হাইকু নিয়ে কিছু কথা

শরীফ আস্-সাবের

অল্প কথায় অনেক কিছু বলতে পারার মধ্যেই কবি ও কবিতার সার্থকতা। কবিতার দৈর্ঘের চাইতে তার গুণগত মান, বক্তব্য, সাবলীলতা এবং আবেদন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি রফিক আজাদের লেখা এক লাইনের একটি কবিতা পড়েছিলাম ‘ঈশ্বর হলেন অগ্নি, যিনি এ হৃদয়ে থাকেন (রফিক আজাদ, ‘ঈশ্বর’, সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে, ১৯৭৪)। মনের মধ্যে দাগ কেটে যাওয়া সেই কবিতাটি আমার সবচে’ প্রিয় কবিতার মধ্যে একটি। একই সাথে, সদ্য প্রয়াত প্রিয় কবিবন্ধু আলম তালুকদারের একটি শক্তিশালী এক লাইনের কবিতার উল্লেখ করতে চাই, ‘যারা ক্ষমতায় ইতিহাস তাদের’ (কবি আলম তালুকদারের ফেইসবুক টাইমলাইন, ১৭ মে ২০২০)। উর্দু ভাষায় লেখা ‘জুরা’ (couplet) ও ‘রুবাই’-এর ভক্ত আমি। ‘ময়মনসিংংহ গীতিকা’র চটুল চতুর্পদী এবং খনা’র বচনের দ্বিপদী প্রকাশও আমাকে সমানভাবে বিমোহিত করে। জাপানি অনুকবিতা হাইকুর সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিন আগের। তথাপি, বলতে দ্বিধা নেই, হাইকুর বিমূর্ত (abstract) প্রকাশ এবং বাংলা ভাষায় এর তুলনামলক দুর্বল উপস্থিতি আমার মধ্যে হাইকু সম্পর্কে তেমন একটা আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি।

তবে, সম্প্রতি ফেইসবুকে আমার প্রিয় দুই কবি, আবিদ আনোয়ার এবং রহিমা আখতার কল্পনার বাংলা ‘প্রকরণসিদ্ধ’ হাইকু বিষয়ক কতিপয় পোস্ট দেখার পর মনে হলো, হাইকু সম্পর্কে আরো কিছু জানা দরকার। এই দফায়, নতুন নতুন হাইকু এবং হাইকুর প্রকৃতি, গড়ন, ধৃতি ও নিষ্কর্ষ সম্পর্কে বিভিন্ন লেখালেখি পড়তে পড়তে শেষমেশ এর প্রেমেই পড়ে গেলাম!

যাই হোক, কবি আবিদ আনোয়ারের ২০১০ সালে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হাইকু বিষয়ক লেখাটিতে বহু বছর পর আবারো চোখ বুলালাম। এর মধ্যে ‘কালি ও কলমে’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ‘হাইকুর নান্দনিকতা’ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘বর্ষার হাইকু’ এবং বাংলা ট্রিবিউনে ২০১৮ সালে প্রকাশিত অহ নওরোজের ‘হাইকুর প্রসঙ্গ-কথা’ লেখাসহ বেশ কিছু লেখা পড়ে নিলাম।

জাপানী হাইকু লিজেন্ড বাশো, সিকি, বুসন, ইসা, টাকাহামা ও কিকাকুর লেখা কিছু হাইকুর ইংরেজি অনুবাদসহ বিভন্ন সময়কালে লেখা মূল বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা বেশ কিছু হাইকু পড়তে গিয়ে মনে হলো, হাইকু সত্যিকার অর্থে রস, বিন্যাস, অভিব্যক্তি ও আবেদনে অনন্য এক কাব্য প্রকরণ। তবে, কালের পরিক্রমায় হাইকুর ধরন পাল্টেছে আর বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে এসে তা পরিগ্রহ করেছে বিবিধ আদল ও বিন্যাস।

বাংলায় হাইকু চর্চার গোড়াপত্তনটা রবি ঠাকুর করে গেলেও বাংলায় শুদ্ধ হাইকু চর্চা শুরু হয় আরো অনেক পরে। তবে কাব্যের একটি সতন্ত্র শাখা হিসাবে এর ব্যবহার ও পাঠকপ্রিয়তা এখনো বেশ সীমিত। দুই বাংলার কিছু হাইকু এবং এতদসংক্রান্ত আলোচনা পড়ে মনে হলো, হাইকু এখনো বাংলায় সর্বজনগ্রাহ্য কোনো একক গঠন, ছন্দ ও প্রকৃতি ধারণ করে উঠতে পারেনি। যদিও এর প্রকরণগত সাযুজ্য ও যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

যাই হোক হাইকু সম্পর্কে লেখালেখি শুরুর আগে ‘হাইকু’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক। তিন লাইনের শরীর নিয়ে হাইকুর উৎপত্তি ও বিকাশ জাপানে। হাইকু শব্দটিকে ভেঙে দিলে আমরা পাই, ‘হাই’ , যার অর্থ হচ্ছে, ‘খেলা করা’ আর ‘কু’ মানে ‘শব্দ’ বা ‘কথা’। প্রতিটি হাইকুতে দুটি চিত্রকল্পের সন্নিধি (Juxtaposition) ও মিথস্ক্রিয়ায় ফুটে ওঠে এক কাব্যিক ব্যঞ্জনা। এই পর্যায়ে, মাতসুও বাশোর একটি জনপ্রিয় কবিতার উদাহরণ আমরা দেখে নিতে পারি, ‘ফুরু ইকে য়া/কাওয়াজু তবিকোমু/মিজু নো ওতো’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর অনুবাদ করেছেন এইভাবে, ‘পুরোনো পুকুর,/ব্যাঙের লাফ,/জলের শব্দ’। এই নাতিদীর্ঘ ঘরানার কবিতার পরিচয় করিয়ে দিতে রবি ঠাকুর বলেন, ‘এই তিন লাইনই ওদের কবি, পাঠক, উভয়ের পক্ষে যথেষ্ট... এদের হৃদয় ঝরনার জলের মতো শব্দ করে না, সরোবরের জলের মতো স্তব্ধ... হৃদয়ের দাহ ক্ষোভ প্রাণকে খরচ করে, এদের সেই খরচ কম। এদের অন্তরের সমস্ত প্রকাশ সৌন্দর্য্যবোধে... তিন লাইনেই এদের কুলোয়, এবং কল্পনাতেও এরা শান্তির ব্যাঘাত করে না (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাপান যাত্রী, ইন্ডিয়ান পাব্লিশিং হাউস, ১৯৩১)।

এই পর্যায়ে, জাপানী হাইকুতে ব্যবহৃত মারা, কানা, টংকা, কিগো, কিরেজি ইত্যাদি বিষয়গুলির খানিক অনুধাবন করা জরুরি। বাংলায় হাইকুর মাত্রা ও ছন্দবিন্যাস বিষয়ে আবিদ আনোয়ার কৃত ডেইলি স্টারের তথ্যবহুল লেখাটির সঙ্গে আমি মোটামুটি সহমত। তবে বাংলা হাইকু লেখায় ‘মোরা’ বা মাত্রা হিসাবে মাত্রাবৃত্তের একক ব্যবহারে আমার কিছুটা আপত্তি আছে। মাত্রাবৃত্ত বাংলায় সম্ভবত সব চাইতে জুতসই ছন্দ। তবে, জাপানী ‘মারা’ কিংবা ‘কানা’ যেহেতু ঠিক বাংলা মাত্রা অথবা ইংরেজি syllable-এর গঠনের সঙ্গে পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ নয়, সেই হিসাবে যে কোনো একটি মাত্রার রক্ষনশীল ব্যবহারে হাইকুকে সীমাবদ্ধ করা হয়তো ঠিক নয়। হাইকু বিশেষজ্ঞ, আর এইচ ব্লাইথ-এর মতে, ‘হাইকু কবিতা কিংবা সাহিত্য কোনটিই নয়... হাইকু নীরব ভাষায় নির্মিত এক পরিষ্কার আয়না কিংবা অর্ধ উন্মুক্ত দরজা যা পথের নিশানা দেখায়... যদিও তা ‘কেন’, ‘কোথায়’, ‘কীভাবে’ কিছুই নির্দেশ করে না’ (R.H. Blyth, Haiku, Volume 1: Eastern Culture, Hokuseido Press, ToKzo, 1949)।

যুগলবন্দী চালের (২, ৪, ৬, ৮...) কারণে হাইকুতে অক্ষরবৃত্তের ব্যবহার সম্ভব নয় ঠিক। তবে স্বরবৃত্ত ও মুক্তক ছন্দে হাইকু লেখায় তেমন সমস্যা না হলেও শ্রুতি ও লয়ে মাত্রাবৃত্ত ‘মুহূর্তকাব্য’ হিসাবে হাইকুর ‘আহ্ত্ব’কে (‘আহ্’ অনুভুতি) মূর্ত করার ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি পারঙ্গম। তবে, এর মানে এই নয় যে, স্বরবৃত্ত কিংবা মুক্তকে হাইকু লেখা যাবে না। এই ক্ষেত্রে জাপানী ‘মারা’ আমার কাছে স্বরবৃত্তের কাছাকাছি ছন্দ হিসাবেই প্রতিভাত হয়, মাত্রা বা অক্ষরবৃত্ত নয়। এ প্রসঙ্গে, বাশাও এর ৫-৭-৫ মাত্রার ইংরেজি উচ্চারণে লিপিবদ্ধ একটি হাইকুর উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য, “ha-tsu shi-gu-re (5) /sa-ru mo ko-mi-no o (৭)/ho-shi-ge na-ri” (৫) (অহ নওরোজ, হাইকুর প্রসঙ্গ-কথা, বাংলা ট্রিবিউন, ২৭ মে , ২০১৮)।

জাপানি এবং ইংরেজি হাইকুতে অন্ত্যমিল আবশ্যক নয়। বাংলায় প্রথম ও তৃতীয় চরণের অন্ত্যমিল শ্রুতিমধুর হলেও তা অত্যাবশ্যক নয়। জাপানী কেতায় বাংলা হাইকুতে যতিচিহ্নের ব্যবহারে অনেকের আপত্তি থাকলেও আমি মনে করি বাংলায় যতিচিহ্নবিহীন লেখা অনেক সময় খাপছাডা হয়ে যেতে পারে। ঋতু, প্রকৃতি ও চিত্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। তবে হাইকু জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই অবশ্যবলয় থেকে বেড়িয়ে আসছে এবং এ নিযে চলছে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা।

সব মিলিয়ে, বাংলায় হাইকু চর্চা বাড়াতে ছন্দ প্রকরণ এবং অন্ত্যমিল বিষয়ে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়তো বা মন্দ কিছু নয়। এর ফলে হাইকুর বৈচিত্র্যময়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে লেখক ও পাঠক সংখ্যা।

সব শেষে সবার সঙ্গে তিন আঙ্গিকে লেখা আমার তিনটি হাইকু শেয়ার করছি:

১.

আকাশে মেঘ,

সূর্যটা আড়ালে,

ঝড়ো আবেগ।

(মাত্রাবৃত্ত)

২.

চাঁদ গলে পড়ে

এই ভরা শস্যের খেতে

নদীর কিনারে।

(স্বরবৃত্ত)

৩.

নদীতে জল নেই

মৃত্তিকা ফেটে চৌচির

কাঁদে চাতকী।

(স্বরবৃত্ত, অন্ত্যমিলহীন)

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

হাইকু নিয়ে কিছু কথা

শরীফ আস্-সাবের

image

অল্প কথায় অনেক কিছু বলতে পারার মধ্যেই কবি ও কবিতার সার্থকতা। কবিতার দৈর্ঘের চাইতে তার গুণগত মান, বক্তব্য, সাবলীলতা এবং আবেদন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি রফিক আজাদের লেখা এক লাইনের একটি কবিতা পড়েছিলাম ‘ঈশ্বর হলেন অগ্নি, যিনি এ হৃদয়ে থাকেন (রফিক আজাদ, ‘ঈশ্বর’, সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে, ১৯৭৪)। মনের মধ্যে দাগ কেটে যাওয়া সেই কবিতাটি আমার সবচে’ প্রিয় কবিতার মধ্যে একটি। একই সাথে, সদ্য প্রয়াত প্রিয় কবিবন্ধু আলম তালুকদারের একটি শক্তিশালী এক লাইনের কবিতার উল্লেখ করতে চাই, ‘যারা ক্ষমতায় ইতিহাস তাদের’ (কবি আলম তালুকদারের ফেইসবুক টাইমলাইন, ১৭ মে ২০২০)। উর্দু ভাষায় লেখা ‘জুরা’ (couplet) ও ‘রুবাই’-এর ভক্ত আমি। ‘ময়মনসিংংহ গীতিকা’র চটুল চতুর্পদী এবং খনা’র বচনের দ্বিপদী প্রকাশও আমাকে সমানভাবে বিমোহিত করে। জাপানি অনুকবিতা হাইকুর সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিন আগের। তথাপি, বলতে দ্বিধা নেই, হাইকুর বিমূর্ত (abstract) প্রকাশ এবং বাংলা ভাষায় এর তুলনামলক দুর্বল উপস্থিতি আমার মধ্যে হাইকু সম্পর্কে তেমন একটা আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি।

তবে, সম্প্রতি ফেইসবুকে আমার প্রিয় দুই কবি, আবিদ আনোয়ার এবং রহিমা আখতার কল্পনার বাংলা ‘প্রকরণসিদ্ধ’ হাইকু বিষয়ক কতিপয় পোস্ট দেখার পর মনে হলো, হাইকু সম্পর্কে আরো কিছু জানা দরকার। এই দফায়, নতুন নতুন হাইকু এবং হাইকুর প্রকৃতি, গড়ন, ধৃতি ও নিষ্কর্ষ সম্পর্কে বিভিন্ন লেখালেখি পড়তে পড়তে শেষমেশ এর প্রেমেই পড়ে গেলাম!

যাই হোক, কবি আবিদ আনোয়ারের ২০১০ সালে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হাইকু বিষয়ক লেখাটিতে বহু বছর পর আবারো চোখ বুলালাম। এর মধ্যে ‘কালি ও কলমে’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হাসনাত আব্দুল হাইয়ের ‘হাইকুর নান্দনিকতা’ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘বর্ষার হাইকু’ এবং বাংলা ট্রিবিউনে ২০১৮ সালে প্রকাশিত অহ নওরোজের ‘হাইকুর প্রসঙ্গ-কথা’ লেখাসহ বেশ কিছু লেখা পড়ে নিলাম।

জাপানী হাইকু লিজেন্ড বাশো, সিকি, বুসন, ইসা, টাকাহামা ও কিকাকুর লেখা কিছু হাইকুর ইংরেজি অনুবাদসহ বিভন্ন সময়কালে লেখা মূল বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা বেশ কিছু হাইকু পড়তে গিয়ে মনে হলো, হাইকু সত্যিকার অর্থে রস, বিন্যাস, অভিব্যক্তি ও আবেদনে অনন্য এক কাব্য প্রকরণ। তবে, কালের পরিক্রমায় হাইকুর ধরন পাল্টেছে আর বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে এসে তা পরিগ্রহ করেছে বিবিধ আদল ও বিন্যাস।

বাংলায় হাইকু চর্চার গোড়াপত্তনটা রবি ঠাকুর করে গেলেও বাংলায় শুদ্ধ হাইকু চর্চা শুরু হয় আরো অনেক পরে। তবে কাব্যের একটি সতন্ত্র শাখা হিসাবে এর ব্যবহার ও পাঠকপ্রিয়তা এখনো বেশ সীমিত। দুই বাংলার কিছু হাইকু এবং এতদসংক্রান্ত আলোচনা পড়ে মনে হলো, হাইকু এখনো বাংলায় সর্বজনগ্রাহ্য কোনো একক গঠন, ছন্দ ও প্রকৃতি ধারণ করে উঠতে পারেনি। যদিও এর প্রকরণগত সাযুজ্য ও যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

যাই হোক হাইকু সম্পর্কে লেখালেখি শুরুর আগে ‘হাইকু’ শব্দের অর্থ সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক। তিন লাইনের শরীর নিয়ে হাইকুর উৎপত্তি ও বিকাশ জাপানে। হাইকু শব্দটিকে ভেঙে দিলে আমরা পাই, ‘হাই’ , যার অর্থ হচ্ছে, ‘খেলা করা’ আর ‘কু’ মানে ‘শব্দ’ বা ‘কথা’। প্রতিটি হাইকুতে দুটি চিত্রকল্পের সন্নিধি (Juxtaposition) ও মিথস্ক্রিয়ায় ফুটে ওঠে এক কাব্যিক ব্যঞ্জনা। এই পর্যায়ে, মাতসুও বাশোর একটি জনপ্রিয় কবিতার উদাহরণ আমরা দেখে নিতে পারি, ‘ফুরু ইকে য়া/কাওয়াজু তবিকোমু/মিজু নো ওতো’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর অনুবাদ করেছেন এইভাবে, ‘পুরোনো পুকুর,/ব্যাঙের লাফ,/জলের শব্দ’। এই নাতিদীর্ঘ ঘরানার কবিতার পরিচয় করিয়ে দিতে রবি ঠাকুর বলেন, ‘এই তিন লাইনই ওদের কবি, পাঠক, উভয়ের পক্ষে যথেষ্ট... এদের হৃদয় ঝরনার জলের মতো শব্দ করে না, সরোবরের জলের মতো স্তব্ধ... হৃদয়ের দাহ ক্ষোভ প্রাণকে খরচ করে, এদের সেই খরচ কম। এদের অন্তরের সমস্ত প্রকাশ সৌন্দর্য্যবোধে... তিন লাইনেই এদের কুলোয়, এবং কল্পনাতেও এরা শান্তির ব্যাঘাত করে না (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাপান যাত্রী, ইন্ডিয়ান পাব্লিশিং হাউস, ১৯৩১)।

এই পর্যায়ে, জাপানী হাইকুতে ব্যবহৃত মারা, কানা, টংকা, কিগো, কিরেজি ইত্যাদি বিষয়গুলির খানিক অনুধাবন করা জরুরি। বাংলায় হাইকুর মাত্রা ও ছন্দবিন্যাস বিষয়ে আবিদ আনোয়ার কৃত ডেইলি স্টারের তথ্যবহুল লেখাটির সঙ্গে আমি মোটামুটি সহমত। তবে বাংলা হাইকু লেখায় ‘মোরা’ বা মাত্রা হিসাবে মাত্রাবৃত্তের একক ব্যবহারে আমার কিছুটা আপত্তি আছে। মাত্রাবৃত্ত বাংলায় সম্ভবত সব চাইতে জুতসই ছন্দ। তবে, জাপানী ‘মারা’ কিংবা ‘কানা’ যেহেতু ঠিক বাংলা মাত্রা অথবা ইংরেজি syllable-এর গঠনের সঙ্গে পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ নয়, সেই হিসাবে যে কোনো একটি মাত্রার রক্ষনশীল ব্যবহারে হাইকুকে সীমাবদ্ধ করা হয়তো ঠিক নয়। হাইকু বিশেষজ্ঞ, আর এইচ ব্লাইথ-এর মতে, ‘হাইকু কবিতা কিংবা সাহিত্য কোনটিই নয়... হাইকু নীরব ভাষায় নির্মিত এক পরিষ্কার আয়না কিংবা অর্ধ উন্মুক্ত দরজা যা পথের নিশানা দেখায়... যদিও তা ‘কেন’, ‘কোথায়’, ‘কীভাবে’ কিছুই নির্দেশ করে না’ (R.H. Blyth, Haiku, Volume 1: Eastern Culture, Hokuseido Press, ToKzo, 1949)।

যুগলবন্দী চালের (২, ৪, ৬, ৮...) কারণে হাইকুতে অক্ষরবৃত্তের ব্যবহার সম্ভব নয় ঠিক। তবে স্বরবৃত্ত ও মুক্তক ছন্দে হাইকু লেখায় তেমন সমস্যা না হলেও শ্রুতি ও লয়ে মাত্রাবৃত্ত ‘মুহূর্তকাব্য’ হিসাবে হাইকুর ‘আহ্ত্ব’কে (‘আহ্’ অনুভুতি) মূর্ত করার ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি পারঙ্গম। তবে, এর মানে এই নয় যে, স্বরবৃত্ত কিংবা মুক্তকে হাইকু লেখা যাবে না। এই ক্ষেত্রে জাপানী ‘মারা’ আমার কাছে স্বরবৃত্তের কাছাকাছি ছন্দ হিসাবেই প্রতিভাত হয়, মাত্রা বা অক্ষরবৃত্ত নয়। এ প্রসঙ্গে, বাশাও এর ৫-৭-৫ মাত্রার ইংরেজি উচ্চারণে লিপিবদ্ধ একটি হাইকুর উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য, “ha-tsu shi-gu-re (5) /sa-ru mo ko-mi-no o (৭)/ho-shi-ge na-ri” (৫) (অহ নওরোজ, হাইকুর প্রসঙ্গ-কথা, বাংলা ট্রিবিউন, ২৭ মে , ২০১৮)।

জাপানি এবং ইংরেজি হাইকুতে অন্ত্যমিল আবশ্যক নয়। বাংলায় প্রথম ও তৃতীয় চরণের অন্ত্যমিল শ্রুতিমধুর হলেও তা অত্যাবশ্যক নয়। জাপানী কেতায় বাংলা হাইকুতে যতিচিহ্নের ব্যবহারে অনেকের আপত্তি থাকলেও আমি মনে করি বাংলায় যতিচিহ্নবিহীন লেখা অনেক সময় খাপছাডা হয়ে যেতে পারে। ঋতু, প্রকৃতি ও চিত্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। তবে হাইকু জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই অবশ্যবলয় থেকে বেড়িয়ে আসছে এবং এ নিযে চলছে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা।

সব মিলিয়ে, বাংলায় হাইকু চর্চা বাড়াতে ছন্দ প্রকরণ এবং অন্ত্যমিল বিষয়ে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়তো বা মন্দ কিছু নয়। এর ফলে হাইকুর বৈচিত্র্যময়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে লেখক ও পাঠক সংখ্যা।

সব শেষে সবার সঙ্গে তিন আঙ্গিকে লেখা আমার তিনটি হাইকু শেয়ার করছি:

১.

আকাশে মেঘ,

সূর্যটা আড়ালে,

ঝড়ো আবেগ।

(মাত্রাবৃত্ত)

২.

চাঁদ গলে পড়ে

এই ভরা শস্যের খেতে

নদীর কিনারে।

(স্বরবৃত্ত)

৩.

নদীতে জল নেই

মৃত্তিকা ফেটে চৌচির

কাঁদে চাতকী।

(স্বরবৃত্ত, অন্ত্যমিলহীন)