শুক্রবার, ২২ জুলাই ২০২২, ০৭ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৩ জিলহজ ১৪৪৩

শিক্ষার উন্নতির স্বরূপ

আলমগীর খান

শিক্ষা নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু কিছু লিখেছেন। এ ক্ষেত্রটি ছিল তার আরেকটি ধ্যানজ্ঞান। শিক্ষার নানাবিধ সমস্যা নিয়ে তিনি বহু আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। তবে তার ‘তোতা-কাহিনী’ গল্প্ েপ্রায় সব কথা সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন। ছোটগল্পটির শেষাংশে রাজার ভাগিনা মহারাজকে বলে, পাখিটার শিক্ষা পুরো হয়েছে। আর রাজা মৃত পাখিটাকে টিপেটুপে দেখলেন তার পেটের মধ্যে পুঁথির কুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করছে।

শিক্ষার অবস্থার এ থেকে সামান্যই উন্নতি হয়েছে, পাখিটার মরার কায়দা খানিকটা আরামদায়ক হয়েছে নিশ্চয়ই। তবে ‘পাখি মরিয়াছে’ বলার মত নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ‘ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই। মেরামত তো লাগিয়াই আছে। তার পর ঝাড়া মোছা পালিশ করার ঘটা দেখিয়া সকলেই’ রেডিও-টিভি-পত্রিকায় রাতদিন বলাবলি করছে ‘উন্নতি হইতেছে’।

অথচ উন্নতিকামী দেশের শিক্ষা নিয়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো ২০১৬ সালে তাদের যৌথভাবে রচিত ‘পুওর ইকোনোমিকস’ বইতে লিখেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থা দুটি মৌলিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়: প্রত্যেকের জন্য ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীর প্রতিভার দিক খুঁজে বের করা।’ তাদের রায় হচ্ছে, এসব দেশে শিক্ষা শিশুদেরকে বঞ্চনা ছাড়া বলতে গেলে কিছুই দেয় না।

ভাবার কারণ নেই যে উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার আকাশচুম্বী উন্নতি হচ্ছে। সেখানেও মেরামত ও ঝাড়া মোছা পালিশ করার ঘটা সারাক্ষণ লেগে আছে। তবে সেখানে কিছু উন্নতিও হচ্ছে সন্দেহ নেই আর ভাগিনাদের খবরদারিরও একটা সীমা আছে। ‘উন্নতি হইতেছে’ চেঁচামেচির পাশাপাশি ‘পাখি মরিয়াছে’ খবরটাও একেবারে ধামাচাপা পড়ছে না।

সব দেশেই শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সাফল্য প্রমাণিত হয় এ কথা বলতে পারায় যে, ‘পাখিটার শিক্ষা পুরো হইয়াছে।’ কিন্তু দুয়েকটা বেয়াড়া পাখির বেলায় কথাটা ঠিকমত খাটে না, ভাগিনাদের তখন মনোকষ্ট বেড়ে যায়। এমন একটি বেয়াড়া পাখির নাম সুইডিশ বালিকা স্কুলছাত্রী গ্রেটা থানবার্গ।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় ব্যবসায়ীদেরকে জীবাশ্ম জালানি থেকে অনতিবিলম্বে সরে আসার আহ্বান জানানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাগিনা ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভেন মানুচিন ১৭ বছর বয়সের থানবার্গকে কড়া উপদেশ ঝাড়েন। তিনি তাকে কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়ালেখা শেষ করার পরই কেবল এসব কথা বলার পরামর্শ দেন। (মারিয়া ক্র্যামার, Treasury Secretary Steven Mnuchin Takes Jab at Greta Thunberg at Davos, নিউইয়র্ক টাইমস, জানুয়ারি ২৩, ২০২০) মানুচিন যে শিক্ষার গৌরবগাথা প্রচার করলেন তা হচ্ছে যথার্থ পুঁজিবাদী শিক্ষা।

এ ব্যাপারে গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস লিখেছিলেন- ‘গ্রেটা যদি মূলধারার অর্থনীতি পড়ে সে কয়েক সেমিস্টার কাটাবে বাজারের মডেল পড়তে পড়তে যেখানে জলবায়ু বিপাকের বালাই নেই ও অর্থনৈতিক সংকট অসম্ভব। অর্থনৈতিক নীতিমালা ও অর্থশাস্ত্র বদলানোর সময় এসেছে। ...থানবার্গকে তখন সেই অর্থশাস্ত্র পড়তে হবে যার শুরু বাজারের মডেল দিয়ে যেখানে গাণিতিকভাবে প্রমাণিত হয় অবাধ ব্যক্তিগত মুনাফা লাভ কীভাবে গণস্বার্র্থের সেবা করে। এসব তত্ত্ব শেখার ও এগুলোর গাণিতিক প্রমাণের জন্য মগজের অনেক কসরতের পরই কেবল সে জানতে পারবে এসবের কিছু ‘ব্যতিক্রম’ আছে- উদাহরণস্বরূপ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান ‘বাহ্যিক প্রভাব’ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা যায়, যে ক্ষতির পুরো মূল্য দূষণকারী বহন করে না। বাজার-ব্যর্থতাকে এভাবে ‘বাহ্যিক প্রভাব’ থেকে উদ্ভূত ‘ব্যতিক্রমের’ কাঠামোভুক্ত করা সম্ভবত এই দুনিয়ার মানুচিনদের বিরাট প্রচার-বিজয়।’ (ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস, Greta Thunberg, Donald Trump and the future of capitalism, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২৯ জানুয়ারি, ২০২০)।

পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো তৈরিই এভাবে। এখানে বাজারের মডেল শেখানো হয় নিখুঁত তত্ত্ব হিসেবে, এর নিয়মিত ব্যর্থতা ও উৎপন্ন দুর্যোগ ‘ব্যতিক্রম’ মাত্র। আর এর খারাপ ফলকে দেখানো হয় তত্ত্ব-বহির্ভূত বিষয় আকারে। অতএব কোনো পুঁজিবাদী উদ্যোগে যদি পরিবেশ দূষণ হয় তা পরিবেশের নিজস্ব সমস্যা, সমাধান হতে পারে পরিবেশটাকেই সংশোধন করে, প্রয়োজনে তার নির্মূলীকরণ দ্বারা! কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগের ফলে যদি কোনো জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দায়দায়িত্ব সেখানকার মানুষজনেরই, তাদের উচ্ছেদ হতে পারে এর একটি যুৎসই ব্যবসায়িক সমাধান!

এরকম শিক্ষা কাঠামো থেকে ব্যাপক হারে স্টিভেন মানুচিন উৎপন্ন হওয়া সম্ভব, গ্রেটা থানবার্গ নয়। গ্রেটা যে এখনও মহৎ আছেন তার কারণ তিনি মনুষ্যত্ব নষ্ট করার উপযোগী ভয়ঙ্কর শিক্ষাযন্ত্রের ওই চোঙের মধ্যে এখনও ঢোকেননি। উন্নত দেশের উন্নত শিক্ষার হালই যদি এ-ই হয়, আমাদের কথা আর বলার দরকার কী?

ছোটবেলা থেকেই এদেশে শিশুরা শোনে-লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। এরচেয়ে জ্ঞানবিদ্বেষী দর্শন আর কোথাও আছে কি? আমাদের ছেলেমেয়েকে যদি জীবনের প্রভাত বেলায়ই লেখাপড়ার উদ্দেশ্য গাড়িঘোড়ায় চড়া শেখানো হয়, তবে বড় হয়ে তারা যে গাড়িঘোড়ায় চড়ার জন্য লেখাপড়ার চেয়ে আরও মোক্ষম উপায় আবিষ্কার করে ফেলবে সেটাই স্বাভাবিক।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাঝে একটা জাদুর বড়ি আছে যা পশ্চাৎপদ পরিবারের শিশুদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্যে অব্যর্থ। বাংলাভাষার শব্দভান্ডারও হয়ত সহায়ক এই বড়ি তৈরিতে- যেমন (তোর) মাথায় গোবর আছে! পেটে খাবার ও দেহে পুষ্টি নেই- প্রতিদিন স্কুলে, পরিবারে ও সমাজে এই সত্যকে ঢেকে দেয়া হয় মাথায় গোবর আবিষ্কার করে!

মিথ্যা কথা বলা শেখানো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটা অন্যতম অবদান। শিশুকাল থেকেই শিশুকে শেখানো হয় তার বন্ধুকে ঠকাতে। যে বড়লোক ছেলে বা মেয়ের গৃহশিক্ষক তাকে চমৎকার নোট লিখে দেন, তিনি তার সন্তানকে শিখিয়ে দেন, কোনো বন্ধুর কাছে তা ডাহা অস্বীকার করতে, বরং তার কোনো নোট নেই বলে অপরেরটা হাতিয়ে নিতে। শিক্ষক শিখিয়ে দেন পরীক্ষার হলে কাউকে কোনো উত্তর না বলতে, নেহাত বলতে হলে মিথ্যা উত্তর যেন বলে দেয়া হয়। যে পরীক্ষা জ্ঞানচর্চার বেলায়ও এই মিথ্যাচার শেখায় তা আমূল পরিবর্তন করা, সম্ভব না হলে উঠিয়ে দেয়াই মঙ্গল নয় কি?

শহরে অনেক বাবা-মা দশ হাত দূরের বাসা থেকেও ছেলেমেয়েকে গাড়িতে চড়িয়ে স্কুলে নিয়ে আসেন। কী উদ্দেশ্যে? সন্তানের কষ্ট লাঘবের জন্য না সতীর্থ শিক্ষার্থীদের সামনে অহংকার প্রকাশের জন্য। অথচ জাপানে কোনো শিশু গাড়িতে স্কুলে আসে না, আসে হেঁটে- এটাই সেখানকার রেওয়াজ। (ড. মঞ্জুরে খোদা, জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা, দ্যু প্রকাশন, ২০২০)। কারণ প্রত্যেক শিশুর গাড়ি না থাকতে পারে, অতএব যাতে কারো অহমবোধ তৈরি না হয় এবং যাদের গাড়ি নেই তাদের যাতে হীনমন্যতা তৈরি না হয়। এই হলো প্রকৃত শিক্ষা।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্তিক মুরলিধরন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার দুটি মূল ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন- প্রথমত জ্ঞান, দক্ষতা, আত্মপরিচয়, নাগরিকত্ববোধ ইত্যাদি প্রসারের মাধ্যমে মানবোন্নয়ন। দ্বিতীয়ত- শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ও অর্জন মূল্যায়ন ও পরিমাপ করে তাকে শিক্ষার পরবর্তী ধাপে ওঠার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদানের জন্য বাছাই করা। কিন্তু বাস্তবে মানবোন্নয়নের চেয়ে এই বাছাই-ই হয়ে উঠেছে শিক্ষার মূল দিক। আর তাই ভারতের এই পুরো ব্যবস্থাটিকে তিনি ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ না বলে ‘ছাঁকনিব্যবস্থা’ বলাই সমীচীন মনে করেন। (Karthik Muralidharan, Reforming the Indian School Education System, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা গোপীনাথ, রঘুরাম রাজন ও মিহির এস. শর্মা সম্পাদিত What the Economy Needs Now, Juggernaut Books, 2019, India)

বর্তমানে দাতাগোষ্ঠীর বদান্যতায় ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বা ‘ইনক্লুসিভ’ ইত্যাদি শব্দের বহুল ব্যবহার চালু হয়েছে। অথচ শিক্ষাব্যবস্থা নামের এই ছাঁকনি ব্যবস্থাটি ব্যাপক ছেলেমেয়েকে বাদ দেয়াতেই বেশি করিৎকর্মা। ছাঁকনি ব্যবস্থায় পেছনে ফেলে দেয়া ও বাদ দেয়ার মূল শিক্ষাকাঠামোটি অক্ষতœ রেখে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বা ‘ইনক্লুসিভ’ জাতীয় শব্দগুলোকে যতটা বাহারি শোনায়, এগুলো ততটা কার্যকর নয়।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো মনে করেন উন্নয়শীল দেশের কারিকুলাম, শিখনপ্রক্রিয়া ও পরীক্ষা ব্যবস্থা সাজানো হয় সচ্ছল পরিবার থেকে আগত মেধাদক্ষতা প্রমাণকারী শিশুদের উপযোগী করে। বাকিদের ছুড়ে ফেলা হয় ভালো রেজাল্টসহ নানা কিসিমের অজুহাতে। তারা মনে করেন যে, এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার দৌড়ে বহু শিশুর পেছনে পড়ে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক হলেও অপরিহার্য। (Poor Economics: A Radical Rethinking of the Way to Fight Global Poverty, PublicAffairs, wbDBqK©, BDGmG, 2011)।

ছাঁকনি-ব্যবস্থারূপী এ শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে ঘুরিয়ে পায়ের ওপর দাঁড় করানোর জন্য অনেকগুলো মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিরাট রাজনৈতিক সাহস, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, প্রকৃত দেশপ্রেম ও ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষের প্রতি পূর্ণ দায়বদ্ধতা ছাড়া যা সম্ভব নয়।

[লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]

শুক্রবার, ২২ জুলাই ২০২২ , ০৭ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৩ জিলহজ ১৪৪৩

শিক্ষার উন্নতির স্বরূপ

আলমগীর খান

শিক্ষা নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু কিছু লিখেছেন। এ ক্ষেত্রটি ছিল তার আরেকটি ধ্যানজ্ঞান। শিক্ষার নানাবিধ সমস্যা নিয়ে তিনি বহু আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। তবে তার ‘তোতা-কাহিনী’ গল্প্ েপ্রায় সব কথা সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন। ছোটগল্পটির শেষাংশে রাজার ভাগিনা মহারাজকে বলে, পাখিটার শিক্ষা পুরো হয়েছে। আর রাজা মৃত পাখিটাকে টিপেটুপে দেখলেন তার পেটের মধ্যে পুঁথির কুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করছে।

শিক্ষার অবস্থার এ থেকে সামান্যই উন্নতি হয়েছে, পাখিটার মরার কায়দা খানিকটা আরামদায়ক হয়েছে নিশ্চয়ই। তবে ‘পাখি মরিয়াছে’ বলার মত নিন্দুক লক্ষ্মীছাড়ার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ‘ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই। মেরামত তো লাগিয়াই আছে। তার পর ঝাড়া মোছা পালিশ করার ঘটা দেখিয়া সকলেই’ রেডিও-টিভি-পত্রিকায় রাতদিন বলাবলি করছে ‘উন্নতি হইতেছে’।

অথচ উন্নতিকামী দেশের শিক্ষা নিয়ে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো ২০১৬ সালে তাদের যৌথভাবে রচিত ‘পুওর ইকোনোমিকস’ বইতে লিখেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থা দুটি মৌলিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়: প্রত্যেকের জন্য ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীর প্রতিভার দিক খুঁজে বের করা।’ তাদের রায় হচ্ছে, এসব দেশে শিক্ষা শিশুদেরকে বঞ্চনা ছাড়া বলতে গেলে কিছুই দেয় না।

ভাবার কারণ নেই যে উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষার আকাশচুম্বী উন্নতি হচ্ছে। সেখানেও মেরামত ও ঝাড়া মোছা পালিশ করার ঘটা সারাক্ষণ লেগে আছে। তবে সেখানে কিছু উন্নতিও হচ্ছে সন্দেহ নেই আর ভাগিনাদের খবরদারিরও একটা সীমা আছে। ‘উন্নতি হইতেছে’ চেঁচামেচির পাশাপাশি ‘পাখি মরিয়াছে’ খবরটাও একেবারে ধামাচাপা পড়ছে না।

সব দেশেই শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সাফল্য প্রমাণিত হয় এ কথা বলতে পারায় যে, ‘পাখিটার শিক্ষা পুরো হইয়াছে।’ কিন্তু দুয়েকটা বেয়াড়া পাখির বেলায় কথাটা ঠিকমত খাটে না, ভাগিনাদের তখন মনোকষ্ট বেড়ে যায়। এমন একটি বেয়াড়া পাখির নাম সুইডিশ বালিকা স্কুলছাত্রী গ্রেটা থানবার্গ।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় ব্যবসায়ীদেরকে জীবাশ্ম জালানি থেকে অনতিবিলম্বে সরে আসার আহ্বান জানানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাগিনা ট্রেজারি সেক্রেটারি স্টিভেন মানুচিন ১৭ বছর বয়সের থানবার্গকে কড়া উপদেশ ঝাড়েন। তিনি তাকে কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়ালেখা শেষ করার পরই কেবল এসব কথা বলার পরামর্শ দেন। (মারিয়া ক্র্যামার, Treasury Secretary Steven Mnuchin Takes Jab at Greta Thunberg at Davos, নিউইয়র্ক টাইমস, জানুয়ারি ২৩, ২০২০) মানুচিন যে শিক্ষার গৌরবগাথা প্রচার করলেন তা হচ্ছে যথার্থ পুঁজিবাদী শিক্ষা।

এ ব্যাপারে গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস লিখেছিলেন- ‘গ্রেটা যদি মূলধারার অর্থনীতি পড়ে সে কয়েক সেমিস্টার কাটাবে বাজারের মডেল পড়তে পড়তে যেখানে জলবায়ু বিপাকের বালাই নেই ও অর্থনৈতিক সংকট অসম্ভব। অর্থনৈতিক নীতিমালা ও অর্থশাস্ত্র বদলানোর সময় এসেছে। ...থানবার্গকে তখন সেই অর্থশাস্ত্র পড়তে হবে যার শুরু বাজারের মডেল দিয়ে যেখানে গাণিতিকভাবে প্রমাণিত হয় অবাধ ব্যক্তিগত মুনাফা লাভ কীভাবে গণস্বার্র্থের সেবা করে। এসব তত্ত্ব শেখার ও এগুলোর গাণিতিক প্রমাণের জন্য মগজের অনেক কসরতের পরই কেবল সে জানতে পারবে এসবের কিছু ‘ব্যতিক্রম’ আছে- উদাহরণস্বরূপ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান ‘বাহ্যিক প্রভাব’ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা যায়, যে ক্ষতির পুরো মূল্য দূষণকারী বহন করে না। বাজার-ব্যর্থতাকে এভাবে ‘বাহ্যিক প্রভাব’ থেকে উদ্ভূত ‘ব্যতিক্রমের’ কাঠামোভুক্ত করা সম্ভবত এই দুনিয়ার মানুচিনদের বিরাট প্রচার-বিজয়।’ (ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস, Greta Thunberg, Donald Trump and the future of capitalism, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২৯ জানুয়ারি, ২০২০)।

পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো তৈরিই এভাবে। এখানে বাজারের মডেল শেখানো হয় নিখুঁত তত্ত্ব হিসেবে, এর নিয়মিত ব্যর্থতা ও উৎপন্ন দুর্যোগ ‘ব্যতিক্রম’ মাত্র। আর এর খারাপ ফলকে দেখানো হয় তত্ত্ব-বহির্ভূত বিষয় আকারে। অতএব কোনো পুঁজিবাদী উদ্যোগে যদি পরিবেশ দূষণ হয় তা পরিবেশের নিজস্ব সমস্যা, সমাধান হতে পারে পরিবেশটাকেই সংশোধন করে, প্রয়োজনে তার নির্মূলীকরণ দ্বারা! কোনো ব্যবসায়িক উদ্যোগের ফলে যদি কোনো জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার দায়দায়িত্ব সেখানকার মানুষজনেরই, তাদের উচ্ছেদ হতে পারে এর একটি যুৎসই ব্যবসায়িক সমাধান!

এরকম শিক্ষা কাঠামো থেকে ব্যাপক হারে স্টিভেন মানুচিন উৎপন্ন হওয়া সম্ভব, গ্রেটা থানবার্গ নয়। গ্রেটা যে এখনও মহৎ আছেন তার কারণ তিনি মনুষ্যত্ব নষ্ট করার উপযোগী ভয়ঙ্কর শিক্ষাযন্ত্রের ওই চোঙের মধ্যে এখনও ঢোকেননি। উন্নত দেশের উন্নত শিক্ষার হালই যদি এ-ই হয়, আমাদের কথা আর বলার দরকার কী?

ছোটবেলা থেকেই এদেশে শিশুরা শোনে-লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে। এরচেয়ে জ্ঞানবিদ্বেষী দর্শন আর কোথাও আছে কি? আমাদের ছেলেমেয়েকে যদি জীবনের প্রভাত বেলায়ই লেখাপড়ার উদ্দেশ্য গাড়িঘোড়ায় চড়া শেখানো হয়, তবে বড় হয়ে তারা যে গাড়িঘোড়ায় চড়ার জন্য লেখাপড়ার চেয়ে আরও মোক্ষম উপায় আবিষ্কার করে ফেলবে সেটাই স্বাভাবিক।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাঝে একটা জাদুর বড়ি আছে যা পশ্চাৎপদ পরিবারের শিশুদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্যে অব্যর্থ। বাংলাভাষার শব্দভান্ডারও হয়ত সহায়ক এই বড়ি তৈরিতে- যেমন (তোর) মাথায় গোবর আছে! পেটে খাবার ও দেহে পুষ্টি নেই- প্রতিদিন স্কুলে, পরিবারে ও সমাজে এই সত্যকে ঢেকে দেয়া হয় মাথায় গোবর আবিষ্কার করে!

মিথ্যা কথা বলা শেখানো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটা অন্যতম অবদান। শিশুকাল থেকেই শিশুকে শেখানো হয় তার বন্ধুকে ঠকাতে। যে বড়লোক ছেলে বা মেয়ের গৃহশিক্ষক তাকে চমৎকার নোট লিখে দেন, তিনি তার সন্তানকে শিখিয়ে দেন, কোনো বন্ধুর কাছে তা ডাহা অস্বীকার করতে, বরং তার কোনো নোট নেই বলে অপরেরটা হাতিয়ে নিতে। শিক্ষক শিখিয়ে দেন পরীক্ষার হলে কাউকে কোনো উত্তর না বলতে, নেহাত বলতে হলে মিথ্যা উত্তর যেন বলে দেয়া হয়। যে পরীক্ষা জ্ঞানচর্চার বেলায়ও এই মিথ্যাচার শেখায় তা আমূল পরিবর্তন করা, সম্ভব না হলে উঠিয়ে দেয়াই মঙ্গল নয় কি?

শহরে অনেক বাবা-মা দশ হাত দূরের বাসা থেকেও ছেলেমেয়েকে গাড়িতে চড়িয়ে স্কুলে নিয়ে আসেন। কী উদ্দেশ্যে? সন্তানের কষ্ট লাঘবের জন্য না সতীর্থ শিক্ষার্থীদের সামনে অহংকার প্রকাশের জন্য। অথচ জাপানে কোনো শিশু গাড়িতে স্কুলে আসে না, আসে হেঁটে- এটাই সেখানকার রেওয়াজ। (ড. মঞ্জুরে খোদা, জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা, দ্যু প্রকাশন, ২০২০)। কারণ প্রত্যেক শিশুর গাড়ি না থাকতে পারে, অতএব যাতে কারো অহমবোধ তৈরি না হয় এবং যাদের গাড়ি নেই তাদের যাতে হীনমন্যতা তৈরি না হয়। এই হলো প্রকৃত শিক্ষা।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কার্তিক মুরলিধরন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার দুটি মূল ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন- প্রথমত জ্ঞান, দক্ষতা, আত্মপরিচয়, নাগরিকত্ববোধ ইত্যাদি প্রসারের মাধ্যমে মানবোন্নয়ন। দ্বিতীয়ত- শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ও অর্জন মূল্যায়ন ও পরিমাপ করে তাকে শিক্ষার পরবর্তী ধাপে ওঠার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদানের জন্য বাছাই করা। কিন্তু বাস্তবে মানবোন্নয়নের চেয়ে এই বাছাই-ই হয়ে উঠেছে শিক্ষার মূল দিক। আর তাই ভারতের এই পুরো ব্যবস্থাটিকে তিনি ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ না বলে ‘ছাঁকনিব্যবস্থা’ বলাই সমীচীন মনে করেন। (Karthik Muralidharan, Reforming the Indian School Education System, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, গীতা গোপীনাথ, রঘুরাম রাজন ও মিহির এস. শর্মা সম্পাদিত What the Economy Needs Now, Juggernaut Books, 2019, India)

বর্তমানে দাতাগোষ্ঠীর বদান্যতায় ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বা ‘ইনক্লুসিভ’ ইত্যাদি শব্দের বহুল ব্যবহার চালু হয়েছে। অথচ শিক্ষাব্যবস্থা নামের এই ছাঁকনি ব্যবস্থাটি ব্যাপক ছেলেমেয়েকে বাদ দেয়াতেই বেশি করিৎকর্মা। ছাঁকনি ব্যবস্থায় পেছনে ফেলে দেয়া ও বাদ দেয়ার মূল শিক্ষাকাঠামোটি অক্ষতœ রেখে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বা ‘ইনক্লুসিভ’ জাতীয় শব্দগুলোকে যতটা বাহারি শোনায়, এগুলো ততটা কার্যকর নয়।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো মনে করেন উন্নয়শীল দেশের কারিকুলাম, শিখনপ্রক্রিয়া ও পরীক্ষা ব্যবস্থা সাজানো হয় সচ্ছল পরিবার থেকে আগত মেধাদক্ষতা প্রমাণকারী শিশুদের উপযোগী করে। বাকিদের ছুড়ে ফেলা হয় ভালো রেজাল্টসহ নানা কিসিমের অজুহাতে। তারা মনে করেন যে, এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার দৌড়ে বহু শিশুর পেছনে পড়ে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক হলেও অপরিহার্য। (Poor Economics: A Radical Rethinking of the Way to Fight Global Poverty, PublicAffairs, wbDBqK©, BDGmG, 2011)।

ছাঁকনি-ব্যবস্থারূপী এ শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে ঘুরিয়ে পায়ের ওপর দাঁড় করানোর জন্য অনেকগুলো মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিরাট রাজনৈতিক সাহস, দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা, প্রকৃত দেশপ্রেম ও ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষের প্রতি পূর্ণ দায়বদ্ধতা ছাড়া যা সম্ভব নয়।

[লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি]