ঔষধে দেশ ভরে যায়। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিছু লোক অতিরিক্ত ধনী হতে থাকে। অপরাধীরা ধরা পড়ে না। স্তাবকের দলে রাজসভা পরিপূর্ণ থাকে। তাদের ভিড়ে ভালো মানুষেরা রাজার কাছে আসতে পারে না। তারা দূরে সরে যায়। রাজার ভুলভ্রান্তি সংশোধনের পথ রুদ্ধ হতে থাকে।

গুরুজীত বুঝতে পারেন একটা বিপদ আসন্ন। বিপদ কোন্ দিক থেকে আসছে তা স্পষ্ট নয়। রাজা ইন্দ্রজীত তাঁর চেয়ে অনেক যোগ্য, সাহসী ও জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও আত্মরক্ষা করতে পারেননি। তাঁর করুণ পরিণতির কথা মনে পড়লে গুরুজীতের মন বিষণœ হয়ে পড়ে। তাঁর চারপাশে এত লোক থাকা সত্ত্বেও তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করেন। নিজেকে সব সময় একা মনে হয়। তিনি কার কাছে আশ্রয় চাইবেন? মনে হয় তাঁর কেউ নেই। এই পৃথিবীতে তিনি সম্পূর্ণ একা। এসব ভাবতে ভাবতে রাজা একদিন বিকেলে রাজউদ্যানে পায়চারী করছেন এমন সময় তিনি দেখতে পান, এক জটাধারী সন্ন্যাসী উদ্যানের এক প্রান্তে বসে ধ্যান করছেন। তিনি সন্ন্যাসীর কাছে যেতেই সন্ন্যাসী ধ্যান ভঙ্গ করে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, রাজা আপনি কী ভাবছেন তা আমি জানি। রাজা ইন্দ্রজীতের করুণ পরিণতির জন্য তিনি নিজেই দায়ী ছিলেন। শত্রুকে মিত্র এবং মিত্রকে শত্রু ভাবলে ধ্বংস অনিবার্য। বোকার মতো প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তিনি ভালো কাজ করেননি। তিনি নিজের জীবনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। গুরুজীত বললেন, রাজা ইন্দ্রজীত খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি প্রজাদের ভালোবাসতেন, তাদের বিশ^াস করতেন। আপনারাই তো বলেন, মানুষের উপর বিশ^াস হারানো পাপ। সন্ন্যাসী বললেন, প্রত্যেক মানুষের প্রধান ও প্রাথমিক কর্তব্য নিজেকে রক্ষা করা। যে লোক নিজেকে রক্ষা করতে পারে না সে অপরকে রক্ষা করবে কেমন করে। তাদের বাঁচাবার জন্য নিজের বেঁচে থাকা জরুরি ছিল। মানুষ যখন বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পায় না, তখন সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। রাজার জীবন সার্থক ছিল। এ জন্যে প্রত্যেক মানুষের সার্থক জীবন কাম্য হওয়া উচিত। তবে তাঁর জানা উচিত ছিল, পরাজিত শত্রু সব সময় প্রতিহিংসা পরায়ণ ও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়। আপনি আজ দেশকে উন্নতির যে পর্যায়ে এনেছেন রাজা ইন্দ্রজীত বেঁচে থাকলে তা অনেক আগেই সম্পন্ন করতে পারতেন। এতগুলো বছর মানুষকে দুঃখকষ্ট আর নির্যাতন ভোগ করতে হতো না। যে আত্মত্যাগ মানুষের কল্যাণে আসে তা ভালো, আর যে আত্মত্যাগ মানুষের কষ্ট বাড়ায় তা কারো কাম্য হতে পারে না। যুদ্ধ জয়কে স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে। রাজাকে দেশে সুশাসনের জন্য কঠোর এবং নির্মোহ হতে হয়। এতে অনেকের স্বার্থে আঘাত লাগে। তারা ক্ষুব্ধ হয়। তাদের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা প্রবল হয়। তাই রাজার নিরাপত্তা বিশেষ জরুরি। বেশি আবেগপ্রবণ হওয়া রাজাকে মানায় না। রাজার চোখে জল বেমানান। এ জন্যে রাজা আর প্রজায় এত ব্যবধান।

গুরুজীত বললেন, আমাকে কী করতে হবে?

সন্ন্যাসী বললেন, বিধাতা মানুষ সৃষ্টির সময় প্রত্যেক মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য তার উপযোগী সক্ষমতা দান করে থাকেন। রাজাকে রাজার উপযোগী, প্রজাকে প্রজার উপযোগী। এই সক্ষমতার সদ্ব্যবহার করলে কোনো অঘটন ঘটেনা। রাজার বেঁচে থাকার উপর আনেক মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। এজন্য রাজাকে সর্ব্বোচ্চ নিরাপত্তা নিতে হয়। রাজার ভালো মন্দের উপর দেশের মানুষের ভালো-মন্দ নির্ভর করে। প্রজাকে রক্ষা করা রাজার ধর্ম। প্রজার প্রতি রাজার দরদকে কেউ যেন তার দুর্বলতা না ভাবে। প্রজার ভালোর জন্য আপনি কঠোর হবেন, কিন্তু নির্মম বা নিষ্ঠুর হবেন না। রাজার সুশাসনের সবচেয়ে বড়ো বাধা তার বিশেষ সুবিধাভোগী মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীরা। তাদের স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলে তারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা দেশপ্রেমিক বা জনদরদী না হলে দেশে সুশাসন আসবে না। তাদের বেশিরভাগ শয়তানের দ্বারা প্রভাবিত। শয়তানের প্ররোচণাতেই পৃথিবীতে যত অপকর্ম হয়। চাটুকার মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীদের সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকবেন।

গুরুজীত বললেন, আমি প্রজাদের খুব ভালোবাসি। সব সময় তাদের মঙ্গল কামনা করি।

সন্ন্যাসী বললেন, রাজাকে সব সময় প্রজাদের দুঃখ কষ্টের অংশীদার হতে হয়, প্রজাদের আস্থা অর্জন করতে হয়। তাদের আস্থা একবার নষ্ট হলে তা পুনরুদ্ধারের সুযোগ থাকে না। জনপ্রিয়তায় বিভ্রান্ত হবেন না। জনপ্রিয়তা আর আস্থা এক নয়। লক্ষ্যে স্থির থেকে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে মানুষ কখনো পরাজিত হয় না।

গুরুজীত বললেন, আমি আমার সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠা দিয়ে প্রজাদের আস্থা ধরে রাখবো। আস্থাহীন রাজার রাজ্য শাসনের অধিকার থাকে না।

সন্ন্যাসী বললেন, রাজা হচ্ছেন জাতির বাতিঘর। রাজা ইন্দ্রজীতের মতোই আপনাকে গোটা জাতির স্বপ্নকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। আপনার পিছুটান নেই, আপনার হারাবার কিছু নেই। আপনি পারবেন। যার হারাবার ভয় থাকে না, সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। সে কারো কাছ থেকে কোনো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করে না। বিবেকবান মানুষেরা আত্মবিশ^াসী হয়। গভীর আত্মবিশ^াস একজন মানুষকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যায়। কিন্তু অহংকার মানুষের আত্মবিশ^াসে ফাটল ধরিয়ে দেয়। এই বলে সন্ন্যাসী রাজার বাম বাহুতে একটি রক্ষাকবচ বেঁধে দিয়ে বললেন, আত্মবিশ^াস মানুষকে আত্মরক্ষা করতে সাহায্য করে। তারপর সন্ন্যাসী নির্দেশের সুরে রাজাকে বললেন, আগামী তিন দিন আপনি আত্মগোপনে থাকবেন। কাক-পক্ষীও যেন আপনার খোঁজ না পায়। আপনি জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান রাজা। আপনাকে আমার আর বলার কিছু নেই। আত্মগোপন শেষে তিন দিন পর আপনি রাজদরবারে ফিরে এসে যে সিদ্ধান্ত নেবেন সে অনুযায়ী কাজ করবেন। রক্ষা কবচটি কখনো আপনার হাত থেকে খুলবেন না। আপনার বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, বিবেক এবং অভিজ্ঞতা আপনাকে নতুন পথের সন্ধান দেবে। শত্রুকে কখনো দুর্বল ভাববেন না। একজন আত্মসচেতন মানুষ মনের আয়নায় তার ভবিষ্যত দেখতে পায়। কোনো একক সিদ্ধান্ত নেবার আগে প্রজাদের মনোভাব জেনে নেবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, আপনার পতন আপনার হাতে। বিবেকের বিপক্ষে কাজ করলে আপনার পতন অনিবার্য। আপনার হৃদয়ে সব সময় একজন সাধারণ প্রজার অনুভুতি ধারণ করবেন। চাটুকারের কথায় আস্থা না রেখে সমালোচকের কথা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবেন।

সন্ন্যাসীর পরামর্শ অনুযায়ী রাজা গুরুজীত আত্মগোপনে চলে গেলেন। সন্ন্যাসী রটিয়ে দিলেন, রাজা গুরুজীত বিশ^াসঘাতক প্রহরীদের হাতে নিহত হয়েছেন। রাজপ্রাসাদে কেউ বেঁচে নেই।

রাজা নিহত হয়েছেন শুনে মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীসহ রাজসভার লোকজন ভয়ে পালাতে শুরু করে। প্রজারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। রাজার সাহায্যে কেউ এগিয়ে এলো না।

তিন দিন পর গুরুজীত রাজসভায় ফিরে এলেন। তিনি দেখেন, রাজসভা জনশূন্য। কেউ কোথাও নেই। রাজা বিস্মিত হলেন। মানসিক আঘাত পেলেন। কিন্তু ভেঙ্গে পড়লেন না। রক্ষাকবচটি স্পর্শ করে সিংহাসনে বসলেন। সন্ন্যাসীর সব কথা স্মরণ করলেন। রাজা হতে হলে তাকে রাজার মতো রাজা হতে হবে। শত্রু মিত্র চিনতে হবে। লক্ষ্যে স্থির থেকে তাকে প্রজাদের কল্যাণে নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজ করতে হবে।