দাবাত

রুহুল আমিন বাচ্চু

কাক্কু, ও কাক্কু, এরই কাইল আঙ্গো ঘরে দাবাত লন। ডাইল-ভাত দুগা খাইবেন।

-খালি যে ডাইল-ভাতের কথা কইলা? লগে আর কিছু...

ইউসুফের বউ থতমত খায়। পাশেই ফরিদুলের ঘর। সে ঘর থেকে সকালের নাশতা সেরে বের হতেই বৃষ্টির তাড়া খেয়ে ইউসুফের ঘরে ঢুকি। ইউসুফ সম্পর্কের দিক থেকে চাচা হলেও বয়সে আমার ছোট। ইউসুফের বউ একখিলি পান বানিয়ে পিরিচ এগিয়ে দেয়, বলে, কাক্কু এক্কাই হাছা-মিছা ন’...কদুদি-ইছামাছদি...

- ও আইচ্যা বুইজ্জি, বেহেশতি খানা। আঁর বড় হছন্দের।

- আরো আছে উজাইয়া- কইমাছ, এক্কাই আ-াভরা। কাইল রাইতোযে ডার আইছিলো, লগে খাড়াঝিলিক-বিজলী। কইমাছ তো কানাই কানাই আঙ্গে ডেঙ্গা ভরি গেছে। ঝড়ি তুফানের বাড়িদি-দুয়ার খুলি টর্চ মারি চাই ওম্মা কইমাছ কানাই কানাই আঙ্গো দুয়ারের সামনেদি যায়। ডেকচি একগা লই নামি গেলাম। ইগুন আঙ্গো হচ্চুমের হুইরের মাছ- বড্ডা বড্ডা হুরান মাছ। আঙ্গো হেতনরে কই নামি আইয়েন তাড়াতাড়ি, মাইনষে টের হাইলে হরে ভাগে হাইতেন্ন-

জিজ্ঞাসা করলাম, তই ইউসুফে ক’গা হাইছে?

- আর কইয়েন না, আন্ধা বেডা, চোক্কে দেয় না, হিয়ার হরে চশমা ভিজি এক্কাই বোন্দা অই গেছে। হেতনের ঠ্যাংগের কিনারথুন কাশেম তিন চাইরগা কইমাছ ধরি লই যায় কইতো হারে না। তই বেকে দুই-চাইর-দশগা হাইছে। আঁই কুড়ি দেড়েক হাইছি। হারা বাড়ির বেকগুন নামি গেছে ডেঙ্গায় টের হাই-

আন্নেরে বড্ডা বড্ডা আণ্ডাওলা দু’গা হেয়াইজকাঁচামরিচদি ভাজি দিউম। আঁই জানি, ইগিন আন্নের হুরা হছন্দের জিনিস।

বল্লাম, ঠিকই ধইচ্চো। আলহামদুলিল্লাহ, কিসমতে থাকলে কাইলভালা খানাই অইবো। তই হান দিছযে হাগলা সুপারি নাইনি?

ও, কাঁচা সুপারি, আন্নে তো আবার হাগলা সুপারি কন। আইচ্যা ব্যবস্থা করি।

পান সুপারি তেমন একটা খাই না, তবে গ্রামের বাড়ি গেলে কাঁচা সুপারি দিয়ে দুই এক খিলি সামাধা করি। কাঁচা সুপারিতে একটু ঝিমধরা ভাব আসে- বেশ উপভোগ করি।

বল্লাম, আঁরে দাবাত খাওয়াইলে নিয়ম কানুন জান তো?

- জ্বে, তিনবেলা খাওয়াইতে অইবো।

-কিসমতে থাকলে খাইবেন। বেসুবিধা নাই। ছোড হুতের বউ আছে। খেদমত কইরবো ছওয়াব হাইবো। হেতির রান্ধনের হাত ভালা।

বল্লাম, আঁইতো মোল্লা-মৌলভী ন’ আঁরে খাওয়াই কি ফায়দা হাসিল কইরবা?

-ওম্মা কিয়া কন, আন্নে আঙ্গো বাড়ির মুরুব্বি, আইছেন ক’দিনের লাই, আঙ্গো হে ক্ষমতা আছে নি আন্নেরে দাবাত দি খাওয়াইতাম। আন্নের খেদমত কইত্তে হাইল্লে আমরা খুশি। আঙ্গো হোলাহাইন আরব দেশে থায় হিত্তনও হুনি খুশি অইবো। আসলে দিলের দোয়াই আসল দোয়া।

- বুইজ্জি, অনেক কথা কই হালাইছো-

- গোছল গা ধুই নামাজ হড়ি কাইল চলি আইয়েন। বেনের নাস্তা আন্নের ঘরে হাডাই দিউম।

চাকরিতে অবসর নিয়ে খেয়াল হলো বাপ-দাদার ভিটায় একটা ঘর করি, সে ভাবনা থেকেই গ্রামে যাওয়া-আসাটা বেশি বেশি হচ্ছে। চাচাতো ভাই ফরিদুলের ঘরেই খাবারের যাবতীয় ব্যবস্থা। থাকছি নোয়াবাড়ির আরেক চাচার পরিত্যক্ত দালানে। ব্যাংকার চাচা বাড়ি বানালেন কিন্তু বাড়ির নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই মারা গেলেন। নিজেও ভাবি শেষ বয়সে বাড়ির কাজ ধরলাম, শেষাবধি কি হবে আল্লায়ই ভালো জানেন। নিজ বাড়ির পরিসরে বাইশটি ঘর। কেন জানি অনেকেই এক-দুই বেলা করে খাওয়াতে চায়। আমিও উপভোগ করি।

প্রথম দিকে বাড়িময় অতিরিক্ত তেল-মসল্লার দাপাদাপিতে হা-পিত্তেশ করতে থাকি। পরে বুঝলাম, তরকারির স্বাদ বাড়ানোর জন্য তাদের এই চেষ্টা। বাবুলের স্ত্রীর কথা-

- ওম্মা কীয়া কন! তেল বাদদি রান্ধে কেমনে?

চাচাতো ভাই বাবুলে স্ত্রীর বিস্ময়।

বলি- তরকারি আগে হানিদি সিদ্ধ করি হিয়ার হরে হাচামিছাতেল দুই চাইর হোডা দি, লাড়ি-চাড়ি লইবা। আঙ্গো দাদী-নানীরা কেন্নে রাইনতো হুন নাই কোনোদিন? হে সময় তেলে শিশি আছিলো এক পোয়া সাইজের। সপ্তাহে হাটবার দুই ছটার তেল দি সাতদিন রান্ধন চইলতো। হোয়াদের কমতি আছিলো না। মাইনষের হেডের অসুখও আছিলো কম কম।

বাবুল কাছেই বসে জিংলা কাটছিলো। হাতের দাটা মাটিতে কোপিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, হেতিগো অনে মাসে তিন গ্যালন তেল লাগে। হেড-বুক বেকগিন জ্বালাই হালাইছে। কত্তো কই এরে তেল কমাই দে, জানে মারিস না কইলাম; হুনেনি আঁর কতা। কিছু কইলে গ্যালন আরো উত করি ঢালি দেয়।

- খান তো আন্নে। আঁই কদ্দুর খাই? আঁরওতো হেড জ্বলে, খাইতাম হারিনি! ভাত খাই হাচা-মিছা দুগা। আঁর কি আর খরচ? কদ্দুর হান খাই হিয়ারলাই কতো খোঁটা-খুঁটি। এককানা ডাক্তরের কাছে নিতে কই- হুনে না। কইলে দুগা টেবলেট লই আনে- বলেই একগাল পান মুখে ঠেসে দেয়। আগেই টের পাই ঘরময় জর্দার ঘ্রাণ।

বলি, হানের লগে জর্দা খাও?

বাবুল এবার মাটিতে গেঁথে যাওয়া দা তুলে পিঠ চুলকাতে চুলকাতে বলে, বড্ডা ভাই বিশ্বাস করেন হত্তি হাটে হেতনের লাই একবিড়া হান আর এক ডিব্বা জর্দা আনন লাগে। এককানা দেরি অইলে আঁরে কয় কিরপিন। অঁই বলে কিরপিন! জান হানি করি হালাইছি- এ সংসারের লাই।

- কইতান ন’নি- সাহস নিয়ে দু’কদম এগিয়ে আসে বাবুলে স্ত্রী। একদ্দুরইতো খাই, মাইনষের কতো সাধ-আহ্লাদ জীবনে থায়, আঁর কি কোনো সাধ-আহ্লাদ হুরন কইচ্ছেননি জীবনে। না এককান ভালা শাড়ি না কোনহানে বেড়াইতে গেছি শখ করি। হারাজীবন হেতেনের এ বাঁশমুড়ার ভিতরে জিন্দেগী কাডাইলাম।

- কতাতো কোনখান মিছা ন’। অন এ বয়সে আর কি কইরবা! হোলাহাইন বড় অইছে সুন্দর করি চইলবা- তই এককান কতা কই তোঁর ভালার লাই। জর্দারে হারাম করি দেও। উত্তর ঘরের বুয়ারে তো দেখছ, মুখে-গলায় ক্যান্সারের ঘা। আহহারে কি ছিদ্দতের জিন্দেগী। মরি গেছে ভালাই অইছে- আল্লায় মাফ করুক।

- ভাইজান আঁই কিত্তাম কন? হানের লগে জর্দা কদ্দুর না খাইলে হান আইন্যা আইন্যা লাগে- মুখে হোয়াদ এন্নেই কমি গেছে-

- তা অইলে হান এক্কাই ছাড়ি দেও-

- ওম্মা কিয়া কন? হানছাড়া আঁই বাইচ্চুম কেন্নে! হানছাড়া মরি যানও ভালা...

- কতা যন হুইনতানো আরো ডবল ডবল করি জর্দা-হান খাই মরি যাও। আমরা হিগারে দেই হুনি হান নোখাইন্যা বেডি একগা বিয়া করাই দিউম...

বাবুল এবার বাঁশে জোরে এক কোপ বসিয়ে বলে, বড্ডা ভাই এককাই আঁর মনের কতা কইছেন। আঁর জিন্দেগীরে এককাই জ্বালাই হালাইছে-

ঘরের ভেতর থেকে আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছে, সাথে বিলাপ- ওরে আল্লারে, আঁই হেতনের শনের সংসারে টিনের ঘর উডাইলাম- জীবনভর বান্দির মতন খাটলাম- কোনদিন অঁর মুই যদি এককানা রেনি চাইতো? অন শেষকালে কয় আবার বিয়া কইরবো-

বাবুল জোরহাতে বাঁশে ঘন ঘন কোপ বসিয়ে বলে, বড্ডাভাই, আন্নে ঘরে যাই আরাম করেন- হেতনের এইগান ঘণ্টাদুই চইলবো- আঁইও কাজ-কাম থুই বাজারমুই যাই-

বৃষ্টি থেমে গেছে একটু আগে। ইউসুফের ঘর থেকে বের হতেই পেছন ডাক, কাক্কু চা বানাইছি- খাই যান...

ইউসুফের বউ পেছনে গলা বাড়িয়ে বলে, বউ চা’র মইদ্যে একগা এলাচি ভাঙ্গি দেও।

বাইরে থেকে কালাম মাওলানার গলার হাঁক।

- কইও কাগু, আন্নে বলে ইউসুফের ঘরে। আঁই আন্নেরে হারাবাড়ি টোকাই আইছি।

মাওলানার চুল-দাঁড়ি সব সাদা হলেও বয়সে আমিই মুরুব্বি। সম্পর্কের দিক থেকে চাচা। মাওলানা দাদা নানা দুটোই হয়েছেন বহু আগে। মেয়ের ঘরের নাতিন কলেজে পড়ে। অবশ্য মাওলানারা একটু কাঁচা বয়সেই বিয়ে-শাদী মোবারক সেরে নেন। এ বয়সেও মাওলানার স্ত্রীর কোলে নবজাতক। মাওলানার স্ত্রীর কথা, হোলা-হাইন কোলে-হিডে না থাকলে সংসার অয়নি-

গেলবার তো এক সিজনেই মাওলানার স্ত্রী, পুত্র, কন্যার ঘরে নতুন সদস্য এসেছে। মাওলানার স্পষ্ট বক্তব্য, আল্লার বান্দা-রসুলের উম্মতের সংখ্যা বেশি বেশি দরকার।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইউসুফের ঘরের সিঁড়িতে মাওলানার মুখোমুখি হলাম। মাদ্রাসা থেকে ফিরে ঘরে না ঢুকে আমাকে খুঁজছেন। ব্যাপার অতি জরুরি ধরে নিলাম। রায়পুরা মাদ্রাসায় পড়ান। প্রতি বৃহস্পতিবারে বাড়িতে এসে শনিবার সকালে ফিরে যান।

দেখা হলে কেমন আছি, কাজকামের উন্নতি কেমন এর বাইরে জরুরত জিজ্ঞাসা কিছু থাকে না। আজকের জরুরি বিষয় সম্পর্কে আমি রীতিমত ঘাবড়ে আছি। হাতের ছাতিটা খাড়া করে মাটিতে ঠেকিয়ে একটু হেসে জানান দিলেন, কাইল আঙ্গো ঘরে দুগা ভাত খাইয়েন।

দরজার আড়ালেই ইউসুফের বউ। একটু এগিয়ে বলে, কালাম ভাইজান, কাক্কু কাইল তিনবেলা আঙ্গো ঘরে দাবাত খাইবো। আন্নে খাবাইলে হরু নেন...

মাওলানা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে, তোঙ্গো দাবাত হরু কইল্লে অয় না?

- না না আঁই আড়াথুন হবে কদু একগা কাডি লইছি। তাজা জিনিস কাক্কু হছন্দ করে।

আমি ভাবছি ভিন্ন কথা, মুন্সি-মাওলানারা সাধারণত অন্যের বাড়িতে দাওয়াত খায় কিন্তু নিজের ঘরে কাউকে খাওয়ায় স্মরণে আসছে না। সালামের ক্ষেত্রেও তাই, নিজেরা শুধু সালাম নেন, বিশেষ কেউ না হলে কাউকে সালাম দেন না। আমার ক্ষেত্রে ভিন্নতা ভাবিয়ে তুলছে আমাকে।

মাওলানা বিড় বিড় করে কী ভাবছেন। এদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আবার নামছে।

ইউসুফের স্ত্রী আওয়াজ দেয়, আলম ভাইজান ঘরে আইয়্যেন চা বানান্যা আছে।

- না গো, বলে মাওলানা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। যেতে যেতে বলেন, আইচ্যা আঁই ঘরে যাই কতা কই চাই...

মাওলানা ফিরে যাচ্ছেন কোনাকুনি মানিকের উঠোন দিয়ে। তিন চার দিনের টানা বৃষ্টিতে উঠোনে কাদার ওপর সবুজ শেওলা জমেছে। সতর্কভাবে চলতে গিয়ে দু’বার পিছলে যাচ্ছিলেন। শেষ রক্ষা হলো না মাওলানা পাতানো একটা অর্ধ ইটের দিকে পা বাড়াতেই পিছলে পড়েন, দেহটা তিন হাত দূরে পিছলিয়ে ঠেকে যায় সুপারি গাছের গোড়ায়।

মাওলানা একবার মাগো পরে লা-হাওলা অলা কুউঅতা বলতে বলতে কয়েক মুহূর্ত চিৎপটাং রইলেন। মানিক ঘর থেকে দৌড়ে এসে মাওলানাকে ধরে তুল্লো, মাওলানার স্ত্রী শব্দ শুনে নিজ ঘর থেকে বের হতেই ঘরের সামনে হোঁচট খেয়ে বসে যায়। মাওলানার মেয়ে নিজ মেয়েকে কোল থেকে ছোট বোনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে- আব্বাগো বলে ছুটে আসে। মাওলানা উদ্ধারপর্ব শেষ হলো জন দশেক বাড়ির ছেলে মেয়ের টানাহেঁচড়ায়। নিজেকে মোড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলহামদুলিল্লাহ্ বলে দু’এক কদম এগিয়ে গেলেন মানিকের কাঁধ ধরে।

- আব্বাগো, আন্নে দুঃখু হাইছেননি কোন? বলে মেয়ে তাসলিমা বাবাকে জড়িয়ে কাঁদলো কিছুক্ষণ।

ইউসুফের ঘরে আমার দাওয়াত পর্ব শুরু। সকালের মেঘমুক্ত রোদের বেলা। গতদিনের বৃষ্টিতে গাছগাছালি কেমন ঝিম মেরে ছিল, আজ যেন সজীবতার উষ্ণ প্রলেপ নিয়ে চিক্ চিক্ করছে।

জানালা দিয়ে লক্ষ্য করছি ইউসুফের আগমন। দুটি প্লেট ঢাকনি দিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে আমার ঘরের দিকে। রুটি সব্জি আর ডিম পোছ। খাবার শেষ করে আলহামদুলিল্লাহ বল্লাম। প্লেট আর ঢাকনির জন্য ইউসুফ অপেক্ষাতেই ছিল। যাওয়ার আগে মনে করিয়ে দিল, ‘জোহর সারি চলি আইয়্যেন’।

ইউসুফের ছেলে বউয়ের রান্না আমার খুব পছন্দের। এর আগেও বহুবার খেয়েছি ও ঘরে। তেল-মসল্লার বাহার আমার কাক্সিক্ষত পরিমাণ মতোই। দুপুরের খাবার প্রতীক্ষায় ডাইনিংয়ে। ছেলেবউ তাগাদা দিল, ভাইয়া হুম, খানা শুরু করেন। বল্লাম, ইউসুফ আসুক এক লগে খাইয়্যুম।

ইউসুফের স্ত্রী ডালের বাটি চামচসমেত নিয়ে আসতে আসতে বলে, হেতন আন্তাই গোসল সারেন। বেন ধরি হুইরের আড়া বান্ধি কতোক্ষণ কুড়ালদি দারুয়া বানাইছে। আঁই কিত্তাম কাকা, এই আন্ধা ধেঙ্গা বুইড়া মাঝে মইধ্যে চেতি উঠি এইডা হেইডা করে। করবি কর পরিমাণ মতো, শইল্যে যা সয়। হিয়ার হরে তিনদিন বিছনাত হড়ি কোঁতায়, এরে গেলামরে- কোমড় বেদনা, ঘাড়ে বেদনা, হাঁটুর গিড়া কামড়ায়- কতা হুনে না এককাই।

আমার পাতে ভাত দিতে দিতে বলে, আন্নে খান, বিষমরুক হেতার।

লাকড়ির ঘর থেকে একটা মুরগি কট্ কট্ কটাস বলে জানান দিল- তিনি একখানা ডিম্ব ত্যাগ করেছেন। মালিককে খুশির খবর জানান দিয়ে উড়াল দিলেন। ইউসুফ গামছা কাঁধে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ছেলে বউকে বলে- এরি রিয়া, আণ্ডাগা পোছ করি কাক্কুর পাতে দেও।

বল্লাম, না-রে। আইজ বিয়ানে নাস্তার লগে একগা খাইছি- আইজ আর আণ্ডা খাইতান্নো- প্রেসার আছে।

ইউসুফের স্ত্রী আরেক চামচ ডাল পাতে দিয়ে বলে, ইগা দেশী মুরগির আণ্ডা খাইলে কিচ্ছু অইতো ন’, ছোড আণ্ডা, এক লোকমার বেশি অইত্তোন’। ঘপ করি খাই হালাইবেন। লাউ-ইছামাছ, কইমাছ ভাজি, কুমড়ার ফুল দিয়ে মাছের ডিম্ব ভাজি, কাচকির চচ্চরি- সবই আমার পছন্দের খাবার।

কারেন্ট গেছে কিছুক্ষণ আগে। খেতে বসে না ঘামলেও হাসফাঁস করছি। ইউসুফের স্ত্রী একটা হাতপাখা দোলাতে দোলাতে বলে, কাক্কু কুমড়ার হুলদি কইমাছের আণ্ডা কদুহাতা মুড়ি বউয়ে খোলাত দিছে।

বল্লাম, এককাই দারুণ হোয়াদ অইছে।

ইউসুফ আগ দুয়ারদি মোবাইল কানে লাগিয়ে হাসতে হাসতে স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছে।

ইউসুফের স্ত্রী হাসির রেশ ধরে এগিয়ে মোবাইল ধরতে যায়। ইউসুফ ধমক দিয়ে বলে, আঁর কতা শেষ অয় ন’। এরই ভালা খবর...

ইউসুফের স্ত্রী কথা কেড়ে নিয়ে বলে, কী হাডাইছে নি?

- হ, হ উচ্চারণের সাথে ইউসুফের হাসি ঝল্কে উঠে।

- আল্লা মাবুদ-আল্লা মাবুদ। স্বস্তির শ্বাস ফেলে ইউসুফের স্ত্রী মুরগির পুরা বাটিটা আমার পাতে ঢেলে দিয়ে মোবাইল ধরতে ছুটে যায়। ইউসুফ স্ত্রীর হাতে মোবাইল দিয়ে রিয়া-রিয়া বলে ছেলে বউকে ডাকতে থাকে। রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, এরে বড় রাতাগা জবাই দি রাইতে কাক্কুরে খাওয়াইবি।

কেমন একটা উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখিন হলাম। কোনমতে খাবার শেষে একখিলি পান নিয়ে বের হতেই ইউসুফের স্ত্রী মোবাইল কানের পাশ থেকে সরিয়ে বলে, কাকা, ছোলেমান আন্নেরে সালাম দিছে।

বিয়ালে মনে করি চা-নাশতা খাই যাইয়্যেন।

আমি দরজার দিকে পা বাড়াতেই ইউসুফের স্ত্রী ছুটে এসে বলে, কাকা-কাকা কারেন্ট আইছে। এ দুপুরদি কই যাইবেন, হে রুমে কতোক্ষণ হুতি থান, আঁই নতুন চাদর বিছাই দিউম।

বল্লাম, না যাওন লাগে মিস্ত্রীগো লগে না থাকলে কাম আগায় না।

ইউসুফের ঘর পেরিয়ে বাড়ির উত্তর গলির শেষে মাওলানার ঘর। মাওলানার স্ত্রীর গলা শোনা যায়...

এরি হুনেন, আন্নে মাদ্রাসায় খবর দেন উডানে আছাড় খাই কোমড়ে দুঃখু হাইছেন। তিনদিনের ছুটি লন। কাইল কাক্কুরে দাবাত দেন। বিয়ালে খিলপাড়া যাই বড্ডা একগা রাতা কিনি আইনবেন। এবার ফিসফিসিয়ে বলে- হুইনছেননি, কাক্কুর খানা শেষ নো অইতেই ইউসুফের হুতের ফোন- টেঁয়া হাডাইছে ছয় মাস হরে, -হিয়ার আগে মতিনের ঘরে দাবাত খাইতে খাইতে- হোলার ফোন...

মাওলানার দীর্ঘশ্বাস, আঙ্গো হিগুনও মছিবতে আছে, আকামা, ভিসার খরচ আগেরতুন ডবল ডবল। হিয়ার হরে করোনার আকাল, কাম-কাইজ নাই। কফিলগুনও বেলাজ-বেহায়া। আঙ্গোরে কস মিসকিন, আর আঙ্গো হোলাহাইনের টেঁয়া মারি খাস তোরা। আল্লায় বিচার কইরবো।

মাওলানার স্ত্রীর শেষ কথা আমার কানে বাজে, উডেন আন্নে, আইজ বাজার বার। চাই না কারো উছিলায় যদি খোদা আঙ্গো উপরে রহম করে।

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

দাবাত

রুহুল আমিন বাচ্চু

image

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

কাক্কু, ও কাক্কু, এরই কাইল আঙ্গো ঘরে দাবাত লন। ডাইল-ভাত দুগা খাইবেন।

-খালি যে ডাইল-ভাতের কথা কইলা? লগে আর কিছু...

ইউসুফের বউ থতমত খায়। পাশেই ফরিদুলের ঘর। সে ঘর থেকে সকালের নাশতা সেরে বের হতেই বৃষ্টির তাড়া খেয়ে ইউসুফের ঘরে ঢুকি। ইউসুফ সম্পর্কের দিক থেকে চাচা হলেও বয়সে আমার ছোট। ইউসুফের বউ একখিলি পান বানিয়ে পিরিচ এগিয়ে দেয়, বলে, কাক্কু এক্কাই হাছা-মিছা ন’...কদুদি-ইছামাছদি...

- ও আইচ্যা বুইজ্জি, বেহেশতি খানা। আঁর বড় হছন্দের।

- আরো আছে উজাইয়া- কইমাছ, এক্কাই আ-াভরা। কাইল রাইতোযে ডার আইছিলো, লগে খাড়াঝিলিক-বিজলী। কইমাছ তো কানাই কানাই আঙ্গে ডেঙ্গা ভরি গেছে। ঝড়ি তুফানের বাড়িদি-দুয়ার খুলি টর্চ মারি চাই ওম্মা কইমাছ কানাই কানাই আঙ্গো দুয়ারের সামনেদি যায়। ডেকচি একগা লই নামি গেলাম। ইগুন আঙ্গো হচ্চুমের হুইরের মাছ- বড্ডা বড্ডা হুরান মাছ। আঙ্গো হেতনরে কই নামি আইয়েন তাড়াতাড়ি, মাইনষে টের হাইলে হরে ভাগে হাইতেন্ন-

জিজ্ঞাসা করলাম, তই ইউসুফে ক’গা হাইছে?

- আর কইয়েন না, আন্ধা বেডা, চোক্কে দেয় না, হিয়ার হরে চশমা ভিজি এক্কাই বোন্দা অই গেছে। হেতনের ঠ্যাংগের কিনারথুন কাশেম তিন চাইরগা কইমাছ ধরি লই যায় কইতো হারে না। তই বেকে দুই-চাইর-দশগা হাইছে। আঁই কুড়ি দেড়েক হাইছি। হারা বাড়ির বেকগুন নামি গেছে ডেঙ্গায় টের হাই-

আন্নেরে বড্ডা বড্ডা আণ্ডাওলা দু’গা হেয়াইজকাঁচামরিচদি ভাজি দিউম। আঁই জানি, ইগিন আন্নের হুরা হছন্দের জিনিস।

বল্লাম, ঠিকই ধইচ্চো। আলহামদুলিল্লাহ, কিসমতে থাকলে কাইলভালা খানাই অইবো। তই হান দিছযে হাগলা সুপারি নাইনি?

ও, কাঁচা সুপারি, আন্নে তো আবার হাগলা সুপারি কন। আইচ্যা ব্যবস্থা করি।

পান সুপারি তেমন একটা খাই না, তবে গ্রামের বাড়ি গেলে কাঁচা সুপারি দিয়ে দুই এক খিলি সামাধা করি। কাঁচা সুপারিতে একটু ঝিমধরা ভাব আসে- বেশ উপভোগ করি।

বল্লাম, আঁরে দাবাত খাওয়াইলে নিয়ম কানুন জান তো?

- জ্বে, তিনবেলা খাওয়াইতে অইবো।

-কিসমতে থাকলে খাইবেন। বেসুবিধা নাই। ছোড হুতের বউ আছে। খেদমত কইরবো ছওয়াব হাইবো। হেতির রান্ধনের হাত ভালা।

বল্লাম, আঁইতো মোল্লা-মৌলভী ন’ আঁরে খাওয়াই কি ফায়দা হাসিল কইরবা?

-ওম্মা কিয়া কন, আন্নে আঙ্গো বাড়ির মুরুব্বি, আইছেন ক’দিনের লাই, আঙ্গো হে ক্ষমতা আছে নি আন্নেরে দাবাত দি খাওয়াইতাম। আন্নের খেদমত কইত্তে হাইল্লে আমরা খুশি। আঙ্গো হোলাহাইন আরব দেশে থায় হিত্তনও হুনি খুশি অইবো। আসলে দিলের দোয়াই আসল দোয়া।

- বুইজ্জি, অনেক কথা কই হালাইছো-

- গোছল গা ধুই নামাজ হড়ি কাইল চলি আইয়েন। বেনের নাস্তা আন্নের ঘরে হাডাই দিউম।

চাকরিতে অবসর নিয়ে খেয়াল হলো বাপ-দাদার ভিটায় একটা ঘর করি, সে ভাবনা থেকেই গ্রামে যাওয়া-আসাটা বেশি বেশি হচ্ছে। চাচাতো ভাই ফরিদুলের ঘরেই খাবারের যাবতীয় ব্যবস্থা। থাকছি নোয়াবাড়ির আরেক চাচার পরিত্যক্ত দালানে। ব্যাংকার চাচা বাড়ি বানালেন কিন্তু বাড়ির নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই মারা গেলেন। নিজেও ভাবি শেষ বয়সে বাড়ির কাজ ধরলাম, শেষাবধি কি হবে আল্লায়ই ভালো জানেন। নিজ বাড়ির পরিসরে বাইশটি ঘর। কেন জানি অনেকেই এক-দুই বেলা করে খাওয়াতে চায়। আমিও উপভোগ করি।

প্রথম দিকে বাড়িময় অতিরিক্ত তেল-মসল্লার দাপাদাপিতে হা-পিত্তেশ করতে থাকি। পরে বুঝলাম, তরকারির স্বাদ বাড়ানোর জন্য তাদের এই চেষ্টা। বাবুলের স্ত্রীর কথা-

- ওম্মা কীয়া কন! তেল বাদদি রান্ধে কেমনে?

চাচাতো ভাই বাবুলে স্ত্রীর বিস্ময়।

বলি- তরকারি আগে হানিদি সিদ্ধ করি হিয়ার হরে হাচামিছাতেল দুই চাইর হোডা দি, লাড়ি-চাড়ি লইবা। আঙ্গো দাদী-নানীরা কেন্নে রাইনতো হুন নাই কোনোদিন? হে সময় তেলে শিশি আছিলো এক পোয়া সাইজের। সপ্তাহে হাটবার দুই ছটার তেল দি সাতদিন রান্ধন চইলতো। হোয়াদের কমতি আছিলো না। মাইনষের হেডের অসুখও আছিলো কম কম।

বাবুল কাছেই বসে জিংলা কাটছিলো। হাতের দাটা মাটিতে কোপিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, হেতিগো অনে মাসে তিন গ্যালন তেল লাগে। হেড-বুক বেকগিন জ্বালাই হালাইছে। কত্তো কই এরে তেল কমাই দে, জানে মারিস না কইলাম; হুনেনি আঁর কতা। কিছু কইলে গ্যালন আরো উত করি ঢালি দেয়।

- খান তো আন্নে। আঁই কদ্দুর খাই? আঁরওতো হেড জ্বলে, খাইতাম হারিনি! ভাত খাই হাচা-মিছা দুগা। আঁর কি আর খরচ? কদ্দুর হান খাই হিয়ারলাই কতো খোঁটা-খুঁটি। এককানা ডাক্তরের কাছে নিতে কই- হুনে না। কইলে দুগা টেবলেট লই আনে- বলেই একগাল পান মুখে ঠেসে দেয়। আগেই টের পাই ঘরময় জর্দার ঘ্রাণ।

বলি, হানের লগে জর্দা খাও?

বাবুল এবার মাটিতে গেঁথে যাওয়া দা তুলে পিঠ চুলকাতে চুলকাতে বলে, বড্ডা ভাই বিশ্বাস করেন হত্তি হাটে হেতনের লাই একবিড়া হান আর এক ডিব্বা জর্দা আনন লাগে। এককানা দেরি অইলে আঁরে কয় কিরপিন। অঁই বলে কিরপিন! জান হানি করি হালাইছি- এ সংসারের লাই।

- কইতান ন’নি- সাহস নিয়ে দু’কদম এগিয়ে আসে বাবুলে স্ত্রী। একদ্দুরইতো খাই, মাইনষের কতো সাধ-আহ্লাদ জীবনে থায়, আঁর কি কোনো সাধ-আহ্লাদ হুরন কইচ্ছেননি জীবনে। না এককান ভালা শাড়ি না কোনহানে বেড়াইতে গেছি শখ করি। হারাজীবন হেতেনের এ বাঁশমুড়ার ভিতরে জিন্দেগী কাডাইলাম।

- কতাতো কোনখান মিছা ন’। অন এ বয়সে আর কি কইরবা! হোলাহাইন বড় অইছে সুন্দর করি চইলবা- তই এককান কতা কই তোঁর ভালার লাই। জর্দারে হারাম করি দেও। উত্তর ঘরের বুয়ারে তো দেখছ, মুখে-গলায় ক্যান্সারের ঘা। আহহারে কি ছিদ্দতের জিন্দেগী। মরি গেছে ভালাই অইছে- আল্লায় মাফ করুক।

- ভাইজান আঁই কিত্তাম কন? হানের লগে জর্দা কদ্দুর না খাইলে হান আইন্যা আইন্যা লাগে- মুখে হোয়াদ এন্নেই কমি গেছে-

- তা অইলে হান এক্কাই ছাড়ি দেও-

- ওম্মা কিয়া কন? হানছাড়া আঁই বাইচ্চুম কেন্নে! হানছাড়া মরি যানও ভালা...

- কতা যন হুইনতানো আরো ডবল ডবল করি জর্দা-হান খাই মরি যাও। আমরা হিগারে দেই হুনি হান নোখাইন্যা বেডি একগা বিয়া করাই দিউম...

বাবুল এবার বাঁশে জোরে এক কোপ বসিয়ে বলে, বড্ডা ভাই এককাই আঁর মনের কতা কইছেন। আঁর জিন্দেগীরে এককাই জ্বালাই হালাইছে-

ঘরের ভেতর থেকে আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছে, সাথে বিলাপ- ওরে আল্লারে, আঁই হেতনের শনের সংসারে টিনের ঘর উডাইলাম- জীবনভর বান্দির মতন খাটলাম- কোনদিন অঁর মুই যদি এককানা রেনি চাইতো? অন শেষকালে কয় আবার বিয়া কইরবো-

বাবুল জোরহাতে বাঁশে ঘন ঘন কোপ বসিয়ে বলে, বড্ডাভাই, আন্নে ঘরে যাই আরাম করেন- হেতনের এইগান ঘণ্টাদুই চইলবো- আঁইও কাজ-কাম থুই বাজারমুই যাই-

বৃষ্টি থেমে গেছে একটু আগে। ইউসুফের ঘর থেকে বের হতেই পেছন ডাক, কাক্কু চা বানাইছি- খাই যান...

ইউসুফের বউ পেছনে গলা বাড়িয়ে বলে, বউ চা’র মইদ্যে একগা এলাচি ভাঙ্গি দেও।

বাইরে থেকে কালাম মাওলানার গলার হাঁক।

- কইও কাগু, আন্নে বলে ইউসুফের ঘরে। আঁই আন্নেরে হারাবাড়ি টোকাই আইছি।

মাওলানার চুল-দাঁড়ি সব সাদা হলেও বয়সে আমিই মুরুব্বি। সম্পর্কের দিক থেকে চাচা। মাওলানা দাদা নানা দুটোই হয়েছেন বহু আগে। মেয়ের ঘরের নাতিন কলেজে পড়ে। অবশ্য মাওলানারা একটু কাঁচা বয়সেই বিয়ে-শাদী মোবারক সেরে নেন। এ বয়সেও মাওলানার স্ত্রীর কোলে নবজাতক। মাওলানার স্ত্রীর কথা, হোলা-হাইন কোলে-হিডে না থাকলে সংসার অয়নি-

গেলবার তো এক সিজনেই মাওলানার স্ত্রী, পুত্র, কন্যার ঘরে নতুন সদস্য এসেছে। মাওলানার স্পষ্ট বক্তব্য, আল্লার বান্দা-রসুলের উম্মতের সংখ্যা বেশি বেশি দরকার।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইউসুফের ঘরের সিঁড়িতে মাওলানার মুখোমুখি হলাম। মাদ্রাসা থেকে ফিরে ঘরে না ঢুকে আমাকে খুঁজছেন। ব্যাপার অতি জরুরি ধরে নিলাম। রায়পুরা মাদ্রাসায় পড়ান। প্রতি বৃহস্পতিবারে বাড়িতে এসে শনিবার সকালে ফিরে যান।

দেখা হলে কেমন আছি, কাজকামের উন্নতি কেমন এর বাইরে জরুরত জিজ্ঞাসা কিছু থাকে না। আজকের জরুরি বিষয় সম্পর্কে আমি রীতিমত ঘাবড়ে আছি। হাতের ছাতিটা খাড়া করে মাটিতে ঠেকিয়ে একটু হেসে জানান দিলেন, কাইল আঙ্গো ঘরে দুগা ভাত খাইয়েন।

দরজার আড়ালেই ইউসুফের বউ। একটু এগিয়ে বলে, কালাম ভাইজান, কাক্কু কাইল তিনবেলা আঙ্গো ঘরে দাবাত খাইবো। আন্নে খাবাইলে হরু নেন...

মাওলানা কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলে, তোঙ্গো দাবাত হরু কইল্লে অয় না?

- না না আঁই আড়াথুন হবে কদু একগা কাডি লইছি। তাজা জিনিস কাক্কু হছন্দ করে।

আমি ভাবছি ভিন্ন কথা, মুন্সি-মাওলানারা সাধারণত অন্যের বাড়িতে দাওয়াত খায় কিন্তু নিজের ঘরে কাউকে খাওয়ায় স্মরণে আসছে না। সালামের ক্ষেত্রেও তাই, নিজেরা শুধু সালাম নেন, বিশেষ কেউ না হলে কাউকে সালাম দেন না। আমার ক্ষেত্রে ভিন্নতা ভাবিয়ে তুলছে আমাকে।

মাওলানা বিড় বিড় করে কী ভাবছেন। এদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আবার নামছে।

ইউসুফের স্ত্রী আওয়াজ দেয়, আলম ভাইজান ঘরে আইয়্যেন চা বানান্যা আছে।

- না গো, বলে মাওলানা নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ান। যেতে যেতে বলেন, আইচ্যা আঁই ঘরে যাই কতা কই চাই...

মাওলানা ফিরে যাচ্ছেন কোনাকুনি মানিকের উঠোন দিয়ে। তিন চার দিনের টানা বৃষ্টিতে উঠোনে কাদার ওপর সবুজ শেওলা জমেছে। সতর্কভাবে চলতে গিয়ে দু’বার পিছলে যাচ্ছিলেন। শেষ রক্ষা হলো না মাওলানা পাতানো একটা অর্ধ ইটের দিকে পা বাড়াতেই পিছলে পড়েন, দেহটা তিন হাত দূরে পিছলিয়ে ঠেকে যায় সুপারি গাছের গোড়ায়।

মাওলানা একবার মাগো পরে লা-হাওলা অলা কুউঅতা বলতে বলতে কয়েক মুহূর্ত চিৎপটাং রইলেন। মানিক ঘর থেকে দৌড়ে এসে মাওলানাকে ধরে তুল্লো, মাওলানার স্ত্রী শব্দ শুনে নিজ ঘর থেকে বের হতেই ঘরের সামনে হোঁচট খেয়ে বসে যায়। মাওলানার মেয়ে নিজ মেয়েকে কোল থেকে ছোট বোনের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে- আব্বাগো বলে ছুটে আসে। মাওলানা উদ্ধারপর্ব শেষ হলো জন দশেক বাড়ির ছেলে মেয়ের টানাহেঁচড়ায়। নিজেকে মোড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলহামদুলিল্লাহ্ বলে দু’এক কদম এগিয়ে গেলেন মানিকের কাঁধ ধরে।

- আব্বাগো, আন্নে দুঃখু হাইছেননি কোন? বলে মেয়ে তাসলিমা বাবাকে জড়িয়ে কাঁদলো কিছুক্ষণ।

ইউসুফের ঘরে আমার দাওয়াত পর্ব শুরু। সকালের মেঘমুক্ত রোদের বেলা। গতদিনের বৃষ্টিতে গাছগাছালি কেমন ঝিম মেরে ছিল, আজ যেন সজীবতার উষ্ণ প্রলেপ নিয়ে চিক্ চিক্ করছে।

জানালা দিয়ে লক্ষ্য করছি ইউসুফের আগমন। দুটি প্লেট ঢাকনি দিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে আমার ঘরের দিকে। রুটি সব্জি আর ডিম পোছ। খাবার শেষ করে আলহামদুলিল্লাহ বল্লাম। প্লেট আর ঢাকনির জন্য ইউসুফ অপেক্ষাতেই ছিল। যাওয়ার আগে মনে করিয়ে দিল, ‘জোহর সারি চলি আইয়্যেন’।

ইউসুফের ছেলে বউয়ের রান্না আমার খুব পছন্দের। এর আগেও বহুবার খেয়েছি ও ঘরে। তেল-মসল্লার বাহার আমার কাক্সিক্ষত পরিমাণ মতোই। দুপুরের খাবার প্রতীক্ষায় ডাইনিংয়ে। ছেলেবউ তাগাদা দিল, ভাইয়া হুম, খানা শুরু করেন। বল্লাম, ইউসুফ আসুক এক লগে খাইয়্যুম।

ইউসুফের স্ত্রী ডালের বাটি চামচসমেত নিয়ে আসতে আসতে বলে, হেতন আন্তাই গোসল সারেন। বেন ধরি হুইরের আড়া বান্ধি কতোক্ষণ কুড়ালদি দারুয়া বানাইছে। আঁই কিত্তাম কাকা, এই আন্ধা ধেঙ্গা বুইড়া মাঝে মইধ্যে চেতি উঠি এইডা হেইডা করে। করবি কর পরিমাণ মতো, শইল্যে যা সয়। হিয়ার হরে তিনদিন বিছনাত হড়ি কোঁতায়, এরে গেলামরে- কোমড় বেদনা, ঘাড়ে বেদনা, হাঁটুর গিড়া কামড়ায়- কতা হুনে না এককাই।

আমার পাতে ভাত দিতে দিতে বলে, আন্নে খান, বিষমরুক হেতার।

লাকড়ির ঘর থেকে একটা মুরগি কট্ কট্ কটাস বলে জানান দিল- তিনি একখানা ডিম্ব ত্যাগ করেছেন। মালিককে খুশির খবর জানান দিয়ে উড়াল দিলেন। ইউসুফ গামছা কাঁধে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ছেলে বউকে বলে- এরি রিয়া, আণ্ডাগা পোছ করি কাক্কুর পাতে দেও।

বল্লাম, না-রে। আইজ বিয়ানে নাস্তার লগে একগা খাইছি- আইজ আর আণ্ডা খাইতান্নো- প্রেসার আছে।

ইউসুফের স্ত্রী আরেক চামচ ডাল পাতে দিয়ে বলে, ইগা দেশী মুরগির আণ্ডা খাইলে কিচ্ছু অইতো ন’, ছোড আণ্ডা, এক লোকমার বেশি অইত্তোন’। ঘপ করি খাই হালাইবেন। লাউ-ইছামাছ, কইমাছ ভাজি, কুমড়ার ফুল দিয়ে মাছের ডিম্ব ভাজি, কাচকির চচ্চরি- সবই আমার পছন্দের খাবার।

কারেন্ট গেছে কিছুক্ষণ আগে। খেতে বসে না ঘামলেও হাসফাঁস করছি। ইউসুফের স্ত্রী একটা হাতপাখা দোলাতে দোলাতে বলে, কাক্কু কুমড়ার হুলদি কইমাছের আণ্ডা কদুহাতা মুড়ি বউয়ে খোলাত দিছে।

বল্লাম, এককাই দারুণ হোয়াদ অইছে।

ইউসুফ আগ দুয়ারদি মোবাইল কানে লাগিয়ে হাসতে হাসতে স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছে।

ইউসুফের স্ত্রী হাসির রেশ ধরে এগিয়ে মোবাইল ধরতে যায়। ইউসুফ ধমক দিয়ে বলে, আঁর কতা শেষ অয় ন’। এরই ভালা খবর...

ইউসুফের স্ত্রী কথা কেড়ে নিয়ে বলে, কী হাডাইছে নি?

- হ, হ উচ্চারণের সাথে ইউসুফের হাসি ঝল্কে উঠে।

- আল্লা মাবুদ-আল্লা মাবুদ। স্বস্তির শ্বাস ফেলে ইউসুফের স্ত্রী মুরগির পুরা বাটিটা আমার পাতে ঢেলে দিয়ে মোবাইল ধরতে ছুটে যায়। ইউসুফ স্ত্রীর হাতে মোবাইল দিয়ে রিয়া-রিয়া বলে ছেলে বউকে ডাকতে থাকে। রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে, এরে বড় রাতাগা জবাই দি রাইতে কাক্কুরে খাওয়াইবি।

কেমন একটা উদ্ভট পরিস্থিতির সম্মুখিন হলাম। কোনমতে খাবার শেষে একখিলি পান নিয়ে বের হতেই ইউসুফের স্ত্রী মোবাইল কানের পাশ থেকে সরিয়ে বলে, কাকা, ছোলেমান আন্নেরে সালাম দিছে।

বিয়ালে মনে করি চা-নাশতা খাই যাইয়্যেন।

আমি দরজার দিকে পা বাড়াতেই ইউসুফের স্ত্রী ছুটে এসে বলে, কাকা-কাকা কারেন্ট আইছে। এ দুপুরদি কই যাইবেন, হে রুমে কতোক্ষণ হুতি থান, আঁই নতুন চাদর বিছাই দিউম।

বল্লাম, না যাওন লাগে মিস্ত্রীগো লগে না থাকলে কাম আগায় না।

ইউসুফের ঘর পেরিয়ে বাড়ির উত্তর গলির শেষে মাওলানার ঘর। মাওলানার স্ত্রীর গলা শোনা যায়...

এরি হুনেন, আন্নে মাদ্রাসায় খবর দেন উডানে আছাড় খাই কোমড়ে দুঃখু হাইছেন। তিনদিনের ছুটি লন। কাইল কাক্কুরে দাবাত দেন। বিয়ালে খিলপাড়া যাই বড্ডা একগা রাতা কিনি আইনবেন। এবার ফিসফিসিয়ে বলে- হুইনছেননি, কাক্কুর খানা শেষ নো অইতেই ইউসুফের হুতের ফোন- টেঁয়া হাডাইছে ছয় মাস হরে, -হিয়ার আগে মতিনের ঘরে দাবাত খাইতে খাইতে- হোলার ফোন...

মাওলানার দীর্ঘশ্বাস, আঙ্গো হিগুনও মছিবতে আছে, আকামা, ভিসার খরচ আগেরতুন ডবল ডবল। হিয়ার হরে করোনার আকাল, কাম-কাইজ নাই। কফিলগুনও বেলাজ-বেহায়া। আঙ্গোরে কস মিসকিন, আর আঙ্গো হোলাহাইনের টেঁয়া মারি খাস তোরা। আল্লায় বিচার কইরবো।

মাওলানার স্ত্রীর শেষ কথা আমার কানে বাজে, উডেন আন্নে, আইজ বাজার বার। চাই না কারো উছিলায় যদি খোদা আঙ্গো উপরে রহম করে।