নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়

দেবাহুতি চক্রবর্তী

না, আজ আমি বাংলাদেশের অতিক্রান্ত ৫০ বছরের ধর্মীয়, নৃত্তাত্বিক, ভাষাগত বা চেতনাগত প্রগতিশীল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের খতিয়ান মেলে ধরতে বসিনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম যন্ত্রণার সিংহভাগই বহন করেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষত হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়। কোন সরকারের আমলেই সেই পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করার কোন উদ্যোগ উল্লেখযোগ্যভাবে গ্রহণ করা হয়নি। ১৬ ডিসেম্বরের পরে শরণার্থী হিন্দুর এক বড় অংশ সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরে আসেনি।

সর্বস্ব খোয়ানো দেশে ফিরে আসা হিন্দুর সংখ্যা তাইবলে নেহাৎ কম নয়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাস, উচ্ছ্বাস আর আস্থা নিয়েই তাদের ফিরে আসা। অথচ সেই বাংলাদেশ ছাড়তে অব্যাহতভাবে বাধ্য হয়েছে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ শত হিন্দু। নিছক শখের বশবর্তী হয়ে দেশছাড়া হিন্দুর সংখ্যা হাতে গোণা। চাপা সন্ত্রাসের মুখে নীরবে দেশছাড়া মানুষগুলোর ভারতে আশ্রয় নেয়ার ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। একাত্তরে ভারত রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ সব ধর্ম বর্ণের মানুষকে আন্তরিকতার সঙ্গে আশ্রয় দিয়েছে এটা সত্য। পরবর্তী সময়ে যারা গেছে, তারা কিন্তু হিন্দু হলেও সাদরে গৃহীত হয়নি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি আর সামাজিক কাঠামো কোনোটাই দীর্ঘদিন যাবৎ আশ্রয় প্রার্থী হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুকূল নয়। যারা যেতে বাধ্য হচ্ছে, তারা প্রতিনিয়ত সেই দেশের রাষ্ট্রীয় নানা আইনের গ্যাঁড়াকলে নিষ্পেষিত হয়েছে, হচ্ছে। সামাজিকভাবেও তারা নানা নির্যাতন ও বৈষম্যর শিকার। অথচ, অনেক উচ্চশিক্ষিত-পরিচিত বন্ধুজনরাও নানাভাবে হিন্দুদের শোনায়, ভারত তো তোদের দেশ। মানে স্বদেশেই হিন্দুরা আশ্রিত। মুসলিম জনগোষ্ঠীর দয়ায় টিকে থাকা। এসব শোনা মানে মানসিক ভাবে প্রতিনিয়ত নিপীড়িত ও কুণ্ঠিত হওয়া। অথচ পরিসংখ্যান বলে, বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন কারণে ভারতে মুসলিমদেরই আসা-যাওয়া বেশি। কারণ যাই হোক, সেসব দোষের নয়। দোষ হিন্দুদের আসা-যাওয়াতেই। স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে এখনো কিছু হিন্দু আছে, যাদের ওপারে সহায়-সম্পদ আছে। কিন্তু, সেই সংখ্যা খুব বেশি আর নেই। বরং এখনকার সংগতিপূর্ণ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা অনেক বেশি লক্ষণীয়।

এই দেশের অধিকাংশ হিন্দুর এখন বোঝার সময় এসেছে, মার খেয়ে, মার হজম করে দেশ ছাড়ার পথ তাদের সংকুচিত হয়ে এসেছে। ভারতে চরম হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থান যতই বৃদ্ধি পাক, বাঙালি হিন্দুর ভারতে সহজেই আশ্রয় নেয়ার পথ নানাভাবে অবরুদ্ধ করতে তারা সচেষ্ট রয়েছে। বাংলা ও বাঙালির প্রতি বিদ্বেষ ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির বহুদিনের বৈশিষ্ট্য। আসামে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি হিন্দু বন্দি জীবন যাপন করছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষত হিন্দুদের তাহলে পথ কী? মাটি কামড়ে এই দেশেই পড়ে থাকতে হবে। আর থাকতেই যখন হবে তখন বুক-পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকাও অভ্যাস করতে হবে।

এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ধর্মভীরু। কিন্তু সবাই ধর্মান্ধ নয়। অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। আজও হিন্দুরা এ দেশে যে যেভাবে বসবাস করছে, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা অনস্বীকার্য। কিন্তু, এদেশে তারাও ক্রমশই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। তারাও নানাভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অনেকেই আজকাল কথায় কথায় বলে, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু শব্দ দুটো ব্যবহার ঠিক নয়। শব্দ দুটির এভাবে প্রচলনের কথা ছিল না, এটা যেমন সত্য। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দুঃখজনক হলেও এই শব্দগুলো আপাত এড়িয়ে যাওয়ার পথ নেই।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েও ক্রমবর্ধমান মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ বলা অসমীচীন নয়। সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছত্রছায়ায় মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শব্দগুলো রীতিমতো বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের ভেতর করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকার প্রবণতা ক্রমেই পোক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের ১৭/১৮ কোটি মানুষের মধ্যে দেড়-দুই কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ এখনো রয়েছে। যাদের অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এদের না আছে একতা, না আছে দৃঢ়তা। হিন্দু সংসদ সদস্য, প্রতিমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সরকার দলীয় রাজনীতিতে নবীন-প্রবীণ প্রভাবশালী সদস্য যারাই আছে, তারা এই অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলে না। একইভাবে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী হিন্দুদের অধিকাংশই সরকারের বিরাগভাজন হতে রাজি নয়। বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির কমিটি, নানা পুজো কমিটি, সংখ্যালঘুদের নামে বিভিন্ন কমিটির সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক খুব সুখকর নয়। নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে এই বিচ্ছিন্নতা, এই নীরবতা আর যাই হোক, মঙ্গলজনক নয়।

দুই-আড়াই মাস পর আবার বিভিন্ন পুজোর মওসুম আসছে। কোথাও না কোথাও ধর্মানুভূতি আহত হবে। হিংসাত্মক আচরণ কম-বেশি ছড়িয়ে পড়বে। সরকার সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণে সেখানে কতটা সচেষ্ট হবে বা সফল হবে, তা সরকারই জানে। লোহাগড়ার ঘটনার পরেও বিচ্ছিন্নভাবে হিন্দুদের মন্দিরে আক্রমণের ঘটনা অব্যাহত আছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এসব চক্রান্ত.... এই কথাগুলোও শোনা যায়। চক্রান্তের হাত থেকে একটা জনগোষ্ঠীকে রক্ষার দায়িত্ব কার?

যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকারের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছা এখন প্রশ্নাতীত নয়, সে ক্ষেত্রে শুধু গণিমতের মাল হয়ে খয়রাতি দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকার অভ্যাসটা থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিজেদেরই মুক্ত হতে হবে। ইউ টিউবে শুনলাম, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ঢাকার এক সমাবেশে নড়াইলের এক তরুণ (হ্যামলেট সাহা) লোহাগড়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে যেয়ে সম্প্রদায়ের স্বার্থে সত্য উচ্চারণের জন্য জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি মেনে নেওয়ার কথা বলেছে। হিন্দুদের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এখন এই রকম ঝুঁকি মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। একা নয়। সমবেতভাবে। হিংসা বা প্রতিহিংসা দিয়ে নয়। সাহস ও সত্য উচ্চারণ দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতায় আনতে হবে। শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপের মাঝ দিয়েই প্রতিবাদী হতে হবে। অনুকূল পরিস্থিতি, আস্থা, বিশ্বাস সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরে মন্দিরে দুর্গাপূজার ও অন্যান্য পুজোর আড়ম্বর বর্জন করতে হবে। ইতিপূর্বে ও ঘট পুজোর মাধ্যমে ধর্মীয় আচরণ পালন হয়েছে। এখন বাহ্যিকভাবে দেখানো উৎসব বর্জনে একতাবদ্ধ হওয়া আবশ্যকীয়।

সাম্প্রদায়িক বীভৎসতার ঘটনাগুলোর অন্তরালের কারণগুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদী হতে হবে। ‘যে কারণগুলো সংখ্যালঘুদের মৌলিক নাগরিক অধিকার হরণ করে আছে, যে কারণগুলোর জন্য নিয়ত ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সেসব চিহ্নিত করে শান্তিপূর্ণভাবে দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। সংখ্যালঘু ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায় ঘুরে দাঁড়ালে সংখ্যা কম বা বেশি কোনো বড়ো বিষয় নয়। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন অনেক বেশি মুসলিম তখন অধিকতর পাশে দাঁড়াবে। এই সম্মিলিত শক্তির কাছে ধর্মান্ধ অপশক্তির পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠবে।

দেশ আমার, মাটি আমার, এই মাটিতে আমার সমান অধিকার... একসঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এই উচ্চারণের শক্তিতে সুসংহত না হলে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করতে না পারলে সামনে আরও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে... দুই-ই অপরাধ। বাংলাদেশে ব্যক্তি সুবিধাভোগী, দালাল, স্তাবক হিন্দুদের উপলব্ধি করাতে হবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দাবানল যে কাউকেই স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল, ভীরু, অশিক্ষিত দরিদ্র সংখ্যালঘুদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। ঐক্যবদ্ধ মানসিক শক্তি নিয়ে স্বল্পসংখ্যক মানুষও বৃহৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।... সরকার না চাইলে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত ভাবে ঘটে না। এই কথাগুলোর মর্ম সরকারকে উপলব্ধি করতে বাধ্য করানোর সময় এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন অবধি মৌলবাদ বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সযতেœ লালিত-পালিত হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কতক গৎ বাঁধা বক্তব্য আর পদক্ষেপ যথেষ্ট ভাবার অবকাশ নেই। সরকারের ফরমায়েস মতো বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উৎসব আতিশয্য বর্জন করা উচিত। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রতীক সেজে মিডিয়ায় প্রচারের সুযোগ করে দেয়া পণ্য বিপণির মতোই। এভাবে কিছু সময় কিছু মানুষ আনন্দে মেতে উঠতে পারে। কিন্তু সম্প্রদায়ের মৌলিক নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার হতে পারে না। অন্যায় নির্বিবাদে সহ্য করার অপরিসীম শক্তি আর যাই হোক অন্যায়কে প্রতিহত করতে পারে না।

[লেখক : সম্পাদক, আন্তর্জাতিক উপপরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]

শনিবার, ২৩ জুলাই ২০২২ , ০৮ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৪ জিলহজ ১৪৪৩

নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়

দেবাহুতি চক্রবর্তী

না, আজ আমি বাংলাদেশের অতিক্রান্ত ৫০ বছরের ধর্মীয়, নৃত্তাত্বিক, ভাষাগত বা চেতনাগত প্রগতিশীল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের খতিয়ান মেলে ধরতে বসিনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম যন্ত্রণার সিংহভাগই বহন করেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষত হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়। কোন সরকারের আমলেই সেই পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করার কোন উদ্যোগ উল্লেখযোগ্যভাবে গ্রহণ করা হয়নি। ১৬ ডিসেম্বরের পরে শরণার্থী হিন্দুর এক বড় অংশ সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরে আসেনি।

সর্বস্ব খোয়ানো দেশে ফিরে আসা হিন্দুর সংখ্যা তাইবলে নেহাৎ কম নয়। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাস, উচ্ছ্বাস আর আস্থা নিয়েই তাদের ফিরে আসা। অথচ সেই বাংলাদেশ ছাড়তে অব্যাহতভাবে বাধ্য হয়েছে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ শত হিন্দু। নিছক শখের বশবর্তী হয়ে দেশছাড়া হিন্দুর সংখ্যা হাতে গোণা। চাপা সন্ত্রাসের মুখে নীরবে দেশছাড়া মানুষগুলোর ভারতে আশ্রয় নেয়ার ইতিহাস মোটেই সুখকর নয়। একাত্তরে ভারত রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ সব ধর্ম বর্ণের মানুষকে আন্তরিকতার সঙ্গে আশ্রয় দিয়েছে এটা সত্য। পরবর্তী সময়ে যারা গেছে, তারা কিন্তু হিন্দু হলেও সাদরে গৃহীত হয়নি। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি আর সামাজিক কাঠামো কোনোটাই দীর্ঘদিন যাবৎ আশ্রয় প্রার্থী হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুকূল নয়। যারা যেতে বাধ্য হচ্ছে, তারা প্রতিনিয়ত সেই দেশের রাষ্ট্রীয় নানা আইনের গ্যাঁড়াকলে নিষ্পেষিত হয়েছে, হচ্ছে। সামাজিকভাবেও তারা নানা নির্যাতন ও বৈষম্যর শিকার। অথচ, অনেক উচ্চশিক্ষিত-পরিচিত বন্ধুজনরাও নানাভাবে হিন্দুদের শোনায়, ভারত তো তোদের দেশ। মানে স্বদেশেই হিন্দুরা আশ্রিত। মুসলিম জনগোষ্ঠীর দয়ায় টিকে থাকা। এসব শোনা মানে মানসিক ভাবে প্রতিনিয়ত নিপীড়িত ও কুণ্ঠিত হওয়া। অথচ পরিসংখ্যান বলে, বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন কারণে ভারতে মুসলিমদেরই আসা-যাওয়া বেশি। কারণ যাই হোক, সেসব দোষের নয়। দোষ হিন্দুদের আসা-যাওয়াতেই। স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে এখনো কিছু হিন্দু আছে, যাদের ওপারে সহায়-সম্পদ আছে। কিন্তু, সেই সংখ্যা খুব বেশি আর নেই। বরং এখনকার সংগতিপূর্ণ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা অনেক বেশি লক্ষণীয়।

এই দেশের অধিকাংশ হিন্দুর এখন বোঝার সময় এসেছে, মার খেয়ে, মার হজম করে দেশ ছাড়ার পথ তাদের সংকুচিত হয়ে এসেছে। ভারতে চরম হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থান যতই বৃদ্ধি পাক, বাঙালি হিন্দুর ভারতে সহজেই আশ্রয় নেয়ার পথ নানাভাবে অবরুদ্ধ করতে তারা সচেষ্ট রয়েছে। বাংলা ও বাঙালির প্রতি বিদ্বেষ ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির বহুদিনের বৈশিষ্ট্য। আসামে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি হিন্দু বন্দি জীবন যাপন করছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষত হিন্দুদের তাহলে পথ কী? মাটি কামড়ে এই দেশেই পড়ে থাকতে হবে। আর থাকতেই যখন হবে তখন বুক-পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকাও অভ্যাস করতে হবে।

এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ধর্মভীরু। কিন্তু সবাই ধর্মান্ধ নয়। অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। আজও হিন্দুরা এ দেশে যে যেভাবে বসবাস করছে, সে ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা অনস্বীকার্য। কিন্তু, এদেশে তারাও ক্রমশই সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। তারাও নানাভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অনেকেই আজকাল কথায় কথায় বলে, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু শব্দ দুটো ব্যবহার ঠিক নয়। শব্দ দুটির এভাবে প্রচলনের কথা ছিল না, এটা যেমন সত্য। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দুঃখজনক হলেও এই শব্দগুলো আপাত এড়িয়ে যাওয়ার পথ নেই।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েও ক্রমবর্ধমান মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ বলা অসমীচীন নয়। সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছত্রছায়ায় মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শব্দগুলো রীতিমতো বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের ভেতর করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকার প্রবণতা ক্রমেই পোক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের ১৭/১৮ কোটি মানুষের মধ্যে দেড়-দুই কোটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ এখনো রয়েছে। যাদের অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এদের না আছে একতা, না আছে দৃঢ়তা। হিন্দু সংসদ সদস্য, প্রতিমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সরকার দলীয় রাজনীতিতে নবীন-প্রবীণ প্রভাবশালী সদস্য যারাই আছে, তারা এই অব্যাহত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে কথা বলে না। একইভাবে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী হিন্দুদের অধিকাংশই সরকারের বিরাগভাজন হতে রাজি নয়। বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির কমিটি, নানা পুজো কমিটি, সংখ্যালঘুদের নামে বিভিন্ন কমিটির সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক খুব সুখকর নয়। নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে এই বিচ্ছিন্নতা, এই নীরবতা আর যাই হোক, মঙ্গলজনক নয়।

দুই-আড়াই মাস পর আবার বিভিন্ন পুজোর মওসুম আসছে। কোথাও না কোথাও ধর্মানুভূতি আহত হবে। হিংসাত্মক আচরণ কম-বেশি ছড়িয়ে পড়বে। সরকার সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণে সেখানে কতটা সচেষ্ট হবে বা সফল হবে, তা সরকারই জানে। লোহাগড়ার ঘটনার পরেও বিচ্ছিন্নভাবে হিন্দুদের মন্দিরে আক্রমণের ঘটনা অব্যাহত আছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এসব চক্রান্ত.... এই কথাগুলোও শোনা যায়। চক্রান্তের হাত থেকে একটা জনগোষ্ঠীকে রক্ষার দায়িত্ব কার?

যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকারের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ন্ত্রণের সদিচ্ছা এখন প্রশ্নাতীত নয়, সে ক্ষেত্রে শুধু গণিমতের মাল হয়ে খয়রাতি দাক্ষিণ্যে বেঁচে থাকার অভ্যাসটা থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিজেদেরই মুক্ত হতে হবে। ইউ টিউবে শুনলাম, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ঢাকার এক সমাবেশে নড়াইলের এক তরুণ (হ্যামলেট সাহা) লোহাগড়ার ঘটনার বর্ণনা দিতে যেয়ে সম্প্রদায়ের স্বার্থে সত্য উচ্চারণের জন্য জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি মেনে নেওয়ার কথা বলেছে। হিন্দুদের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এখন এই রকম ঝুঁকি মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। একা নয়। সমবেতভাবে। হিংসা বা প্রতিহিংসা দিয়ে নয়। সাহস ও সত্য উচ্চারণ দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতায় আনতে হবে। শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপের মাঝ দিয়েই প্রতিবাদী হতে হবে। অনুকূল পরিস্থিতি, আস্থা, বিশ্বাস সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরে মন্দিরে দুর্গাপূজার ও অন্যান্য পুজোর আড়ম্বর বর্জন করতে হবে। ইতিপূর্বে ও ঘট পুজোর মাধ্যমে ধর্মীয় আচরণ পালন হয়েছে। এখন বাহ্যিকভাবে দেখানো উৎসব বর্জনে একতাবদ্ধ হওয়া আবশ্যকীয়।

সাম্প্রদায়িক বীভৎসতার ঘটনাগুলোর অন্তরালের কারণগুলোর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদী হতে হবে। ‘যে কারণগুলো সংখ্যালঘুদের মৌলিক নাগরিক অধিকার হরণ করে আছে, যে কারণগুলোর জন্য নিয়ত ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সেসব চিহ্নিত করে শান্তিপূর্ণভাবে দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। সংখ্যালঘু ধর্মীয় বা নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায় ঘুরে দাঁড়ালে সংখ্যা কম বা বেশি কোনো বড়ো বিষয় নয়। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন অনেক বেশি মুসলিম তখন অধিকতর পাশে দাঁড়াবে। এই সম্মিলিত শক্তির কাছে ধর্মান্ধ অপশক্তির পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠবে।

দেশ আমার, মাটি আমার, এই মাটিতে আমার সমান অধিকার... একসঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এই উচ্চারণের শক্তিতে সুসংহত না হলে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জন করতে না পারলে সামনে আরও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে... দুই-ই অপরাধ। বাংলাদেশে ব্যক্তি সুবিধাভোগী, দালাল, স্তাবক হিন্দুদের উপলব্ধি করাতে হবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দাবানল যে কাউকেই স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল, ভীরু, অশিক্ষিত দরিদ্র সংখ্যালঘুদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। ঐক্যবদ্ধ মানসিক শক্তি নিয়ে স্বল্পসংখ্যক মানুষও বৃহৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।... সরকার না চাইলে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত ভাবে ঘটে না। এই কথাগুলোর মর্ম সরকারকে উপলব্ধি করতে বাধ্য করানোর সময় এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন অবধি মৌলবাদ বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সযতেœ লালিত-পালিত হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কতক গৎ বাঁধা বক্তব্য আর পদক্ষেপ যথেষ্ট ভাবার অবকাশ নেই। সরকারের ফরমায়েস মতো বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের উৎসব আতিশয্য বর্জন করা উচিত। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রতীক সেজে মিডিয়ায় প্রচারের সুযোগ করে দেয়া পণ্য বিপণির মতোই। এভাবে কিছু সময় কিছু মানুষ আনন্দে মেতে উঠতে পারে। কিন্তু সম্প্রদায়ের মৌলিক নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার হতে পারে না। অন্যায় নির্বিবাদে সহ্য করার অপরিসীম শক্তি আর যাই হোক অন্যায়কে প্রতিহত করতে পারে না।

[লেখক : সম্পাদক, আন্তর্জাতিক উপপরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ]