ক্ষতি হয়ে গেল শিক্ষাব্যবস্থায়

এম এ কবীর

স্বাধীনতার ৫০ বছরে সবচেয়ে ক্ষতি হয়ে গেল শিক্ষাব্যবস্থায়। প্রথম দিকে শিক্ষক-অভিভাবকেরা নকল করাকে উৎসাহিত করেছেন। পরবর্তীকালে শিক্ষাঙ্গনে টাকাপয়সা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। মুখ্য হয়ে উঠে নিয়োগ-বাণিজ্য। কোচিং ব্যবসাকে অবারিত করার জন্য এলাকার রাজনৈতিক নেতা, অভিভাবক যৌথভাবে যোগ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। একজন শিক্ষকের যখন চরম অবমাননা হয়, তখন প্রশাসন তাদের বিরাট বাহিনী নিয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রাজনীতিবিদ, চেয়ারম্যান, সভাপতি ও অভিভাবকেরা তাকিয়ে থাকেন। ভাবেন এটা তো তার অপমান হচ্ছে না, যার অপমান হওয়ার হোক, আমাদের তাতে কী। তারা ভাবেন না সারা দেশে ধিক্কারের কেন্দ্র এখন রাজশাহী, নড়াইল আর আশুলিয়ার ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো।

এক জায়গায় অধ্যক্ষকে পেটানো হলো, শিক্ষককে জুতোর মালা পরানো হলো, আরেক জায়গায় শিক্ষককে হত্যাই করা হলো। এতে অভিভাবকদেরও একটা বড় ধিক্কার তাদের প্রাপ্য হলো। কী শেখালেন ছেলেমেয়েদের? দশম শ্রেণীর একজন ছাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রেমের জন্য নয়, শুধু শাসনের জন্য একজন শিক্ষককে হত্যা করে ফেলল! আবার একটি ফেসবুক পোস্ট এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল যে তার জন্য লাঞ্ছিত করতে হবে। যে ছেলেটি পোস্টটি দিয়েছে তাকে তো পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। শিক্ষক, নাট্যকার রতন সিদ্দিকীর বাড়িতে একেবারে অকারণে হামলা করা হলো।

শিক্ষার শেষ মর্যাদাটুকু ধ্বংস করার জন্য সমাজের একশ্রেণীর মানুষের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার আভাস কি মেলে এখান থেকে? বিষয়টি গভীরভাবে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক। সবাই আখের গোছাতে ব্যস্ত এবং সেই আখের হচ্ছে মানবিক-সাংস্কৃতিক-চিন্তাবিহীন টাকা। আমাদের এখন সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে, শিক্ষকদের বাঁচাতে হবে। তাহলেই দেশ বাঁচবে। তা না হলে আমাদের যে বড় বড় অর্জন, এগুলো সবই রসাতলে যাবে। মানুষের চেতনা দুই রকম। একটি সচেতন অবস্থায় মানুষ যখন কথা বলে তখন হিসাব-নিকাশ করে বলে। আবার যখন ব্যক্তি অবচেতন মনে কথা বলে তখন আসল কথাটি প্রকাশ পায়। ধর্ষণের অভিযোগে এমসি কলেজ ছাত্রাবাস ভস্মীভূত হয়েছে। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা কতটা অসহায় হলে রাস্তায় নামেন সেটি সহজেই অনুমেয়।

‘শিক্ষা-সংস্কার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একদা বলেছিলেন : ‘দেশের লোককে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি নিজে না করি, তবে আমরা সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব- অন্নে মরিব, স্বাস্থ্যে মরিব, বুদ্ধিতে মরিব, চরিত্রে মরিব- ইহা নিশ্চয়। বস্তুত আমরা প্রত্যহই মরিতেছি অথচ তাহার প্রতিকারের উপযুক্ত চেষ্টামাত্র করিতেছি না, তাহার চিন্তামাত্র যথার্থরূপে আমাদের মনেও উদয় হইতেছে না, এই যে নিবিড় মোহাবৃত নিরূদ্যম ও চরিত্রবিকার- বাল্যকাল হইতে প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত কোন অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ইহা নিবারণের কোনো উপায় নাই।’

শিশুদের প্রতি আমাদের অবহেলা, অযতœ আর উদাসীনতাই বেশি কাজ করে। পারিবারিক আবহের মধ্যে শিশুর যে মনন ও মানস গড়ে ওঠে পরিণত বয়সে তারই প্রতিফলন সমাজে প্রকাশিত হয়। চরিত্র গঠনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা থাকলেও পরিবারই শিশুর প্রধান শিক্ষালয়। কিন্তু এ কথা আমরা মনেই রাখি না কিংবা ক্বচিৎ মনে রাখলেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখি না। মনে রাখি না বলেই শিশুদের প্রতি পরিবারের প্রাথমিক দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা আমাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। শিশুর মানস গঠনের দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্ত থাকার অভ্যাস আমাদের চরিত্রে বদ্ধমূল। শিশুদের মানস গঠনে পরিবারের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলার ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মানুষের মতো মানুষরূপে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পরিবারের সামগ্রিক আবহ থেকে বিচ্ছিন্ন এক জগতের তথাকথিত মানুষরূপেই বড় হয়ে উঠছে তারা। এ ক্ষেত্রে নীতিনৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ সর্বোপরি একজন সফল সামাজিক মানুষ হিসেবে কোথাও স্থান করে নিতে পারে না।

সমাজের মধ্য থেকেও অসামাজিক এক গলগ্রহ হিসেবে ভাসমান জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়। কেননা বিপন্ন শৈশব থেকেই বিপর্যস্ত তারুণ্য, যা শুধু উচ্ছৃঙ্খলতার জন্ম দিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভারাক্রান্ত করে চলে। কিছুদিন আগে আমরা ঢাকার তেজগাঁও কলেজ শিক্ষিকার টিপকা-, নওগাঁয় স্কুলে ছাত্রীদের হিজাব খুলে ফেলার ঘটনা, মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় ম-লের জেল খাটার ঘটনা দেখেছি। দেখেছি সামাজিক নানা প্রতিবাদও। তবু ভিন্ন আঙ্গিকে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। কোনো কিছু থেকে আমরা কোনো শিক্ষাই যেন গ্রহণ করতে পারি না। এসব ঘটনা লৌকিক কিংবা অলৌকিক যেভাবেই ঘটুক না কেন প্রতিটি ঘটনার শিকার শিক্ষক। এ রকম একেকটি কা- বাংলাদেশের একেক প্রান্তে একেক সময়ে ঘটলেও সেসব যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তা আমরা মনে করতে পারি না, খুব সহজে মেনেও নিতে পারি না।

দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে আমরা যদি সরলীকরণ করে ফেলি তাহলে এসব অন্যায় অপরাধের প্রবণতা আরও বিস্তৃত হবে এবং এর সুষ্ঠু বিচার পাওয়াও সম্ভব হবে না কোনো দিন। অন্যান্য পেশার মানুষের চেয়ে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার প্রকৃতি ও স্বরূপ একেবারেই যেন ভিন্ন। বাহ্যিক চাকচিক্য, জাঁকজমক এবং জৌলুসের বিপরীতে তা অদৃশ্য বটে কিন্তু অসীম। বাহ্যিক চাকচিক্য, জাঁকজমক ও জৌলুস নেইÑকিন্তু অন্তর্গত অনুভবে শিক্ষকরা এসব লাভের ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিয়েই শিক্ষক হন। দারিদ্র্যকে বরণের মধ্য দিয়ে মহত্ত্বকে ঐশ^র্যম-িত করে তোলেন। অর্থাৎ এসব আড়ম্বরপূর্ণ সহস্র চাহিদাকে জয় করে মানবিক ঐশ^র্যেই সমাজে শিক্ষকরা বসবাস করেন- শিক্ষার্থীদের কর্মময় জীবনের আদর্শ, রুচি, সংস্কার-সংস্কৃতি এমনকি জীবনযাপনের অন্তর্গত অনুভব হয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মনের মধ্যে বিরাজ করেন। ‘বিরাজ’ শব্দটির ওপর আমরা বিশেষ জোর দিতে চাই- শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অদৃশ্য গুণাবলির অস্তিত্ব সদাসর্বদাই অনুভব করে। যেসব শিক্ষকের কাছে আমাদের হাতেখড়ি, যাদের সৃষ্টিগুণ ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকবর্তিকার মাধ্যমে আমরা মানুষ, সমাজ, ধর্মকর্ম, জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শনের বোধ অর্জন করি সেসব শিক্ষকই আমাদের অন্তর্জগতে ব্যাপক অস্তিত্ব নিয়ে সদাই বিরাজমান।

শৈশবের শিক্ষকরা তাই এখনো বর্তমান, শারীরিকভাবে মৃতরাও আমাদের কাছে আদর্শিকভাবে জীবন্ত ও উজ্জ্বল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার এই সম্পর্কের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার কোনো বাছ-বিচার নেই, নেই অবৈজ্ঞানিক চিন্তাপ্রসূত কোনো বিকারও। কেননা, তাদের জ্ঞান, দর্শন ও আদর্শের সূক্ষ্ম আলোকরশ্মি এখনো আমাদের জীবন চলার পথের পাথেয়। আমরা জীবন যুদ্ধের প্রাত্যহিক সংগ্রামে ব্যস্ত থাকলেও কোনো না কোনো সময়, কোনো না কোনো শিক্ষকের অদৃশ্য স্মৃতির সামনে দাঁড়াই, মুখোমুখি হই। শিক্ষকেরই জ্ঞানের দ্যূতি, দর্শনের আলো, বিজ্ঞানের যৌক্তিকতা জীবনযুদ্ধের সংগ্রামে আমাদের নিয়তই ভরসা জুগিয়ে চলে, পথ দেখিয়ে নেয়। আমরাও আশ^স্ত হয়ে সংগ্রামশীল জীবনটাকে উদযাপন করি। নানা বর্ণের বর্ণিল উদযাপনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সমাজে শিক্ষকরা আদর্শিক এক উচ্চতা নিয়ে অনন্য অবস্থানে বসবাস করেন। সেখানে বিত্তের বৈভব হয়তো নেই, অন্তরের অনাবিল ঐশ^র্য আছে, যা যুগযুগান্তরকে আলোকিত করে আসছে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে।

সাম্প্রতিককালে আমরা নানাভাবে শিক্ষকদের ওপর আঘাত আসতে দেখছি, ভাবতে হবে এই আঘাত কীভাবে প্রতিহত করা সম্ভব? আমরা কীভাবে এ আঘাত প্রতিরোধ করব? শিক্ষকরা কি শিক্ষার্থীর প্রতিপক্ষ অবস্থানে দাঁড়াবেন? কোনো শিক্ষক কখনোই তা পারবেন না। শিক্ষার্থীর কল্যাণের জন্যই শিক্ষক কখনো বা কঠোরতা দেখান, কঠোর হন, এক ধরনের চাপ দিয়ে শিক্ষার্থীর ভেতরকার অকল্যাণ বিনাশের মাধ্যমে কল্যাণ ও মঙ্গলের আবাহন করেন। শিক্ষার্থী যখন সেই আহ্বান-আবাহনকে উপলব্ধিতে ব্যর্থ হয় তখনই সৃষ্টি হয় বিপত্তির। সাভারের শিক্ষক-হত্যার ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করে, আমরা বিস্মিত হই! ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কথা বাদ দিলেও বলা যায় এ তো মনুষ্য সমাজের কাজ নয়। এরূপ বিপত্তির উৎস তাহলে কোথায়?

বাংলাদেশে শিক্ষকদের ওপর ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। এসব ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, শিক্ষকদের ওপর হামলা মানে শিক্ষার ওপর হামলা। আমরা যদি শিক্ষকদের সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হই, তাহলে শেষ পর্যন্ত শিশুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৬ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষকদের ওপর সাম্প্রতিক ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় ইউনিসেফ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ইউনিসেফ এসব হামলার নিন্দা জানায় এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। পাশাপাশি, আমরা শিক্ষকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার আহ্বান জানাই। শেলডন ইয়েট বলেন, শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এই কাজটি পালন করার জন্য শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক চিন্তা করতে শেখানো, তাদের পরিপূর্ণ সম্ভাবনা অনুযায়ী ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের কোনো ধরনের ভীতি ছাড়াই শেখাতে সক্ষম হতে হবে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

ক্ষতি হয়ে গেল শিক্ষাব্যবস্থায়

এম এ কবীর

স্বাধীনতার ৫০ বছরে সবচেয়ে ক্ষতি হয়ে গেল শিক্ষাব্যবস্থায়। প্রথম দিকে শিক্ষক-অভিভাবকেরা নকল করাকে উৎসাহিত করেছেন। পরবর্তীকালে শিক্ষাঙ্গনে টাকাপয়সা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। মুখ্য হয়ে উঠে নিয়োগ-বাণিজ্য। কোচিং ব্যবসাকে অবারিত করার জন্য এলাকার রাজনৈতিক নেতা, অভিভাবক যৌথভাবে যোগ দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। একজন শিক্ষকের যখন চরম অবমাননা হয়, তখন প্রশাসন তাদের বিরাট বাহিনী নিয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রাজনীতিবিদ, চেয়ারম্যান, সভাপতি ও অভিভাবকেরা তাকিয়ে থাকেন। ভাবেন এটা তো তার অপমান হচ্ছে না, যার অপমান হওয়ার হোক, আমাদের তাতে কী। তারা ভাবেন না সারা দেশে ধিক্কারের কেন্দ্র এখন রাজশাহী, নড়াইল আর আশুলিয়ার ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো।

এক জায়গায় অধ্যক্ষকে পেটানো হলো, শিক্ষককে জুতোর মালা পরানো হলো, আরেক জায়গায় শিক্ষককে হত্যাই করা হলো। এতে অভিভাবকদেরও একটা বড় ধিক্কার তাদের প্রাপ্য হলো। কী শেখালেন ছেলেমেয়েদের? দশম শ্রেণীর একজন ছাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রেমের জন্য নয়, শুধু শাসনের জন্য একজন শিক্ষককে হত্যা করে ফেলল! আবার একটি ফেসবুক পোস্ট এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল যে তার জন্য লাঞ্ছিত করতে হবে। যে ছেলেটি পোস্টটি দিয়েছে তাকে তো পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। শিক্ষক, নাট্যকার রতন সিদ্দিকীর বাড়িতে একেবারে অকারণে হামলা করা হলো।

শিক্ষার শেষ মর্যাদাটুকু ধ্বংস করার জন্য সমাজের একশ্রেণীর মানুষের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার আভাস কি মেলে এখান থেকে? বিষয়টি গভীরভাবে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক। সবাই আখের গোছাতে ব্যস্ত এবং সেই আখের হচ্ছে মানবিক-সাংস্কৃতিক-চিন্তাবিহীন টাকা। আমাদের এখন সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে, শিক্ষকদের বাঁচাতে হবে। তাহলেই দেশ বাঁচবে। তা না হলে আমাদের যে বড় বড় অর্জন, এগুলো সবই রসাতলে যাবে। মানুষের চেতনা দুই রকম। একটি সচেতন অবস্থায় মানুষ যখন কথা বলে তখন হিসাব-নিকাশ করে বলে। আবার যখন ব্যক্তি অবচেতন মনে কথা বলে তখন আসল কথাটি প্রকাশ পায়। ধর্ষণের অভিযোগে এমসি কলেজ ছাত্রাবাস ভস্মীভূত হয়েছে। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা কতটা অসহায় হলে রাস্তায় নামেন সেটি সহজেই অনুমেয়।

‘শিক্ষা-সংস্কার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একদা বলেছিলেন : ‘দেশের লোককে শিশুকাল হইতে মানুষ করিবার সদুপায় যদি নিজে উদ্ভাবন এবং তাহার উদ্যোগ যদি নিজে না করি, তবে আমরা সর্বপ্রকারে বিনাশপ্রাপ্ত হইব- অন্নে মরিব, স্বাস্থ্যে মরিব, বুদ্ধিতে মরিব, চরিত্রে মরিব- ইহা নিশ্চয়। বস্তুত আমরা প্রত্যহই মরিতেছি অথচ তাহার প্রতিকারের উপযুক্ত চেষ্টামাত্র করিতেছি না, তাহার চিন্তামাত্র যথার্থরূপে আমাদের মনেও উদয় হইতেছে না, এই যে নিবিড় মোহাবৃত নিরূদ্যম ও চরিত্রবিকার- বাল্যকাল হইতে প্রকৃত শিক্ষা ব্যতীত কোন অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ইহা নিবারণের কোনো উপায় নাই।’

শিশুদের প্রতি আমাদের অবহেলা, অযতœ আর উদাসীনতাই বেশি কাজ করে। পারিবারিক আবহের মধ্যে শিশুর যে মনন ও মানস গড়ে ওঠে পরিণত বয়সে তারই প্রতিফলন সমাজে প্রকাশিত হয়। চরিত্র গঠনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা থাকলেও পরিবারই শিশুর প্রধান শিক্ষালয়। কিন্তু এ কথা আমরা মনেই রাখি না কিংবা ক্বচিৎ মনে রাখলেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখি না। মনে রাখি না বলেই শিশুদের প্রতি পরিবারের প্রাথমিক দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলার প্রবণতা আমাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। শিশুর মানস গঠনের দায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্ত থাকার অভ্যাস আমাদের চরিত্রে বদ্ধমূল। শিশুদের মানস গঠনে পরিবারের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে চলার ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মানুষের মতো মানুষরূপে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পরিবারের সামগ্রিক আবহ থেকে বিচ্ছিন্ন এক জগতের তথাকথিত মানুষরূপেই বড় হয়ে উঠছে তারা। এ ক্ষেত্রে নীতিনৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ সর্বোপরি একজন সফল সামাজিক মানুষ হিসেবে কোথাও স্থান করে নিতে পারে না।

সমাজের মধ্য থেকেও অসামাজিক এক গলগ্রহ হিসেবে ভাসমান জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়। কেননা বিপন্ন শৈশব থেকেই বিপর্যস্ত তারুণ্য, যা শুধু উচ্ছৃঙ্খলতার জন্ম দিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভারাক্রান্ত করে চলে। কিছুদিন আগে আমরা ঢাকার তেজগাঁও কলেজ শিক্ষিকার টিপকা-, নওগাঁয় স্কুলে ছাত্রীদের হিজাব খুলে ফেলার ঘটনা, মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় ম-লের জেল খাটার ঘটনা দেখেছি। দেখেছি সামাজিক নানা প্রতিবাদও। তবু ভিন্ন আঙ্গিকে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। কোনো কিছু থেকে আমরা কোনো শিক্ষাই যেন গ্রহণ করতে পারি না। এসব ঘটনা লৌকিক কিংবা অলৌকিক যেভাবেই ঘটুক না কেন প্রতিটি ঘটনার শিকার শিক্ষক। এ রকম একেকটি কা- বাংলাদেশের একেক প্রান্তে একেক সময়ে ঘটলেও সেসব যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তা আমরা মনে করতে পারি না, খুব সহজে মেনেও নিতে পারি না।

দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া এ ধরনের ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে আমরা যদি সরলীকরণ করে ফেলি তাহলে এসব অন্যায় অপরাধের প্রবণতা আরও বিস্তৃত হবে এবং এর সুষ্ঠু বিচার পাওয়াও সম্ভব হবে না কোনো দিন। অন্যান্য পেশার মানুষের চেয়ে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার প্রকৃতি ও স্বরূপ একেবারেই যেন ভিন্ন। বাহ্যিক চাকচিক্য, জাঁকজমক এবং জৌলুসের বিপরীতে তা অদৃশ্য বটে কিন্তু অসীম। বাহ্যিক চাকচিক্য, জাঁকজমক ও জৌলুস নেইÑকিন্তু অন্তর্গত অনুভবে শিক্ষকরা এসব লাভের ইচ্ছাকে জলাঞ্জলি দিয়েই শিক্ষক হন। দারিদ্র্যকে বরণের মধ্য দিয়ে মহত্ত্বকে ঐশ^র্যম-িত করে তোলেন। অর্থাৎ এসব আড়ম্বরপূর্ণ সহস্র চাহিদাকে জয় করে মানবিক ঐশ^র্যেই সমাজে শিক্ষকরা বসবাস করেন- শিক্ষার্থীদের কর্মময় জীবনের আদর্শ, রুচি, সংস্কার-সংস্কৃতি এমনকি জীবনযাপনের অন্তর্গত অনুভব হয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মনের মধ্যে বিরাজ করেন। ‘বিরাজ’ শব্দটির ওপর আমরা বিশেষ জোর দিতে চাই- শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের অদৃশ্য গুণাবলির অস্তিত্ব সদাসর্বদাই অনুভব করে। যেসব শিক্ষকের কাছে আমাদের হাতেখড়ি, যাদের সৃষ্টিগুণ ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকবর্তিকার মাধ্যমে আমরা মানুষ, সমাজ, ধর্মকর্ম, জ্ঞানবিজ্ঞান ও দর্শনের বোধ অর্জন করি সেসব শিক্ষকই আমাদের অন্তর্জগতে ব্যাপক অস্তিত্ব নিয়ে সদাই বিরাজমান।

শৈশবের শিক্ষকরা তাই এখনো বর্তমান, শারীরিকভাবে মৃতরাও আমাদের কাছে আদর্শিকভাবে জীবন্ত ও উজ্জ্বল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যকার এই সম্পর্কের ভেতর সাম্প্রদায়িকতার কোনো বাছ-বিচার নেই, নেই অবৈজ্ঞানিক চিন্তাপ্রসূত কোনো বিকারও। কেননা, তাদের জ্ঞান, দর্শন ও আদর্শের সূক্ষ্ম আলোকরশ্মি এখনো আমাদের জীবন চলার পথের পাথেয়। আমরা জীবন যুদ্ধের প্রাত্যহিক সংগ্রামে ব্যস্ত থাকলেও কোনো না কোনো সময়, কোনো না কোনো শিক্ষকের অদৃশ্য স্মৃতির সামনে দাঁড়াই, মুখোমুখি হই। শিক্ষকেরই জ্ঞানের দ্যূতি, দর্শনের আলো, বিজ্ঞানের যৌক্তিকতা জীবনযুদ্ধের সংগ্রামে আমাদের নিয়তই ভরসা জুগিয়ে চলে, পথ দেখিয়ে নেয়। আমরাও আশ^স্ত হয়ে সংগ্রামশীল জীবনটাকে উদযাপন করি। নানা বর্ণের বর্ণিল উদযাপনের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। সমাজে শিক্ষকরা আদর্শিক এক উচ্চতা নিয়ে অনন্য অবস্থানে বসবাস করেন। সেখানে বিত্তের বৈভব হয়তো নেই, অন্তরের অনাবিল ঐশ^র্য আছে, যা যুগযুগান্তরকে আলোকিত করে আসছে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে।

সাম্প্রতিককালে আমরা নানাভাবে শিক্ষকদের ওপর আঘাত আসতে দেখছি, ভাবতে হবে এই আঘাত কীভাবে প্রতিহত করা সম্ভব? আমরা কীভাবে এ আঘাত প্রতিরোধ করব? শিক্ষকরা কি শিক্ষার্থীর প্রতিপক্ষ অবস্থানে দাঁড়াবেন? কোনো শিক্ষক কখনোই তা পারবেন না। শিক্ষার্থীর কল্যাণের জন্যই শিক্ষক কখনো বা কঠোরতা দেখান, কঠোর হন, এক ধরনের চাপ দিয়ে শিক্ষার্থীর ভেতরকার অকল্যাণ বিনাশের মাধ্যমে কল্যাণ ও মঙ্গলের আবাহন করেন। শিক্ষার্থী যখন সেই আহ্বান-আবাহনকে উপলব্ধিতে ব্যর্থ হয় তখনই সৃষ্টি হয় বিপত্তির। সাভারের শিক্ষক-হত্যার ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করে, আমরা বিস্মিত হই! ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কথা বাদ দিলেও বলা যায় এ তো মনুষ্য সমাজের কাজ নয়। এরূপ বিপত্তির উৎস তাহলে কোথায়?

বাংলাদেশে শিক্ষকদের ওপর ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসঙ্ঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। এসব ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, শিক্ষকদের ওপর হামলা মানে শিক্ষার ওপর হামলা। আমরা যদি শিক্ষকদের সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হই, তাহলে শেষ পর্যন্ত শিশুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৬ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষকদের ওপর সাম্প্রতিক ধারাবাহিক হামলার ঘটনায় ইউনিসেফ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ইউনিসেফ এসব হামলার নিন্দা জানায় এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। পাশাপাশি, আমরা শিক্ষকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার আহ্বান জানাই। শেলডন ইয়েট বলেন, শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু এই কাজটি পালন করার জন্য শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক চিন্তা করতে শেখানো, তাদের পরিপূর্ণ সম্ভাবনা অনুযায়ী ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকদের কোনো ধরনের ভীতি ছাড়াই শেখাতে সক্ষম হতে হবে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]