মননে পাকিস্তানি ভূত

সজীব ওয়াফি

কয়েক দিন আগে বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় ম-লকে হেনস্তা করা হলো, এরপর নড়াইলে জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশের অনুমতিতে কলেজ অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে প্রকাশ্যে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ কী? কারণ হচ্ছে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে হৃদয় ম-ল বিজ্ঞান এবং ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন; আর নড়াইলের অধ্যক্ষ দোষ করেছিলেন একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত জনতা কলেজে বিক্ষোভ করলে তিনি কলেজের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ডেকেছিলেন। এরও আগে হিন্দু নারী লতা সমাদ্দারের কপালে টিপ পরা নিয়ে তুমুল হইচই। ঘটনা একটা ফুরাতে না ফুরাইতেই অন্য একটা এসে হাজির। অধ্যক্ষকে অপদস্ত করার পর এবারে এই সারিতে যুক্ত হয়েছে নড়াইলে হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, মারধর, লুটপাট আর মন্দির ভাঙচুর!

প্রশ্ন দাঁড়াল একাত্তরে যা মিমাংসা হয়ে গেল, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে সেগুলো নতুন করে আবির্ভাব হলো কেন? সত্যি বলতে ব্রিটিশরা আমাদের মাথায় যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত ঢুকিয়ে গেছে, তা আমরা ভুলতে পারিনি। ইতিহাস টানাটানি না করে একটু বর্তমান পাকিস্তানের দিকে তাকাই, নিশ্চয়ই দেখতে পাব সেখানে কি হয় আর না হয়। আমরা দেখতে পাবো জঙ্গিবাদ, সামরিক একনায়কতন্ত্র, শিল্পপতি, জমিদার এবং জোতদারদের একটা শ্রেণী। তাদের সরকার টিকে থাকে জনগণের ক্ষমতা বলে নয়, সামরিক বাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা সেখানে অন্যায়। মোটাদাগে বললে ওপরে আল্লাহ আর জমিনে সামরিক বাহিনী। পাঠ্যপুস্তকে শেখানো হয় বাঙালি বিদ্বেষ। মাদ্রাসার কম শিক্ষিত শিক্ষক এবং ছাত্ররা সেখানকার জুতা সেলাই থেকে একেবারে চন্ডি পাঠ ধর্মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। মাঝেমধ্যে মসজিদেও গোলাবর্ষণ হয়। অর্থাৎ অন্য ধর্মাবলম্বীদের আক্রমণ করার মতো পরিস্থিতি যখন পাচ্ছে না, তখন কাকের মাংস কাকে খায়! ত্যক্ত-বিরক্ত সেখানকার সচেতন নাগরিকেরা এখন বাংলাদেশ হতে চাওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে সেই ২০০৯ সাল থেকে, একটানা তৃতীয় মেয়াদে। গণতান্ত্রিক কোন রাষ্ট্রে একটা দলের এভাবে পর পর তিন মেয়াদ পূর্ণ করার নজির দুর্লভ। একটানা তিন মেয়াদ থাকতে গিয়ে সরকারকে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজনকে তোয়াজ করতে চলতে হচ্ছে, কখনো কখনো চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে; একদিকে অভ্যন্তরীণ শক্তি আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শক্তি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে! এখন নামার কোন উপায় নেই, নামলেই বাঘ খেয়ে ফেলবে। এ কারণে সমস্ত কিছু অনুকূলে রাখতে বিপজ্জনক জেনেও টানতে হচ্ছে দলের ভেতরে। এমন কৌশলের কারণে তারা বামপন্থী মতাদর্শের সঙ্গেও আছে, ডান মতাদর্শের সঙ্গেও আছে। গত এক দশকে কোন সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার হয়নি। বরঞ্চ ভুক্তভোগীদেরই দিনের পর দিন জেলে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হলে সরকার বিরোধীদের বড় একটা অংশ সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে অনিহা দেখায়, কেননা তাদের ধারণা তাতে সংখ্যাগুরুদের বিরাট অংশ তাদের ওপর নাখোশ হয়। বিরোধীরা ঘুরতে থাকে তাদের সংকীর্ণ বলয়ের ভেতরে। সুতরাং অপরাধীদের আটকানো জন্য সরকারের নিরব কৌশলকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আপাতত কেউ নাই। মুষ্টিমেয় যারা আছে তাদের শক্তি একেবারেই ক্ষীণ। সুযোগটা নিয়েছে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীরা। তাদের চিন্তা কোনক্রমেই যদি এই জাতির সংস্কৃতি পাল্টে দেয়া যায়। এতে নিরবে যে বার্তাটা সংখ্যালঘুদের কাছে পৌঁছায় তা হলোÑদেখো আমরা ক্ষমতায় থাকার পরেও এই অবস্থা, আমরা ক্ষমতা থেকে নামলে তোমাদের কি হবে কল্পনা করো! পাশাপাশি হামলাকারীদের বিচারের মুখোমুখি না করে সাম্প্রদায়িকতার গায়েও হাত বুলিয়ে দেওয়া হলো যে দেখতেছ না আমরা ধর্ম অবমাননাকারীকে বিচারের আওতায় এনেছি।

পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ হলো, বাধা আরোপ করা হলো পহেলা বৈশাখ পালন করা যাবে না। টিপ পরা নিয়েও নানান কথা ছিল। এগুলো নাকি বিজাতীয় হিন্দু সংস্কৃতি! গেল পহেলা বৈশাখের দিকে যদি তাকানো যায় মনে হবে পুলিশের মিছিল! মৌলবাদীদের নানা ধাঁচের কটূক্তি তো ছিলই। স্বাধীনভাবে কে কি পোশাক পরিধান করবে, সেই জায়গাটুকুও সীমিত হয়ে এসেছে। টিপকা-ের পর নরসিংদীতে এক নারীর পোশাক পরা নিয়ে সংঘটিত উত্তেজনা তারই উদাহরণ। অতশত কথা বাদ দিয়ে এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বছর ৩০ আগেরকার আর বর্তমান নারী শিক্ষার্থীদের পোশাকের দিকে তাকালেই আন্দাজ করা সম্ভব আমরা কোন পথে হাঁটছি। ধরে নিলাম মানুষের মনস্তাত্ত্বিক এই পরিবর্তন ভালোর জন্য। তবে যেই জন্য পোশাকের এই পরিবর্তন সেই অপরাধটা তো কমছে না উপরন্তু মহামারীর মতো বাড়ছে; শিশুরাও নির্যাতিত হচ্ছে। নৈতিকতার যে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, সেটা কিঞ্চিৎ পরিমাণও হয়নি। উল্টো রোজার সময়ে রোজাকে পুঁজি করে জিনিসপত্রের অত্যধিক দাম হাঁকানো। সমাজের নানা স্তরে সুদ-ঘুষের আধিক্য। হাতে গোনা দু’একজন বাদে সুযোগের অভাবে সবাই সৎ আছেন। দু’একজন যারা সৎ তাদের ভোগান্তির আর শেষ নাই, পদে পদে বাঁধা।

রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলা হলো, হামলা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে, ধর্মের আগুনে পুড়ে ল-ভ- হয়ে গেল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিজড়িত সমস্ত জিনিস। হামলার এই ধারাবাহিকতা পাবনা, রংপুর, গাইবান্ধা, ভোলা, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর কোথাও বাদ যায়নি। গত বছর দুর্গাপূজার সময়ে কুমিল্লায় নানুয়াদিঘীর পাড়ে মন্দিরে কোরআন রেখে একটা উৎসব কীভাবে নষ্ট করা যায়, তা তো সবাই দেখলাম। কীভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর পরিকল্পিত হামলা হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নানুয়াদিঘীর পাড়। সারা দেশে ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করল, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে দু’একটা জায়গাতে সংঘর্ষ হয়। যতদূর মনে পরে সংঘর্ষে আক্রমণকারী দু’একজন মারাও গিয়েছিলেন। অনেকে বলাবলি শুরু করল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করল তারা ধর্মের জন্য শহীদ হয়েছে। সর্বশেষ সিসিটিভি ফুটেজে যখন দেখা গেল কোরআন রেখেছে স্বয়ং একজন মুসলমান এবং এর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী একটা মসজিদের বিপথগামী লোকজন জড়িত, তখন কিন্তু এই সব ইসলাম প্রিয় উত্তেজিত জনতার মুখে কোন রা নেই। বাস্তবপক্ষে কুমিল্লার এই ঘটনায় কি কোরআন অবমাননা হয়েছে নাকি সনাতন ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে? আর হুজুগে যারা জীবন দিল ইসলাম ধর্ম মতে তাদের স্থান কই হবে এটা মুসলমানগণ ভালো করেই জানেন। ইসলাম প্রিয় মানুষের কিন্তু উচিত ছিল কোরআনকে একজন মুসলমান কেন মন্দিরে নিয়ে গিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের একটা উৎসব নষ্ট করল সেই জন্য প্রতিবাদ করা।

নড়াইলের লোহাগড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, যুক্তিতর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আকাশ সাহা অপরাধ করেছে; সে ক্ষেত্রে তার বাবাকে গ্রেপ্তার করা কি যুক্তিসঙ্গত? অন্যের ধর্মালয়ে হামলা করে নিজ ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়! ধর্ম এতই ঠুনকো! হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ বা লুটপাট কি ইসলাম সমর্থন করে? করে না, কোন ধর্মই এই সব অধর্ম কার্যকলাপ সমর্থন করে না। কেউ যদি অপরাধ করেও থাকে এ জন্য অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো যায়, কিন্তু অন্য কোন প্রকারের ক্ষতিসাধন করা ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ! অথচ ইসলামের নাম করে প্রতিনিয়ত আক্রমণ হচ্ছে, এতে সারা বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। কেননা যারা মুসলমান নয়, তারা তো কোরআন-হাদিস পড়তে জানেন না। তারা মুসলমানদের আচরণ দিয়ে ইসলাম পরিমাপ করবে স্বাভাবিক। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে এবং ধর্মালয়ে আগুন-লুটপাট ও ভাঙচুরের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজকে একাট্টা হয়ে দাঁড়ানো সময় এসেছে। কারণ, এই সব অধর্মগুলো ইসলামের শিক্ষা নয়, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। প্রশ্ন তুলতে হবে সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার করতে রাষ্ট্র নিরব কেন? বারবার এ ধরনের হামলায় কে লাভবান হচ্ছে?

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

মননে পাকিস্তানি ভূত

সজীব ওয়াফি

কয়েক দিন আগে বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় ম-লকে হেনস্তা করা হলো, এরপর নড়াইলে জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশের অনুমতিতে কলেজ অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে প্রকাশ্যে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ কী? কারণ হচ্ছে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে হৃদয় ম-ল বিজ্ঞান এবং ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন; আর নড়াইলের অধ্যক্ষ দোষ করেছিলেন একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত জনতা কলেজে বিক্ষোভ করলে তিনি কলেজের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ডেকেছিলেন। এরও আগে হিন্দু নারী লতা সমাদ্দারের কপালে টিপ পরা নিয়ে তুমুল হইচই। ঘটনা একটা ফুরাতে না ফুরাইতেই অন্য একটা এসে হাজির। অধ্যক্ষকে অপদস্ত করার পর এবারে এই সারিতে যুক্ত হয়েছে নড়াইলে হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, মারধর, লুটপাট আর মন্দির ভাঙচুর!

প্রশ্ন দাঁড়াল একাত্তরে যা মিমাংসা হয়ে গেল, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে সেগুলো নতুন করে আবির্ভাব হলো কেন? সত্যি বলতে ব্রিটিশরা আমাদের মাথায় যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত ঢুকিয়ে গেছে, তা আমরা ভুলতে পারিনি। ইতিহাস টানাটানি না করে একটু বর্তমান পাকিস্তানের দিকে তাকাই, নিশ্চয়ই দেখতে পাব সেখানে কি হয় আর না হয়। আমরা দেখতে পাবো জঙ্গিবাদ, সামরিক একনায়কতন্ত্র, শিল্পপতি, জমিদার এবং জোতদারদের একটা শ্রেণী। তাদের সরকার টিকে থাকে জনগণের ক্ষমতা বলে নয়, সামরিক বাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা সেখানে অন্যায়। মোটাদাগে বললে ওপরে আল্লাহ আর জমিনে সামরিক বাহিনী। পাঠ্যপুস্তকে শেখানো হয় বাঙালি বিদ্বেষ। মাদ্রাসার কম শিক্ষিত শিক্ষক এবং ছাত্ররা সেখানকার জুতা সেলাই থেকে একেবারে চন্ডি পাঠ ধর্মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে। মাঝেমধ্যে মসজিদেও গোলাবর্ষণ হয়। অর্থাৎ অন্য ধর্মাবলম্বীদের আক্রমণ করার মতো পরিস্থিতি যখন পাচ্ছে না, তখন কাকের মাংস কাকে খায়! ত্যক্ত-বিরক্ত সেখানকার সচেতন নাগরিকেরা এখন বাংলাদেশ হতে চাওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে সেই ২০০৯ সাল থেকে, একটানা তৃতীয় মেয়াদে। গণতান্ত্রিক কোন রাষ্ট্রে একটা দলের এভাবে পর পর তিন মেয়াদ পূর্ণ করার নজির দুর্লভ। একটানা তিন মেয়াদ থাকতে গিয়ে সরকারকে বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজনকে তোয়াজ করতে চলতে হচ্ছে, কখনো কখনো চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে; একদিকে অভ্যন্তরীণ শক্তি আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শক্তি। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে! এখন নামার কোন উপায় নেই, নামলেই বাঘ খেয়ে ফেলবে। এ কারণে সমস্ত কিছু অনুকূলে রাখতে বিপজ্জনক জেনেও টানতে হচ্ছে দলের ভেতরে। এমন কৌশলের কারণে তারা বামপন্থী মতাদর্শের সঙ্গেও আছে, ডান মতাদর্শের সঙ্গেও আছে। গত এক দশকে কোন সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার হয়নি। বরঞ্চ ভুক্তভোগীদেরই দিনের পর দিন জেলে আটকে রাখা হয়েছে। এমনকি সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হলে সরকার বিরোধীদের বড় একটা অংশ সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে অনিহা দেখায়, কেননা তাদের ধারণা তাতে সংখ্যাগুরুদের বিরাট অংশ তাদের ওপর নাখোশ হয়। বিরোধীরা ঘুরতে থাকে তাদের সংকীর্ণ বলয়ের ভেতরে। সুতরাং অপরাধীদের আটকানো জন্য সরকারের নিরব কৌশলকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আপাতত কেউ নাই। মুষ্টিমেয় যারা আছে তাদের শক্তি একেবারেই ক্ষীণ। সুযোগটা নিয়েছে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীরা। তাদের চিন্তা কোনক্রমেই যদি এই জাতির সংস্কৃতি পাল্টে দেয়া যায়। এতে নিরবে যে বার্তাটা সংখ্যালঘুদের কাছে পৌঁছায় তা হলোÑদেখো আমরা ক্ষমতায় থাকার পরেও এই অবস্থা, আমরা ক্ষমতা থেকে নামলে তোমাদের কি হবে কল্পনা করো! পাশাপাশি হামলাকারীদের বিচারের মুখোমুখি না করে সাম্প্রদায়িকতার গায়েও হাত বুলিয়ে দেওয়া হলো যে দেখতেছ না আমরা ধর্ম অবমাননাকারীকে বিচারের আওতায় এনেছি।

পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ হলো, বাধা আরোপ করা হলো পহেলা বৈশাখ পালন করা যাবে না। টিপ পরা নিয়েও নানান কথা ছিল। এগুলো নাকি বিজাতীয় হিন্দু সংস্কৃতি! গেল পহেলা বৈশাখের দিকে যদি তাকানো যায় মনে হবে পুলিশের মিছিল! মৌলবাদীদের নানা ধাঁচের কটূক্তি তো ছিলই। স্বাধীনভাবে কে কি পোশাক পরিধান করবে, সেই জায়গাটুকুও সীমিত হয়ে এসেছে। টিপকা-ের পর নরসিংদীতে এক নারীর পোশাক পরা নিয়ে সংঘটিত উত্তেজনা তারই উদাহরণ। অতশত কথা বাদ দিয়ে এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বছর ৩০ আগেরকার আর বর্তমান নারী শিক্ষার্থীদের পোশাকের দিকে তাকালেই আন্দাজ করা সম্ভব আমরা কোন পথে হাঁটছি। ধরে নিলাম মানুষের মনস্তাত্ত্বিক এই পরিবর্তন ভালোর জন্য। তবে যেই জন্য পোশাকের এই পরিবর্তন সেই অপরাধটা তো কমছে না উপরন্তু মহামারীর মতো বাড়ছে; শিশুরাও নির্যাতিত হচ্ছে। নৈতিকতার যে পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, সেটা কিঞ্চিৎ পরিমাণও হয়নি। উল্টো রোজার সময়ে রোজাকে পুঁজি করে জিনিসপত্রের অত্যধিক দাম হাঁকানো। সমাজের নানা স্তরে সুদ-ঘুষের আধিক্য। হাতে গোনা দু’একজন বাদে সুযোগের অভাবে সবাই সৎ আছেন। দু’একজন যারা সৎ তাদের ভোগান্তির আর শেষ নাই, পদে পদে বাঁধা।

রামুর বৌদ্ধপল্লিতে হামলা হলো, হামলা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে, ধর্মের আগুনে পুড়ে ল-ভ- হয়ে গেল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিজড়িত সমস্ত জিনিস। হামলার এই ধারাবাহিকতা পাবনা, রংপুর, গাইবান্ধা, ভোলা, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর কোথাও বাদ যায়নি। গত বছর দুর্গাপূজার সময়ে কুমিল্লায় নানুয়াদিঘীর পাড়ে মন্দিরে কোরআন রেখে একটা উৎসব কীভাবে নষ্ট করা যায়, তা তো সবাই দেখলাম। কীভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর পরিকল্পিত হামলা হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নানুয়াদিঘীর পাড়। সারা দেশে ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করল, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে দু’একটা জায়গাতে সংঘর্ষ হয়। যতদূর মনে পরে সংঘর্ষে আক্রমণকারী দু’একজন মারাও গিয়েছিলেন। অনেকে বলাবলি শুরু করল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করল তারা ধর্মের জন্য শহীদ হয়েছে। সর্বশেষ সিসিটিভি ফুটেজে যখন দেখা গেল কোরআন রেখেছে স্বয়ং একজন মুসলমান এবং এর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী একটা মসজিদের বিপথগামী লোকজন জড়িত, তখন কিন্তু এই সব ইসলাম প্রিয় উত্তেজিত জনতার মুখে কোন রা নেই। বাস্তবপক্ষে কুমিল্লার এই ঘটনায় কি কোরআন অবমাননা হয়েছে নাকি সনাতন ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে? আর হুজুগে যারা জীবন দিল ইসলাম ধর্ম মতে তাদের স্থান কই হবে এটা মুসলমানগণ ভালো করেই জানেন। ইসলাম প্রিয় মানুষের কিন্তু উচিত ছিল কোরআনকে একজন মুসলমান কেন মন্দিরে নিয়ে গিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের একটা উৎসব নষ্ট করল সেই জন্য প্রতিবাদ করা।

নড়াইলের লোহাগড়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, যুক্তিতর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আকাশ সাহা অপরাধ করেছে; সে ক্ষেত্রে তার বাবাকে গ্রেপ্তার করা কি যুক্তিসঙ্গত? অন্যের ধর্মালয়ে হামলা করে নিজ ধর্মের প্রতিষ্ঠা হয়! ধর্ম এতই ঠুনকো! হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ বা লুটপাট কি ইসলাম সমর্থন করে? করে না, কোন ধর্মই এই সব অধর্ম কার্যকলাপ সমর্থন করে না। কেউ যদি অপরাধ করেও থাকে এ জন্য অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো যায়, কিন্তু অন্য কোন প্রকারের ক্ষতিসাধন করা ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ! অথচ ইসলামের নাম করে প্রতিনিয়ত আক্রমণ হচ্ছে, এতে সারা বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। কেননা যারা মুসলমান নয়, তারা তো কোরআন-হাদিস পড়তে জানেন না। তারা মুসলমানদের আচরণ দিয়ে ইসলাম পরিমাপ করবে স্বাভাবিক। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়িতে এবং ধর্মালয়ে আগুন-লুটপাট ও ভাঙচুরের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজকে একাট্টা হয়ে দাঁড়ানো সময় এসেছে। কারণ, এই সব অধর্মগুলো ইসলামের শিক্ষা নয়, পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। প্রশ্ন তুলতে হবে সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার করতে রাষ্ট্র নিরব কেন? বারবার এ ধরনের হামলায় কে লাভবান হচ্ছে?

[লেখক : প্রাবন্ধিক]