ভারতে উপরাষ্ট্রপতি ভোট

গৌতম রায়

বেশ খানিকটা টালবাহুনার পর বিজেপি শিবিরের পক্ষ থেকে উপরাষ্ট্রপতি পদে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের নাম ঘোষিত হয়েছে। সম্মিলিতভাবে বিজেপি বিরোধীরা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীমতি মার্গারেট আলভা কে উপরাষ্ট্র প্রতিপদে প্রার্থী করেছেন। বিজেপি শিবির থেকে প্রার্থীর নাম ঘোষণা, বা বিরোধী শিবির থেকে প্রার্থীর নাম ঘোষণা, কোনো কিছু ঘিরেই কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত তার কোনো রকম প্রতিক্রিয়া জানাননি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধীদের প্রার্থী নির্বাচন ঘিরে তার স্বভাব নাটকীয়তা জারি রেখেছিলেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে যখন উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে বৈঠক আহ্বান করা হয়, সেই বৈঠক এড়িয়ে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বৈঠক চলাকালীন প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শারদ পাওয়ার, যাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মমতা প্রার্থী করার জন্য প্রথম নাম প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি একাধিকবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হয়, মমতা ব্যস্ত আছেন। বৈঠক দীর্ঘক্ষণ চলে। কিন্তু কখনোই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে শারদ পাওয়ারের মতো একজন প্রবীণ নেতা কেন তাকে খুঁজছেন, কি কারণে তাকে ফোন করেছেন, সে সম্পর্কে পাল্টা ফোন আসে না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের ‘টগর বোস্টমীর মতো ভূমিকা পালন করবেন এটা বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই বুঝতে পারা গিয়েছিল। রাজ্যপাল হিসেবে জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে রাজভবনে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের দেবী কালী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য ঘিরে বিজেপিপন্থী একাংশের তথাকথিত সাধু-সন্তদের সঙ্গে বিরোধী দল নেতা শুভেন্দু অধিকারী কে নিয়ে দেখা করেছিলেন। সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের নাম না করে বিষোদগার ও করেছিলেন। ঠিক তার পরের দিনই ধনখর দার্জিলিং চলে যান। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দার্জিলিং এ ছিলেন। সব থেকে মজার কথা হলো, আসামের মুখ্যমন্ত্রী তথা পূর্বাঞ্চলের বিশিষ্ট বিজেপি নেতা হেমন্ত বিশ্বশর্মা সেইসময় দার্জিলিং এ আসেন।

হেমন্ত বিশ্বশর্মা যে দার্জিলিং এ আসছেন এ কথাটা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে গোপন রাখা হয়। রাজ্যপাল হেমন্ত বিশ্বশর্মা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে যে গোপন বৈঠক হতে চলেছে, সেই কথাটিও গোপনে থাকে। যে সংবাদ মাধ্যমগুলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কফি খাওয়া থেকে ফুচকা তৈরি করা, মোমো তৈরি করা ইত্যাদি ব্যক্তিগত পর্যায়ের ঘটনা গুলিকে প্রচারের ক্ষেত্রে একটা তুরীয় শিবিরের সবসময় অবস্থান করেন, মমতা সেইসব বিশেষ প্রিয়ভাজন সংবাদ মাধ্যম পক্ষ থেকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তথা পূর্বাঞ্চলকে হিন্দু আধিপত্যবাদীদের দখলে নিয়ে আসবার অন্যতম প্রধান কারিগর, হেমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে রাজ্যপাল ধনখড়কে মাঝখানে রেখে মমতার যে বৈঠক হতে চলেছে, সে সম্পর্কে ‘টু’ শব্দটি করে না।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে সেই গোপন বৈঠক চলে। বৈঠকে শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেন, সৌজন্যমূলক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে তিনি চা খেয়েছেন আর একটা বিস্কুট খেয়েছেন। অর্থাৎ; আড়াই ঘণ্টা ধরে সেই সময়ের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখর, যার সঙ্গে মমতার প্রতিদিনই টুইতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হয়, তিনি এবং আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা ,যিনি গোটা আসামজুড়ে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের সহ নাগরিকদের, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার জন্য সব রকমের তোড়জোড় প্রায় সমাপ্ত করে ফেলেছেন, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া মুসলমান সহ নাগরিকদের কার্যত বন্দী দশাতে রেখে দেওয়ার জন্য তৈরি করেছেন ক্যাম্প, তার সঙ্গে নিজেকে মুসলমান সমাজের ‘মসিহা’ বলে দাবি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আড়াই ঘণ্টা ধরে গোপন বৈঠক চলল, আর সেই গোপন বৈঠকে কোন রাজনৈতিক বিষয় এলো কি, এলো না, সে সম্পর্কে মমতা একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন না। ঠিক তখনই বুঝতে পেরে গিয়েছিল, একটা বড় রকমের চমক সাম্প্রদায়িক শিবিরের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভেতর দিয়ে মমতা দিতে চলেছেন।

সংবাদ মাধ্যম হেমন্ত বিশ্বশর্মার দার্জিলিং-এ আসা, মমতার সঙ্গে গোপন বৈঠক সম্পর্কে কোন খবর বৈঠকের আগে না দিলেও সি পি আই(এম) রাজ্যসম্পাদক মহম্মদ সেলিম ওই বৈঠকের আগেই হেমন্ত বিশ্বশর্মা যে দার্জিলিং এ আসছেন এবং সেই মুহূর্তের দার্জিলিংয়ে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখর এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত আছেন সেটা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন।

মহঃ সেলিমের সাংবাদিক সম্মেলনে বলা কথার ভেতর থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল কি ধরনের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার একটা নতুন সমীকরণ তৈরি হতে চলেছে। পরবর্তীকালে জগদীপ ধানখরের নাম বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা তাদের শিবিরের উপরাষ্ট্রপতি পদ প্রার্থী হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণার পর অত্যন্ত রসিক ভঙ্গিমায় এক অনুকরণীয় রাজনৈতিক সমীকরণ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেছেন মহঃ সেলিম।

তিনি বলেছেন, অনেক সময় বাড়ির বউ যদি একটু ঝগড়াঝাঁটি করে, মান-অভিমান করে শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়, তারপর বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বোঝাপড়া করে, আলাপ-আলোচনা করে, গোটা ঝগড়াঝাঁটি মিটমাট করে, বউকে আবার শশুরবাড়িতে ফিরিয়ে আনে... বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পর্ক টা ঠিক তেমন ই। সেই উদ্দেশ্যেই দার্জিলিংয়ে ধনখর, হেমন্ত বিশ্বশর্মা আর মমতার বৈঠককে আমরা দেখতে পারি।

ইন্দিরা গান্ধীর জীবনকালের শেষ দিকে আরএসএস ধীরে ধীরে কংগ্রেসের ভেতরে নিজেদের আদর্শগত বিষয়গুলিকে বিস্তার ঘটাতে সচেষ্ট ছিল। আমরা দেখেছিলাম ইন্দিরার মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর রাজীব জামানায়, তাকে ঘিরে যে ‘কিচেন কেবিনেট’ তৈরি হয়েছিল, সেসবের কার্যাবলীর ভেতর দিয়ে সংঘের কংগ্রেসের ভিতর প্রভাব বিস্তার আমরা দেখেছিলাম। ভুলে গেলে চলবে না যে, সেই সময় কাল থেকেই আরএসএস মমতাকে টার্গেট হিসেবে ধরে নিয়ে, কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গই নয়, গোটা পূর্বাঞ্চলে নিজেদের রাজনৈতিক নখদন্ত বিস্তারের কাজটিকে শুরু করেছিল।

রাজীব গান্ধীর শাসনকালে মমতার একটা তথাকথিত বিদ্রোহী ইমেজ এবং পরবর্তীকালে পি ভি নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে টাডা আইন ঘিরে মুসলমানদের প্রতি একটা ছদ্ম আবেগ, ইত্যাদির ভেতর দিয়ে আরএসএসের তৈরি করে দেওয়ার ছক অনুযায়ী, তাদেরই মেরুকরণের রাজনীতি টাকে ধীরে ধীরে মমতা একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার দিকে এগিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মমতা যখন কংগ্রেস দল থেকে বেরিয়ে তার নিজের আঞ্চলিক দল, ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ তৈরি করেন, তখন নির্বাচন কমিশনে সেই দলের স্বীকৃতি, নির্বাচনী প্রতীক পাওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে সরাসরি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন বিজেপির সেই সময়ের প্রথম সারির নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী। নির্বাচন কমিশনে মমতা যাতে এই ঘাসফুল প্রতীকটি পান, সেজন্যে আডবানী নিজে চিঠি পর্যন্ত লিখেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করতে গেলে সরাসরি সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের সামনে আনলে কার্যসিদ্ধি হবে না, এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ খুব ভালোভাবেই জানত। তাদের সহযোগী কংগ্রেস দলও খুব ভালো করে সেটা জানত। সেই কারনেই মমতার মতো একজন ছদ্ম ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতিকে সামনে আনা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শিতে বসে বিজেপির সঙ্গে চোর পুলিশ খেলা মমতা অনেক খেলেছেন কিন্তু আরএসএসের অন্যতম প্রধান থিঙ্ক ট্যাংক জগদীভ ধনখরকে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে তুলে আনবার ক্ষেত্রে, ধানখর নিজে, মমতা এবং হেমন্ত বিশ্বশর্মা যে ভূমিকা নিয়েছেন, তা থেকে মমতার ওপরে আরএসএসের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে এখন আর বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

আরএসএ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে ধ্বংস করে, রাজনৈতিক হিন্দুর রাষ্ট্রে পরিণত করবার লক্ষ্যেই, অন্যতম একটি পদক্ষেপ হিসেবে, তাদের নিজেদের তাত্ত্বিক শিবিরের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব জগদীপ ধনখরকে উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে পাঠাচ্ছে। সেই কাজটি সূচারুরূপে সম্পাদিত করবার ক্ষেত্রে মমতা যেভাবে আরএসএসের প্রতি নিজের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিলেন, আনুগত্যের পরিচয় দিলেন, তার সুফল নিশ্চিত হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবিরের পক্ষ থেকে অচিরেই মমতাকে দেয়া হবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

শনিবার, ২৩ জুলাই ২০২২ , ০৮ শ্রাবণ ১৪২৯ ২৪ জিলহজ ১৪৪৩

ভারতে উপরাষ্ট্রপতি ভোট

গৌতম রায়

বেশ খানিকটা টালবাহুনার পর বিজেপি শিবিরের পক্ষ থেকে উপরাষ্ট্রপতি পদে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের নাম ঘোষিত হয়েছে। সম্মিলিতভাবে বিজেপি বিরোধীরা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শ্রীমতি মার্গারেট আলভা কে উপরাষ্ট্র প্রতিপদে প্রার্থী করেছেন। বিজেপি শিবির থেকে প্রার্থীর নাম ঘোষণা, বা বিরোধী শিবির থেকে প্রার্থীর নাম ঘোষণা, কোনো কিছু ঘিরেই কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত তার কোনো রকম প্রতিক্রিয়া জানাননি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধীদের প্রার্থী নির্বাচন ঘিরে তার স্বভাব নাটকীয়তা জারি রেখেছিলেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে যখন উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে বৈঠক আহ্বান করা হয়, সেই বৈঠক এড়িয়ে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বৈঠক চলাকালীন প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শারদ পাওয়ার, যাকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মমতা প্রার্থী করার জন্য প্রথম নাম প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি একাধিকবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে বলা হয়, মমতা ব্যস্ত আছেন। বৈঠক দীর্ঘক্ষণ চলে। কিন্তু কখনোই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে শারদ পাওয়ারের মতো একজন প্রবীণ নেতা কেন তাকে খুঁজছেন, কি কারণে তাকে ফোন করেছেন, সে সম্পর্কে পাল্টা ফোন আসে না।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের ‘টগর বোস্টমীর মতো ভূমিকা পালন করবেন এটা বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই বুঝতে পারা গিয়েছিল। রাজ্যপাল হিসেবে জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে রাজভবনে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের দেবী কালী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য ঘিরে বিজেপিপন্থী একাংশের তথাকথিত সাধু-সন্তদের সঙ্গে বিরোধী দল নেতা শুভেন্দু অধিকারী কে নিয়ে দেখা করেছিলেন। সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের নাম না করে বিষোদগার ও করেছিলেন। ঠিক তার পরের দিনই ধনখর দার্জিলিং চলে যান। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দার্জিলিং এ ছিলেন। সব থেকে মজার কথা হলো, আসামের মুখ্যমন্ত্রী তথা পূর্বাঞ্চলের বিশিষ্ট বিজেপি নেতা হেমন্ত বিশ্বশর্মা সেইসময় দার্জিলিং এ আসেন।

হেমন্ত বিশ্বশর্মা যে দার্জিলিং এ আসছেন এ কথাটা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে গোপন রাখা হয়। রাজ্যপাল হেমন্ত বিশ্বশর্মা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে যে গোপন বৈঠক হতে চলেছে, সেই কথাটিও গোপনে থাকে। যে সংবাদ মাধ্যমগুলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কফি খাওয়া থেকে ফুচকা তৈরি করা, মোমো তৈরি করা ইত্যাদি ব্যক্তিগত পর্যায়ের ঘটনা গুলিকে প্রচারের ক্ষেত্রে একটা তুরীয় শিবিরের সবসময় অবস্থান করেন, মমতা সেইসব বিশেষ প্রিয়ভাজন সংবাদ মাধ্যম পক্ষ থেকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী তথা পূর্বাঞ্চলকে হিন্দু আধিপত্যবাদীদের দখলে নিয়ে আসবার অন্যতম প্রধান কারিগর, হেমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে রাজ্যপাল ধনখড়কে মাঝখানে রেখে মমতার যে বৈঠক হতে চলেছে, সে সম্পর্কে ‘টু’ শব্দটি করে না।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে সেই গোপন বৈঠক চলে। বৈঠকে শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেন, সৌজন্যমূলক বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে তিনি চা খেয়েছেন আর একটা বিস্কুট খেয়েছেন। অর্থাৎ; আড়াই ঘণ্টা ধরে সেই সময়ের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখর, যার সঙ্গে মমতার প্রতিদিনই টুইতে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হয়, তিনি এবং আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা ,যিনি গোটা আসামজুড়ে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের সহ নাগরিকদের, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার জন্য সব রকমের তোড়জোড় প্রায় সমাপ্ত করে ফেলেছেন, নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া মুসলমান সহ নাগরিকদের কার্যত বন্দী দশাতে রেখে দেওয়ার জন্য তৈরি করেছেন ক্যাম্প, তার সঙ্গে নিজেকে মুসলমান সমাজের ‘মসিহা’ বলে দাবি করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আড়াই ঘণ্টা ধরে গোপন বৈঠক চলল, আর সেই গোপন বৈঠকে কোন রাজনৈতিক বিষয় এলো কি, এলো না, সে সম্পর্কে মমতা একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন না। ঠিক তখনই বুঝতে পেরে গিয়েছিল, একটা বড় রকমের চমক সাম্প্রদায়িক শিবিরের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভেতর দিয়ে মমতা দিতে চলেছেন।

সংবাদ মাধ্যম হেমন্ত বিশ্বশর্মার দার্জিলিং-এ আসা, মমতার সঙ্গে গোপন বৈঠক সম্পর্কে কোন খবর বৈঠকের আগে না দিলেও সি পি আই(এম) রাজ্যসম্পাদক মহম্মদ সেলিম ওই বৈঠকের আগেই হেমন্ত বিশ্বশর্মা যে দার্জিলিং এ আসছেন এবং সেই মুহূর্তের দার্জিলিংয়ে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখর এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত আছেন সেটা সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন।

মহঃ সেলিমের সাংবাদিক সম্মেলনে বলা কথার ভেতর থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল কি ধরনের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার একটা নতুন সমীকরণ তৈরি হতে চলেছে। পরবর্তীকালে জগদীপ ধানখরের নাম বিজেপি সভাপতি জে পি নাড্ডা তাদের শিবিরের উপরাষ্ট্রপতি পদ প্রার্থী হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণার পর অত্যন্ত রসিক ভঙ্গিমায় এক অনুকরণীয় রাজনৈতিক সমীকরণ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেছেন মহঃ সেলিম।

তিনি বলেছেন, অনেক সময় বাড়ির বউ যদি একটু ঝগড়াঝাঁটি করে, মান-অভিমান করে শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়, তারপর বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বোঝাপড়া করে, আলাপ-আলোচনা করে, গোটা ঝগড়াঝাঁটি মিটমাট করে, বউকে আবার শশুরবাড়িতে ফিরিয়ে আনে... বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পর্ক টা ঠিক তেমন ই। সেই উদ্দেশ্যেই দার্জিলিংয়ে ধনখর, হেমন্ত বিশ্বশর্মা আর মমতার বৈঠককে আমরা দেখতে পারি।

ইন্দিরা গান্ধীর জীবনকালের শেষ দিকে আরএসএস ধীরে ধীরে কংগ্রেসের ভেতরে নিজেদের আদর্শগত বিষয়গুলিকে বিস্তার ঘটাতে সচেষ্ট ছিল। আমরা দেখেছিলাম ইন্দিরার মর্মান্তিক হত্যাকা-ের পর রাজীব জামানায়, তাকে ঘিরে যে ‘কিচেন কেবিনেট’ তৈরি হয়েছিল, সেসবের কার্যাবলীর ভেতর দিয়ে সংঘের কংগ্রেসের ভিতর প্রভাব বিস্তার আমরা দেখেছিলাম। ভুলে গেলে চলবে না যে, সেই সময় কাল থেকেই আরএসএস মমতাকে টার্গেট হিসেবে ধরে নিয়ে, কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গই নয়, গোটা পূর্বাঞ্চলে নিজেদের রাজনৈতিক নখদন্ত বিস্তারের কাজটিকে শুরু করেছিল।

রাজীব গান্ধীর শাসনকালে মমতার একটা তথাকথিত বিদ্রোহী ইমেজ এবং পরবর্তীকালে পি ভি নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে টাডা আইন ঘিরে মুসলমানদের প্রতি একটা ছদ্ম আবেগ, ইত্যাদির ভেতর দিয়ে আরএসএসের তৈরি করে দেওয়ার ছক অনুযায়ী, তাদেরই মেরুকরণের রাজনীতি টাকে ধীরে ধীরে মমতা একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার দিকে এগিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মমতা যখন কংগ্রেস দল থেকে বেরিয়ে তার নিজের আঞ্চলিক দল, ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ তৈরি করেন, তখন নির্বাচন কমিশনে সেই দলের স্বীকৃতি, নির্বাচনী প্রতীক পাওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে সরাসরি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন বিজেপির সেই সময়ের প্রথম সারির নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী। নির্বাচন কমিশনে মমতা যাতে এই ঘাসফুল প্রতীকটি পান, সেজন্যে আডবানী নিজে চিঠি পর্যন্ত লিখেছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ক্ষমতাচ্যুত করতে গেলে সরাসরি সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকদের সামনে আনলে কার্যসিদ্ধি হবে না, এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ খুব ভালোভাবেই জানত। তাদের সহযোগী কংগ্রেস দলও খুব ভালো করে সেটা জানত। সেই কারনেই মমতার মতো একজন ছদ্ম ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতিকে সামনে আনা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্শিতে বসে বিজেপির সঙ্গে চোর পুলিশ খেলা মমতা অনেক খেলেছেন কিন্তু আরএসএসের অন্যতম প্রধান থিঙ্ক ট্যাংক জগদীভ ধনখরকে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে তুলে আনবার ক্ষেত্রে, ধানখর নিজে, মমতা এবং হেমন্ত বিশ্বশর্মা যে ভূমিকা নিয়েছেন, তা থেকে মমতার ওপরে আরএসএসের নিয়ন্ত্রণ ঘিরে এখন আর বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

আরএসএ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির মাধ্যমে ধ্বংস করে, রাজনৈতিক হিন্দুর রাষ্ট্রে পরিণত করবার লক্ষ্যেই, অন্যতম একটি পদক্ষেপ হিসেবে, তাদের নিজেদের তাত্ত্বিক শিবিরের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব জগদীপ ধনখরকে উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে পাঠাচ্ছে। সেই কাজটি সূচারুরূপে সম্পাদিত করবার ক্ষেত্রে মমতা যেভাবে আরএসএসের প্রতি নিজের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিলেন, আনুগত্যের পরিচয় দিলেন, তার সুফল নিশ্চিত হিন্দু সম্প্রদায়িক শিবিরের পক্ষ থেকে অচিরেই মমতাকে দেয়া হবে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]