শিখন ঘাটতি নাকি মৌলিক জায়গাতেই সমস্যা?

মাছুম বিল্লাহ

জুন মাসের ২৭, ২৮ ও ২৯ তারিখ খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি, শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে কথা বলেছি ও ক্লাস নিয়েছি তাদের অবস্থা বুঝার জন্য। একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখলাম শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ‘ag Question’-০এর ওপর ক্লাস নিচ্ছেন এবং বোর্ডে শিক্ষার্থীদের এই বাক্যগুলো লিখে দিয়ে বলছেন যে, এগুলোর ag Question তৈরি করো। দেখলাম কোন শিক্ষার্থীই করতেও পারছে না, কেউ কোন কথাও বলছে না, শিক্ষককে কিছু জিজ্ঞাসাও করছে না। শিক্ষক শুধু বলছেন যে, এগুলো করে ফেলো। বাক্যগুলো লেখার পর সেগুলো নিজের পড়তে হয়, শিক্ষার্থীদের দ্বারা পড়াতে হয়। তারপর একটি দুটি উদাহরণ দিয়ে একই ধরনের বাক্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের এক্সারসাইজ করানো উচিত। তা না হলে কেউ বুঝবে না। পরে আমি একই ধরনের বাক্য দিয়ে স্বলপ সময়ের মধ্যে কয়েকটি ag Question-এর করানোর চেষ্টা করলাম। কয়েকজন শিক্ষার্থী পেরেছে, সবাই তখনো পারেনি। বুঝলাম এ ধরনের প্রাকটিস শ্রেণীকক্ষে করানো হয় না। করালে প্রায় সব শিক্ষার্থীই মোটামুটি বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারতো।

করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা প্রায় ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল। তবে বন্ধের ওই সময়ে টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস নেয়াসহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা ছিল। যদিও এসব কার্যক্রমে সব এলাকার সব শিক্ষার্থী সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কতটুকু শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা নিরূপণের উদ্যেগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ জন্য ‘বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট’ বা বেডুর মাধ্যমে একটি গবেষণা করানো হয়। এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। ২০২১ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে কী মাত্রায় শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা উঠে এসেছে এই গবেষণায়। এসব শিক্ষার্থী এখন নবম শ্রেণীতে পড়ে। তারা ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। দৈবচয়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেশের প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী ও প্রায় ছয় হাজার শিক্ষকের ওপর গবেষণাটি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ওই তিন বিষয়ে অনলাইন পরীক্ষায় অংশ নেয়। এ ছাড়া এ তিন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি সম্পর্কে শ্রেণী শিক্ষকের মতামত নেয়া হয়। মাত্রা বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতিকে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ... এ তিন ধাপে বিভক্ত করা হয়েছে। এটিও একটি ভালো দিক। অনলাইন পরীক্ষায় যেসব প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ বা তার বেশি না পারাকে উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ না পারাকে মধ্যম মাত্রার শিখন ঘাটতি হিসেবে ধরা হয়েছে।

গবেষণার তথ্য বলছে বাংলায় ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যম মাত্রায় ও ২৪ শতাংশের উচ্চমাত্রায় শিখণ ঘাটতি রয়েছে। বাংলায় স্বল্পমাত্রায় শিখন ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থী ২৫ শতাংশ। ইংরেজিতে মধ্যম মাত্রায় শিখন ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৮ শতাংশ, উচ্চমাত্রায় ১৮শতাংশ এবং স্বল্পমাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে ২০ শতাংশের। গণিতে মধ্যম মাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর, উচ্চমাত্রার ক্ষেত্রে এই হার ৩৯ শতাংশ এবং স্বল্পমাত্রার ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে তিনটি বিষয়েই বেশি শিখন ঘাটতি দেখা গেছে। খুলনা ও রংপুর বিভাগের শিখন ঘাটতির মাত্রা সবচেয়ে কম। জেলা বিবেচনায় তিনটি বিষয়েই রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি শিক্ষার্থী চিহ্নিত হয়েছে। ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির ক্ষেত্রে তেমন কোন পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে গ্রাম ও শহরভেদে শিখন ঘাটতির মাত্রায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থীর হার শহরে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ এবং গ্রামে সর্বোচ্চ ৪৩ শতাংশ। সমতলের চেয়ে পাহাড়, উপকূল, চর, হাওর অঞ্চলে বেশি শিখন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের চেয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মধ্যম ও উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া, টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার, অনলাইন ক্লাস ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়াসহ বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এখানে একটি বিষয় হচ্ছে, যখন সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ ছিল তখন এসব মাধ্যমে ক্লাস নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, যা প্রশংসার দাবি রাখে। তারপরেও নানা সীমাবদ্ধতা, অসংগতি ও অনভিজ্ঞতার কারণে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীই এর দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। যদিও শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে কোন ধরনের জোড়ালো যুক্তিছাড়া বার বার বলা হতো যে, প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের আওতায় এসেছে। এটি নিয়ে কার্যকর একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত, যদি সরকার সেভাবে চাইত। সেটি কিন্তু হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু গবেষণা করেছেন বা সার্ভে হয়েছে, যার ফল খুব হতাশাজনক। সেই বাস্তবতায় টেলিভিশনের ক্লাস কতটা কাজ দিবে সেটি আবারও ভেবে দেখে প্রয়োজন। তবে, ইউটিউবে কিছু ভিডিও ছেড়ে দিলে যার যখন প্রয়োজন সেটি দেখে নিতে পারবে। এই যুক্তিটি খারাপ নয়। টেলিভিশনে চলতে পারে। তবে, সবচেয়ে জোর দিয়ে যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে, নিজ নিজ শ্রেণীকক্ষেই সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হবে। যেসব বিষয় বেশি কঠিন ও শিক্ষার্থীরা সমস্যা বেশি ফেস করে সেসব বিষয়গুলোতে, বাকিগুলোতেও কমপক্ষে এক দিন অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হবে। সেজন্য শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের তরফ থেকে, অভিভাবকদের কাছ থেকে এবং সরকারি তরফে কিছু ফি প্রদান করতে হবে।

সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে ২০২৩ সালেও সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য ২০২৪ সালের পরীক্ষার্থীদের সামনে রেখে গবেষণাটি করা হয়, যাতে চিহ্নিত ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা নেয়া যায়। উদ্যোগটিকে সাধুবাদ জানাই। করোনা মহামারীর জেরে দেশের সব পর্যাযের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হয়েছে। মহামারীকালে অষ্টম শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে মধ্যম উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাকি বিষয়গুলোতেও কিন্তু তাদের অবস্থা ভালো নয়। সার্বিক ঘাটতি পূরণের নিমিত্তে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]

শনিবার, ২৩ জুলাই ২০২২ , ০৮ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৪ জিলহজ ১৪৪৩

শিখন ঘাটতি নাকি মৌলিক জায়গাতেই সমস্যা?

মাছুম বিল্লাহ

জুন মাসের ২৭, ২৮ ও ২৯ তারিখ খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি, শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে কথা বলেছি ও ক্লাস নিয়েছি তাদের অবস্থা বুঝার জন্য। একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখলাম শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ‘ag Question’-০এর ওপর ক্লাস নিচ্ছেন এবং বোর্ডে শিক্ষার্থীদের এই বাক্যগুলো লিখে দিয়ে বলছেন যে, এগুলোর ag Question তৈরি করো। দেখলাম কোন শিক্ষার্থীই করতেও পারছে না, কেউ কোন কথাও বলছে না, শিক্ষককে কিছু জিজ্ঞাসাও করছে না। শিক্ষক শুধু বলছেন যে, এগুলো করে ফেলো। বাক্যগুলো লেখার পর সেগুলো নিজের পড়তে হয়, শিক্ষার্থীদের দ্বারা পড়াতে হয়। তারপর একটি দুটি উদাহরণ দিয়ে একই ধরনের বাক্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের এক্সারসাইজ করানো উচিত। তা না হলে কেউ বুঝবে না। পরে আমি একই ধরনের বাক্য দিয়ে স্বলপ সময়ের মধ্যে কয়েকটি ag Question-এর করানোর চেষ্টা করলাম। কয়েকজন শিক্ষার্থী পেরেছে, সবাই তখনো পারেনি। বুঝলাম এ ধরনের প্রাকটিস শ্রেণীকক্ষে করানো হয় না। করালে প্রায় সব শিক্ষার্থীই মোটামুটি বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারতো।

করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা প্রায় ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি পাঠদান বন্ধ ছিল। তবে বন্ধের ওই সময়ে টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনে ক্লাস নেয়াসহ নানাভাবে শিক্ষার্থীদের শেখানোর কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা ছিল। যদিও এসব কার্যক্রমে সব এলাকার সব শিক্ষার্থী সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের কতটুকু শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা নিরূপণের উদ্যেগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ জন্য ‘বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট’ বা বেডুর মাধ্যমে একটি গবেষণা করানো হয়। এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। ২০২১ শিক্ষাবর্ষে অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতে কী মাত্রায় শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা উঠে এসেছে এই গবেষণায়। এসব শিক্ষার্থী এখন নবম শ্রেণীতে পড়ে। তারা ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। দৈবচয়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেশের প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী ও প্রায় ছয় হাজার শিক্ষকের ওপর গবেষণাটি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ওই তিন বিষয়ে অনলাইন পরীক্ষায় অংশ নেয়। এ ছাড়া এ তিন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি সম্পর্কে শ্রেণী শিক্ষকের মতামত নেয়া হয়। মাত্রা বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতিকে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ... এ তিন ধাপে বিভক্ত করা হয়েছে। এটিও একটি ভালো দিক। অনলাইন পরীক্ষায় যেসব প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ বা তার বেশি না পারাকে উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ না পারাকে মধ্যম মাত্রার শিখন ঘাটতি হিসেবে ধরা হয়েছে।

গবেষণার তথ্য বলছে বাংলায় ৩১ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যম মাত্রায় ও ২৪ শতাংশের উচ্চমাত্রায় শিখণ ঘাটতি রয়েছে। বাংলায় স্বল্পমাত্রায় শিখন ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থী ২৫ শতাংশ। ইংরেজিতে মধ্যম মাত্রায় শিখন ঘাটতি থাকা শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৮ শতাংশ, উচ্চমাত্রায় ১৮শতাংশ এবং স্বল্পমাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে ২০ শতাংশের। গণিতে মধ্যম মাত্রায় শিখন ঘাটতি রয়েছে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর, উচ্চমাত্রার ক্ষেত্রে এই হার ৩৯ শতাংশ এবং স্বল্পমাত্রার ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগে তিনটি বিষয়েই বেশি শিখন ঘাটতি দেখা গেছে। খুলনা ও রংপুর বিভাগের শিখন ঘাটতির মাত্রা সবচেয়ে কম। জেলা বিবেচনায় তিনটি বিষয়েই রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি শিক্ষার্থী চিহ্নিত হয়েছে। ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির ক্ষেত্রে তেমন কোন পার্থক্য দেখা যায়নি। তবে গ্রাম ও শহরভেদে শিখন ঘাটতির মাত্রায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতিসম্পন্ন শিক্ষার্থীর হার শহরে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ এবং গ্রামে সর্বোচ্চ ৪৩ শতাংশ। সমতলের চেয়ে পাহাড়, উপকূল, চর, হাওর অঞ্চলে বেশি শিখন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অন্যদিকে সাধারণ ধারার শিক্ষার্থীদের চেয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

মধ্যম ও উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া, টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার, অনলাইন ক্লাস ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়াসহ বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এখানে একটি বিষয় হচ্ছে, যখন সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি বন্ধ ছিল তখন এসব মাধ্যমে ক্লাস নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল, যা প্রশংসার দাবি রাখে। তারপরেও নানা সীমাবদ্ধতা, অসংগতি ও অনভিজ্ঞতার কারণে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থীই এর দ্বারা উপকৃত হয়েছিল। যদিও শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে কোন ধরনের জোড়ালো যুক্তিছাড়া বার বার বলা হতো যে, প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের আওতায় এসেছে। এটি নিয়ে কার্যকর একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত, যদি সরকার সেভাবে চাইত। সেটি কিন্তু হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু গবেষণা করেছেন বা সার্ভে হয়েছে, যার ফল খুব হতাশাজনক। সেই বাস্তবতায় টেলিভিশনের ক্লাস কতটা কাজ দিবে সেটি আবারও ভেবে দেখে প্রয়োজন। তবে, ইউটিউবে কিছু ভিডিও ছেড়ে দিলে যার যখন প্রয়োজন সেটি দেখে নিতে পারবে। এই যুক্তিটি খারাপ নয়। টেলিভিশনে চলতে পারে। তবে, সবচেয়ে জোর দিয়ে যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে, নিজ নিজ শ্রেণীকক্ষেই সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হবে। যেসব বিষয় বেশি কঠিন ও শিক্ষার্থীরা সমস্যা বেশি ফেস করে সেসব বিষয়গুলোতে, বাকিগুলোতেও কমপক্ষে এক দিন অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হবে। সেজন্য শিক্ষকদের বিদ্যালয়ের তরফ থেকে, অভিভাবকদের কাছ থেকে এবং সরকারি তরফে কিছু ফি প্রদান করতে হবে।

সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে ২০২৩ সালেও সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য ২০২৪ সালের পরীক্ষার্থীদের সামনে রেখে গবেষণাটি করা হয়, যাতে চিহ্নিত ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা নেয়া যায়। উদ্যোগটিকে সাধুবাদ জানাই। করোনা মহামারীর জেরে দেশের সব পর্যাযের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হয়েছে। মহামারীকালে অষ্টম শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে মধ্যম উচ্চমাত্রায় শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাকি বিষয়গুলোতেও কিন্তু তাদের অবস্থা ভালো নয়। সার্বিক ঘাটতি পূরণের নিমিত্তে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি।

[লেখক : কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভলান্টিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ফর বাংলাদেশ]