সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে

আর কে চৌধুরী

১৬ জুলাই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত অর্ধশতাধিক। এর মধ্যে টাঙ্গাইলে একই পরিবারের তিনজনসহ আটজন নিহত হয়েছেন। ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন একই পরিবারের তিনজন। বগুড়ায় পিতা-পুত্রসহ চারজন নিহত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে নিহত হয়েছেন চারজন। এ ছাড়া হবিগঞ্জে তিনজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজন, গাজীপুরে দুজন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে একজন, দিনাজপুরের খানসামায় একজন এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণে ঘরে ঘরে উঠেছে কান্নার রোল। তবে তা যানবাহন চালকদের সুমতি ফেরাবে কিনা- একটি বড়মাপের প্রশ্ন। সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ বারবার ফুঁসে উঠলেও তা বাস-ট্রাক-পিকআপ চালকদের যথেচ্ছতা থামাতে কোনো অবদানই রাখতে পারেনি।

কোনভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেন? বহু অনিয়ম ঘটে রাস্তায়। যেসব কারণে রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল লেগেই আছে। ময়লার গাড়ির ধাক্কায় পাঁচ বছরে ৩২ মৃত্যু। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, অপেশাদার, অস্থায়ী, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালকরাই চালাচ্ছেন এসব গাড়ি। খবরে প্রকাশ, দুই সিটি করপোরেশনের ৯৪৬টি ভারী গাড়ি চালানোর জন্য এখনো পর্যাপ্ত দক্ষ চালক নেই।

মহাসড়কে কী হচ্ছে? চলতি বছরের শুরু থেকে গত ১২ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে গাবতলী-পাটুরিয়া মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০টি। এর মধ্যে ২৫টি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে সেলফি পরিবহন। একটি পরিবহন এত দুর্ঘটনায় কেন? কারণ দীর্ঘদিন ব্যবহারে ফিটনেস হারানোয় বাসগুলোর দূরপাল্লায় চলাচলের সক্ষমতা নেই। বেশির ভাগ বাসের এই পথে চলাচলের অনুমোদন নেই। সেই সঙ্গে বেশির ভাগ চালকের লাইসেন্সও নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এরপরও সড়কে হতাহতের ঘটনা প্রশমনে কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয়। বরং এআরআই তাদের গবেষণা থেকে জানায়, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেমন ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ছিল সাড়ে ২২ শতাংশ। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২০ সালে পথচারী মৃত্যুর হার ছিল ২৯ দশমিক ৯। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৬ শতাংশে। সামগ্রিক বিবেচনায় আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ৫ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের সড়ক ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। সড়ক উন্নয়নে সরকারের বিপুল বিনিয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট, তবে তা নিরাপদ চলাচল যে নিশ্চিত করতে পারেনি, এ নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই। বিষয় বিশেষজ্ঞরা সড়ক নির্মাণ ও মেরামতে ব্যাপক অনিয়ম ও অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা প্রায় বলে থাকেন। সড়কের বেহাল অবস্থার বিষয়টি মিডিয়ার নিত্যদিনের শিরোনামে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে ভয়াবহ যে বিষয়টি যুক্ত হয়েছে, তা হলো সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট।

অর্থাৎ এখানে সর্বত্র সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দারুণ অভাব রয়েছে। রোববার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিট (এআরআই) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সড়কে ক্ষয়ক্ষতির কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যা অনভিপ্রেত হলেও বিস্ময়কর নয়। সেখানে বলা হয়েছে, সড়কে অব্যবস্থাপনার কারণে বছরে মোট ক্ষতি ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা জিডিপির দুই শতাংশ। এছাড়া শুধু ঢাকায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে বার্ষিক ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা জিডিপির তিন শতাংশ। এর সঙ্গে রয়েছে জানমালের ক্ষতি।

আমরা কোনো মতেই এমন অনিরাপদ সড়ক চাই না। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। চালকদের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। গাড়ির ফিটনেসের ব্যাপারে কোনো আপস করা যাবে না।

[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]

বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই ২০২২ , ০৬ শ্রাবণ ১৪২৯ ২২ জিলহজ ১৪৪৩

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে

আর কে চৌধুরী

১৬ জুলাই দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ২৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত অর্ধশতাধিক। এর মধ্যে টাঙ্গাইলে একই পরিবারের তিনজনসহ আটজন নিহত হয়েছেন। ময়মনসিংহের ত্রিশালে ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন একই পরিবারের তিনজন। বগুড়ায় পিতা-পুত্রসহ চারজন নিহত হয়েছেন। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে নিহত হয়েছেন চারজন। এ ছাড়া হবিগঞ্জে তিনজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুজন, গাজীপুরে দুজন, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে একজন, দিনাজপুরের খানসামায় একজন এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণে ঘরে ঘরে উঠেছে কান্নার রোল। তবে তা যানবাহন চালকদের সুমতি ফেরাবে কিনা- একটি বড়মাপের প্রশ্ন। সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ বারবার ফুঁসে উঠলেও তা বাস-ট্রাক-পিকআপ চালকদের যথেচ্ছতা থামাতে কোনো অবদানই রাখতে পারেনি।

কোনভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেন? বহু অনিয়ম ঘটে রাস্তায়। যেসব কারণে রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল লেগেই আছে। ময়লার গাড়ির ধাক্কায় পাঁচ বছরে ৩২ মৃত্যু। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, অপেশাদার, অস্থায়ী, লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালকরাই চালাচ্ছেন এসব গাড়ি। খবরে প্রকাশ, দুই সিটি করপোরেশনের ৯৪৬টি ভারী গাড়ি চালানোর জন্য এখনো পর্যাপ্ত দক্ষ চালক নেই।

মহাসড়কে কী হচ্ছে? চলতি বছরের শুরু থেকে গত ১২ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে গাবতলী-পাটুরিয়া মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৭০টি। এর মধ্যে ২৫টি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে সেলফি পরিবহন। একটি পরিবহন এত দুর্ঘটনায় কেন? কারণ দীর্ঘদিন ব্যবহারে ফিটনেস হারানোয় বাসগুলোর দূরপাল্লায় চলাচলের সক্ষমতা নেই। বেশির ভাগ বাসের এই পথে চলাচলের অনুমোদন নেই। সেই সঙ্গে বেশির ভাগ চালকের লাইসেন্সও নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এরপরও সড়কে হতাহতের ঘটনা প্রশমনে কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয়। বরং এআরআই তাদের গবেষণা থেকে জানায়, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেমন ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ছিল সাড়ে ২২ শতাংশ। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২০ সালে পথচারী মৃত্যুর হার ছিল ২৯ দশমিক ৯। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৬ শতাংশে। সামগ্রিক বিবেচনায় আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ৫ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের সড়ক ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। সড়ক উন্নয়নে সরকারের বিপুল বিনিয়োগের বিষয়টি স্পষ্ট, তবে তা নিরাপদ চলাচল যে নিশ্চিত করতে পারেনি, এ নিয়ে কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই। বিষয় বিশেষজ্ঞরা সড়ক নির্মাণ ও মেরামতে ব্যাপক অনিয়ম ও অতিরিক্ত ব্যয়ের কথা প্রায় বলে থাকেন। সড়কের বেহাল অবস্থার বিষয়টি মিডিয়ার নিত্যদিনের শিরোনামে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে ভয়াবহ যে বিষয়টি যুক্ত হয়েছে, তা হলো সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট।

অর্থাৎ এখানে সর্বত্র সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দারুণ অভাব রয়েছে। রোববার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিট (এআরআই) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সড়কে ক্ষয়ক্ষতির কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যা অনভিপ্রেত হলেও বিস্ময়কর নয়। সেখানে বলা হয়েছে, সড়কে অব্যবস্থাপনার কারণে বছরে মোট ক্ষতি ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা জিডিপির দুই শতাংশ। এছাড়া শুধু ঢাকায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে বার্ষিক ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা জিডিপির তিন শতাংশ। এর সঙ্গে রয়েছে জানমালের ক্ষতি।

আমরা কোনো মতেই এমন অনিরাপদ সড়ক চাই না। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। চালকদের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। গাড়ির ফিটনেসের ব্যাপারে কোনো আপস করা যাবে না।

[লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, রাজউক]