পৌরাণিক আকাশে রবির পুরাণ

সাদ কামালী

(পূর্ব প্রকাশের পর)

বেশি দিনের কথা নয়, রবি তখন বিলাত যাননি, বিলাতযাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে মেজদার কাছেও নয়, আমেদাবাদ বম্বেও নয়, আন্না তনখার প্রেম নিবেদনে রবি অপ্রস্তুত নয়, তখন হিন্দু মেলার নানা আয়োজনে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা বেশ উৎসাহে চলছে, জ্যোতিঠাকুর মনে করেন তখনই রবি পদাবলীগুলি লিখেছেন, মাঝে মাঝে সংশোধন সংযোজন করেন। বড়দার নেতৃত্বে ‘ভারতী’ বের হতে থাকলে ভারতীতে ১৩টি ‘ভানুসিংহের কবিতা’ শিরোনামে ছাপা হয়। ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ লেখা আগে শেষ হলেও প্রকাশ হতে হতে ১২৯১। কবির খুব উৎসাহ ছিল না। নতুন বউঠানের আগ্রহ থাকলেও রবি প্রকাশ করেন নি। যখন তিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলেন তখন আর বউঠান কাদম্বরী নেই, রবি উৎসর্গ করলেন তাঁর উদ্দেশে-

‘ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না’ (র র ১ম খণ্ড)।

অবশ্য ‘ভারতী’তে রবীন্দ্রনাথ প্রথম লেখেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনাটি। জ্যোতির মনে আছে, ষোল বৎসরের রবির কলমে মধুকবি কি অসহায়ভাবে সমালোচিত হলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকৃতি নিয়ে। জ্যোতি হঠাৎ বলেন, পণ্ডিতবর আপনি কি মধুসূদনকে পড়েছেন, তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যটি বিশেষ করে?

সঞ্জয়ের চিবুকে হাসি ছড়িয়ে যায়, মধু বড় কবি, কিন্তু ব্যাস-বাল্মীকি-রবি নয়, ওঁর সৃষ্টি নতুন, স্বকীয়, নতুন মনের খোঁজ মিলে, কিন্তু তেমন ক’রে হৃদয়ে গাঁথা সুর তৈরি হয় না। আমি কবির সৃষ্টি, বলতে পারো মায়া জগতের, চিন্তা বুদ্ধির চেয়ে সুর ও ছন্দের ঘোরেই যত আনন্দ। অন্যদিকে, সুর ছন্দ তো শুধু নয়, সর্বত্র বিহারের অবাধ সাহস ও যোগ্যতা শুধু দেখলাম রবির মধ্যে, কালিদাস, জয়দেব, মধু, বুদ্ধ অনেকেই এসেছেন, রবি কি অদ্বিতীয় নয়? এমন ব্যাপ্তি আছে আর কারও? তুমি তো জানো যখন রবি সুরে ছন্দে বৈষ্ণব প্রেমের পদ লিখছেন, তখনি আবার মেঘনাদবধের মতো নতুন, জটিল প্রকরণের কাব্যটি পাঠ শেষে তাকে নিয়ে তীব্র আলোচনা করছেন। ভানুসিংহের পদাবলীর চরিত্র বা বিষয় ও দৃষ্টির সঙ্গে মেঘনাদের পার্থক্য গগনচুম্বি। তবে ও তখন নিতান্তই কিশোর, তোমরা যারা বড়, বিশেষ এক উৎসাহে হিন্দুমেলা ক’রে যাচ্ছ। কেবল কৈশোর উত্তীর্ণ রবি হয়তো তোমাদের উদ্দীপনার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। না হলে মধু কবির ওই সমালোচনা রবি করতেন না, পরে অবশ্য রবি বহুবার অনুশোচনা করেছেন। নিজেকেই নিজে প্রকাশ্য রচনায় নিন্দা করেছেন। জ্যোতির চোখে দৃষ্টি পড়ে না, অনেক নিচে নেমে আকাশ নক্ষত্র সাজানো উঠান নিয়ে ঝকঝক করছে। জ্যোতির চোখে সেই নক্ষত্রের সরু আলো, সঞ্জয় এসবের খবরও রাখেন! রবি তবে আত্মসমালোচনা লিখেছিলেন! সঞ্জয় বলেন, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আলোচনায়, পরে এই আলোচনার নিন্দাসহ বিভিন্ন প্রবন্ধে রবি কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারত ও দুই আদি কবি বাল্মীকি-ব্যাসদেব সম্পর্কে লিখেছেন। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী’ গ্রন্থের ভূমিকায় রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে নিজের মত যেমন দিচ্ছেন তেমন প্রাচীন সাহিত্য আলোচনাতে এই দুই মহাকাব্য নিয়ে তাঁর মত প্রকাশ করেছেন। এসবের মধ্যে তাঁর ভারতকে উপলদ্ধি করার ধরন ও কাব্য সম্পর্কে তাঁর সমান্তরাল মত প্রকাশ ক’রে যান।

রবি ‘রামায়ণী’র ভূমিকা লেখেন ১৩১০-এ, তখন ও অনেক পরিণত, অভিজ্ঞতার ভাণ্ড যেমন, তেমন নানা উদ্যোগে ভারত ও তার ঐতিহ্যর মূলকে চিনতে পারছেন, দেখো কত সুন্দর করে ও লিখেছে, ‘রামায়ণী’র ভূমিকায়... ‘এক শ্রেণীর কবি আছে যাহার রচনার ভিতর দিয়া একটি সমগ্র দেশ, একটি সমগ্র যুগ, আপনার হৃদয়কে আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করিয়া তাহাকে মানবের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।... ইহারা যাহা রচনা করেন তাহাকে কোনো ব্যক্তি বিশেষের রচনা বলিয়া মনে হয় না। মনে হয় যেন তাহা বৃহৎ বৃহস্পতির মতো দেশের ভূতলজঠর হইতে উদ্ভূত হইয়া সেই দেশকেই আশ্রয়চ্ছায়া দান করিয়াছে।... রামায়ণ-মহাভারতকে মনে হয় যেন জাহ্নবী ও হিমাচলের ন্যায় তাহারা ভারতেরই, ব্যাস-বাল্মীকি উপলক্ষ মাত্র। বস্তুত ব্যাস-বাল্মীকি তো কাহারও নাম ছিল না। ওতো একটা উদ্দেশে নামকরণ মাত্র’ (রামায়ণী, র র-৩)। জ্যোতি ঠাকুর সঞ্জয়কে থামিয়ে দেন, রবি তো ভালো বলেছেন, ব্যাস-বাল্মীকি কারও নাম নয়! নাম ছিল না, একটা উদ্দেশ্যে নামকরণ। সত্যিই তাই, ওদের জন্ম আবির্ভাব ইতিহাসের কোনো জনপদের নয়, সম্ভবও নয়, অতিপ্রাকৃত ইতিহাসের কথা শুধু প্রাচীন কবিদের অন্তরে সৃষ্টি, ওই নামেরও সৃষ্টি এবং প্রাচীন আর্য্য সভ্যতার ভারতীয় প্রবাহে ওই কাব্যদুটি বিভিন্ন কবির হাতে পর্যায়ক্রমে উৎকর্ষতা অর্জন করে চিরকালের হয়ে ওঠে। সঞ্জয় বলেন, রবিও বলছেন সে কথা, কিন্তু স্বর ভিন্ন, রামায়ণ-মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময়বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে- রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এই ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস। এই দুই বিপুল কাব্যহর্মের মধ্যে চিরকালের সিংহাসন বিরাজমান।’ (ঐ)

জ্যোতি বলেন, মানুষের চিরকালীন আকাক্সক্ষা হলো অশুভ অধর্মের পরাজয়, শুভ, ধন সম্পদ, আয়ু ও প্রেমের জয়, প্রেমের জন্য সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ, রাজ্যজয়, রাজ্যগৌরব, প্রজার মন জয়, তার শান্তি শৃঙ্খলা কামনা এসবই মানুষের চিরকালীন আকাক্সক্ষার ইতিহাস, কোনো কালের ইতিহাস নয়, রবির কথা আমারও। সঞ্জয় একটু ঠেস দিয়ে বলেন, কিন্তু বলতে পারো নি, মহাকবিই এই সত্য বোঝে এবং প্রকাশ করতে পারে। তুমি অতি-প্রাকৃতের কথা বললে, রবিও বলেছেন এভাবে বিদেশীদের মতো ক’রে নয়, ‘প্রকৃতিভেদে একের কাছে যাহা অতিপ্রাকৃত অন্যের কাছে তাহাই প্রাকৃত। ভারতবর্ষ রামায়ণের মধ্যে অতিপ্রাকৃতের আতিশয্য দেখে নাই’ (ঐ)। লক্ষ্য করো, রবি কিন্তু তাঁর কথা বলছেন না, বলছেন ভারতবর্ষের কথা, অর্থাৎ আপামর কথা। কারণ রবি ভালোই জানেন, শ্রুতিযন্ত্রে আমরা যতসংখ্যক শব্দ-তরঙ্গের অভিঘাত উপলব্ধি করতে পারি তাহার সীমা আছে, সেই সীমার উপরের সপ্তকে সুর চড়ালে আমাদের কর্ণ তাকে গ্রহণই করে না। কাব্যে চরিত্র এবং ভাব-উদ্ভাবন সম্বন্ধেও সে-কথা খাটে। তাহলে অতিপ্রাকৃত বর্ণনার এমন কিছুই ইতর বিশেষ ঘটেনি যে ভারতবর্ষের আপামর মানুষ এই মহাকাব্যটিকে উপেক্ষা করতে পারে। রবি বলছেন, ‘রামায়ণ-কথা হইতে ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবণিতা, আপামর সাধারণ কেবল যে শিক্ষা পাইয়াছে তাহা নহে, আনন্দ পাইয়াছে; কেবল যে ইহাকে শিরোধার্য করিয়াছে তাহা নহে, ইহাকে হৃদয়ের মধ্যে রাখিয়াছে; ইহা যে কেবল ধর্মশাস্ত্র তাহা নহে, ইহা তাহাদের কাব্য।’ (ঐ) তোমরা কেউ নও, এই রবিই লিখেছেন কবিতায়, নারদ কবি বাল্মীকিকে বলছেন...

সেই সত্য যা রচিবে তুমি

ঘটে যা তা সব সত্য নহে।

কবি, তব মনোভূমি

রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।

(ভাষা ও ছন্দ)

বাল্মীকি নারদকে যে প্রশ্ন করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাংলায় লিখছেন ওই ‘রামায়ণী’ নিবন্ধে- “কোন্ একটিমাত্র নর”কে আশ্রয় করিয়া সমগ্র লক্ষ্মী রূপ গ্রহণ করিয়াছেন?’ তখন উত্তরে নারদ বললেন, ‘এত গুণযুক্ত পুরুষ তো দেবতাদের মধ্যেও দেখি না। তবে যে নরচন্দ্রমার মধ্যে এই সকল গুণ আছে তাহার কথা শুন। রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই কথা দেবতার কথা নহে।’

বাল্মীকির কাব্যে ওই পুরুষ চিত্রিত হন, রামচন্দ্র নামে। ইতিহাসে নয়, এই পুরাণ কাব্যেই সেই রামের ইতিহাস কাব্যসত্যে নির্মিত হলো। আবার রবি রামায়ণকে শুধুমাত্র কাব্য বলেই বিবেচনা করছেন না। তাঁর পাঠকদের বলছেন, ‘বাল্মীকির রামচরিত-কথাকে পাঠকগণ কেবলমাত্র কাব্য বলিয়া দেখিবেন না, তাহাকে ভারতবর্ষের রামায়ণ বলিয়া জানিবেন। তাহা হইলে রামায়ণের দ্বারা ভারতবর্ষকে ও ভারতবর্ষের দ্বারা রামায়ণকে যথার্থভাবে বুঝিতে পারিবেন। ইহা স্মরণ করিবেন যে, কোনো ঐতিহাসিক গৌরবকাহিনী (রামায়ণ) নহে, পরন্তু পরিপূর্ণ মানবের আদর্শ-চরিত ভারতবর্ষ শুনিতে চাহিয়াছিল এবং আজ পর্যন্ত তাহা অশ্রান্ত আনন্দের সহিত শুনিয়া আসিতেছে’ (ঐ)। তাহলে, রবির কাছে রামায়ণ-মহাভারত কখনো ইতিহাস নয়, ভারতবর্ষের আবেগপ্রবণ মানুষের তুমুল আকাক্সক্ষার কাব্য ও চিরকালীন ইতিহাস। তবে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনার সময় ওর অপরিণত মনে এবং হয়তো অন্যদের তৈরি পরিবেশের চাপ পড়েছিল বলা যায়। তোমাদের বা আরও পরবর্তীকালের একটি পাঠ দেখা যাক এই প্রসঙ্গের। তবে আগে মহাভারত ও রামায়ণ প্রসঙ্গে ‘কুমারসম্ভব’ ও ‘শকুন্তলা’ আলোচনায় রবির উপলব্ধি দেখো, ‘মহাভারতে যে-একটা বিপুল কর্মের আন্দোলন দেখা যায় তাহার মধ্যে একটি বৃহৎ বৈরাগ্য স্থির অনিমেষভাবে রহিয়াছে। মহাভারতের কর্মেই কর্মের চরম প্রাপ্তি নহে। তাহার সমস্ত শৌর্যবীর্য, রাগদ্বেষ, হিংসা-প্রতিহিংসা, প্রয়াস ও সিদ্ধির মাঝখানে শ্মশান হইতে মহাপ্রস্থানের ভৈরবসংগীত বাজিয়া উঠিতেছে। রামায়ণেও তাহাই; পরিপূর্ণ আয়োজন ব্যর্থ হইয়া যায়, করায়ত্ত সিদ্ধি স্খলিত হইয়া পড়ে- সকলেরই পরিণামে পরিত্যাগ। অথচ এই ত্যাগে দুঃখে নিষ্ফলতাতেই কর্মের মহত্ত্ব ও পৌরুষের প্রভাব রজতগিরির ন্যায় উজ্জ্বল অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে’ (প্রাচীন সাহিত্য, র র ৩য় খণ্ড)।

সময়টা শ্রাবণ ১২৮৪ (১৮৭৭), রবীন্দ্রনাথ তখন ষোল বছরের কিশোর, তরুণ বয়সের আরম্ভ মাত্র। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ‘জ্যোতিদাদার’ উদ্যোগে ‘ভারতী’ প্রকাশ হয়। ঠাকুর পরিবারের উৎসাহ ও সহযোগিতায় সামাজিক সাংস্কৃতিক আলোড়ন সৃষ্টির ভিতর ‘ভারতী’ পত্রিকা আরও একটি নতুন সংযোজন হলো। আর রবীন্দ্রনাথের জন্য ‘মোটের উপর এই সময়টা আমার পক্ষে একটা উন্মত্ততার সময় ছিল।’ এ-সময়ে তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনার মাধ্যমে ভারতী-তে প্রথম লিখতে আরম্ভ করেন। বাংলা ভাষা ও কাব্যে নতুন, নিরীক্ষাধর্মী আঙ্গিক, নতুন ছন্দ সর্বোপরি ঐতিহ্যগত বিশ্বাস সংস্কারের বিপরীতে নতুন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির কাব্য ‘মেঘনাদবধ’ সম্পর্কে ষোল বছরের রবীন্দ্রনাথ ‘তীব্র সমালোচনা’ এবং ‘দাম্ভিক সমালোচনাটা’ লেখেন। সে-আলোচনার ভাষা, যুক্তি, আবেগ এবং দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর কাঁচা বয়সের অপরিণত বুদ্ধির সকল প্রকাশই ঘটে। শুরুতে ট্র্যাজেডি ও মহাকাব্য সম্পর্কে নিজের ধারণার উল্লেখ শেষে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “অনেকে জানেন না, সমস্তটা নিকাশ করিয়া ফেলিলে অনেক সময় ট্র্যাজেডির ব্যাঘাত হয়। অনেক সময় সেমিকোলনে যতটা ট্র্যাজেডি থাকে দাঁড়িতে ততটা থাকে না’ (র র পঞ্চদশ খণ্ড)। লেখেন- ... “তিনি মহাকাব্য-রচনার যোগ্য কবি নহেন। মহত্ত্ব দেখিয়া তাঁহার (মাইকেল মধুসূদন দত্ত) কল্পনা উত্তেজিত হয় না। নহিলে তিনি কোন্ প্রাণে রামকে স্ত্রীলোকের অপেক্ষা ভীরু ও লক্ষ্মণকে চোরের অপেক্ষা হীন করিতে পারিলেন! দেবতাদিগকে কাপুরুষের অধম ও রাক্ষসদিগকেই দেবতা হইতে উচ্চ করিলেন!” (্ঐ) অথবা ‘মাইকেল জানেন অনেক মহাকাব্যে স্বর্গ-নরক বর্ণনা আছে; অমনি জোর-জবরদস্তি করিয়া কোনো প্রকারে কায়ক্লেশে অতি সংকীর্ণ, অতি বস্তুগত, অতি পার্থিব, অতি বীভৎস এক স্বর্গ-নরক-বর্ণনার অবতরণ করিলেন।’ সমালোচনার শেষ দু’টি বাক্য এমন, ‘হে বঙ্গমহাকবিগণ! লড়াই-বর্ণনা তোমাদের ভালো আসিবে না, লড়াই-বর্ণনায় তেমন প্রয়োজনও দেখিতেছি না। তোমরা কতকগুলি মনুষ্যত্বের আদর্শ সৃজন করিয়া দেও’ (র র পঞ্চদশ খণ্ড)।

ভারতী পত্রিকা প্রকাশের কিছু আগে থেকে ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে চৈত্রসংক্রান্তিতে ‘চৈত্রমেলা’ পরে উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সাপেক্ষে নাম বদলে ‘হিন্দুমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল, গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের কাকা গিরীন্দ্রনাথের বড় সন্তান) সম্পাদক নবগোপাল মিত্র ছিলেন সহকারী সম্পাদক। হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনায় হিন্দুসম্প্রদায়ের সকল গোত্রের এক সাংস্কৃতিক মহাসম্মিলন ঘটতো মেলায়। ‘হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের লেখক যোগেশচন্দ্র বাগল জানিয়েছেন, মেলার সম্পাদক গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে বলেন, ‘এই মেলার প্রথম উদ্দেশ্য বৎসরের শেষে হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা। যত লোকের জনতা হয় ততই ইহা হিন্দু মেলা ও ইহা হিন্দুদিগের জনতা এই মনে হইয়া হৃদয় আনন্দিত ও স্বদেশানুরাগ বর্ধিত হইয়া থাকে।’ আর মেলার অন্যতম প্রধান সংগঠক মনোমোহন বসুর মতে ‘অসম্বন্ধ হিন্দু-সমাজের মধ্যে ঐক্য স্থাপন’, ‘সম্বৎসরের মধ্যে হিন্দু সমাজের যে কিছু উন্নতি বা দুর্গতি হইয়াছে’ তার সমীক্ষা এবং ‘যে সমস্ত দেশস্থ মহাশয়েরা স্বজাতীয় ও স্বাবলম্বিত শিক্ষাদানে ব্রতী হইয়াছেন বা হইবেন, তাহাদিগকে সমুচিত উৎসাহ প্রদান।’ তরুণ রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনা লিখবার এবং ভারতী প্রকাশের ওই ১৮৭৭ সালেই লিখেছিলেন, ‘লর্ড কার্জনের সময় দিল্লি দরবার সম্বন্ধে একটা গদ্যপ্রবন্ধ’ যা তিনি পড়েছিলেন ‘হিন্দুমেলার গাছের তলায় দাঁড়াইয়া।’ আর পাঠ করেছিলেন ১৮৭৫ সালে ‘হিন্দুমেলার উপহার’ কবিতাটি।

কিশোর-তরুণ রবীন্দ্রনাথের ওপর ব্যাপক প্রভাব ও প্রেরণা ছিলেন তাঁর ‘প্রধান সহায়’ জ্যোতিদাদা। হিন্দুমেলার উদ্দীপনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পর পর কয়েকটি নাটক লেখেন হিন্দুবীরের বীরত্ব ও বিজয় গৌরব নিয়ে। এই বীরের প্রতিপক্ষ অবশ্য সাম্রাজ্যবাদ বৃটিশ নয়, ছিল মুসলমান বা তাঁর নাটকের ‘যবন’ সম্প্রদায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জ্যোতি ঠাকুরের ‘সরোজিনী’ নাটকে যবন বিদ্বেষী গান লিখে দিয়ে জ্যোতিদাদার অকুণ্ঠ প্রশংসা ভোগ করেছিলেন। জ্যোতিদাদার নাটকে হিন্দুবীর সেনার যবন নিধনের বীরত্বে খোদ বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’-এ অতি বীররসের কটাক্ষ করেছিলেন। ‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য হিন্দুমেলা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলবদ্ধির চেষ্টা সেই প্রথম হয়।’ জীবনস্মৃতিতে রবি এই মত লেখেন যখন (১৯১২) তখন তিনিও বালক নন যে কারও কর্ম ও ব্যক্তিত্বের চাপে প্রভাবিত হবেন এমন সম্ভাবনা ক্রমে তিরোহিত। কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথ আলোড়িত হয়েছিলেন এর সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবোধ জাগরণে। ঠিক এসময়েই জ্যোতিদাদার নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল ‘সঞ্জীবনী সভা’ নামে এক সভার। ঋগবেদ উচ্চারণের ভিতর এই সভা হতো। এই সভায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয় পোশাক নিয়ে তাঁর চিন্তা প্রকাশের প্রয়াস পান, কারণ ‘ধূতিটা কর্মক্ষেত্রের উপযোগী নহে অথচ পায়জামাটা বিজাতীয়’ (জীবনস্মৃতি র র নবম খণ্ড)। এমন সাংস্কৃতিক সামাজিক প্রেক্ষাপট ভগবানের অবতার রাম, লক্ষ্মণ ও দেব-দেবতাদের নিয়ে কটাক্ষ অপরপক্ষে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগী মাইকেলের রাবণ, রাক্ষস তথা ইতরজনের উচ্চতর আদর্শে প্রতিষ্ঠা রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেননি তখন। পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘রামায়ণী’ ভূমিকা নিবন্ধে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছেন রাম মানুষ, ভগবান বা কারও অবতার নয়, ‘দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এই কাব্য রচিত তাহা নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন- পণ্ডিতেরা ইহা প্রমাণ করিবেন।... এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলিতেছি যে, কবি যদি রামায়ণে নরচরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত...।’

মেধনাদবধের নতুনত্ব, কাব্য সৌন্দর্য, শ্রেণীনিরপেক্ষ নতুন ও উন্নত চিন্তা এবং এর কাব্যসত্য ষোল বছরের রবীন্দ্রনাথের কাছে অবোধ্য হতেই পারে। মাইকেল এবং বাংলা সাহিত্যের জন্য সৌভাগ্য এই, পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘কাঁচা বয়সের’ দাম্ভিকতাকে তীব্র নিন্দা ক’রে মেঘনাদবধ কাব্যকে ‘অমর কাব্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ‘জীবনস্মৃতি’ (১৯১২)-তে লেখেন, ‘ইতিপূর্বেই আমি অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদবধের তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস- কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্যর ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষè হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম। এই দাম্ভিক সমালোচনাটা দিয়া আমি ‘ভারতী’তে প্রথম লেখা আরম্ভ করিয়াছিলাম’ (জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, নবম খণ্ড)।

রবীন্দ্রোত্তর প্রধান সাহিত্য ব্যক্তিত্ব কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর পূর্ব ও পরবর্তী সকল প্রধান সাহিত্য ও সাহিত্য ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে আলোচনা ও মূল্যায়ন করেছেন। কালিদাস-মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-সুধীন্দ্র-অমিয় সকলের সম্পর্কে বুদ্ধদেব নিজস্ব পাঠ ভাবনা অপূর্ব ভাষাশৈলীতে অকপটে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন নি। ‘মাইকেল’ প্রবন্ধে (১৯৪৫) বুদ্ধদেব বসু মেঘনাদবধ কাব্যের তীব্র সমালোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করেন পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের মেঘনাদবধ কাব্যকে প্রশংসার জন্য। বুদ্ধদেব বসু রবির বালক বয়সের ‘কাঁচা’ সমালোচনাকেই রবির মত হিসেবে শিরোধার্য করতে চান। যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর বালক বয়সের রচনাকে কাঁচাবয়সের উত্তেজনা দাম্ভিকতা বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জীবনস্মৃতিতে তাঁর মত আমরা দেখেছি। বুদ্ধদেব বসুর ‘মাইকেল’ নিবন্ধে ‘মেঘনাধবধ কাব্য’ আলোচনায় ‘কালোপাহাড়ি’ সমালোচনা তীব্র হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যসৃষ্টি’ (আষাঢ় ১৩১৪) প্রবন্ধে মেঘনাদবধ কাব্য সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট মত পড়ে। এবং বুদ্ধদেব বসু ভুল (!) ক’রে বলেন, ‘তারুণ্যের সত্যভাষণ ভারতীতে প্রকাশিত হবার পঁচিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ অগ্রজ-নিন্দার প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা করলেন সাহিত্যসৃষ্টি প্রবন্ধে।’ প্রকৃতপক্ষে, বাংলা ১২৮৪’র শ্রাবণ-কার্তিক, পৌষ-ফাণ্ডুন সংখ্যায় ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনা ধারাবাহিকতাভাবে প্রকাশিত হয়। ওই ‘ভারতী’তেই সাহিত্যসৃষ্টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৩১৪ সালে, তিরিশ বছরের ব্যবধানে। শুধু আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসই নয়, ভারতবর্ষের মনীষীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে বদলেছেন সদর্ধক অর্থে, বোধ উপলব্ধি বিশ্বালোকে নতুন ক’রে দেখার প্রয়াসী তিনি ছিলেন। বুদ্ধদেব কথিত প্রায়শ্চিত্ত নয়, ব্যাপক পাঠ ও জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধির নবায়ন। ইউরোপীয় কবিতার রীতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বাংলা কবিতার সম্পর্ক ও সংস্কার মাইকেল মধুসূদনের হাতে প্রথম উল্লেখযোগ্যভাবে শুরু হয়। তিনি বাংলা কবিতার ছন্দে অমিত্রাক্ষর রীতির প্রয়োগ করেছেন ইংরেজি কাব্য থেকে, বীরাঙ্গনা কাব্য লিখেছেন অভিড কাব্যের অনুসরণে। বাংলায় সনেটের সূচনা করেছেন পেত্রার্কের আদর্শে। মেঘনাদবধ কাব্যে ‘অমিতত্রাক্ষরের নিঃসংশয় প্রতিষ্ঠা। এখানে আছে নানা ইউরোপীয় কবিতার অন্তর্বয়ন, এখানে আছে এক গ্রীক মহাকাব্যের কাঠামোর মধ্যে নতুন ক’রে রামায়ণ রচনা। মেঘনাদবধ কাব্য ও মাইকেল মধুসূদন বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গিবদ্ধ কাব্য ও জীবন’ (শিশিরকুমার দাশ)। বুদ্ধদেব বসু বালক রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার ভাষা অনুকরণ ক’রে কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলেন, ‘উত্তর-রবীন্দ্রের ভাষায় বলতে গেলে, মেঘনাদবধ কাব্য হয়ে-ওঠা পদার্থ নয়, একটা বানিয়ে তোলা জিনিস। আয়োজনের, আড়ম্বরের অভাব নেই, সাজসজ্জার ঘটাও খুব, কিন্তু সমস্ত জিনিসটা আগাগোড়াই মৃত, কোথাও আমাদের প্রাণে নাড়া দেয় না, হৃদয়ে আন্দোলন তোলে না।’ ক্রমশ...

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

পৌরাণিক আকাশে রবির পুরাণ

সাদ কামালী

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

বেশি দিনের কথা নয়, রবি তখন বিলাত যাননি, বিলাতযাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে মেজদার কাছেও নয়, আমেদাবাদ বম্বেও নয়, আন্না তনখার প্রেম নিবেদনে রবি অপ্রস্তুত নয়, তখন হিন্দু মেলার নানা আয়োজনে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা বেশ উৎসাহে চলছে, জ্যোতিঠাকুর মনে করেন তখনই রবি পদাবলীগুলি লিখেছেন, মাঝে মাঝে সংশোধন সংযোজন করেন। বড়দার নেতৃত্বে ‘ভারতী’ বের হতে থাকলে ভারতীতে ১৩টি ‘ভানুসিংহের কবিতা’ শিরোনামে ছাপা হয়। ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ লেখা আগে শেষ হলেও প্রকাশ হতে হতে ১২৯১। কবির খুব উৎসাহ ছিল না। নতুন বউঠানের আগ্রহ থাকলেও রবি প্রকাশ করেন নি। যখন তিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করলেন তখন আর বউঠান কাদম্বরী নেই, রবি উৎসর্গ করলেন তাঁর উদ্দেশে-

‘ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না’ (র র ১ম খণ্ড)।

অবশ্য ‘ভারতী’তে রবীন্দ্রনাথ প্রথম লেখেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনাটি। জ্যোতির মনে আছে, ষোল বৎসরের রবির কলমে মধুকবি কি অসহায়ভাবে সমালোচিত হলেন তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকৃতি নিয়ে। জ্যোতি হঠাৎ বলেন, পণ্ডিতবর আপনি কি মধুসূদনকে পড়েছেন, তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যটি বিশেষ করে?

সঞ্জয়ের চিবুকে হাসি ছড়িয়ে যায়, মধু বড় কবি, কিন্তু ব্যাস-বাল্মীকি-রবি নয়, ওঁর সৃষ্টি নতুন, স্বকীয়, নতুন মনের খোঁজ মিলে, কিন্তু তেমন ক’রে হৃদয়ে গাঁথা সুর তৈরি হয় না। আমি কবির সৃষ্টি, বলতে পারো মায়া জগতের, চিন্তা বুদ্ধির চেয়ে সুর ও ছন্দের ঘোরেই যত আনন্দ। অন্যদিকে, সুর ছন্দ তো শুধু নয়, সর্বত্র বিহারের অবাধ সাহস ও যোগ্যতা শুধু দেখলাম রবির মধ্যে, কালিদাস, জয়দেব, মধু, বুদ্ধ অনেকেই এসেছেন, রবি কি অদ্বিতীয় নয়? এমন ব্যাপ্তি আছে আর কারও? তুমি তো জানো যখন রবি সুরে ছন্দে বৈষ্ণব প্রেমের পদ লিখছেন, তখনি আবার মেঘনাদবধের মতো নতুন, জটিল প্রকরণের কাব্যটি পাঠ শেষে তাকে নিয়ে তীব্র আলোচনা করছেন। ভানুসিংহের পদাবলীর চরিত্র বা বিষয় ও দৃষ্টির সঙ্গে মেঘনাদের পার্থক্য গগনচুম্বি। তবে ও তখন নিতান্তই কিশোর, তোমরা যারা বড়, বিশেষ এক উৎসাহে হিন্দুমেলা ক’রে যাচ্ছ। কেবল কৈশোর উত্তীর্ণ রবি হয়তো তোমাদের উদ্দীপনার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। না হলে মধু কবির ওই সমালোচনা রবি করতেন না, পরে অবশ্য রবি বহুবার অনুশোচনা করেছেন। নিজেকেই নিজে প্রকাশ্য রচনায় নিন্দা করেছেন। জ্যোতির চোখে দৃষ্টি পড়ে না, অনেক নিচে নেমে আকাশ নক্ষত্র সাজানো উঠান নিয়ে ঝকঝক করছে। জ্যোতির চোখে সেই নক্ষত্রের সরু আলো, সঞ্জয় এসবের খবরও রাখেন! রবি তবে আত্মসমালোচনা লিখেছিলেন! সঞ্জয় বলেন, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আলোচনায়, পরে এই আলোচনার নিন্দাসহ বিভিন্ন প্রবন্ধে রবি কিন্তু রামায়ণ ও মহাভারত ও দুই আদি কবি বাল্মীকি-ব্যাসদেব সম্পর্কে লিখেছেন। দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী’ গ্রন্থের ভূমিকায় রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে নিজের মত যেমন দিচ্ছেন তেমন প্রাচীন সাহিত্য আলোচনাতে এই দুই মহাকাব্য নিয়ে তাঁর মত প্রকাশ করেছেন। এসবের মধ্যে তাঁর ভারতকে উপলদ্ধি করার ধরন ও কাব্য সম্পর্কে তাঁর সমান্তরাল মত প্রকাশ ক’রে যান।

রবি ‘রামায়ণী’র ভূমিকা লেখেন ১৩১০-এ, তখন ও অনেক পরিণত, অভিজ্ঞতার ভাণ্ড যেমন, তেমন নানা উদ্যোগে ভারত ও তার ঐতিহ্যর মূলকে চিনতে পারছেন, দেখো কত সুন্দর করে ও লিখেছে, ‘রামায়ণী’র ভূমিকায়... ‘এক শ্রেণীর কবি আছে যাহার রচনার ভিতর দিয়া একটি সমগ্র দেশ, একটি সমগ্র যুগ, আপনার হৃদয়কে আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করিয়া তাহাকে মানবের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।... ইহারা যাহা রচনা করেন তাহাকে কোনো ব্যক্তি বিশেষের রচনা বলিয়া মনে হয় না। মনে হয় যেন তাহা বৃহৎ বৃহস্পতির মতো দেশের ভূতলজঠর হইতে উদ্ভূত হইয়া সেই দেশকেই আশ্রয়চ্ছায়া দান করিয়াছে।... রামায়ণ-মহাভারতকে মনে হয় যেন জাহ্নবী ও হিমাচলের ন্যায় তাহারা ভারতেরই, ব্যাস-বাল্মীকি উপলক্ষ মাত্র। বস্তুত ব্যাস-বাল্মীকি তো কাহারও নাম ছিল না। ওতো একটা উদ্দেশে নামকরণ মাত্র’ (রামায়ণী, র র-৩)। জ্যোতি ঠাকুর সঞ্জয়কে থামিয়ে দেন, রবি তো ভালো বলেছেন, ব্যাস-বাল্মীকি কারও নাম নয়! নাম ছিল না, একটা উদ্দেশ্যে নামকরণ। সত্যিই তাই, ওদের জন্ম আবির্ভাব ইতিহাসের কোনো জনপদের নয়, সম্ভবও নয়, অতিপ্রাকৃত ইতিহাসের কথা শুধু প্রাচীন কবিদের অন্তরে সৃষ্টি, ওই নামেরও সৃষ্টি এবং প্রাচীন আর্য্য সভ্যতার ভারতীয় প্রবাহে ওই কাব্যদুটি বিভিন্ন কবির হাতে পর্যায়ক্রমে উৎকর্ষতা অর্জন করে চিরকালের হয়ে ওঠে। সঞ্জয় বলেন, রবিও বলছেন সে কথা, কিন্তু স্বর ভিন্ন, রামায়ণ-মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময়বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে- রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এই ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস। এই দুই বিপুল কাব্যহর্মের মধ্যে চিরকালের সিংহাসন বিরাজমান।’ (ঐ)

জ্যোতি বলেন, মানুষের চিরকালীন আকাক্সক্ষা হলো অশুভ অধর্মের পরাজয়, শুভ, ধন সম্পদ, আয়ু ও প্রেমের জয়, প্রেমের জন্য সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ, রাজ্যজয়, রাজ্যগৌরব, প্রজার মন জয়, তার শান্তি শৃঙ্খলা কামনা এসবই মানুষের চিরকালীন আকাক্সক্ষার ইতিহাস, কোনো কালের ইতিহাস নয়, রবির কথা আমারও। সঞ্জয় একটু ঠেস দিয়ে বলেন, কিন্তু বলতে পারো নি, মহাকবিই এই সত্য বোঝে এবং প্রকাশ করতে পারে। তুমি অতি-প্রাকৃতের কথা বললে, রবিও বলেছেন এভাবে বিদেশীদের মতো ক’রে নয়, ‘প্রকৃতিভেদে একের কাছে যাহা অতিপ্রাকৃত অন্যের কাছে তাহাই প্রাকৃত। ভারতবর্ষ রামায়ণের মধ্যে অতিপ্রাকৃতের আতিশয্য দেখে নাই’ (ঐ)। লক্ষ্য করো, রবি কিন্তু তাঁর কথা বলছেন না, বলছেন ভারতবর্ষের কথা, অর্থাৎ আপামর কথা। কারণ রবি ভালোই জানেন, শ্রুতিযন্ত্রে আমরা যতসংখ্যক শব্দ-তরঙ্গের অভিঘাত উপলব্ধি করতে পারি তাহার সীমা আছে, সেই সীমার উপরের সপ্তকে সুর চড়ালে আমাদের কর্ণ তাকে গ্রহণই করে না। কাব্যে চরিত্র এবং ভাব-উদ্ভাবন সম্বন্ধেও সে-কথা খাটে। তাহলে অতিপ্রাকৃত বর্ণনার এমন কিছুই ইতর বিশেষ ঘটেনি যে ভারতবর্ষের আপামর মানুষ এই মহাকাব্যটিকে উপেক্ষা করতে পারে। রবি বলছেন, ‘রামায়ণ-কথা হইতে ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবণিতা, আপামর সাধারণ কেবল যে শিক্ষা পাইয়াছে তাহা নহে, আনন্দ পাইয়াছে; কেবল যে ইহাকে শিরোধার্য করিয়াছে তাহা নহে, ইহাকে হৃদয়ের মধ্যে রাখিয়াছে; ইহা যে কেবল ধর্মশাস্ত্র তাহা নহে, ইহা তাহাদের কাব্য।’ (ঐ) তোমরা কেউ নও, এই রবিই লিখেছেন কবিতায়, নারদ কবি বাল্মীকিকে বলছেন...

সেই সত্য যা রচিবে তুমি

ঘটে যা তা সব সত্য নহে।

কবি, তব মনোভূমি

রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।

(ভাষা ও ছন্দ)

বাল্মীকি নারদকে যে প্রশ্ন করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাংলায় লিখছেন ওই ‘রামায়ণী’ নিবন্ধে- “কোন্ একটিমাত্র নর”কে আশ্রয় করিয়া সমগ্র লক্ষ্মী রূপ গ্রহণ করিয়াছেন?’ তখন উত্তরে নারদ বললেন, ‘এত গুণযুক্ত পুরুষ তো দেবতাদের মধ্যেও দেখি না। তবে যে নরচন্দ্রমার মধ্যে এই সকল গুণ আছে তাহার কথা শুন। রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই কথা দেবতার কথা নহে।’

বাল্মীকির কাব্যে ওই পুরুষ চিত্রিত হন, রামচন্দ্র নামে। ইতিহাসে নয়, এই পুরাণ কাব্যেই সেই রামের ইতিহাস কাব্যসত্যে নির্মিত হলো। আবার রবি রামায়ণকে শুধুমাত্র কাব্য বলেই বিবেচনা করছেন না। তাঁর পাঠকদের বলছেন, ‘বাল্মীকির রামচরিত-কথাকে পাঠকগণ কেবলমাত্র কাব্য বলিয়া দেখিবেন না, তাহাকে ভারতবর্ষের রামায়ণ বলিয়া জানিবেন। তাহা হইলে রামায়ণের দ্বারা ভারতবর্ষকে ও ভারতবর্ষের দ্বারা রামায়ণকে যথার্থভাবে বুঝিতে পারিবেন। ইহা স্মরণ করিবেন যে, কোনো ঐতিহাসিক গৌরবকাহিনী (রামায়ণ) নহে, পরন্তু পরিপূর্ণ মানবের আদর্শ-চরিত ভারতবর্ষ শুনিতে চাহিয়াছিল এবং আজ পর্যন্ত তাহা অশ্রান্ত আনন্দের সহিত শুনিয়া আসিতেছে’ (ঐ)। তাহলে, রবির কাছে রামায়ণ-মহাভারত কখনো ইতিহাস নয়, ভারতবর্ষের আবেগপ্রবণ মানুষের তুমুল আকাক্সক্ষার কাব্য ও চিরকালীন ইতিহাস। তবে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনার সময় ওর অপরিণত মনে এবং হয়তো অন্যদের তৈরি পরিবেশের চাপ পড়েছিল বলা যায়। তোমাদের বা আরও পরবর্তীকালের একটি পাঠ দেখা যাক এই প্রসঙ্গের। তবে আগে মহাভারত ও রামায়ণ প্রসঙ্গে ‘কুমারসম্ভব’ ও ‘শকুন্তলা’ আলোচনায় রবির উপলব্ধি দেখো, ‘মহাভারতে যে-একটা বিপুল কর্মের আন্দোলন দেখা যায় তাহার মধ্যে একটি বৃহৎ বৈরাগ্য স্থির অনিমেষভাবে রহিয়াছে। মহাভারতের কর্মেই কর্মের চরম প্রাপ্তি নহে। তাহার সমস্ত শৌর্যবীর্য, রাগদ্বেষ, হিংসা-প্রতিহিংসা, প্রয়াস ও সিদ্ধির মাঝখানে শ্মশান হইতে মহাপ্রস্থানের ভৈরবসংগীত বাজিয়া উঠিতেছে। রামায়ণেও তাহাই; পরিপূর্ণ আয়োজন ব্যর্থ হইয়া যায়, করায়ত্ত সিদ্ধি স্খলিত হইয়া পড়ে- সকলেরই পরিণামে পরিত্যাগ। অথচ এই ত্যাগে দুঃখে নিষ্ফলতাতেই কর্মের মহত্ত্ব ও পৌরুষের প্রভাব রজতগিরির ন্যায় উজ্জ্বল অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে’ (প্রাচীন সাহিত্য, র র ৩য় খণ্ড)।

সময়টা শ্রাবণ ১২৮৪ (১৮৭৭), রবীন্দ্রনাথ তখন ষোল বছরের কিশোর, তরুণ বয়সের আরম্ভ মাত্র। বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় ‘জ্যোতিদাদার’ উদ্যোগে ‘ভারতী’ প্রকাশ হয়। ঠাকুর পরিবারের উৎসাহ ও সহযোগিতায় সামাজিক সাংস্কৃতিক আলোড়ন সৃষ্টির ভিতর ‘ভারতী’ পত্রিকা আরও একটি নতুন সংযোজন হলো। আর রবীন্দ্রনাথের জন্য ‘মোটের উপর এই সময়টা আমার পক্ষে একটা উন্মত্ততার সময় ছিল।’ এ-সময়ে তিনি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনার মাধ্যমে ভারতী-তে প্রথম লিখতে আরম্ভ করেন। বাংলা ভাষা ও কাব্যে নতুন, নিরীক্ষাধর্মী আঙ্গিক, নতুন ছন্দ সর্বোপরি ঐতিহ্যগত বিশ্বাস সংস্কারের বিপরীতে নতুন চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির কাব্য ‘মেঘনাদবধ’ সম্পর্কে ষোল বছরের রবীন্দ্রনাথ ‘তীব্র সমালোচনা’ এবং ‘দাম্ভিক সমালোচনাটা’ লেখেন। সে-আলোচনার ভাষা, যুক্তি, আবেগ এবং দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর কাঁচা বয়সের অপরিণত বুদ্ধির সকল প্রকাশই ঘটে। শুরুতে ট্র্যাজেডি ও মহাকাব্য সম্পর্কে নিজের ধারণার উল্লেখ শেষে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “অনেকে জানেন না, সমস্তটা নিকাশ করিয়া ফেলিলে অনেক সময় ট্র্যাজেডির ব্যাঘাত হয়। অনেক সময় সেমিকোলনে যতটা ট্র্যাজেডি থাকে দাঁড়িতে ততটা থাকে না’ (র র পঞ্চদশ খণ্ড)। লেখেন- ... “তিনি মহাকাব্য-রচনার যোগ্য কবি নহেন। মহত্ত্ব দেখিয়া তাঁহার (মাইকেল মধুসূদন দত্ত) কল্পনা উত্তেজিত হয় না। নহিলে তিনি কোন্ প্রাণে রামকে স্ত্রীলোকের অপেক্ষা ভীরু ও লক্ষ্মণকে চোরের অপেক্ষা হীন করিতে পারিলেন! দেবতাদিগকে কাপুরুষের অধম ও রাক্ষসদিগকেই দেবতা হইতে উচ্চ করিলেন!” (্ঐ) অথবা ‘মাইকেল জানেন অনেক মহাকাব্যে স্বর্গ-নরক বর্ণনা আছে; অমনি জোর-জবরদস্তি করিয়া কোনো প্রকারে কায়ক্লেশে অতি সংকীর্ণ, অতি বস্তুগত, অতি পার্থিব, অতি বীভৎস এক স্বর্গ-নরক-বর্ণনার অবতরণ করিলেন।’ সমালোচনার শেষ দু’টি বাক্য এমন, ‘হে বঙ্গমহাকবিগণ! লড়াই-বর্ণনা তোমাদের ভালো আসিবে না, লড়াই-বর্ণনায় তেমন প্রয়োজনও দেখিতেছি না। তোমরা কতকগুলি মনুষ্যত্বের আদর্শ সৃজন করিয়া দেও’ (র র পঞ্চদশ খণ্ড)।

ভারতী পত্রিকা প্রকাশের কিছু আগে থেকে ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে চৈত্রসংক্রান্তিতে ‘চৈত্রমেলা’ পরে উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য সাপেক্ষে নাম বদলে ‘হিন্দুমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল, গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথের কাকা গিরীন্দ্রনাথের বড় সন্তান) সম্পাদক নবগোপাল মিত্র ছিলেন সহকারী সম্পাদক। হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনায় হিন্দুসম্প্রদায়ের সকল গোত্রের এক সাংস্কৃতিক মহাসম্মিলন ঘটতো মেলায়। ‘হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের লেখক যোগেশচন্দ্র বাগল জানিয়েছেন, মেলার সম্পাদক গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে বলেন, ‘এই মেলার প্রথম উদ্দেশ্য বৎসরের শেষে হিন্দু জাতিকে একত্রিত করা। যত লোকের জনতা হয় ততই ইহা হিন্দু মেলা ও ইহা হিন্দুদিগের জনতা এই মনে হইয়া হৃদয় আনন্দিত ও স্বদেশানুরাগ বর্ধিত হইয়া থাকে।’ আর মেলার অন্যতম প্রধান সংগঠক মনোমোহন বসুর মতে ‘অসম্বন্ধ হিন্দু-সমাজের মধ্যে ঐক্য স্থাপন’, ‘সম্বৎসরের মধ্যে হিন্দু সমাজের যে কিছু উন্নতি বা দুর্গতি হইয়াছে’ তার সমীক্ষা এবং ‘যে সমস্ত দেশস্থ মহাশয়েরা স্বজাতীয় ও স্বাবলম্বিত শিক্ষাদানে ব্রতী হইয়াছেন বা হইবেন, তাহাদিগকে সমুচিত উৎসাহ প্রদান।’ তরুণ রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনা লিখবার এবং ভারতী প্রকাশের ওই ১৮৭৭ সালেই লিখেছিলেন, ‘লর্ড কার্জনের সময় দিল্লি দরবার সম্বন্ধে একটা গদ্যপ্রবন্ধ’ যা তিনি পড়েছিলেন ‘হিন্দুমেলার গাছের তলায় দাঁড়াইয়া।’ আর পাঠ করেছিলেন ১৮৭৫ সালে ‘হিন্দুমেলার উপহার’ কবিতাটি।

কিশোর-তরুণ রবীন্দ্রনাথের ওপর ব্যাপক প্রভাব ও প্রেরণা ছিলেন তাঁর ‘প্রধান সহায়’ জ্যোতিদাদা। হিন্দুমেলার উদ্দীপনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পর পর কয়েকটি নাটক লেখেন হিন্দুবীরের বীরত্ব ও বিজয় গৌরব নিয়ে। এই বীরের প্রতিপক্ষ অবশ্য সাম্রাজ্যবাদ বৃটিশ নয়, ছিল মুসলমান বা তাঁর নাটকের ‘যবন’ সম্প্রদায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ জ্যোতি ঠাকুরের ‘সরোজিনী’ নাটকে যবন বিদ্বেষী গান লিখে দিয়ে জ্যোতিদাদার অকুণ্ঠ প্রশংসা ভোগ করেছিলেন। জ্যোতিদাদার নাটকে হিন্দুবীর সেনার যবন নিধনের বীরত্বে খোদ বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’-এ অতি বীররসের কটাক্ষ করেছিলেন। ‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য হিন্দুমেলা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলবদ্ধির চেষ্টা সেই প্রথম হয়।’ জীবনস্মৃতিতে রবি এই মত লেখেন যখন (১৯১২) তখন তিনিও বালক নন যে কারও কর্ম ও ব্যক্তিত্বের চাপে প্রভাবিত হবেন এমন সম্ভাবনা ক্রমে তিরোহিত। কিশোর কবি রবীন্দ্রনাথ আলোড়িত হয়েছিলেন এর সাংস্কৃতিক ও জাতীয়তাবোধ জাগরণে। ঠিক এসময়েই জ্যোতিদাদার নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল ‘সঞ্জীবনী সভা’ নামে এক সভার। ঋগবেদ উচ্চারণের ভিতর এই সভা হতো। এই সভায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভারতীয় জাতীয় পোশাক নিয়ে তাঁর চিন্তা প্রকাশের প্রয়াস পান, কারণ ‘ধূতিটা কর্মক্ষেত্রের উপযোগী নহে অথচ পায়জামাটা বিজাতীয়’ (জীবনস্মৃতি র র নবম খণ্ড)। এমন সাংস্কৃতিক সামাজিক প্রেক্ষাপট ভগবানের অবতার রাম, লক্ষ্মণ ও দেব-দেবতাদের নিয়ে কটাক্ষ অপরপক্ষে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগী মাইকেলের রাবণ, রাক্ষস তথা ইতরজনের উচ্চতর আদর্শে প্রতিষ্ঠা রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেননি তখন। পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘রামায়ণী’ ভূমিকা নিবন্ধে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছেন রাম মানুষ, ভগবান বা কারও অবতার নয়, ‘দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এই কাব্য রচিত তাহা নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন- পণ্ডিতেরা ইহা প্রমাণ করিবেন।... এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলিতেছি যে, কবি যদি রামায়ণে নরচরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত...।’

মেধনাদবধের নতুনত্ব, কাব্য সৌন্দর্য, শ্রেণীনিরপেক্ষ নতুন ও উন্নত চিন্তা এবং এর কাব্যসত্য ষোল বছরের রবীন্দ্রনাথের কাছে অবোধ্য হতেই পারে। মাইকেল এবং বাংলা সাহিত্যের জন্য সৌভাগ্য এই, পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘কাঁচা বয়সের’ দাম্ভিকতাকে তীব্র নিন্দা ক’রে মেঘনাদবধ কাব্যকে ‘অমর কাব্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। ‘জীবনস্মৃতি’ (১৯১২)-তে লেখেন, ‘ইতিপূর্বেই আমি অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদবধের তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস- কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্যর ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীক্ষè হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম। এই দাম্ভিক সমালোচনাটা দিয়া আমি ‘ভারতী’তে প্রথম লেখা আরম্ভ করিয়াছিলাম’ (জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, নবম খণ্ড)।

রবীন্দ্রোত্তর প্রধান সাহিত্য ব্যক্তিত্ব কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর পূর্ব ও পরবর্তী সকল প্রধান সাহিত্য ও সাহিত্য ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে আলোচনা ও মূল্যায়ন করেছেন। কালিদাস-মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-সুধীন্দ্র-অমিয় সকলের সম্পর্কে বুদ্ধদেব নিজস্ব পাঠ ভাবনা অপূর্ব ভাষাশৈলীতে অকপটে প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন নি। ‘মাইকেল’ প্রবন্ধে (১৯৪৫) বুদ্ধদেব বসু মেঘনাদবধ কাব্যের তীব্র সমালোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করেন পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের মেঘনাদবধ কাব্যকে প্রশংসার জন্য। বুদ্ধদেব বসু রবির বালক বয়সের ‘কাঁচা’ সমালোচনাকেই রবির মত হিসেবে শিরোধার্য করতে চান। যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর বালক বয়সের রচনাকে কাঁচাবয়সের উত্তেজনা দাম্ভিকতা বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জীবনস্মৃতিতে তাঁর মত আমরা দেখেছি। বুদ্ধদেব বসুর ‘মাইকেল’ নিবন্ধে ‘মেঘনাধবধ কাব্য’ আলোচনায় ‘কালোপাহাড়ি’ সমালোচনা তীব্র হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যসৃষ্টি’ (আষাঢ় ১৩১৪) প্রবন্ধে মেঘনাদবধ কাব্য সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট মত পড়ে। এবং বুদ্ধদেব বসু ভুল (!) ক’রে বলেন, ‘তারুণ্যের সত্যভাষণ ভারতীতে প্রকাশিত হবার পঁচিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ অগ্রজ-নিন্দার প্রায়শ্চিত্তের চেষ্টা করলেন সাহিত্যসৃষ্টি প্রবন্ধে।’ প্রকৃতপক্ষে, বাংলা ১২৮৪’র শ্রাবণ-কার্তিক, পৌষ-ফাণ্ডুন সংখ্যায় ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সমালোচনা ধারাবাহিকতাভাবে প্রকাশিত হয়। ওই ‘ভারতী’তেই সাহিত্যসৃষ্টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৩১৪ সালে, তিরিশ বছরের ব্যবধানে। শুধু আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসই নয়, ভারতবর্ষের মনীষীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে বদলেছেন সদর্ধক অর্থে, বোধ উপলব্ধি বিশ্বালোকে নতুন ক’রে দেখার প্রয়াসী তিনি ছিলেন। বুদ্ধদেব কথিত প্রায়শ্চিত্ত নয়, ব্যাপক পাঠ ও জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে উপলব্ধির নবায়ন। ইউরোপীয় কবিতার রীতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে বাংলা কবিতার সম্পর্ক ও সংস্কার মাইকেল মধুসূদনের হাতে প্রথম উল্লেখযোগ্যভাবে শুরু হয়। তিনি বাংলা কবিতার ছন্দে অমিত্রাক্ষর রীতির প্রয়োগ করেছেন ইংরেজি কাব্য থেকে, বীরাঙ্গনা কাব্য লিখেছেন অভিড কাব্যের অনুসরণে। বাংলায় সনেটের সূচনা করেছেন পেত্রার্কের আদর্শে। মেঘনাদবধ কাব্যে ‘অমিতত্রাক্ষরের নিঃসংশয় প্রতিষ্ঠা। এখানে আছে নানা ইউরোপীয় কবিতার অন্তর্বয়ন, এখানে আছে এক গ্রীক মহাকাব্যের কাঠামোর মধ্যে নতুন ক’রে রামায়ণ রচনা। মেঘনাদবধ কাব্য ও মাইকেল মধুসূদন বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসের অঙ্গাঙ্গিবদ্ধ কাব্য ও জীবন’ (শিশিরকুমার দাশ)। বুদ্ধদেব বসু বালক রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার ভাষা অনুকরণ ক’রে কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলেন, ‘উত্তর-রবীন্দ্রের ভাষায় বলতে গেলে, মেঘনাদবধ কাব্য হয়ে-ওঠা পদার্থ নয়, একটা বানিয়ে তোলা জিনিস। আয়োজনের, আড়ম্বরের অভাব নেই, সাজসজ্জার ঘটাও খুব, কিন্তু সমস্ত জিনিসটা আগাগোড়াই মৃত, কোথাও আমাদের প্রাণে নাড়া দেয় না, হৃদয়ে আন্দোলন তোলে না।’ ক্রমশ...