শুক্রবার, ২২ জুলাই ২০২২, ০৭ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৩ জিলহজ ১৪৪৩

নগরে আগুন লাগলে দেবালয়কে রক্ষা করা যায় না

শেখর ভট্টাচার্য

ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে কিংবা অন্য যে কোন কারণেই হোক বাঙালিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ শাসকের কাছাকাছি থেকে অনুগ্রহ গ্রহণ করতে খুব ভালোবাসে। মানবিক গুণাবলী লাভ করে বাঙালি তার জাতি সত্ত্বার পথ পরিক্রমায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্জন করেছে এবং একইভাবে স্বার্থ লাভের আশায় বাঙালিকে শাসক কিংবা ঊর্ধ্বতনদের তল্পী বহন করতেও আমরা দেখেছি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যেমন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন একইভাবে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি মজবুত করার জন্য সুযোগ সন্ধানী বাঙালিরও উদ্ভব ঘটেছিলো।

বিনয় ঘোষ ছিলেন বিশ শতকের একজন বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্য সমালোচক, সাহিত্যিক, লোকসংস্কৃতি সাধক, চিন্তাবিদ ও গবেষক। তার একটি বই পড়ছিলাম, বইটির নাম টাউন কলকাতার কড়চা। মহৎ লেখকের লেখা যখন পাঠ করবেন তখন, মস্তিষ্কে নানা ভাবনার উদয় হয়, মহৎ লেখার এটি একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাঙালির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকান্ডের বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক ভাবি এবং তা নিয়ে আমাদের প্রচুর গবেষণামূলক লেখাজোখাও রয়েছে। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাঙালি চরিত্রের বিশ্লেষণ করেছেন খুব কমসংখ্যক গবেষক ও লেখক। বিনয় ঘোষের বইটি যেকোন পাঠককে বাঙালির সুযোগ সন্ধানী ও স্বার্থপর স্বভাবের সঙ্গে পরিচয় করি দেবে। তবে সকল বাঙালি এসব নেতিবাচক বিশেষণ অর্জন করেননি। সম্পদ ও মেকী আভিজাত্য লোভী মানুষেরাই ছিলেন এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

বিষয়টিকে সহজভাবে অনুধাবনের জন্য লেখার শুরুতেই বিনয় ঘোষের বক্তব্যের একটি অংশ তুলে ধরি প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে। ‘ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে, আঠারো শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে যে সমস্ত কৃতী ব্যক্তি তাদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানি করে। এক পুরুষের দেওয়ানি করে তারা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী বংশধরদের বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যের খোরাক জুগিয়ে এসেছে। বেনিয়ানরা ছিলেন বিদেশি ব্যবসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা। আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীরা এ দেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ব করেন, তখন দেশ ও দেশের মানুষ সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেই জন্য তঁদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়োগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ প্রায় সমস্ত ব্যাপারেই পদে পদে যাদের ওপর নির্ভর করতে হতো তারাই হলো বেনিয়ান। এই বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রথম যুগের ইংরজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন, হিসাবরক্ষক ছিলেন, এমনকি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে।’ (বিনয় ঘোষ, টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)।

এই সুবিধাভোগী যাদের বেনিয়ান বলা হয়েছে তাদের আমরা যুগে যুগে প্রত্যক্ষ করি। বাংলার স্বাধীনতাকে অস্তগামী করতে ইংরেজদের তারা সহায়তা করেছে। মীরজাফর আলীর নেতৃত্বে তারা বড়ই সরব ছিলো তখন। অস্তগামী স্বাধীনতাকে আবার নতুন করে উদয় করার প্রচেষ্টায় সংগঠিত আন্দোলনের সময় অর্থাৎ বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও আমরা এসব সুবিধাভোগীদের তৎপরতা লক্ষ্য করেছি। একটি বিষয় ভেবে অবাক হতে হয় ইতিহাসের কোন পর্যায়েই শেষ পর্যন্ত তাদের জয়ী হত দেখা যায়নি তারপরও সাময়িক সুবিধা, অর্থবিত্ত ক্ষমতা লাভের জন্য তারা তাদের শেষ চেষ্টাটি করে গেছে। তারা কারা ছিলেন? কী করেছেন?

এই বাঙালি বেনিয়ান বা সুবিধাভোগীরা প্রথম যুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী, বাণিজ্য প্রতিনিধি আর মহাজন শুধু ছিল না, তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও সহচর। ১৬৯০ সালে জোব চার্ণক হুগলী নদীর উজান বেয়ে যখন কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিলেন, তখন থেকেই এই শ্রেণীর সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগর সুবাদে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের রাজনৈতিক গাঁটছাড়া। আঠারো শতকের শুরু থেকে সে সম্পর্কে আরো জোরদার হয়। এ জন্যই দেখা যায় ১৭৩৬ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় যে ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করে, তারা সকলেই ছিল একটি বিশেষ সুবিধাবাদী-সম্প্রদায়ের লোক। ১৭৩৯ সালে কোম্পানি কাসিমবাজারে যে পঁচিশ জন ব্যবসায়ী নিয়োগ করে তাদেরও পরিচয় ছিলো অভিন্ন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে যারা জমিদারি লাভ করেছিলেন, তারাই বাঙালি সমাজে অভিজাত শ্রেণী হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। এই অভিজাত শ্রেণীদের উত্তরসূরিরা নিজেদের মেকী আভিজাত্য নিয়ে দীর্ঘ কাল ধরে বাঙালি সমাজে নিজেদের নীল রক্তধারী, ভিন্ন রুচির মানুষ হিসাবে পরিচয় দিয়ে এসেছেন এবং এখনও পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। একইভাবে ইংরেজদের আনুকূল্যের জন্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকারীদের তথ্য পাচারকারী হিসাবেও আমরা তাদের ভূমিকা দেখে থাকি। ইংরেজ দেবতার পূজা-আর্চনা করে দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দী গোমস্তা শ্রেণীর লোকেরা জমিদারি কিনে সামন্ত-অভিজাত্য লাভ করেন।

তাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষা, সংস্কৃতি সমাজকল্যাণের জন্য কাজ করে নিজেদের প্রকৃত অর্থে অভিজাত করেছেন। তাদের কথা এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়। সমাজ সংস্কারের জন্য যেমন এ শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়। সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনে আমরা অনেক শিক্ষিত বাঙালির ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করি। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাঙালি অংশ গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগীদের উত্তরসূরি। আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির অসম্পূর্ণ নবজাগরণেও ব্রিটিশ রাজের পক্ষের শক্তির উত্তরসূরিদের অংশগ্রহণ দেখে থাকি। যদিও এই নবজাগরণে তাদের অংশগ্রহণ নিরঙ্কুশ ছিলো না।

পাকিস্তান আমলে আমাদের পূর্ব বাংলায়ও এরকম বেনিয়ান শ্রেণী ধর্মের নামে, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পরেও আমরা তাদের তৎপরতা লক্ষ্য করি। আত্মঘাতী বাঙালি (নীরদ সি’র অর্থে নয়) হিসেবে তাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বিরুদ্ধে লড়তে দেখা যায়। শুধু রবীন্দ্র, নজরুল নন বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই ছিলো বাঙালি জাতিসত্ত্বা বিকাশ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পথে ‘পথের কাঁটার’ মতো। ভাষা আন্দোলনকে তারা ধর্মের বর্ম দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। শাসক শ্রেণীর সঙ্গে তাদের সুর ছিলো অভিন্ন, যেমন ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে জমিদারদের কথার সুর ছিলো একই তারে বাধা, ঠিক সেরকম।

ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই শুধু নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে বায়ান্ন থেকে সুচিত বাঙালির প্রতিটি নায্য আন্দোলনের বিরোধিতা করে গেছে সুবিধাবাদি, ধর্মান্ধ সেই শ্রেণী, সমাজের মানুষেরা। একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে তারা পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সশস্ত্র লড়াই করেছে নিজেদের প্রতিবেশি, সমাজ ও ঐক্যবদ্ধ জাতির বিরুদ্ধে। তারা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করেছে। সে দাঙ্গার আগুন এখনও তুষের আগুনের মতো জ্বলছে সারা বাংলাদেশে। অনেকেই এরকম সাম্প্রদায়িক বর্বরতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ঘটনার ওজন কমাতে এগিয়ে আসেন। ক্রমাগত এই তথাকথিত বিচ্ছিন্ন ঘটনা এখন নিয়মিত দলনের পর্যায়ে নেমে এসেছে। এ কথা আমার অনেকেই বুঝতে পারছিনা অথবা বুঝতে পারলেও নিজেদের সুবিধাবাদী মনোভাব জাগ্রত হওয়ার কারণে, না বুঝার ভান করছি।

স্বাধীনতা অর্জনের পর এই সুবিধাবাদী শ্রেণী নিজেদের পর্দার আড়ালে রেখেছিলো কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর তারা আবার স্বরূপে আবির্ভূত হয়। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ নিয়ে তারা আবার মাঠে নামে। শুধু ধর্ম, জাতীয়তাবাদ নয় ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়েও তাদের এজেন্ডাকে আবারো বেগবান করে তোলে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরে থেকে, শাসক দলের সদস্য হয়েও এই শ্রেণীর অনেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে ক্রমাগত।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। মনে রাখতে হবে মানুষকে বিশ্বাস করে বাংলার স্বাধীনতা পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়েছিলো। সেই স্বাধীনতা আবার ফিরে পেতে আমাদের দুইশ বছরের বেশি সময় লেগেছে। আর এই স্বাধীনতা কিনে নিতে আমাদের যে দাম দিতে হয়েছে তা ছিলো সীমাহীন। আজ যারা ধর্মের নামে, সারা দেশে অরাজকতা চালাচ্ছে তাদের অরাজকতাকে যারা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তাদের মনে রাখতে হবে নগরে আগুন লাগলে দেবালয়কে রক্ষা করা যায় না। সেই আগুন কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। আজ যারা প্রজ্বালিত আগুন থেকে নিরাপদ আছেন তারাও সে আগুনের ধ্বংস যজ্ঞের বাইরে যেতে পারবেন না। তারাও দগ্ধ হবেন। সময় কিন্তু খুব বেশি নেই। জেগে ওঠার সময় হয়েছে। এখন যদি জেগে ওঠা না যায় তাহলে বদ্ধ ঘরের ভেতরে আমাদের অনেকের নিরাপদ ভাবা অবস্থানও আগুনের শিখায় প্রজ্বালিত হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

image

নড়াইলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়

আরও খবর
শিক্ষার উন্নতির স্বরূপ
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতেই হবে
আম রপ্তানি বাড়াতে সংরক্ষণ প্রকল্প ও কিছু কথা

শুক্রবার, ২২ জুলাই ২০২২ , ০৭ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৩ জিলহজ ১৪৪৩

নগরে আগুন লাগলে দেবালয়কে রক্ষা করা যায় না

শেখর ভট্টাচার্য

image

নড়াইলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়

ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে কিংবা অন্য যে কোন কারণেই হোক বাঙালিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ শাসকের কাছাকাছি থেকে অনুগ্রহ গ্রহণ করতে খুব ভালোবাসে। মানবিক গুণাবলী লাভ করে বাঙালি তার জাতি সত্ত্বার পথ পরিক্রমায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্জন করেছে এবং একইভাবে স্বার্থ লাভের আশায় বাঙালিকে শাসক কিংবা ঊর্ধ্বতনদের তল্পী বহন করতেও আমরা দেখেছি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যেমন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন একইভাবে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি মজবুত করার জন্য সুযোগ সন্ধানী বাঙালিরও উদ্ভব ঘটেছিলো।

বিনয় ঘোষ ছিলেন বিশ শতকের একজন বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্য সমালোচক, সাহিত্যিক, লোকসংস্কৃতি সাধক, চিন্তাবিদ ও গবেষক। তার একটি বই পড়ছিলাম, বইটির নাম টাউন কলকাতার কড়চা। মহৎ লেখকের লেখা যখন পাঠ করবেন তখন, মস্তিষ্কে নানা ভাবনার উদয় হয়, মহৎ লেখার এটি একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাঙালির ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকান্ডের বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক ভাবি এবং তা নিয়ে আমাদের প্রচুর গবেষণামূলক লেখাজোখাও রয়েছে। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাঙালি চরিত্রের বিশ্লেষণ করেছেন খুব কমসংখ্যক গবেষক ও লেখক। বিনয় ঘোষের বইটি যেকোন পাঠককে বাঙালির সুযোগ সন্ধানী ও স্বার্থপর স্বভাবের সঙ্গে পরিচয় করি দেবে। তবে সকল বাঙালি এসব নেতিবাচক বিশেষণ অর্জন করেননি। সম্পদ ও মেকী আভিজাত্য লোভী মানুষেরাই ছিলেন এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।

বিষয়টিকে সহজভাবে অনুধাবনের জন্য লেখার শুরুতেই বিনয় ঘোষের বক্তব্যের একটি অংশ তুলে ধরি প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে। ‘ইংরেজ আমলের গোড়ার দিকে, আঠারো শতকের মধ্যে কলকাতা শহরে যে সমস্ত কৃতী ব্যক্তি তাদের পরিবারের আভিজাত্যের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তারা অধিকাংশই তার রসদ (টাকা) সংগ্রহ করেছিলেন বড় বড় ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়ীদের দেওয়ানি করে। এক পুরুষের দেওয়ানি করে তারা যে বিপুল বিত্ত সঞ্চয় করেছিলেন, তা-ই পরবর্তী বংশধরদের বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যের খোরাক জুগিয়ে এসেছে। বেনিয়ানরা ছিলেন বিদেশি ব্যবসায়ীদের প্রধান পরামর্শদাতা। আঠারো শতকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীরা এ দেশে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আরম্ব করেন, তখন দেশ ও দেশের মানুষ সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই ছিল না বলা চলে। সেই জন্য তঁদের ব্যবসায়ের মূলধন নিয়োগ থেকে আরম্ভ করে পণ্যদ্রব্যের সরবরাহ প্রায় সমস্ত ব্যাপারেই পদে পদে যাদের ওপর নির্ভর করতে হতো তারাই হলো বেনিয়ান। এই বাঙালি বেনিয়ানরাই প্রথম যুগের ইংরজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী ছিলেন, বাণিজ্য প্রতিনিধি ছিলেন, হিসাবরক্ষক ছিলেন, এমনকি তাদের মহাজনও ছিলেন বলা চলে।’ (বিনয় ঘোষ, টাউন কলকাতার কড়চা, বিহার সাহিত্য ভবন, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৯০-৯১)।

এই সুবিধাভোগী যাদের বেনিয়ান বলা হয়েছে তাদের আমরা যুগে যুগে প্রত্যক্ষ করি। বাংলার স্বাধীনতাকে অস্তগামী করতে ইংরেজদের তারা সহায়তা করেছে। মীরজাফর আলীর নেতৃত্বে তারা বড়ই সরব ছিলো তখন। অস্তগামী স্বাধীনতাকে আবার নতুন করে উদয় করার প্রচেষ্টায় সংগঠিত আন্দোলনের সময় অর্থাৎ বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও আমরা এসব সুবিধাভোগীদের তৎপরতা লক্ষ্য করেছি। একটি বিষয় ভেবে অবাক হতে হয় ইতিহাসের কোন পর্যায়েই শেষ পর্যন্ত তাদের জয়ী হত দেখা যায়নি তারপরও সাময়িক সুবিধা, অর্থবিত্ত ক্ষমতা লাভের জন্য তারা তাদের শেষ চেষ্টাটি করে গেছে। তারা কারা ছিলেন? কী করেছেন?

এই বাঙালি বেনিয়ান বা সুবিধাভোগীরা প্রথম যুগের ইংরেজ ব্যবসায়ীদের দোভাষী, বাণিজ্য প্রতিনিধি আর মহাজন শুধু ছিল না, তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও সহচর। ১৬৯০ সালে জোব চার্ণক হুগলী নদীর উজান বেয়ে যখন কলকাতায় এসে বাসা বেঁধেছিলেন, তখন থেকেই এই শ্রেণীর সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগর সুবাদে গড়ে উঠেছিল এক ধরনের রাজনৈতিক গাঁটছাড়া। আঠারো শতকের শুরু থেকে সে সম্পর্কে আরো জোরদার হয়। এ জন্যই দেখা যায় ১৭৩৬ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় যে ৫২ জন স্থানীয় ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করে, তারা সকলেই ছিল একটি বিশেষ সুবিধাবাদী-সম্প্রদায়ের লোক। ১৭৩৯ সালে কোম্পানি কাসিমবাজারে যে পঁচিশ জন ব্যবসায়ী নিয়োগ করে তাদেরও পরিচয় ছিলো অভিন্ন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে যারা জমিদারি লাভ করেছিলেন, তারাই বাঙালি সমাজে অভিজাত শ্রেণী হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। এই অভিজাত শ্রেণীদের উত্তরসূরিরা নিজেদের মেকী আভিজাত্য নিয়ে দীর্ঘ কাল ধরে বাঙালি সমাজে নিজেদের নীল রক্তধারী, ভিন্ন রুচির মানুষ হিসাবে পরিচয় দিয়ে এসেছেন এবং এখনও পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। একইভাবে ইংরেজদের আনুকূল্যের জন্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকারীদের তথ্য পাচারকারী হিসাবেও আমরা তাদের ভূমিকা দেখে থাকি। ইংরেজ দেবতার পূজা-আর্চনা করে দেওয়ান-বেনিয়ান-মুৎসুদ্দী গোমস্তা শ্রেণীর লোকেরা জমিদারি কিনে সামন্ত-অভিজাত্য লাভ করেন।

তাদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষা, সংস্কৃতি সমাজকল্যাণের জন্য কাজ করে নিজেদের প্রকৃত অর্থে অভিজাত করেছেন। তাদের কথা এ আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়। সমাজ সংস্কারের জন্য যেমন এ শ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যায়। সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনে আমরা অনেক শিক্ষিত বাঙালির ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করি। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাঙালি অংশ গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবিধাভোগীদের উত্তরসূরি। আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির অসম্পূর্ণ নবজাগরণেও ব্রিটিশ রাজের পক্ষের শক্তির উত্তরসূরিদের অংশগ্রহণ দেখে থাকি। যদিও এই নবজাগরণে তাদের অংশগ্রহণ নিরঙ্কুশ ছিলো না।

পাকিস্তান আমলে আমাদের পূর্ব বাংলায়ও এরকম বেনিয়ান শ্রেণী ধর্মের নামে, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের পরেও আমরা তাদের তৎপরতা লক্ষ্য করি। আত্মঘাতী বাঙালি (নীরদ সি’র অর্থে নয়) হিসেবে তাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের বিরুদ্ধে লড়তে দেখা যায়। শুধু রবীন্দ্র, নজরুল নন বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই ছিলো বাঙালি জাতিসত্ত্বা বিকাশ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পথে ‘পথের কাঁটার’ মতো। ভাষা আন্দোলনকে তারা ধর্মের বর্ম দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। শাসক শ্রেণীর সঙ্গে তাদের সুর ছিলো অভিন্ন, যেমন ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে জমিদারদের কথার সুর ছিলো একই তারে বাধা, ঠিক সেরকম।

ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই শুধু নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে বায়ান্ন থেকে সুচিত বাঙালির প্রতিটি নায্য আন্দোলনের বিরোধিতা করে গেছে সুবিধাবাদি, ধর্মান্ধ সেই শ্রেণী, সমাজের মানুষেরা। একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনে তারা পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সশস্ত্র লড়াই করেছে নিজেদের প্রতিবেশি, সমাজ ও ঐক্যবদ্ধ জাতির বিরুদ্ধে। তারা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করেছে। সে দাঙ্গার আগুন এখনও তুষের আগুনের মতো জ্বলছে সারা বাংলাদেশে। অনেকেই এরকম সাম্প্রদায়িক বর্বরতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ঘটনার ওজন কমাতে এগিয়ে আসেন। ক্রমাগত এই তথাকথিত বিচ্ছিন্ন ঘটনা এখন নিয়মিত দলনের পর্যায়ে নেমে এসেছে। এ কথা আমার অনেকেই বুঝতে পারছিনা অথবা বুঝতে পারলেও নিজেদের সুবিধাবাদী মনোভাব জাগ্রত হওয়ার কারণে, না বুঝার ভান করছি।

স্বাধীনতা অর্জনের পর এই সুবিধাবাদী শ্রেণী নিজেদের পর্দার আড়ালে রেখেছিলো কিন্তু পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর তারা আবার স্বরূপে আবির্ভূত হয়। ধর্ম, জাতীয়তাবাদ নিয়ে তারা আবার মাঠে নামে। শুধু ধর্ম, জাতীয়তাবাদ নয় ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়েও তাদের এজেন্ডাকে আবারো বেগবান করে তোলে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, শাসক শ্রেণীর অভ্যন্তরে থেকে, শাসক দলের সদস্য হয়েও এই শ্রেণীর অনেকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে ক্রমাগত।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। মনে রাখতে হবে মানুষকে বিশ্বাস করে বাংলার স্বাধীনতা পলাশীর আম্রকাননে অস্তমিত হয়েছিলো। সেই স্বাধীনতা আবার ফিরে পেতে আমাদের দুইশ বছরের বেশি সময় লেগেছে। আর এই স্বাধীনতা কিনে নিতে আমাদের যে দাম দিতে হয়েছে তা ছিলো সীমাহীন। আজ যারা ধর্মের নামে, সারা দেশে অরাজকতা চালাচ্ছে তাদের অরাজকতাকে যারা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তাদের মনে রাখতে হবে নগরে আগুন লাগলে দেবালয়কে রক্ষা করা যায় না। সেই আগুন কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। আজ যারা প্রজ্বালিত আগুন থেকে নিরাপদ আছেন তারাও সে আগুনের ধ্বংস যজ্ঞের বাইরে যেতে পারবেন না। তারাও দগ্ধ হবেন। সময় কিন্তু খুব বেশি নেই। জেগে ওঠার সময় হয়েছে। এখন যদি জেগে ওঠা না যায় তাহলে বদ্ধ ঘরের ভেতরে আমাদের অনেকের নিরাপদ ভাবা অবস্থানও আগুনের শিখায় প্রজ্বালিত হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]